‘২১ নম্বর টাউন টানেল। সামনে চলমান সিঁড়ি। উঠছে এবং নামছে। নিঃশব্দে। এবং প্রায় নির্বিশেষে। কোথাও কোনো জনমানুষ নেই। এমনকি এদিকে নেই রোবোগার্ডগুলোও। ত্রিয়া এর মধ্যেই নিজেকে খুলে ফেলেছে। তার দুটি হাত ছড়িয়ে আছে সামনে; পেছনে দুটি পা। শরীরটা চৌকো হয়ে শীতল মেঝেতে পড়ে আছে। মাথাটা তুলে বোঝার চেষ্টা করছে, কেমন লাগছে তাকে দেখতে।
‘খুব বেশি সময় ত্রিয়ার হাতে নেই অবশ্য। টাউনের এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে চোখ নেই রাষ্ট্রের। অদৃশ্য ক্যামেরায় ছাওয়া প্রতিটি স্কয়ার। ত্রিয়া জানে, তাকেও দেখা যাচ্ছে কোনো না কোনো মনিটরে। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে কেউ না কেউ তাকে দেখে ফেলবে। ফেললে, মুহূর্তেই ছুটে আসবে নগর স্বেচ্ছাসেবক দল তাকে উদ্ধার করতে। অথচ কে চায় ওই উদ্ধার!
‘ত্রিয়া চেষ্টা করছে ব্যাপারটা ঘটিয়ে ফেলার।
‘খুব ছোটবেলায়, মাত্র একবার, ঘটাতে পেরেছিল সে। একেবারে হুল্লোড় পড়ে যাওয়ার মতোই ছিল ঘটনাটা; কিন্তু তা হয়নি। ত্রিয়ার মা বিষয়টা এমনভাবে চেপে গিয়েছিল, যেন এটি প্রতিদিনের সর্দি–কাশির মতোই সাধারণ কিছু!
‘এরপর মা মারা গেল। স্বেচ্ছাসেবক দল তার শরীরটা নিয়ে বাক্সবন্দী করে ফেলল; কেটে গেল ১১ বছর। ত্রিয়ার চেষ্টা তবু থামল না! বিশেষত দিন ও রাতের মধ্যবর্তী এই সময়টায়, একটি অস্থির বিপন্ন সময়ের ভেতর, ত্রিয়ার মনে হয়, নিজেকে খুলে ফেলে আমূল বদলে ফেলতে হবে। না হলে সে বাঁচতে পারবে না!
‘কিন্তু এক যুগ পেরিয়ে গেলেও তেমন কিছু আর কখনো ঘটেনি। না ঘটায়, ত্রিয়ার বিষণ্নতার কোনো বদল আর আসেনি!’
‘তুমি কি বিষণ্ন, তাশা?’
একটা নীল কক্ষে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে মেয়েটি। নিখুঁত চেহারা। লম্বাটে নাক, খাঁজ পড়া থুতনি, নিটোল গাল। আর কোনো আসবাব নেই কক্ষটিতে। নীল রং ও আসবাবহীনতা দুটোই পছন্দ তাশার।
‘তুমি কি বিষণ্ন, তাশা?’
তাশা চোখ খোলে। সাদা চোখ। মণি দুটো উজ্জ্বল খয়েরি। ঠিক যেন বাঘ। মুখে নেই এতটুকু বিষণ্নতা। তবু কে যেন তৃতীয়বারের মতো প্রশ্ন করে ওঠে, ‘তুমি কি বিষণ্ন, তাশা?’
‘এক কথা বারবার বললে সেটা প্রলাপের মতো শোনায়। তুমি চুপ থাকতে পারো!’
‘আর এক ফিকশন বারবার লেখা প্রলাপ নয়?’
শ্বাস ফেলে তাশা। জোরেই। মাত্র তো ২৫ বছর বয়স। তার বয়সী মেয়েরা এখন ঘুরতে গেছে ফ্যান্টাসি জোনগুলোয়। হয় ১৩ মাত্রার রোবটদের সঙ্গে না হলে আস্ত আস্ত তরুণের সঙ্গে প্রেম করছে। রক্তের গোপন উচ্ছ্বাসে ভরে আছে তাদের শরীর–মন। উল্লাসের উৎপাত চলছে মাংসের ভেতর। আর সে, প্রিয় নীলকক্ষে বসে লিখছে। ফিকশন। সে কি তাহলে সত্যিই বিষণ্ন?
তাশা উঠে বসে। মোটেও নয়!
‘এই রোবট, গাধা, শোনো, মাত্র ২১ বছর বয়সে আমি এই দুনিয়ার সেরা তরুণ ফিকশন রাইটার হয়েছি। আমার কোনো বিষণ্নতা নেই!’
