হৈটি টৈটি - ষষ্ঠ পর্ব

১১. হাতির পালে

শেষ পর্যন্ত পালের গোদাটা থামল, অন্যরাও থামল তার সঙ্গে। সবাই পেছনে তাকিয়ে দেখলাম। পশ্চাদ্ধাবন থেমে গেছে। কেবল দুটো জোয়ান হাতির সঙ্গে কয়েকটি মেয়েহাতি আসছিল আমাদের পেছন পেছন! মনে হলো, আমাকে যেন ওরা নজরই দিচ্ছে না। পিছিয়ে পড়া সবাই যখন এসে সঙ্গ ধরল এবং সবাই শান্ত হয়ে এল একটু, তখন হাতিগুলো এসে শুঁড় দিয়ে আমায় শুঁকে দেখতে লাগল। ভালো করে তাকিয়ে দেখল আমাকে, অথবা এমনি খানিক ঘুরে বেড়াল আমার চারপাশে। একটা নরম বিড়বিড় আওয়াজ করল তারা, সম্ভবত কিছু একটা জিজ্ঞাসা করছিল আমাকে, কিন্তু কোনো জবাব দিলাম না আমি। ওরা যে শব্দ করছিল, তার মানেই আমি জানতাম না। জানতাম না সেটা বিরক্তির, নাকি তৃপ্তির শব্দ।

সবচেয়ে ভয় ছিল পালের গোদাটাকে। জানতাম, ভাগনার অপারেশন করার আগে আমিও ছিলাম গোদা হাতি। হয়তো এটা সে দলই! পালের নতুন গোদাটা হয়তো আমার সঙ্গে ক্ষমতার লড়াই বাধিয়ে বসবে। স্বীকার করছি, প্রকাণ্ড মহাবল গোদাটা যখন আমার কাছে এগিয়ে এল, যেন নিতান্তই দৈবাৎ তার দাঁতটা দিয়ে খোঁচা মারল আমার গায়ে, তখন বেশ নার্ভাস হয়েই পড়েছিলাম। কিন্তু নিরীহ ভাব করেই রইলাম আমি। দ্বিতীয়বার সে খোঁচা মারল, যেন চ্যালেঞ্জ করল লড়াইয়ের। কিন্তু সে চ্যালেঞ্জ না নিয়ে আমি কেবল একটু পাশে সরে গেলাম। হাতিটা তখন আলগোছে শুঁড় গুটিয়ে মুখের মধ্যে পুরে চুষতে লাগল। পরে জেনেছিলাম, হাতিরা বিস্ময় বা বিহ্বলতা প্রকাশ করে এভাবে। আমার নিরীহতায় গোদাটা স্পষ্টই বিব্রত হয়ে উঠেছিল। বুঝতে পারছিল না কী করবে। হাতির ভাষা আমার তখন জানা ছিল না। ভাবলাম, ওটা বোধ হয় আমাকে স্বাগত জানানোর ইঙ্গিত, তাই আমিও আমার শুঁড় গুঁজলাম মুখে। অস্ফুট শব্দ করে সরে গেল হাতিটা।

হাতির প্রতিটি শব্দ এখন আমি জানি। জানি যে নরম, গম গম শব্দটা আর এই অস্ফুট ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ—দুটোই পরিতৃপ্তির শব্দ। আতঙ্ক প্রকাশ করা হয় একটা উচ্চ গর্জনে, আচমকা ভয় পেলে করে একটা সংক্ষিপ্ত তীক্ষ্ণ শব্দ। আমাকে প্রথম দেখে ঠিক অমন সংক্ষিপ্ত তীক্ষ্ণ শব্দ করে উঠেছিল দলটা। রাগে, জখম বা বিচলিত হলে তারা একটা গভীর গরগর শব্দ তোলে। পিগমিদের আক্রমণের সময় নদীতীরে যে একটা হাতি রয়ে গিয়েছিল, সে এই রকম শব্দ করছিল। সম্ভবত একটা বিষাক্ত তিরের মারাত্মক ঘা খেয়েছিল সে। আর যখন শত্রুকে আক্রমণ করে, তখন একটা কর্ণভেদী চিৎকার করে তারা। এ হলো হাতিদের শব্দকোষের কয়েকটা মূল শব্দ, যাতে কেবল প্রধান প্রধান কয়েকটা অনুভূতিই ব্যক্ত হচ্ছে। কিন্তু এই শব্দগুলো ছাড়াও আবার অর্থের রূপভেদ আছে।

