‘মধ্য যুগ...আমাদের এই অবিশ্বাস্য বিশ শতক মেতেছে মধ্য যুগের উন্মাদতম সব ধারণাকে বাস্তব করতে। পারদ বা সীসাকে সোনায় পরিণত করার পরশপাথর আজ রেডিয়াম। চিরন্তন ইঞ্জিন আমরা এখনো আবিষ্কার করতে পারিনি বটে—সেটা প্রকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ—কিন্তু পরমাণবিক তেজের চিরন্তন ও স্বয়ংনবীভূত উৎস আমরা বের করেছি... সে যুগের আর একটা ধারণার কথা বলি। ১৬৬৬ সালে ইউরোপ ভাবছিল বিশ্বের অবসান আসন্ন।
সে যুগে তার কারণ কেবল ৬৬৬-এই তিনটে সংখ্যা সম্পর্কে সংস্কারাচ্ছন্ন তাৎপর্য আরোপ আর অ্যাপোক্যালিপ্সিতে অন্ধ বিশ্বাস। আজ কিন্তু পরমাণু ও হাইড্রোজেন বোমার কল্যাণে বিশ্ব ধ্বংসের ভাবনার পেছনে খুব বাস্তব ভিত্তি আছে... কিন্তু ওই শরীর জমানোর কথাটা বলি... মধ্যযুগীয় চিকিৎসকের সরল জল্পনাটার একটা বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য আজ আছে। আনাবাইওসিস প্রক্রিয়ার কথা আপনি শুনেছেন নিশ্চয়। লিউভেনহোয়েক এটা আবিষ্কার করেন ১৭০১ সালে। এর অর্থ শৈত্য বা ডিহাইড্রেশনের মাধ্যমে জীবন প্রক্রিয়ার গতি মন্থর করা। মানে শৈত্য এবং জলকণার অভাবের ফলে সব রাসায়নিক ও জৈবিক প্রক্রিয়ার গঠন ভয়ানক কমে যায়।
অনেক আগেই মাছ আর বাদুড়ের আনাবাইওসিস ঘটাতে পেরেছিলেন বৈজ্ঞানিকেরা। শীতে তারা মরে না, সংরক্ষিত থাকে। অবশ্য পরিমিত শীতে...তাছাড়া আর একটা ব্যাপার আছে—ক্লিনিক্যাল মৃত্যু। ব্যাপারটা হলো, হার্ট থেমে গেলে বা নিঃশ্বাস বন্ধ হলেই মানুষ সঙ্গে সঙ্গে মরে না। গত যুদ্ধে ক্লিনিক্যাল মৃত্যু সম্বন্ধে গভীর অনুসন্ধানের সুযোগ পেয়েছিলেন ডাক্তাররা। হার্ট স্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার কয়েক মিনিট পরেও সাঙ্ঘাতিক-জখম মানুষকে জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। মনে রাখবেন, ওরা কিন্তু সাঙ্ঘাতিক-জখম লোক। আপনি পদার্থবিদ—হয়তো জানেন না...’
