মানবসেবা

কানামিতরা মানবজাতির জন্য অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ উপহার নিয়ে এসেছে। যেগুলো পুরো পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে দেবে

কানামিতরা দেখতে সুন্দর নয়, কথাটা সত্য। তারা দেখতে তেমন আকর্ষণীয় নয়। কেউ ওদের প্রথমবার দেখলে হতবাক হয়ে যাবে। এ ধরনের দানবীয় মুখওয়ালা কেউ যখন অন্য নক্ষত্র থেকে এসে পৃথিবীর মানুষকে উপহার দিতে চায়, তখন সেটা গ্রহণ করতে অবশ্যই সংকোচ বোধ হওয়ার কথা।

আমি জানি না, আন্তঃনক্ষত্র থেকে আসা এলিয়েনদের আমরা কীরকম দেখতে বা ভাবতে পছন্দ করি। ব্যাপারটা যেন সব সময় এমন যে মহাজাগতিক দূত বা এলিয়েন দেখতে অবশ্যই ভয়ংকর হবে। যাদের দেখে আমরা, মানে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে যাব। পালিয়ে যাব অন্য কোথাও। আমাদের মনের মধ্যে চলতে থাকে—তারা বিশাল মহাকাশযানে পৃথিবীতে আসবে এবং আমাদের সব কিছু ধ্বংস করে দেবে। কেন আমরা এমন ভাবি, জানি না।

কানামিতরা খর্বাকৃতির। ওদের সারা দেহ লোমশ। নাক বোঁচা, চোখগুলো ছোট। সবুজ রঙের চামড়া জাতীয় আলখাল্লা গায়ে জড়িয়ে রাখে সব সময়। কোমরে এক অদ্ভুত ধরনের পদার্থের বন্ধনী লাগানো। যা-ই হোক, গায়ের পোশাক দেখে বোঝা যায়, কানামিতদের রসবোধ খুব ভালো।

জাতিসংঘের অধিবেশনে তারা তিনজন এসেছে। আমি জাতিসংঘে অনুবাদকের কাজ করি। এই দৃশ্য আমি ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারব না। সারা বিশ্ব থেকে প্রতিনিধি যোগ দিয়েছেন এই অধিবেশনে। তাঁদের মাঝে বিশ্রি সবুজ আলখাল্লা পরা তিনজন ভিনগ্রহবাসী বসে আছে! প্রত্যেকের হাতে একটি করে বই। অদ্ভুত এই দৃশ্য!

কানামিতরা মানবজাতির জন্য অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ উপহার নিয়ে এসেছে। যেগুলো পুরো পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে দেবে।

সবাই কানে হেডফোন লাগিয়ে রেখেছে যেন ভাষা বুঝতে পারে। কিন্তু কানামিতরা তাদের ত্রিকোণাকৃতির কানে হেডফোন লাগায়নি। আমার মনে হয় তারা পৃথিবীর যাবতীয় ভাষা শিখে এসেছে।

আর্জেন্টিনার এক প্রতিনিধি বললেন, তাঁর সরকার নতুন এই সস্তা শক্তির উৎসের ব্যাপারে আগ্রহী। কিন্তু বিস্তারিত পরীক্ষা ছাড়া বিষয়টি তার সরকার আমলে নেবে না।

কানামিতরা মানবজাতির জন্য অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ উপহার নিয়ে এসেছে। যেগুলো পুরো পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে দেবে।

প্রতিনিধিদের অনেকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। কেন তারা মানবজাতির উপকার করতে এসেছে? সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধি বললেন, ‘কেন তারা অন্য গ্রহ থেকে আমাদের উপকার করতে এসেছে? তাদের উদ্দেশ্য কী? তারা উপকার করছে, কিন্তু বিনিময়ে আমাদের কাছে কিছু চাইছে না। এর কারণ কী?’