প্রথম প্রথম খুবই ভয় ছিল, হাতিরা হয়তো টের পেয়ে যাবে যে আমি সাধারণ হাতি নই, দল থেকে তেড়ে ভাগাবে আমাকে। আমার যে কিছু একটা গোলমাল আছে, সেটা তারা হয়তো সত্যিই ধরেছিল, কিন্তু দেখা গেল, তাদের মনোভাব যথেষ্ট শান্তিপূর্ণই। ভাবল, হয়তো আমি একটা ন্যালাখ্যাপা ছেলে, মাথাটা কিছু খারাপ, তবে কারও কোনো অনিষ্ট করব না।

এবার থেকে আমার যা অভিজ্ঞতা, সেটা বেশ একঘেয়ে। সর্বত্রই আমরা হাঁটতাম একের পর এক লাইন বেঁধে। সকাল ১০টা–১১টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত বিশ্রাম। তারপর আবার চরে বেড়ানো। রাত্রেও কয়েক ঘণ্টা অবকাশ। কেউ কেউ গড়িয়ে নিত, প্রায় সবাই ঢুলত, কিন্তু একজন থাকত পাহারায়।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
পাহারার পালা আমার। তারায় ভরা রাত, চাঁদ নেই আকাশে। পালের সবাই খানিকটা চুপচাপ। আমি খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিলাম একটু ভালো করে শোনার আর গন্ধ নেওয়ার জন্য।

সারা জীবন একটা হাতির পালের সঙ্গে কাটাব, এটা কিছুতেই মনে ধরছিল না। মানুষের জন্য মন কেমন করত। দেহটা আমার হাতির হলেও সাধারণ লোকজনের সঙ্গে শান্তিতে নির্ভাবনায় দিন কাটানোই আমার পছন্দ। সাদা চামড়াদের কাছে চলে যেতে খুবই রাজি ছিলাম, কিন্তু ভয় ছিল, আমার দাঁতের জন্য ওরা হয়তো আমায় মেরে ফেলবে। সত্যি বলতে কি, দাঁতটা নষ্ট করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম, তাতে মানুষের কাছে আমার মূল্য থাকত না, কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না। হয় দাঁত আমার অক্ষয়, নয়তো কী করে ভাঙতে হয়, তা আমার জানা ছিল না। এভাবে হাতির পালের সঙ্গেই মাসাধিক ঘুরে বেড়ালাম।

একদিন খোলা মাঠে চরছি, চারদিকে তৃণের আর শেষ নেই। পাহারার পালা আমার। তারায় ভরা রাত, চাঁদ নেই আকাশে। পালের সবাই খানিকটা চুপচাপ। আমি খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিলাম একটু ভালো করে শোনার আর গন্ধ নেওয়ার জন্য। কিন্তু গন্ধ যা পাচ্ছিলাম সে কেবল ঘাসের, কাছাকাছি নিরীহ ছোটখাটো সরীসৃপ আর জীবজন্তুর। হঠাৎ অনেক দূরে, প্রায় দিগন্তরেখায় একটা আলো দেখা গেল। আলোটা নিভে গিয়ে আবার জলে উঠল আগুনের শিখায়।