‘খানিকটা শুনেছি এ বিষয়ে’, মাথা নেড়ে বললেন নিমায়ের।
‘ঠিকই!’ গম্ভীরভাবে বললেন বার্ণ, ‘কিন্তু চার মাস ধরে মিমিকে রেখেছিলাম একটা ছোট্ট কফিনে, নানা রকম নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বসিয়ে তাপমাত্রা রেখেছিলাম প্রায় শূন্যে।’
‘মৃত্যু কথাটার সঙ্গে যদি ক্লিনিক্যাল এই ডাক্তারি লেবেলটা এটে দেওয়া যায় তাহলে মৃত্যুর ভয়াবহতা অনেক কমে যায়, তাই না? আসলে মৃত্যু ও জীবনের মাঝখানে কতগুলো অন্তর্বর্তী অবস্থা আছে: ঘুম, জড়তা, আনাবাইওসিস। মানুষের দেহক্রিয়া তখন তার জাগ্রত অবস্থার তুলনায় মন্থর। গত কয়েক বছর ধরে এই নিয়ে আমি কাজ করছি। দেহক্রিয়াকে সর্বোচ্চ মাত্রায় কমিয়ে আনার জন্যে আনাবাইওসিসকে তার চরমে—ক্লিনিক্যাল মৃত্যুতে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন ছিল। তা করতে পেরেছি আমি। তার জন্যে প্রথমে প্রাণ দিয়েছে ব্যাঙ, খরগোস আর গিনিপিগ। পরে দেহ জমানোর নিয়মকানুন ও পদ্ধতি যখন বেশ পরিষ্কার হয়ে ওঠে, তখন আমার শিম্পাঞ্জি মিমিকে কিছুক্ষণের জন্যে ‘মারবার’ সাহস নিই।’
‘বলেন কি, আমি যে দেখেছি তাকে,’ বললেন নিমায়ের, ‘খুব ফুর্তিবাজ, চেয়ারে চেয়ারে লাফিয়ে বেড়ায়, চিনি চায়।’
‘ঠিকই!’ গম্ভীরভাবে বললেন বার্ণ, ‘কিন্তু চার মাস ধরে মিমিকে রেখেছিলাম একটা ছোট্ট কফিনে, নানা রকম নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বসিয়ে তাপমাত্রা রেখেছিলাম প্রায় শূন্যে।’
চঞ্চলভাবে নতুন একটা সিগারেট টেনে নিয়ে বলে চললেন বার্ণ:
‘তারপর সবচেয়ে জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাটা করি। পরীক্ষা নিজের ওপরেই—চরম আনাবাইওসিস প্রক্রিয়া চালিয়েছি আমার ওপরে। সেটা গত বছরে। নিশ্চয় মনে আছে আপনার, তখন একটা কথা রটেছিল যে প্রফেসর বার্ণের খুব অসুখ। আসলে অসুখেরও বাড়া, পুরো ছয়মাস ধরে আমি ‘মরে’ ছিলাম। সত্যি সে এক অদ্ভুত অনুভূতি নিমায়ের, অবশ্য অনুভূতির একান্ত অবলুপ্তিকে যদি অনুভূতি বলা যায়। সাধারণ ঘুমে আমরা সময়ের তালটা ধীরে হলেও অনুভব করি। কিন্তু এক্ষেত্রে সে রকম কিছু নয়। নার্কটিকের অচৈতন্যতার মতো একটা ব্যাপার ঘটল। তারপর সবকিছুই স্তব্ধ আর অন্ধকার। অবশেষে ফের জীবনে প্রত্যাবর্তন। পরপারে কিন্তু কিছুই ছিল না...’
পা টান করে বসেছিলেন বার্ণ, রোগা রোদপোড়া হাতের ওপর হেলান দিয়ে রেখেছিলেন মাথা। চশমার কাচের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছিল চোখ তাঁর চিন্তাচ্ছন্ন।
‘সূর্য’... অনন্ত অন্ধ মহাশূন্যের একটা কোণ অল্প একটু উজ্জ্বল করে তুলেছে আলোর একটা গোলক। তার চারপাশে ছোটো ছোটো ঠাণ্ডা আরও কিছু গোলক। তাদের সবার জীবন নির্ভর করে আছে ওই সূর্যের ওপর...তারপর এরই একটা গোলকে দেখা দিল মানুষ—চিন্তা করার ক্ষমতাধর এক জাতের প্রাণী। কীভাবে উদ্ভব হলো মানুষের? কত উপকথা আর প্রকল্প আছে তা নিয়ে।
‘একটা জিনিস কিন্তু নিঃসন্দেহ—মানুষের জন্মের জন্যে অতি প্রচণ্ড রকমের একটা বিপর্যয়ের প্রয়োজন ছিল আমাদের গ্রহের।’