সবার কথা শুনে জাতিসংঘের মহাসচিব সিদ্ধান্ত নিলেন, কানামিতদের কিছু পরীক্ষা নেওয়া হবে। প্রতিনিধিদের মধ্যে ফ্রান্স থেকে ছিলেন বিশিষ্ট অপরাধবিজ্ঞানী ডক্টর ডেনিস লেভেক, যিনি মানুষের মস্তিষ্কের অপরাধপ্রবণ চিন্তা ধরতে সক্ষম একটি জটিল যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। ভিনগ্রহ থেকে আসা কানামিতদের মস্তিষ্ক পরীক্ষা করবেন তিনি। কানামিতদের মস্তিষ্ক সুস্থ না অসুস্থ অবস্থায় আছে, এই পরীক্ষা করা হবে আরেকটি যন্ত্রের সাহায্যে। সেটিও ড. ডেনিসের তৈরি।

এক কানামিতকে একটি স্বয়ংক্রিয় চেয়ারে বসানো হলো। ড. ডেনিসের সহকারী সেই কানামিতের মাথায় দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ তার পেঁচিয়ে দিল। তারপর বাহুতে মুড়িয়ে দেওয়া হলো ধাতব কাপড়। শেষে সেই কানামিতের হাতের তালুতে একটি নরম রাবার টিউব ধরিয়ে দেওয়া হলো।

বিরাট হলরুমে বিশ্বের নানা দেশের প্রতিনিধিরা সবাই বিশাল টিভি স্ক্রিনের দিকে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন। ড. ডেনিস সবার উদ্দেশে বললেন, ‘এই যন্ত্র কানামিতের কথার সত্যতা যাচাই করবে। যেহেতু আমাদের কানামিতদের মনস্তাত্ত্বিক দিক অজানা, তাই আমরা দেখব তারা মানুষের মতো চিন্তা করে কি না। আর এটি সত্যতা যাচাইয়ের অনেক বড় প্রয়াস।’

কানামিত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সব প্রতিনিধিদের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট ইংরেজি শব্দে বলল, ‘আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে এই পৃথিবীতে শান্তি ও সুখ প্রতিষ্ঠা করা।

তিনি যন্ত্রের প্রথম ডায়ালের দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘এই অংশ তার হৃৎস্পন্দন রেকর্ড করবে। এটা তার হাতের তালুতে রাখা রাবার টিউবের মাধ্যমে দেহের তড়িৎ পরিবাহিতা দেখাবে। এবং এটা...’ তিনি যন্ত্রের অন্য একটা অংশে নজর দিলেন। ‘এটা তার মস্তিষ্ক থেকে নির্গত বিদ্যুৎ তরঙ্গের ঘনত্বের নমুনা দেখাবে। আর এসবের মাধ্যমেই জানা যাবে সে সত্যি বলছে কি না।’

তিনি দুটি কাঠের তক্তা হাতে নিলেন। একটির রং লাল, আরেকটির রং কালো। লাল তক্তাটি তিন ফুট লম্বা আর কালোটি ৪ ফুট। তিনি সেগুলো সেই কানামিতকে দেখিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘এদের মধ্যে কোনটি লম্বায় বড়?’

‘লালটি,’ কানামিত বলল।

যন্ত্রের ডায়ালে তরঙ্গ-রেখা সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে গেল।

‘আমি আবার বলছি, এদের মধ্যে লম্বা কোনটি?’ ডক্টর বললেন।

‘কালোটি,’ ভিনগ্রহী প্রাণী বলল।

ঠিক এই মুহূর্তে যন্ত্রের রেখা স্বাভাবিক হলো।

‘তুমি কীভাবে পৃথিবীতে এসেছ?’ ডক্টর জিজ্ঞেস করলেন।

‘হেঁটে,’ কানামিত উত্তর দিল।

আবার যন্ত্রের তরঙ্গ-রেখা অস্বাভাবিক হয়ে গেল। আর হলরুমে বসে থাকা প্রতিনিধিরা এমন উত্তর শুনে সমস্বরে হেসে উঠলেন।

