ভিনগ্রহের ক্রিকেটার – পর্ব ৬

গাধা মিজানকে রুমমেট হিসেবে নিতে হোস্টেলের কেউ রাজি ছিল না। একজন–দুজন ভাবল, ছেলেটা যেহেতু বোকাসোকা, রুমমেট হিসেবে পেলে হয়তো তাকে ঠকিয়ে খাওয়া যাবে। কিন্তু তাকে ঠকিয়ে লাভটা হবে কী? সে তো আর বড়লোকের ছেলে নয়।

শেষে সিরাজ স্যারকেই হস্তক্ষেপ করতে হলো। ক্লাস সেভেনের ছাত্র রাজীব ও মোহন আর ক্লাস টেনের ছেলে হায়দার থাকে রুম নম্বর ৭-এ। ওখানে একটা সিট খালি আছে। তিনি মিজানকে নিয়ে নিজেই ঢুকলেন ৭ নম্বর রুমে। রাজীব আর মোহন তখন ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে পড়ে আছে। হায়দার বসে আছে বইয়ের সামনে, একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে। স্যার বললেন, হায়দার, তোমাদের রুমে আজ থেকে মিজান থাকবে। ও তো আজ বিছানা-টিছানা আনতে পারেনি। তোমাদের বিছানাতেই আজ রাতে ও থাকুক। 

হায়দার মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, কিন্তু স্যার, এক রুমে তিন সেভেনের ছাত্র থাকলে আমার ডিস্টার্ব হবে না?

তাকে থামিয়ে দিলেন সিরাজ স্যার। তিনি নাটকের সংলাপ ঝেড়ে বললেন, গুরুর আদেশ অলঙ্ঘনীয়। 

সিরাজ স্যার চলে গেলেন। মিজান দাঁড়িয়ে রইল রুম নম্বর ৭–এর এককোণে। 

হায়দার বলল, মোহন আর রাজীব, ওঠ।

মোহন আর রাজীব কাঁথামুড়ির অবসান ঘটিয়ে উঠে পড়ে বলল, ভালোই হলো, আমাদের ব্রে খেলার একজন পার্টনার পাওয়া গেল। ওরে মিজান, তুই তো ভালোই গাধার ডাক ডাকতে পারবি, নাকি?

হায়দার বলল, মোহন–রাজীব, তোরা আজ এক বিছানায় ডাবলিং করবি। আর মিজান থাকবে আরেকটা বিছানায়। 

মোহন ও রাজীব রাজি, ঠিক আছে। 

সে বিছানা ছেড়ে কাপড়চোপড় পাল্টে চেয়ারে বসে রইল। আর কাঁথার নিচে মুখ লুকিয়ে মোহন আর রাজীব হাসতে লাগল খিলখিল করে।

মোহন আর রাজীব এক বিছানায় শুলো। মিজান আলাদা বেডে। শেষরাতে মিজানের ঘুম ভাঙল শীতল পানির স্পর্শে। সে দেখতে পেল তার বিছানা, কাঁথা সব ভেজা। নিশ্চয় কেউ পানি ঢেলে দিয়েছে।

সে বিছানা ছেড়ে কাপড়চোপড় পাল্টে চেয়ারে বসে রইল। আর কাঁথার নিচে মুখ লুকিয়ে মোহন আর রাজীব হাসতে লাগল খিলখিল করে। পরের দিন আবার হোস্টেলের সব ছেলেকে ডেকে এনে তারা দেখাল গাধা মিজানের কাণ্ড। তাদের দাবি হলো, মিজান রাতে বিছানায় হিসু করেছে।

মিজান কিছুই বলল না। শুধু টয়লেটে ঢুকে নীরবে কেঁদে এল। 

হায়দার বলল, মিজান, এটা কি সত্যি যে তুমি রাতে বিছানায় পেশাব

করেছ?

মিজান বলল, বিছানা ঠান্ডা দেখে আমার ঘুম ভেঙে যায়। কী করে যে বিছানা ভিজল। 

হায়দার বলল, নিশ্চয় মোহন আর রাজীব পানি ঢেলে দিয়েছে। দেখি গন্ধ করে কি না। পেশাবের গন্ধ না থাকলে ওদের স্যারের মার খাওয়াব। 

মোহন আর রাজীব এ কথা শুনতে পেল আড়াল থেকে, আড়ি পেতে। তারা কর্তব্য ঠিক করে ফেলল। তাদের একজন দিনের বেলা নিজেদের বিছানাতেই পেশাব করে দিল। এরপর মুতের গন্ধে রুমে থাকাই হয়ে পড়ল দায়। 

