শুধু যে এসফল্ট রজনেই আলোকছায়া ধরা পড়েছে, তা নিশ্চয়ই নয়। লিমোনাইট, ম্যাংগানিজ অক্সাইড এবং অন্যান্য সাধারণ ধাতুর আকরেও এই ছায়া পাওয়া যেতে পারে। বর্ণবিকার পদ্ধতির ফটোগ্রাফি, যাতে কয়েকটি অস্থায়ী রং নষ্ট করে ফেলে আলো নতুন রং জুগিয়ে দেয়, বহুকাল ধরেই আমাদের জানা। দূর অতীতের এসব ছবি আমরা কোথায় খুঁজব? বহিরাগত আকরের স্তরে বা অত্যন্ত অগভীর জলাশয়ে, স্তরবিন্যাস যেখানে খুব দ্রুত ঘটেছে। সবচেয়ে সম্ভাব্য জায়গার স্তরগুলো যত্ন নিয়ে তুলে ফেলতে হবে। আলোকছায়া ধরতে হবে বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে। এসব ছবি ধরে রাখার কাজ আমাদের শিখতে হবে।
শেষকালে, একথাও মনে রাখতে হবে যে প্রকৃতি আলোর সাহায্য ছাড়াও নিজের অনেক ছবি তুলেছে। আপনারা জানেন, অনেক সময় বিদ্যুৎ চমকালে কাঠের বোর্ড, কাচ এমনকি লোকের গায়ের চামড়ায়ও পারিপার্শ্বিক দৃশ্যের ছাপ পড়েছে। এ ঘটনার ভালো ব্যাখ্যা বিজ্ঞান এখনো দিতে পারেনি। ইলেকট্রিসিটির ডিসচার্জের ফলেও যে এরকম ছবি ফুটে উঠতে পারে, সে সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। রেডিয়ামের বিচ্ছুরণের মতো অদৃশ্য রেডিয়েশনের ফলে এই ডিসচার্জ সম্ভব হতে পারে।
‘একবার যদি আমরা ভালো করে ধারণা করতে পারি কী আমাদের খুঁজতে হবে, তবে কোথায় খুঁজতে হবে তা ঠিক ধরা যাবে। আমাদের খোঁজাও সফল হবে।’
বক্তৃতা শেষ হলো। নিকিতিনের পর যারা বলল, তারা নিকিতিনের সিদ্ধান্তে সরাসরি অবিশ্বাস প্রকাশ করল। একজন বিখ্যাত ভূবিজ্ঞানী তো নিকিতিনের বক্তৃতাকে বললেন অত্যন্ত কল্পনাপ্রবণ। কিন্তু বিজ্ঞানের দিক দিয়ে একেবারেই মূল্যহীন ‘জীবাশ্মরোমন্যাস’ মাত্র। কিন্তু এসব সমালোচনায় নিকিতিন একটুও বিচলিত হলো না। এরপর তাকে কী করতে হবে তা সে জানে।
বড় হলঘরটার প্রবেশপথে নিকিতিন দাঁড়িয়ে পড়ল। লোহা পেটার আওয়াজে ঘর ভরে গেছে। মুখোমুখি বসানো দুটো কাচের কেসে একজোড়া বেটে সরীসৃপ কালো দাঁত বের করে বীভৎস হাসি হাসছে। আরও দূরে মেঝের ওপর পড়ে আছে লোহার বিম, নল, বল্টু, যন্ত্রপাতি। ঘরের মাঝে দুটো আড়াআড়ি ভাবে বসানো লোহার বিম। তাতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দুটো লম্বা খুঁটি—টিরানোসরের কঙ্কালের প্রধান স্ট্যানশিয়ন বা অবলম্বন। এদের একটাতে এরমধ্যেই একটা জটিল লোহার ফ্রেম লাগান হয়েছে। দুজন ল্যাবরেটরি কর্মী যত্ন নিয়ে তাতে টিরানোসরের পিছনের পায়ের বিরাট হাড়গুলো জোড়া দিচ্ছে। কঙ্কালটার ওপর দিয়ে চলে যাওয়া নলগুলোর দিকে নিকিতিন একবার তাকাল। টিরানোসরের ৮৩টা কশেরুকার বদলে এখনো তাতে শুধু তামার আংটা লাগানো রয়েছে।
অন্য স্ট্যানশিয়নটার কাছে একটা মস্তবড় বল্টু ৮ বার স্প্যানার নিয়ে মার্তিন মার্তিনভিচ নড়বড়ে মইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে। তার গোমড়ামুখ, হাড় জিরজিরে সঙ্গীটি একটা লম্বা নল নিয়ে মই বেয়ে উঠছে। তারও পরনে সুতির জোব্বা।
‘সাবধান!’ নিকিতিন চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওতে হবে না! ভারাটা টেনে আনতে বুঝি কুঁড়েমি লাগছে?’