‘আরও একবার বলছি, তুমি কীভাবে এখানে এসেছ?’ প্রশ্ন করলেন ডক্টর।

কানামিত বলল, ‘মহাকাশযানে।’ এবার যন্ত্রের রেখা ফের স্বাভাবিক দেখাল। ডক্টর প্রতিনিধিদের মুখোমুখি হলেন। তিনি বললেন, ‘বেশ কিছু পরীক্ষা করার পর আমি এবং আমার সহকারী নিশ্চিত হয়েছি যে কানামিত এ কথাটি মিথ্যে বলেনি। আমার এই যন্ত্র ভালোই কাজ করেছে।’

তিনি এবার সেই কানামিতের দিকে ফিরে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিনিধির করা প্রশ্নটি আবার করলেন, ‘কানামিত, তুমি কেন মানবজাতিকে বেশ কিছু ভালো উপহার দিতে চাইছ? তোমার বা তোমাদের উদ্দেশ্য কী?’

কানামিত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সব প্রতিনিধিদের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট ইংরেজি শব্দে বলল, ‘আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে এই পৃথিবীতে শান্তি ও সুখ প্রতিষ্ঠা করা। আমরা চাই, আমাদের গ্রহ যে আনন্দ উপভোগ করছে তা এই গ্রহের মানুষও উপভোগ করুক। ইতিমধ্যে ছায়াপথের অন্যান্য গ্রহে আমরা এসব উপহার বিতরণ করে এসেছি। তারা সবাই সুখে আছে। এই পৃথিবীতে কোনো ক্ষুধার্ত মানুষ থাকবে না, যুদ্ধ থাকবে না, অভাব থাকবে না—এটাই হবে আমাদের জন্যে সবচেয়ে বড় পুরস্কার।’

আরও পড়ুন

প্রতিনিধিরা আগ্রহ নিয়ে কানামিতের কথা শুনল। বক্তব্য শেষে হলরুমে বয়ে গেল বিতর্কের ঝড়। কেউ কেউ প্রশ্ন করতে চাইল। অনেকেই চাইল কানামিতের সঙ্গে সরাসরি দেখা করতে। কিন্তু মহাসচিব আজকের মতো অধিবেশন সমাপ্ত ঘোষণা করলেন।

চেম্বার থেকে বের হতেই গ্রিগরির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তার চেহারা লাল হয়ে আছে। গ্রিগরি আমার সহকর্মী। সেও একজন অনুবাদক।

‘কারা এই প্রহসনের আয়োজন করেছে?’ গ্রিগরি ক্রোধের স্বরে বলল।

‘আমার কাছে যান্ত্রিক পরীক্ষাটি সত্য মনে হয়েছে,’ ওকে বললাম।

‘এটা প্রহসন! যদি তারা সত্যিই বলছে, তবে এত বিতর্কের কী হলো?’ সে তাচ্ছিল্যভরে বলল।

‘আগামীকাল অধিবেশনে এটা নিয়ে আরও বির্তক হবে আশা করি।’

‘আগামীকাল আসার আগে অনেক কিছু ঘটতে পারে। আমার মাথায় ঢুকছে না, শুধু তাদের মিষ্টি কথায় গলে গিয়ে কীভাবে আমরা অমন ভয়ংকরদর্শন প্রাণীদের ওপর বিশ্বাস করছি! কীভাবে!’

‘তাদের আকার-আকৃতি নিয়ে নয় বরং তারা যে আমাদের ভালো কিছু দেওয়ার উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে, সেটা নিয়ে ভাব।’

গ্রিগরি ‘ধ্যাৎ’ জাতীয় কিছু একটা শব্দ করে চলে গেল।

পরদিন সারা বিশ্বের সরকারি গবেষণাগারগুলোতে কানামিতদের দেওয়া সস্তা শক্তির উৎস পরীক্ষা করে দেখা হলো। পরীক্ষায় বেরিয়ে এল বিস্ময়কর তথ্য। একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে তাদের দেওয়া ছোট ধাতব বাক্সগুলো বেশি পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। আর সেই বাক্সও তৈরি করা যাবে কম খরচে। পৃথিবীর সব মানুষের কাছে একটি করে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী বাক্স থাকবে। বিকেলের দিকে খবর এল, ১৭টি দেশ ইতিমধ্যেই এসব বাক্স তৈরির জন্য কারখানা স্থাপন করে ফেলেছে। কানামিতরা বাক্স তৈরির পদ্ধতি শিখিয়ে দিচ্ছে।