তাদের মুখের হাসি নিভে যেতে বেশিক্ষণ সময় কিন্তু লাগল না। মিজান ঝড়ের বেগে দৌড়ে এসে চমৎকার করে হাত ঘুরিয়ে এত দ্রুতগতির বল এত নিপুণ লাইন–লেংথ বজায় রেখে করে ফেলল যে গণেশ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখতে পেল পেছনে স্টাম্প উড়ে গেছে। 

১০

ক্লাস সেভেনের টিম মোটামুটি চূড়ান্ত হয়ে গেছে। তবু জয়েন স্যার আর ড্রিল স্যার শেষ পর্যন্ত বোলিং-ব্যাটিংয়ের পরীক্ষা নিচ্ছেন। কারণ, এই মার্কসটা ছেলেদের ফার্স্ট টার্মিনাল পরীক্ষায় তারা যোগ করতে চান।

মিজান আজকে বল করবে। ব্যাট করবে গণেশ। 

মিজান প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রথমে সে করতে চায় ফাস্ট বল। সে বলটা নিয়ে একেবারে পাকা খেলোয়াড়ের মতো করে নিজের প্যান্টে ঘষতে লাগল। তারপর বড় একটা দৌড় দৌড়ানোর জন্য চলে গেল অনেকটা দূরে। সবাই হাসতে লাগল। গাধা মিজানের কাণ্ডটা দেখো। জীবনে যে বলটা স্টাম্পের আশপাশে ফেলতে পারল না, সে কিনা বল করার আগে পোজপাজ দেখাচ্ছে!

তাদের মুখের হাসি নিভে যেতে বেশিক্ষণ সময় কিন্তু লাগল না। মিজান ঝড়ের বেগে দৌড়ে এসে চমৎকার করে হাত ঘুরিয়ে এত দ্রুতগতির বল এত নিপুণ লাইন–লেংথ বজায় রেখে করে ফেলল যে গণেশ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখতে পেল পেছনে স্টাম্প উড়ে গেছে। 

সবাই একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। 

ড্রিল স্যার বললেন, অ্যাকসিডেন্টালি এটা ঘটে গেছে। এই মিজান, আবার বল কর তো। সোহান, যা, তুই ব্যাট ধর। 

ড্রিল স্যার বললেন, মিজান তুই আরও বল কর তো দেখি। নে, এবার স্পিন কর। মিজান একেবারে ধ্রুপদী কায়দার স্পিন করে দেখাল।

মিজান আবার বল করতে দৌড় ধরল। তার দৌড়ানো, এগিয়ে আসা, হাত ঘোরানো, বল ছুড়ে মারা সবকিছুতেই একটা নিপুণ অভ্যস্ত ফাস্ট বোলারের ভঙ্গি।

আর বলের গতি তো রীতিমতো তাজ্জব লাগানো। 

এবং বিস্ময়কর হলো, সোহানও তার বলে ব্যাট ছোঁয়াতে পারল না। 

ড্রিল স্যার বললেন, উঁহু, অ্যাকসিডেন্ট তো দুবার ঘটতে পারে না। মিজান, আবার বল কর তো। 

মিজান এবারও দৌড় আরম্ভ করতে গেল একই জায়গায়। দৌড়ে এল জোরে। কিন্তু শেষের দিকে এসে নিজের দৌড়ের ওপর নিজেই যেন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে বসল। তারপর বলটা আঙুলের কারসাজিতে একটু সুইং করালো। এর জন্য প্রস্তুত ছিল না সোহান। এলবিডব্লু হয়ে গেল সে, যদিও কোনো আম্পায়ার ছিল না বলে আঙুল উঠল না ওপরের দিকে।

ড্রিল স্যার বললেন, মিজান তুই আরও বল কর তো দেখি। নে, এবার স্পিন কর। মিজান একেবারে ধ্রুপদী কায়দার স্পিন করে দেখাল। আবার স্পিন বল করার ভঙ্গিতে আলতো এগিয়ে এসে এত জোরে বল ছুড়ে দিল যে তা হলো ফাস্ট বলেরও বেশি। 

ড্রিল স্যার আবার ধপাস করে পড়ে গেলেন। এবার তার পিঠে ব্যাট লাগেনি, এবার তার মাথা ঘুরছে। এ রকম একজন বোলার তার স্কুলে এল কোথা থেকে। এ তো কেবল ক্লাস সেভেন বা এই স্কুলের সম্পদ নয়, পুরো দেশের জন্য সম্পদ বলে বিবেচিত হতে পারে। 

মাথাঘোরা ভাবটা একটু কমলে ড্রিল স্যার তাকে ১০-এ ১০ মার্কস দিয়ে দিলেন।

চলবে…