‘শুধু শুধু সময় নষ্ট করে কী হবে, সের্গেই পাভলভিচ!’ মার্তিন মার্তিনভিচ ওপর থেকে সানন্দে বলে উঠল, ‘এতে আমাদের কিচ্ছু হবে না!’
নিকিতিন হেসে কাঁধ ঝাঁকাল। গোমড়ামুখ সহকর্মীটি স্ট্যানশিয়নের শেষে ওপরের টিতে নল বসাল। মার্তিন মার্তিনভিচ স্প্যানার দিয়ে নলটা জোরে এঁটে দিল। নলটা টিরানোসরের মস্ত মাথাটা ওতে বসানোর কথা। একপাশে ঘুরে গিয়ে গোমড়ামুখ সহকর্মীটিকে এক ধাক্কা মারল। সে গিয়ে আবার পড়ল মইয়ের সবচেয়ে উঁচু সরু রানে মার্তিন মার্তিনভিচের ওপর। তারপরে দুজনেই একসঙ্গে ডিগবাজী খেয়ে পড়ল মেঝেতে। মাটিতে ছিটকে পড়া লোহার নলগুলোর আওয়াজে ডুবে গেল ওদের চিৎকার আর কাচ ভাঙার শব্দ।
মার্তিন মার্তিনভিচ দাঁড়িয়ে উঠে টাকের ওপর সদ্য গজানো আবটায় হাত বোলাতে লাগল।
‘এ তো তোমার কাছে কিছুই না,’ একটু রেগেই বলল নিকিতিন।
‘নিশ্চয়ই!’ মার্তিন মার্তিনভিচ কিছুতেই দমবার পাত্র নয়, ‘আর কেউ হলে জন্মের মতো তাকে পঙ্গু হয়ে থাকতে হতো। এখন তো কেবল কতগুলো ভাঙা কাচের সাক্ষী রইল, তাও প্লেট-গ্লাস নয়। ওহে এস, এবার ভারাটাই নিয়ে যাওয়া যাক।’ সোজাসুজি বলে ফেলল মার্তিন মার্তিনভিচ।
নিকিতিনও তার জোব্বাটা পরে নিয়ে ওদের সঙ্গে হাত লাগাল। লোহার কাঠামো তৈরি করা আর সাময়িকভাবে হাড়গুলো জোড়া লাগান হচ্ছে সবচেয়ে সময়সাপেক্ষ কাজ। তবে সে কাজ এর মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। শরীরটা তৈরি। পরবর্তী কাজ হচ্ছে জোড়া লাগিয়ে আংটা, কড়া আর বল্টুগুলোতে ভারী হাড়গুলো লাগানো। তাতেও বেশ কয় মাস লাগল। ল্যাবরেটরিতে হাড়ের মাটিগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে। ভাঙা অংশগুলোকে আঠা দিয়ে জুড়ে দেওয়া। যে অংশগুলো পাওয়া যায়নি, কাঠ আর জিপসাম দিয়ে তাদের জায়গা পূরণ করা হয়েছে।
কাঠামোটা বেশ ভালভাবেই তৈরি। কঙ্কালটা বসানোর সময় যে ভুল শোধরাতে হয়েছে, তার সংখ্যা বেশি নয়। বৈজ্ঞানিক আর ল্যাবরেটরির কর্মীরা সানন্দে বহুরাত পর্যন্ত খেটে চলেছে। আর্কার্লি পাহাড়ে জন্তুটার যে ছবি তারা দেখেছে, সেই নিদর্শন অনুসারে কঙ্কালটাকে গড়ে তুলতে তারা বদ্ধপরিকর।
(চলবে…)
* ইভান ইয়েফ্রেমভ রুশ জীবাশ্মবিদ ও কল্পবিজ্ঞান লেখক। জীবাশ্মবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ট্যাফোনোমি। ফসিলের প্যাটার্ন—কোনো প্রাণী কীভাবে পচে গিয়ে জীবাশ্মে পরিণত হয় এবং এ জীবাশ্মের প্যাটার্ন কীরকম—সেসব বিষয় নিয়ে এ শাখায় আলোচনা করা হয়। ইয়েফ্রেমভের বেশ কিছু বিজ্ঞান কল্পকাহিনির একটি অনুবাদ সংকলন প্রকাশিত হয় মস্কোর ‘বিদেশি ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ থেকে। ইভান ইয়েফ্রেমভ গল্প সংকলন নামের এ বইয়ের গল্পগুলো বাংলায় অনুবাদ করেছেন শুভময় ঘোষ।