কয়েক মুহূর্ত যেতে প্রথম আলোটার বাঁ দিকে জ্বলে উঠল আরও একটা আগুন, তারপর আরও কিছু দূরে তৃতীয় ও চতুর্থ আগুন। শিকারিরা রাতের জন্য ছাউনি ফেলে যে আগুন জ্বালে, এ তা নয়। একেকটা আগুন জ্বলছিল একটু দূর পরপর, যেন একটা বড় রাস্তা পেতে বাতি জ্বালানো হয়েছে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই লক্ষ করলাম, উল্টো দিক থেকেও ঠিক একই রকম আলোর ঝলকানি। দুই সারি আগুনের মাঝখানে পড়েছি আমরা। শিগগিরই এই দুই সারির এক প্রান্ত থেকে হল্লা শুরু করবে শিকারিরা আর অন্য মুখে থাকবে হয় গর্ত নয়তো খেদা-শিকারিরা, আমাদের জ্যান্ত ধরতে চায়, নাকি মারতে চায় সেই অনুসারে। গর্তে পড়লে আমরা পা ভেঙে বসব, তখন কোনো কাজেই লাগব না, মরণ ছাড়া। খেদায় পড়লে দাসত্বের এক জীবন শুরু। হাতিরা আগুন দেখে ভয় পায়। সাধারণত ভীরু জন্তু তারা। হইহল্লায় চকিত হয়ে উঠে তারা ছুটতে থাকে খোলা মুখটার দিকে, যেখানে আগুন বা হইহল্লা নেই, আর সেই দিকেই থাকে নীরব ফাঁদ বা মৃত্যু।

গোটা পালের মধ্যে একমাত্র আমিই অবস্থাটা বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু সেটা কি আমার পক্ষে একটা সুযোগ? কী করব আমি? আগুনের দিকে ছুটে যাব? সেখানে আছে সশস্ত্র মানুষ। হয়তো বেষ্টনী ভেদ করে যাওয়ার সৌভাগ্য হতে পারে। অনিবার্য মৃত্যু বা দাসত্বের চেয়ে এই ঝুঁকি নেওয়া ভালো, কিন্তু সে ক্ষেত্রে দল ছাড়া হয়ে যাব, নিঃসঙ্গ হাতি হিসেবে জীবন শুরু করতে হবে। আর আজ হোক কাল হোক, প্রাণ দিতে হবে একটা বুলেট, একটা বিষাক্ত তির নয়তো কোনো জন্তুর নখরে।

আরও পড়ুন

মনে হবে তখনো যেন ইতস্তত করছি, অথচ আসলে পথ আমার বাছা হয়ে গিয়েছিল। কেননা, অজ্ঞাতসারেই আমি দল থেকে সরে আসছিলাম, চকিত হয়ে হাতির দল যেই দাপাদাপি শুরু করবে, তখন হস্তীদেহের সেই ভিড়ের টানে আমি যেন বিপদের মুখে না পড়ি।

ততক্ষণে শিকারিদের চেঁচামেচি, ঢাকের বাদ্যি, হুইসেল, গুলি ছোড়া শুরু হয়ে গেছে। খুব গভীর একটা শিঙার মতো আওয়াজ করলাম আমি। হাতিরা জেগে উঠে চকিত হয়ে ডাক ছেড়ে দাপাদাপি শুরু করে দিল। এমন অসম্ভব গর্জন যে মাটি থরথর করে উঠল। আশপাশে তাকিয়ে হাতিরা দেখল, আগুনগুলো যেন ক্রমশ কাছে আসছে (সত্যি সত্যিই কাছে আসছিল আগুন)। ডাক থামিয়ে সব একদিকে ছুটল হাতিরা, কিন্তু সেদিকে শিকারিদের হইহল্লা বেড়ে ওঠাতে তারা ছুটল ঠিক উল্টো দিকে সর্বনাশের মুখে। মৃত্যু অবশ্য তখনো খুব কাছে নয়, এই হাতি–তাড়া চলে কয়েক দিন ধরে। ক্রমাগত কাছে আসবে আগুন, কাছে আসবে শিকারিরা, ধীরে ধীরে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে হাতিদের, যতক্ষণ না তারা গিয়ে পড়বে হয় গর্তে, নয় খেদায়।