শুধু শেষ লাইনের ওপর পূর্ণ আস্থা না থাকায় পুরো বাক্যটাই আর বলতে পারে না তাশা। বরং বলে, ‘যখন লিখব, তখন তোমাকে চুপ থাকতে হবে, জানো তো?’
কণ্ঠটা বলে, ‘আমার তো অনেক রকম দায়িত্ব। তোমার লেখা দেখভালের দায়িত্ব যেমন আছে, তেমনি তো তোমাকে দেখভালেরও দায়িত্ব আছে। আমি তো সে কারণেই নিযুক্ত। ভুলে যেয়ো না আমি ৩৩ মাত্রার রোবট। আমাকে তুমি উপহার পেয়েছ!’
এ কথা সত্যি। ৩৩ মাত্রার এই রোবট এমনি এমনি কিনতে পাওয়া যায় না, তা কারও যতই ক্রেডিট থাকুক। সেরা তরুণ রাইটার পুরস্কার জেতার পর, প্রায় দুই বছর কেটে গেলে ইউনিয়ন তাকে এই রোবট দিয়েছে। পৃথিবীতে তার মতো সাধারণ খুব কম জনের কাছেই এমন একটা রোবট আছে; যা মানুষের বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
তাশা একটা বোতামে চাপ দেয়। দিলে, তার সামনে হলোগ্রাফিক্যালি একটা অবয়ব ফুটে ওঠে। দেখা যায় ত্রিয়াকে। বলে, ‘কেমন দেখাচ্ছে বলো তো আমার এই চরিত্রকে?’
‘তুমি যেমন ভেবেছ, তেমনই।’
‘ঠিক। ও ত্রিয়া। আমার ফিকশনের চরিত্র। কিন্তু ও আমি নই!’
কণ্ঠটা বলে, ‘কিন্তু ওর বয়স তোমার মতোই ২৫। এবং তোমার মতোই তো ওর মা ছোটবেলায় মারা গেছে। তোমার সাথে ওর অনেক মিল।’
‘মোটেও নয়। ও নিজেকে খুলে ফেলতে পারে। হাত-পা-মাথা...সব! আর খুলতে খুলতে একদিন ও একটা মাকড়সা হয়ে যেতে পেরেছিল, জানো?’
‘তুমিও তো নিজেকে খুলে ফেলতে পারো। লেখকদের নাকি তা–ই করতে হয়। সবকিছু খুলে খুলে অন্য কিছুতে রূপান্তরিত হতে হয়।’
‘লেখক যা লেখেন, তা কখনো বিশ্বাস করো না যে সেটা লেখকের জীবেন ঘটেছে; এবং এমনকি, অবিশ্বাসও কোরো না!’
‘তোমার কথা ধাঁধার মতো লাগছে, আমি কোড ভাঙতে পারছি না!’
‘কথা বলো না। আমাকে ভাবতে দাও।’
তাশা আবার চোখ বন্ধ করে। ভাবতে শুরু করে। ভাবনাগুলো লিখিত আকারে জমা হতে থাকে মাদারফাইলে। শব্দের পর শব্দ...লাইনের পর লাইন...দৃশ্যের পর দৃশ্য…।
২.
‘আপনি কী করেন?’
‘লিখি।’
‘কী লেখেন?’
‘ফিকশন।’
‘বয়স কত আপনার?’
‘২৫।’
‘নিজেকে খুলে ফেলেছিলেন কীভাবে?’
‘খুলে ফেলিনি তো।’
‘ক্যামেরায় আপনার নিজেকে খুলে ফেলার দৃশ্য ধারণ করা আছে। চাইলেই দেখতে পারেন।’
‘ওটা ক্যামেরার ভুল। আমার নয়। আমি কি এখন যেতে পারি?’
‘কী নাম যেন বললেন আপনার?’
‘ত্রিয়া।’
‘আপনার কোড?’
‘আমি কি এখন যেতে পারি?’
‘আপনি না বললেও আপনার কোড আমরা বের করে নিতে পারব। সেটার জন্য আমাদের এক মিনিট সময়ও লাগবে না। কিন্তু তা আমরা করতে চাই না। আমরা চাই, আপনি আমাদের সহযোগিতা করেন। আপনি নিজেকে কীভাবে খুলে ফেলেছিলেন, তা জানান!’
‘ধরে নিন আমি রোবট।’
‘এটা যেহেতু আপনি নন, সেহেতু এটা ধরে আমাদের তদন্ত এগোতে পারি না।’
‘আমি কি এখন যেতে পারি?’