পরদিন আরেকটা উপহার নিয়ে এল তারা। এমন একটি তরল পদার্থ, যেটি যেকোনো অনুর্বর ভূমিতে ছড়িয়ে দিলে খুব দ্রুতই সেখানে ফসল ফলতে শুরু করবে। মাটির নাইট্রেট পদার্থের উৎপাদনের হার বাড়িয়ে দেবে।

সারা পৃথিবীর পত্রিকা জুড়ে শিরোনাম হচ্ছে ‘কানামিত’। ভীনগ্রহীদের একজন বলল, ‘আপনাদের এখন যথেষ্ট বিদ্যুৎ রয়েছে এবং খাদ্যোৎপাদন বহুগুণে বেড়ে গেছে।’ সে তার তিন আঙুলের হাত দিয়ে টেবিলে রাখা তাদের তৃতীয় উপহারের দিকে ইশারা করল। একটি বাক্স, যার সামনে অধিবৃত্তাকার প্রতিফলক লাগানো। সে বলল, ‘আজ আমি আপনাদের তৃতীয় উপহারের বিষয়ে বলব। এটাও প্রথম দুটোর মতোই খুব গুরুত্বপূর্ণ।’

আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে কানামিতরা আমাদের এই পৃথিবীকে স্বর্গের কাছাকাছি কিছু বানিয়ে দিয়েছে। তাহলে তাদের সন্দেহের হেতু কী?

জাতিসংঘের আজকের অধিবেশন কানামিতদের অনুরোধে সারা বিশ্বজুড়ে সম্প্রচারিত হচ্ছে। সে আবার বলল, ‘এই যন্ত্র চারপাশে এমন একটি ক্ষেত্র তৈরি করবে, যে ক্ষেত্রে কোনো কিছু বিস্ফোরিত হবে না।’

গোটা হলরুম জুড়ে পিনপতন নিরবতা। যখন কেউ বিষয়টা বুঝতে পারছে না, তখন সেই কানামিতই ব্যাপারটা খোলাসা করে বলল, ‘আর কখনো যুদ্ধ হবে না।’

এটাই সহস্রাব্দের সবচেয়ে বড় বার্তা। পুরোপুরি সত্য। বিস্ফোরণ ছাড়া যেকোনো যুদ্ধ প্রায় অসম্ভব। আর এমনিতেও কিছুদিনের মধ্যে সারা বিশ্বের প্রতিটি দেশ খাদ্যে এবং শক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যাবে। যুদ্ধ বাধার কোনো কারণই থাকবে না।

কানামিতদের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে অধিবেশনের কোনো প্রতিনিধি একটা প্রশ্নও করল না। গ্রিগরিও নিশ্চুপ হয়ে গেল।

এই অধিবেশনের কয়েক মাস পরে আমি জাতিসংঘের চাকরি ছেড়ে দিলাম। সংস্থাটি প্রায় অকার্যকর হয়ে গেছে। কারণ এখন কোনো দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহ নেই। সব দেশ স্বাবলম্বী। তাই তাদের বিচারিক বা সালিশি প্রক্রিয়ার প্রয়োজন ফুরিয়েছে।

অনুবাদক হিসেবে কানামিত অ্যাম্বাসিতে আমার চাকরি হয়ে গেল।

চাকরির প্রথম দিন দেখা হলো গ্রিগরির সঙ্গে। আমি অবাক হয়ে তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি এখানে কী করছ? যাদের প্রতি এত ঘৃণা, তাদের এখানে কেন এসেছ?’