আমি কিন্তু হাতির দলের সঙ্গে গেলাম না। একলা রয়ে গেলাম। হাতির গোটা পালের মধ্যে যে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল, তা সঞ্চারিত হয়ে গেল আমার হস্তীস্নায়ুতে, সেখান থেকে মানবমস্তিষ্কে। আমার সচেতন মনটা আচ্ছন্ন হয়ে গেল ভয়ে। ওই দলের সঙ্গেই হুড়মুড় করে ছুটে যাচ্ছিলাম আরকি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব মানবিক সাহস, সব ইচ্ছাশক্তিকে প্রয়োগ করলাম। না! আমার মানবমস্তিষ্ক দিয়ে জয় করতে হবে আমার হস্তীসুলভ আতঙ্ক; রক্ত–মাংসের, অস্থির যে বিরাট পাহাড় আমায় ধ্বংসের দিকে টানছে, তাকে শাসন করতে হবে।

ঠিক একজন লরি ড্রাইভারের মতো আমার ‘লরি’র হুইল আমি ঘুরিয়ে দিলাম সোজা নদীর দিকে। ছলাৎ করে উঠল জল, ছিটকে পড়ল চারদিকে, তারপরই সব চুপচাপ... জলে আমার হস্তীরক্ত শান্ত হয়ে এল। মস্তিষ্কের জয় হলো। এখন আমার হাতির পা যুক্তির লাগামে কড়া করে বাঁধা। আমার ইচ্ছার বশ মেনে ওরা এখন নদীর পাঁকাল তলদেশে পা ফেলে চলেছে।

ঠিক করলাম, হিপোপটেমাসের মতো পুরো শরীরটা জলে ডুবিয়ে রাখব, সাধারণ হাতি এটা করার কথা কখনো ভাবতেও পারে না। নিশ্বাস নেব শুঁড়ের ডগা দিয়ে। অন্তত তার চেষ্টা করলাম। কিন্তু চোখে আর কানে পানি লেগে অস্বস্তি হচ্ছিল। থেকে থেকে মাথা তুলে শোনার চেষ্টা করছিলাম। খুব কাছে এসে গেছে শিকারিরা। ফের ডুব দিলাম পানিতে। শেষ পর্যন্ত আমাকে না লক্ষ করেই পেরিয়ে চলে গেল শিকারিরা।

অবিরত এই আতঙ্ক আর উত্তেজনা ইতিমধ্যে আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছিল। যা–ই হোক না কেন, ঠিক করলাম, শিকারিদের কাছে আত্মসমর্পণ করব না। কঙ্গো নদী বেয়ে সাঁতরে যাব কোনো একটা কুঠির খোঁজে। স্ট্যানলিপুল আর বমের মাঝখানে এমন কুঠি আছে কতগুলো। কোনো একটা খামার বা কুঠিতে গিয়ে হাজির হব, যে করে হোক, লোককে বোঝাব যে আমি বুনো হাতি নই, ট্রেনিং পাওয়া হাতি। তারা আমাকে মারবে না বা তাড়া করবে না।

আরও পড়ুন
‘সরে যা ওখান থেকে, নয়তো তোর মাথাটাই ফুটো করে দেব। এই! কী নাম তোর?’ নিশানা করতে করতে বলল সাদা লোকটা।