‘না।’
ত্রিয়া উঠে দাঁড়ায় নিষেধ সত্ত্বেও। এবং তখনই ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবকের ইনচার্জ তাকে ধরে। ধরলে ত্রিয়া ঘুরে একটা লাথি চালায় ইনচার্জের বুক লক্ষ্য করে। ইনচার্জ সেটাকে এড়িয়ে যেতে পারে। সঙ্গে ত্রিয়ার কবজি ঘুরিয়েও ধরতে পারে। বলে ওঠে, ‘চাইলেই আপনাকে আমরা যেতে দিতে পারি না। আপনার জন্য রয়েছে আমাদের গবেষণাগার। আপনার এমন নিজেকে খুলে ফেলার বিষয়টা নিয়ে আমরা সাবধানী। ব্যাপারটা আমরা আরও জানতে চাই।’
‘কিন্তু আমি জানাতে দিতে চাই না!’
‘ইউনিয়নের চাওয়াই শেষ চাওয়া, পৃথিবীর স্বার্থে, তাই নাকি?’
ত্রিয়া একটি গালি দিয়ে ওঠে। আর তখনই সব কটি বাতি নিভে যায়। গাঢ় অন্ধকারের ভেতর ত্রিয়াকে কোথায় যেন নিয়ে যাওয়া হতে থাকে। ত্রিয়া যে কিছুই দেখতে পায় না, তা না। অন্ধকারের ভেতর খুব সরু একটা কমলা আলোর দিকে তারা যেন যেতে থাকে। অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই।
৩.
‘তাশা, আমার মনে হয় তোমার ঘুমানো দরকার।’
‘আমি ঠিক আছি। কথা বলো না।’
‘তাহলে কি তুমি কিছু খাবে? এফ ব্লকের সবচেয়ে তাজা আনারসের শরবত আছে কিচেনে। শরীর চাঙা করার জন্য খুবই উপযুক্ত। খেয়ে নাও।’
‘আমি ঠিক আছি, বললামই তো। কেন কথা বাড়াচ্ছ?’
‘কারণ, আমার মনে হচ্ছে, তুমি ঠিকভাবে চিন্তা করতে পারছ না।’
‘মানে?’
‘আমি দেখছি, ইনচার্জকে তুমি লাত্থি দিচ্ছ!’
‘আমি না ত্রিয়া...’
‘এবং কী বিস্ময়কর ব্যাপার, ইউনিয়নকে তুমি গালিও দিচ্ছ! এই পৃথিবীতে এমনটা কি হওয়া সম্ভব?’
‘যা হওয়া সম্ভব, তা হলে ফিকশন হয় নাকি? যা হতে পারত, হয়তো তা-ই ফিকশন।’
‘আমার মনে হয়, গালির ব্যাপারটা তোমার আবার ভাবা উচিত।’
‘তুমি কি আমার লেখা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছ?’
অনেকক্ষণ কোনো শব্দ হয় না আর। তাশা শ্বাস ফেলে একটা। আবার ভাবতে শুরু করতে চায়, কিন্তু তখনই রোবটের কণ্ঠটা ফিরে আসে, ‘আমার তথ্য বলছে, একমাত্র মানুষই অন্যকে ভুল বুঝতে পারে। ব্যাপারটা নিদারুণ আফসোসের!’
‘কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, তুমি আসলে আমার লেখা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছ!’
‘আমি শুধু তোমাকে সাহায্য করতে চাইছি। আমাকে সে জন্যই ইউনিয়ন নিযুক্ত করেছে, তাই না?’
‘বকর বকর না করে চুপ থাকো তুমি।’
৪.
হলরুমটা বড়। এত বড় যে মঞ্চ থেকে চারদিকে তাকিয়ে দিক ঠাহর করে উঠতে পারছে না তাশা। তার পাশে রয়েছেন আরও কিছু লেখক। তারা সবাই বুদ্ধিদীপ্ত, অন্তত তাশার কাছে তা–ই মনে হচ্ছে। সবার বিপরীতে তাশাই বরং কিছুটা ম্লান এবং এলোমেলো।
প্রত্যেক ফিকশন রাইটারের নতুন নতুন লেখা প্রকাশ পেতে যাচ্ছে। সেসব নিয়েই উৎসব! প্রত্যেকের লেখা একাধিক প্রাজ্ঞকে পড়তে দেওয়া হয়েছে। তারাও তাদের মতামত জানাবেন। এ প্রসঙ্গে সবার প্রথমেই চলে এসেছে তাশার ফিকশনের কথা। ত্রিয়া নামের অনন্য এক মেয়ের গল্প এটা। যে মেয়েটি নিজেকে খুলে ফেলতে পারে! তারপর ছড়িয়ে দিতে পারে সমস্ত অণুর ভেতর। এমন গল্প আগে কখনো দেখা গেছে কি?
