পৃথিবীতে মানবসভ্যতা ও অন্যান্য প্রাণীদের টিকে থাকার অন্যতম কারণ সূর্য। সূর্যরশ্মি ছাড়া আমাদের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। সূর্য থেকে আমরা আলো পাই, তাপ পাই। সৌরশক্তি বাঁচিয়ে রাখে উদ্ভিদদের, তাদের খাদ্য যোগান দেয়। এই আলো বলি আর তাপ, দুটো আসলে একই শক্তির ভিন্ন রূপ। এই শক্তির নাম তড়িৎচুম্বক শক্তি। এই শক্তির উৎপত্তি সূর্যের কেন্দ্রের উত্তপ্ত চুলায়। এই যে নাক্ষত্রিক চুলা, সেটা আসলে কতটা গরম? আরেকটি বড় পরিসরে প্রশ্নটা এভাবে করা যায়, সূর্য আসলে কতটা গরম?
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার হিসেবে, সূর্যের কোর বা কেন্দ্রের তাপমাত্রা ২৭ মিলিয়ন ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ১৫ মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ ১৫০ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস! তবে সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা সে তুলনায় কম। এ তাপমাত্রা মাত্র ১০ হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৫ হাজার ৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে।
নাসার স্পেস প্লেসের তথ্য অনুযায়ী, সূর্য প্রতি সেকেন্ডে ৪.২৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন শক্তি নিঃসরণ করে। এটা প্রায় ৩৮৪.৬ সেপটিলিয়ন ওয়াট বা ৩৮৪.৬×১০২৬ ওয়াটের সমান। তবে এই বিপুল শক্তির অল্পই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে এসে পৌঁছায়। সে পরিমাণটাও কম নয়। প্রতি বর্গমিটারে ১৫ লাখ কিলোওয়াট বা ১.৫×১০৭ ওয়াট। হিসেবে দেখা গেছে, সূর্য প্রতি সেকেন্ড যে পরিমাণ শক্তি নিঃসরণ করে, তা গোটা বিশ্বের মানুষ সারা বছর যে শক্তি ব্যবহার করে, তার সমান।
বিপুল এই শক্তি উৎপাদন হয় যেখানে, চলুন জেনে নিই, সেই সূর্যের প্রতিটি স্তর কতটা গরম। সূর্যের তাপমাত্রারই-বা এত পরিবর্তন হয় কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আগে জানতে হবে, সূর্যের তাপ সৃষ্টি হয় কীভাবে। সূর্য মূলত গ্যাস ও প্লাজমা দিয়ে তৈরি। এর বেশিরভাগটুকুই হাইড্রোজেন। প্রায় ৯২ শতাংশ। সূর্য আরও কিছুটা ছোট হলে এটি বৃহস্পতি গ্রহের মতো হাইড্রোজেনে পূর্ণ একটি বল হতো।
নাসার স্পেস প্লেসের মতে, সূর্যের কোর বা কেন্দ্রে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ হাইড্রোজেন। প্রচণ্ড মধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে ও অতি চাপে দুটো হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস একসঙ্গে যুক্ত হয়ে গঠন করে নতুন মৌল। এই প্রক্রিয়াটির নাম ফিউশন। হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো ফিউশন প্রক্রিয়ায় পরিণত হয় হিলিয়ামে।
বিরতিহীনভাবে সূর্যের কেন্দ্রে চলছে এই ফিউশন বিক্রিয়া। ফলে উৎপন্ন হচ্ছে শক্তি। সে জন্যই সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা পৌঁছে যায় প্রায় ১৫০ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। সূর্যের কেন্দ্রের এই তাপমাত্রা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে নক্ষত্রটির পৃষ্ঠে, বায়ুমণ্ডলে এবং এর বাইরেও। আর বাইরে তাপমাত্রা ছড়িয়ে পড়ার কারণেই আমরা আলো পাই।