১২. বোম্বেটেদের চাকরি

দেখা গেল, পরিকল্পনাটা কাজে হাসিল করা তেমন সহজ নয়। অচিরেই কঙ্গোর প্রধান নদীপথ দিয়ে রওনা দিলাম। চললাম স্রোতের অনুকূলে। দিনের বেলায় যেতাম তীর বরাবর, রাতে সাঁতরে চলতাম মাঝনদী দিয়ে। এভাবে যাওয়াটা নিরাপদ। নদীর এ অংশে নৌকা চলাচল করে, তাই বুনো জানোয়ারেরা তীর ঘেঁষে যেতে ভয় পায়। গেলাম মাসখানেক ধরে, তার মধ্যে কেবল একবার শুনেছিলাম দূরে একটা সিংহের ডাক, আর একবার একটা বিশ্রী মোলাকাত হয়েছিল, বলা যায়, ধাক্কা লেগেছিল একটা জলহস্তীর সঙ্গে। ঘটনাটা ঘটে রাতে। কেবল নাকটি বের করে সে জলকেলি করছিল। আমি নজর করিনি। সাঁতরাতে সাঁতরাতে তুষার শিলায় জাহাজের ধাক্কা লাগার মতো করে ধাক্কা লাগল বিদঘুটে জন্তুটার সঙ্গে। জানোয়ারটা একেবারে গভীরে তলিয়ে গেল, তার ভোঁতা মুখটা দিয়ে কষে গুঁতা মারতে লাগল আমার পেটে। আমি তাড়াতাড়ি সাঁতরে দূরে চলে গেলাম। জলহস্তী ভেসে উঠে রাগে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে পিছু নিলে আমার। যাহোক, ওর নাগাল ছাড়িয়ে যেতে অসুবিধা হলো না।

এভাবে সাঁতরে নিরাপদে এসে পৌঁছালাম লুকুঙ্গাতে—এখানে একটা মস্ত বেলজিয়ান কুঠি আছে, অন্তত পতাকাটা দেখে তাই অনুমান করলাম। ভোরবেলায় বন ছেড়ে মাথা দোলাতে দোলাতে হেঁটে গেলাম বাড়ির দিকে। কিন্তু তাতে কোনো সুবিধা হলো না। প্রকাণ্ড দুটো চৌকি-কুকুর প্রচণ্ড ঘেউ ঘেউ করে আমার পেছনে লাগল। সাদা শার্ট পরা একটা লোক ঘর থেকে বেরিয়ে এল কিন্তু আমাকে দেখেই আবার ঢুকে পড়ল। চেঁচামেচি করে কতগুলো নিগ্রো আঙিনা পেরিয়ে গিয়ে আশ্রয়ও নিল বাড়িটায়। তারপর...রাইফেল চলল দুবার। তৃতীয়বারের জন্য আর অপেক্ষা করলাম না। জায়গাটা ফেলে আবার বনে এসে ঢুকতে বাধ্য হলাম।

একদিন রাতে একটা পাতলা বিষণ্ন বনের মধ্য দিয়ে চলেছি। মধ্য আফ্রিকায় এ রকম বন অনেক। কালো কালো গাছপালা, পায়ের নিচের মাটি কাদা কাদা, কালো কালো গুঁড়ি। কিছু আগে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়ে গেছে, বিষুবমণ্ডলের পক্ষে রাত্রিটা বেশ ঠান্ডা, ফুরফুরে হাওয়া বইছিল। মোটা চামড়া সত্ত্বেও অন্যান্য হাতির মতো আমারও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া সহ্য হয় না। বৃষ্টি পড়লে বা আবহাওয়া স্যাঁতসেঁতে থাকলে আমি শরীর গরম রাখার জন্য হাঁটতে থাকি।

নিয়মিত গতিতে কয়েক ঘণ্টা হাঁটার পর একটা আগুন দেখতে পেলাম। এলাকাটা রীতিমতো বুনো; আশপাশে একটি নিগ্রো গ্রামও চোখে পড়ে না। এ আগুন জ্বালল কে? একটু দ্রুত এগিয়ে গেলাম। বন শেষ হয়ে গেল। সামনে নিচু তৃণভূমি। নিশ্চয় কিছু আগে এখানে একটা দাবানল দেখা দিয়েছিল, ঘাস এখনো বেড়ে ওঠেনি। বন থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে একটা পুরোনো জীর্ণ তাঁবু। তার সামনেই আগুন জ্বলছে, কাছে দুজন লোক, স্পষ্টতই ইউরোপীয়। তাদের একজন আগুনের ওপর ঝোলানো একটা পাত্রে রান্না করছে। তৃতীয় লোকটি বেশ সুপুরুষ, স্পষ্টতই দেশীয়, অর্ধনগ্ন-অগ্নিকুণ্ড থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে একটা ব্রোঞ্জমূর্তির মতো।