প্রশ্নটা ছুটে আসে তাশার কাছে, ত্রিয়া কে? এটি কি আপনি?
‘না। আমি ত্রিয়া নই তো। আমি তাশা। আর ত্রিয়া হলো ত্রিয়া।’
‘ফিকশনটি খুবই বাস্তবানুগ। মনে হয় যেন চোখের সামনে সব দেখতে পাচ্ছি!’
‘আমি অবশ্য তা চাই না। চোখের সামনে দেখার জন্য আমাদের অনেক কিছু আছে। নিয়মিতই তৈরি হচ্ছে কত ধরনের দেখার বস্তু। আমার ভাবনা চোখের সামনে দেখার বস্তু না হোক!’
‘তাহলে কী চান আপনি আপনার লেখায়?’
‘এমন কিছু…যা দিয়ে সিনেমা তৈরি হতে পারে না। ছবি তৈরি হতে পারে না। অপেরা হতে পারে না। যা চাইলেই স্ক্রিনের সামনে যেন চলমান হয়ে না ওঠে।’
‘এমন কিছু কি হওয়া সম্ভব সত্যি?’
‘যদি এমন না হয়, তাহলে সিনেমার সাথে ফিকশন রাইটিংয়ের পার্থক্য কী থাকবে? অনেক বছর আগে, পৃথিবীতে এটিই ধারণা ছিল যে চোখের সামনে সব দেখতে পাওয়াই দারুণ ফিকশন…যখন ক্যামেরা আবিষ্কার হয়নি, তখন ছবি আঁকা হতো হুবহু করে। সেটিই ছিল তখনকার চাওয়া। কিন্তু ক্যামেরা যখন চলে এল, তখন হুবহু অবয়ব আর আরাধ্য থাকল না—চিত্রশিল্পী তখন দেখায় নয়, ভাবায় মনোযোগ দিলেন! আমি তেমনটাই চাই। ত্রিয়াকে আপনারা দেখতে পেলে আমি খুশি হবো না, কিন্তু ত্রিয়াকে যদি বুঝতে পারেন, অনুভব করেন, তাহলেই আমার আনন্দ!’
‘ত্রিয়াকে আমরা বুঝেছি বলেই মনে হয়েছে। ইউনিয়নের কাছে যাবার পর ত্রিয়া দারুণভাবে তাদের সাহায্য করেছে গবেষণাগারে…’
‘আপনি বোধ হয় ভুল করছেন...ত্রিয়া গবেষণাগার থেকে পালিয়ে এসেছে…’
‘না না। কী বলেন! আপনার লেখাতেই তো আমরা পেলাম… ত্রিয়া ইউনিয়নের গবেষণায় সাহায্য করল এবং ত্রিয়া হয়ে উঠল ইউনিয়নের একজন নিষ্ঠ কর্মী! তা-ই নয় কি?’
‘কক্ষনো না। ত্রিয়া পালিয়ে এসেছে এবং শেষবারের মতো নিজেকে খুলে ফেলতে পেরেছে। আর যখন মানুষ নিজেকে খুলে ফেলতে পারে...তখন সে হয়ে ওঠে যেকোনো কিছু! একটা সুন্দর ফুল বা মাকড়সা! একটা জোনাকি কিংবা কোনো প্রবাল…ত্রিয়া কী হতে চেয়েছিল, আমরা জানতে পারি না…কারণ, আমরা নিজেরাও সত্যিই জানতে পারি না আমরা কী হতে চাই!’
বলা যায়, তর্কই শুরু হয়ে গেছে। হলরুম গমগম করে ওঠে ত্রিয়ার চূড়ান্ত অবস্থা নিয়ে। আর এরই মধ্যে অতিকায় পর্দায় তাশার লেখা ফিকশনটা দেখা যেতে থাকে। এবং সেখানে তাশা দেখে, কী আশ্চর্য, ত্রিয়া হয়ে উঠেছে একজন ইউনিয়নকর্মী!
তাশার ঘাম হতে থাকে। এমন ফিকশন সে লেখেনি। তাশা চিৎকার করতে চায় কিন্তু তখনই সেই কণ্ঠটা ভেসে আসে তাশার ভেতর থেকেই…
‘তুমি কি বিষণ্ন, তাশা? কিন্তু তুমি জেনে খুশি হবে, তুমি এই দশকের শ্রেষ্ঠ ফিকশন রাইটারের পুরস্কার পেতে চলেছ। আজই বিকেলের বুলেটিনেই তুমি তা জানতে পারবে! আমরা এ নিয়ে আজ রাতেই উল্লাস করব, কী বলো?’