সূর্যের কেন্দ্রের বাইরে রয়েছে তেজস্ক্রিয় অঞ্চল। এ অঞ্চলের তাপমাত্রা ২০ লাখ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৭০ লাখ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়। কেন্দ্র থেকে তাপমাত্রা সূর্যের পৃষ্ঠে পৌঁছাতে হাজারো বছর সময় লেগে যায়।
সূর্যের তেজস্ক্রিয় অঞ্চলের বাইরের দিকে আছে কনভেকশন অঞ্চল। কনভেকশন মানে পরিচলন। সে হিসেবে এ অঞ্চলটির নাম বাংলায় হতে পারে, পরিচলন অঞ্চল। এ অঞ্চলটি তেজস্ক্রিয় অঞ্চল থেকে ২ লাখ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। তাপমাত্রা হতে পারে ২০ লাখ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। অঞ্চলটিতে প্লাজমাগুলো ফুটন্ত পানির মতো পরিচলন প্রক্রিয়ায় চলাচল করে। গরম প্লাজমার বুদবুদ তাপ বয়ে নিয়ে আসে সূর্যপৃষ্ঠে।
এবার জানা যাক, সূর্যের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা কেমন। সূর্যের বায়ুমণ্ডলের মধ্যে রয়েছে তিনটি স্তর—ফটোস্ফিয়ার, ক্রোমোস্ফিয়ার ও করোনা অঞ্চল। আসলে সূর্যের বায়ুমণ্ডলের প্রতিটি স্তর বা অঞ্চলের তাপমাত্রা ভিন্ন। যেমন ফটোস্ফিয়ার অঞ্চলের তাপমাত্রা ৫ হাজার ৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখানেই সূর্যের বিকিরণ দৃশ্যমান আলো হিসেবে শনাক্ত করা হয়। ফটোস্ফিয়ারের সানস্পট বা সৌরকলঙ্কগুলো কালো দেখায়। কারণ, সূর্যপৃষ্ঠের অন্যান্য অংশের তুলনায় ফটোস্ফিয়ার শীতল। ইউনিভার্সিটি করপোরেশন অব অ্যাটমোসফেরিক রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী, ফটোস্ফিয়ার অঞ্চলের তাপমাত্রা ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার ৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে।
ক্রোমোস্ফিয়ার ফটোস্ফিয়ারের ওপরে অবস্থিত। তাপমাত্রাও ফটোস্ফিয়ারের কাছাকাছি। এ দুটি স্তরের মধ্যে পার্থক্য প্রায় ১০০ মাইল বা ১৬০ কিলোমিটার। তাপমাত্রা থাকে ৬ হাজার ডিগ্রি থেকে ৪ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত।
এর ওপরের এবং সূর্যের সবচেয়ে বাইরের অঞ্চলটির নাম করোনা। হয়তো ভাবতে পারেন, করোনা অঞ্চল যেহেতু সূর্যপৃষ্ঠ থেকে অনেকটা বাইরে, তাই এখানকার তাপমাত্রা হবে সর্বনিম্ন। কিন্তু এ অঞ্চলে এসে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। বাংলায় সে জন্য একটি যথার্থ প্রবাদ আছে, সূর্যের চেয়ে বালি গরম। এ অঞ্চলটির অবস্থাও তাই। সূর্যপৃষ্ঠ থেকে এ অঞ্চলের তাপমাত্রা প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ গুণ বেশি!
আগেই বলেছি, এটা সূর্যের বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে বাইরের অঞ্চল। সূর্যের দৃশ্যমান পৃষ্ঠ ফটোস্ফিয়ার থেকে হাজার হাজার মাইল ওপর পর্যন্ত বিস্তৃত। এ অঞ্চলের তাপমাত্রা হতে পারে ১০ থেকে ২০ লাখ ডিগ্রি সেলসিয়াস! অর্থাৎ, এ অঞ্চলটি ফটোস্ফিয়ার থেকে প্রায় ৫০০ গুণ বেশি গরম।
সূর্যপৃষ্ঠ থেকে বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে বাইরের স্তর এত গরম কেন? বিষয়টি বিজ্ঞানীদেরও বেশ অবাক করেছে। এ সম্পর্কিত কিছু ধারণা অবশ্য আছে। তবে সুনির্দিষ্ট কোনো উপসংহারে পৌঁছানো যায়নি। এ সম্পর্কিত ধারণা, গবেষণা ও বর্তমানে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নিয়ে পরের কোনো লেখায় আলোচনা করব।
লেখক: সম্পাদনা দলের সদস্য, বিজ্ঞানচিন্তা
সূত্র: স্পেস ডট কম, ফিস ডট অর্গ, নাসা