ওদের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে আগুনের দিকে এগোলাম। আমার দিকে তাকাতেই আমি পোষা হাতির মতো হাঁটু মুড়ে বসলাম পিঠে বোঝা নেওয়ার মতো করে। শোলার টুপি পরা বেঁটে লোকটা একটা রাইফেল টেনে নিল স্পষ্টই গুলি করার জন্য। কিন্তু দেশীয় লোকটা ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলে উঠল:

‘মারিস না, মারিস না, ভালো হাতি, পোষমানা হাতি!’ আমার কাছে ছুটে এল সে।

‘সরে যা ওখান থেকে, নয়তো তোর মাথাটাই ফুটো করে দেব। এই! কী নাম তোর?’ নিশানা করতে করতে বলল সাদা লোকটা।

না সরেই উত্তর দিল দেশীয় লোকটা, ‘ম্পেপো।’ আমার আরও কাছে সরে এল সে, যেন তার দেহটা দিয়ে সে বুলেট আড়াল করতে চায়। ‘দেখছিস না বানা*, এটা পোষমানা,’ আমার শুঁড়ে হাত বুলিয়ে সে বলল।

‘ভাগ বলছি, বাঁদর কোথাকার!’ রাইফেল হাতে লোকটা চেঁচাল, ‘গুলি করব কিন্তু, এক, দুই…।’

‘দাঁড়া, বাকালা,’ বললে দ্বিতীয় সাদা লোকটা। বেশ লম্বা, রোগা সে, ‘ম্পেপো ঠিকই বলেছে। যথেষ্ট দাঁত জোগাড় হয়েছে আমাদের, কিন্তু মাথাডি পর্যন্ত হলেও বয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ হবে না, সস্তাও পড়বে না। হাতিটা পোষমানাই বটে। কে তার মনিব, কেমন করে এখানে এসে পৌঁছাল, সেসব খোঁজ না নিয়ে কাজে লাগানো যাবে ওটাকে। টনখানেক বোঝা হাতি বেশ তুলতে পারে, যদিও তা নিয়ে বেশি দূরে যেতে পারবে না। ধরা যাক, আধা টন বইতে পারবে ঠিক। ৩০ কি ৪০টা কুলির কাজ করে দেবে। বুঝছিস না, তাতে একটা পয়সাও খরচ লাগবে না আমাদের। যখন আর আমাদের দরকার লাগবে না, তখন মেরে ফেললেই হবে। ওর খাসা দাঁত দুটোও পাওয়া যাবে। কী বলিস?’

বাকালা নামধারী লোকটা অধৈর্যভরে শুনতে শুনতেই কয়েকবার নিশানা করল। কিন্তু তার সঙ্গী যখন বলল, হাতির বদলে কুলি ভাড়া করলে কত খরচ পড়বে, তখন সে শেষ পর্যন্ত কথা শুনে রাইফেল নামিয়ে রাখল। ‘অ্যাই, কী নাম তোর?’ চেঁচাল সে দেশীয় লোকটার উদ্দেশে। জবাব এল, ‘ম্ –ম্পেপো’। পরে দেখেছি যে দেশীয় লোকটাকে ডাকার সময় বাকালা সর্বদাই ওই কথা জিজ্ঞাসা করত আর ও-ও ঠিক একই জবাব দিত, ‘ম’ অক্ষরের ওপর থেমে যেত একটু, যেন নিজের নামটা উচ্চারণ করতে কষ্ট হচ্ছে তার।

‘এদিকে আয়, নিয়ে আয় হাতিটাকে।’

ম্পেপো যখন আমাকে আগুনের কাছে যাওয়ার জন্য ইঙ্গিত করল, তখন সাগ্রহেই তা পালন করলাম আমি।

‘কী বলে ডাকা যায় ওকে? অ্যাঁ? ট্রুয়েন্ট** নামটা বেশ জুতসই হবে, কী বলিস কক্স?’