তাকে লজ্জিত দেখাল। সে বলল, ‘আসলে তারা দেখতে যতটা ভয়ঙ্কর, ততটা ভয়ঙ্কর নয়।’

আমি তাকে নিয়ে নিচে লাউঞ্জে গেলাম। জায়গাটা বেশ সুনসান। চায়ে চুমুক দিয়ে সে বলল, ‘আমি এখনো তাদের ঘৃণা করি। একটা সন্দেহ মন থেকে যাচ্ছে না। তারা কেন এসব করছে আমাদের জন্য? উদ্দেশ্য কী? তুমি খেয়াল করেছিলে, সোভিয়েত প্রতিনিধির করা প্রশ্নের জবাব কিন্তু কানামিত দেয়নি।’

আমি মনোযোগ দিয়ে তাকালাম তার দিকে।

‘তারা বলেছে, আমাদের শান্তি এবং সুখ এনে দেবে। কিন্তু বলেনি, কেন এনে দেবে।’

আমি তাকে বোঝানোর জন্যে বললাম, ‘অনেক মানুষ কেন...’

‘আরে ধ্যাত! তাদেরও উদ্দেশ্য থাকে। এখন কথা হচ্ছে, আমাদের উপকার করে তারা কী অর্জন করতে চাইছে?’

‘সংস্কৃতি...’ আমি বললাম।

‘সংস্কৃতি না, ছাই! এমন কিছু, যা আমাদের চিন্তার বাইরে। যা শুধু কানামিতরা জানে। কিন্তু বিশ্বাস করো পিটার, নিঃস্বার্থ পরার্থপরতা বলে কিছু নেই, সেটা যেকোনো ক্ষেত্রেই হোক না কেন। তারা অবশ্যই কিছু না কিছু অর্জন করতে চাইছে।’

আমি বললাম, ‘আর এ জন্যই তুমি এখানে। তাদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করছ।’

‘ঠিক। আমি তাদের গ্রহে দশ বছরের বিনিময়-নভোযানের প্রথম যাত্রায় অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলাম। তারা প্রতি বছর পৃথিবী থেকে মানুষ নিয়ে যাবে নিজেদের গ্রহে। তাদের এ ঘোষণার এক সপ্তাহের মধ্যে কোটা পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় আমি আর যেতে পারব না। এতে ভালোই হয়েছে। আমি তাদের ভাষা নিয়ে গবেষণা করছি। তাদের অঙ্গভঙ্গি দেখে অনুমান করা যায়, তারা কী বলছে। এ ছাড়া তাদের ভাষার মৌলিক কিছু দিক আমি বুঝতে পেরেছি। কিছু প্রবাদ একদম ইংরেজি প্রবাদের কাছাকাছি। আমি নিশ্চিত, আমি এর উত্তর বের করতে পারব।’

গ্রিগরি চলে গেল। কিন্তু এরপর সে প্রতিদিন তার গবেষণার উন্নতির কথা আমাকে জানাতে লাগল। ঠিক মাস খানেক পরে তার সঙ্গে আবার দেখা হলো। তাকে খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছে। সে বলল, কানামিতদের একটি বই সে হাতে পেয়েছে। এই বই তারা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। পুরো বইটা তারা নানান প্রতীক ব্যবহার করে লিখেছে। চীনা ভাষার চেয়েও জঘন্য। কিন্তু সে এটার রহস্য উদঘাটন করেই ছাড়বে, যত বছরই লাগুক না কেন। গ্রিগরি আমার সহযোগিতা কামনা করল।

আরও পড়ুন

যা-ই হোক, আমি নিজের স্বার্থেই তাকে সহযোগিতা করতে সম্মত হলাম। আমি জানি, এটা বেশ সুদূরপ্রসারী কাজ। আমরা দুজন একসঙ্গে অনেক রাত ভাষার রহস্য ভেদে ব্যয় করলাম। কানামিতদের বুলেটিন বোর্ড নিয়ে গবেষণা করলাম। একেবারে দুষ্প্রাপ্য অভিধান ইলিংশ-কানামিত, যা শুধু গুটিকয়েক কানামিত কর্মকর্তার জন্য তৈরি করা হয়েছে, সেটার এক কপি চুরি করলাম। আমার বিবেকে বাধা দিলেও চুরি করতে বাধ্য হয়েছি। কারণ ভাষা আমার প্রিয় বিষয়। একটি অদ্ভুত ভাষা সম্পর্কে জানার আগ্রহ আমি কোনোভাবেই দমিয়ে রাখতে পারছিলাম না।

বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে আমরা সেই বইয়ের শিরোনামের অর্থ বের করতে পারলাম। শিরোনামে লেখা, ‘কীভাবে মানবসেবা করা যায়’। বইটি অ্যাম্বাসিতে নতুন যোগ দেওয়া কানামিতদের পড়তে দেওয়া হয়।

প্রতি মাসেই স্পেসশিপে করে নতুন কানামিতের দল আসছে। তারা এখানে গবেষণাগার, ক্লিনিক এবং আরও অনেক কিছু প্রতিষ্ঠা করেছে। বর্তমানে এই পৃথিবীতে কানামিতদের বিরোধী যদি কেউ থেকে থাকে, তবে সে একমাত্র গ্রিগরি।

মাত্র এক বছরের মাথায় সারা পৃথিবীর বিস্ময়কর পরিবর্তন হলো। কোনো দেশে সেনাবাহিনী নেই, কোনো কিছুর অভাব নেই, বেকারত্ব নেই। পত্রিকায় কোনো দুঃসংবাদ নেই। হাইড্রোজেন বোমার মাধ্যমে সভ্যতা ধ্বংসের খবর নেই। এসব সুসংবাদের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াও খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কানামিতরা এখন মানুষের জৈবরসায়ন নিয়ে কাজ করছে। তারা চাইছে মানুষের উচ্চতা আরও বাড়াতে, পেশীশক্তি বৃদ্ধি করতে এবং স্বাস্থ্যবান করে তুলতে। এক কথায় আমাদের সুপার হিউম্যানে পরিণত করতে চাচ্ছে। মানুষের হৃদরোগ ও ক্যানসারের প্রতিষেধকও আছে তাদের কাছে।

বইয়ের শিরনামের অর্থ আবিষ্কার করার পরের রাত থেকে গ্রিগরিকে আর দেখিনি। এদিকে আমি লম্বা ছুটিতে কানাডায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে গ্রিগরির মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। চোখগুলো কেমন ঘোলাটে হয়ে আছে।

‘কী হয়েছে গ্রিগরি? তোমাকে বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত লাগছে!’

‘নিচে লাউঞ্জে চলো।’

আমি তার সঙ্গে গেলাম। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।

‘কী ব্যাপার, কী হয়েছে বলছ না কেন?’

‘কানামিতরা আমাকে তাদের পরবর্তী বিনিময়-শিপের যাত্রীদের তালিকায় রেখেছে। তোমাকেও রেখেছে।’

‘বেশ, কিন্তু...’

‘তারা পরার্থপর নয়।’

আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে কানামিতরা আমাদের এই পৃথিবীকে স্বর্গের কাছাকাছি কিছু বানিয়ে দিয়েছে। তাহলে তাদের সন্দেহের হেতু কী? আমার কথা শুনে সে মাথা নাড়ল।

তারপর আমি বললাম, ‘আচ্ছা, তাহলে তাদের কথার সত্যতা প্রমাণের যে পরীক্ষা করা হলো, সেটা?’

‘একটা প্রহসন। আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম।’

আমি বিরক্ত স্বরে বললাম, ‘আর বইটি? কীভাবে মানবসেবা করা যায় সম্পর্কে কী বলবে?’

‘আমি সেই বইয়ের প্রথম অধ্যায় পড়েছি। যা পড়ার পর গত এক সপ্তাহ আমি ঘুমাতে পারিনি। আর সে কথা বলার জন্যই আজ তোমার কাছে এসেছি।’

‘কী কথা?’

‘আমাদের তারা তাদের গ্রহে নিয়ে যাচ্ছে কেন, জানো?’

‘কেন?’

‘রান্না করতে।’

‘মানে?’

‘হ্যাঁ, ওটা আসলে একটা রান্নার বই। ওই বইয়ে মাংস রান্নার পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে।’

লেখক: সিনিয়র অফিসার, সিটি ব্যাংক পিএলসি, গুলশান, ঢাকা

আরও পড়ুন