‘তিন ভবঘুরের সঙ্গে চলে চার নম্বর। সাদা চামড়া কালো মন, কালো চামড়া সাদা মন। একটি কেবল সৎ, আর সে বাকুবা।’ বলে নিস্তেজ হয়ে চিত হয়ে পড়ল লোকটা।

কক্সের দিকে তাকালাম আমি। ওর গায়ের রংটা কেমন নীলচে। বিশেষ করে অবাক হলাম ওর নাকটা দেখে। মনে হয় যেন লাইলাক রঙে ডুব দিয়ে উঠেছে। নীলচে গায়ের ওপর আবার একটা নীলচে শার্ট, গলা খোলা, আস্তিন কনুইয়ের ওপর গড়ানো। গলাটা ভাঙা ভাঙা, কেমন অস্ফুট তোতলামির স্বরে কথা বলে, সে স্বরটাও কেমন যেন নীলচে বলে মনে হলো আমার। ভাঙা গলাটা তার শার্টের মতোই বিবর্ণ।

‘বেশ,’ সায় দিল কক্স, ‘ট্রুয়েন্ট বলেই ডাকা যাবে।’

আগুনের কাছেই একদলা ছেঁড়া কাপড়চোপড় যেন নড়ে উঠল। মোটা গলায় কে জিজ্ঞাসা করল:

‘কী ব্যাপার?’

‘এখনো বেঁচে আছিস তাহলে? আমরা তো ভেবেছিলাম সেঁটে গেছিস,’ কাপড়ের স্তূপটার উদ্দেশে বাকালা বললে শান্ত গলায়।

স্তূপটা আবার নড়েচড়ে তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল একটা মস্ত হাত। ছোঁড়া কাপড়চোপড় ঝেড়ে ফেলে উঠে বসল বেশ দীর্ঘকায় একটি লোক, দুই হাতে ভর দিয়ে দুলতে লাগল একটু। মুখটা ভয়ানক ফ্যাকাশে, লালচে দাড়ি এলোমেলো। স্পষ্টতই লোকটার খবে অসুখ-মুখটা//// বরফের মতো সাদা। নিষ্প্রভ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে সে হাসল।

‘তিন ভবঘুরের সঙ্গে চলে চার নম্বর। সাদা চামড়া কালো মন, কালো চামড়া সাদা মন। একটি কেবল সৎ, আর সে বাকুবা।’ বলে নিস্তেজ হয়ে চিত হয়ে পড়ল লোকটা।

‘ভুল বকছে,’ মন্তব্য করল বাকালা।

কক্স বলল, ‘এ ধরনের ভুল বকুনি কিন্তু অপমানজনক। হেঁয়ালি করে কথা কইছে। একজন সৎ আর সে হলো বাকুবা। কী বলছে বুঝলি? ম্পেপো হলো বাকুবা জাতের লোক। ওর দাঁত দেখলেই বুঝবি। ওর ওপরের পাটির সামনের দাঁত ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এটা বাকুবা প্রথা। তার মানে ও–ই কেবল সৎ লোক আর আমরা সবাই ছেঁচোড়।’

‘ব্রাউন। ওর চামড়া আমাদের চেয়েও সাদা, তার মানে মনটা ওর আরও কালো। ব্রাউন, তুইও একটা ছেঁচোড়, বুঝেছিস?’

কিন্তু কোনো জবাব দিল না ব্রাউন।

‘আবার জ্ঞান হারিয়েছে।’

‘সেই ভালো, মরলে আরও ভালো। ও আর এখন আমাদের কাজে লাগছে না বিশেষ, বরং বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

‘কিন্তু সেরে উঠলে ও একাই আমাদের দুজনের কাজ করবে।’

‘সেই আনন্দেই থাক। বুঝতে পারছিস না ও এখন নিতান্তই ফালতু।’

বিড়বিড় করে কী একটা ভুল বকল ব্রাউন, আলাপটা তাই ওখানেই থেমে গেল।

‘অ্যাই, কী নাম তোর?’

‘ম-ম্পেপো...’

‘হাতিটা নিয়ে গিয়ে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখ, পালিয়ে যায় না যেন।’

‘না পালাবে না,’ আমার পায়ে হাত বুলিয়ে জবাব দিল ম্পেপো।

পরদিন সকালে আমার মনিবদের দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলাম। সবচেয়ে ভালো লাগল ম্পেপোকে। সব সময়ই সে হাসিখুশি—ঝকঝক করছে তার সাদা দাঁত। অবশ্য ওপরের দুটি দাঁত না থাকায় একটু বিকৃত বোঝা গেল, হাতি ভালোবাসে ম্পেপো, বেশ যত্ন করত আমাকে। আমার কান, চোখ, পা, চামড়ার ভাঁজগুলো সব ধুয়ে দিত। উপহারও আনত আমার জন্য মিষ্টি ফল পাকুড়, আমার জন্যই বিশেষ করে এসব আনত সে।

ব্রাউন তখনো অসুস্থ, তাই লোকটা ঠিক কেমন বোঝা গেল না। মুখখানা ওর ভালো লাগত, আর সঙ্গীদের সঙ্গে কথা বলার খোলামেলা ধরনটা। কিন্তু বাকালা আর কক্সের প্রতি আমার একটা বিতৃষ্ণা জন্মাল।

বিশেষ করে বাকালা তার নোংরা ছেঁড়া স্যুটে এক অদ্ভুত অপ্রীতিকর জীব বলে বোধ হলো। স্যুটটার কাট বেশ ভালো, কাপড়টাও দামি, সম্ভবত কোনো এক ধনী পরিব্রাজকের। মনে হলো, এই স্যুট আর তাঁবু দুই-ই বাকালা কোনো একটা বেআইনি উপায়ে অর্জন করেছে। হয়তো কোনো নামজাদা ব্রিটিশ অভিযাত্রীকে খুন করে লুটপাট করেছে। চমৎকার রাইফেলটাও ওই ইংরেজের সম্পত্তি হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। তার চওড়া বেল্টে সর্বদাই থাকত একটা বড় রিভলবার আর অতিকায় একটা ছোরা। জাতে সে হয় পর্তুগিজ, নয় স্প্যানিশ। স্বদেশ, পরিবার বা নির্দিষ্ট কোনো পেশা—কিছুই নেই।

ঝাপসা নীলাভ চেহারার কক্স হলো ইংরেজ, স্বদেশের আইনবহির্ভূত। তিনজনই বোম্বেটে, হাতি মারে কেবল তার দাঁতের জন্য, কোনো আইনকানুনে বা সীমান্তের কোনো পরোয়া করে না।

তাদের পথপ্রদর্শক নির্দেশকের কাজ করত ম্পেপো। বয়স খুব কম হলেও হাতির ব্যাপারে এবং হাতি শিকারে সে ওস্তাদ। হাতি শিকারের পদ্ধতি তার অবশ্য নিষ্ঠুর ও বর্বর, কিন্তু অন্য কোনো পদ্ধতি সে জানত না। পুরুষানুক্রমে পাওয়া পদ্ধতিরই প্রয়োগ করত সে। বোম্বেটেদের কাছে অবশ্য সবই সমান, হাতি কীভাবে মারা হলো, তাতে কিছুই তাদের এসে যায় না। আগুনের বেষ্টনীতে ফেলে তারা হাতিদের পুড়িয়ে মারত দমবন্ধ করে, মারত তীক্ষ্ণ খুঁটি গাড়া গর্তে ফেলে, গুলি করত, পেছনের পায়ের শিরা কেটে দিত, গাছের ওপর থেকে ভারী গাড়ি ফেলে অজ্ঞান করে দিয়ে পরে শেষ করে দিত। ম্পেপো ছিল ওদের কাছে খুব কাজের।

আগামী পর্বে সমাপ্য

* বানা-কর্তা, সাহেব।

**ট্রুয়েন্ট (ইং) ভবঘুরে।

—অনুবাদক