ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ – ৫

প্রতীকী মেশিন

টেস্ট ল্যাবরেটরিতে ঢোকার আগেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলাম। আমার যুক্তি ছিল এরকম—আমায় এরা পরীক্ষা করে দেখবে, তার ফলে ক্রাফৎশ্‌তুদতের দঙ্গল আমার আভ্যন্তরীণ সত্তার সব খবর পেয়ে যাবে। তারা জানতে চেষ্টা করবে, তাদের অভিপ্রেত আবেগ বা সংবেদন আমার মধ্যে সঞ্চারিত করতে হলে কী ধরনের বিদ্যুৎ-চুম্বক উত্তেজনা প্রয়োজন। এতে যদি তারা সফল হয়, তাহলে আমি পুরোপুরি তাদের মুঠোয় চলে যাব, পরিত্রাণের কোনো আশা থাকবে না। যদি সফল না হয়, তাহলে কিছুটা মানসিক স্বাধীনতা আমার থাকবে, যা খুবই কাজে লাগবে আমার। তাই দরকার ছিল এই ডাকাতগুলোকে যথাসম্ভব বোকা বানানো। এটা যে আমি কিছুটা করতে পারি, তা অনুমান করলাম গতকাল ক্রাফৎশ্‌তুদতের জনৈক দাসের এ কথা থেকে যে গাণিতিক ক্ষেত্রটা ছাড়া প্রেরণা কোড একেক লোকের জন্য একেক রকম।

যে বড় ঘরটায় আমায় নিয়ে আসা হলো, সেটা বড় বড় নানা যন্ত্রে ঠাসা, দেখতে অনেকটা বিদ্যুৎ-স্টেশনের কন্ট্রোল রুমের মতো। ল্যাবরেটরির মাঝখানটায় একটা কন্ট্রোল কনসোল, তাতে কলকব্জার প্যানেল আর ডায়াল। বাঁ দিকে তারের জালের পেছনে মাথা তুলেছে একটা ট্র্যান্সফরমার, চিনেমাটির প্যানেলে কয়েকটা জেনারেটর ল্যাম্প জ্বলছে লাল আলোয়। বোঝা যায়, তারের জালটা জেনারেটরের স্ক্রিন-গ্রিডের কাজ করছে, তার সঙ্গে একটা ভোল্টমিটার ও অ্যামিটার লাগানো। এই ভোল্টমিটার আর অ্যামিটার দেখে জেনারেটরের ক্ষমতা মাপা হয় বলে মনে হয়। কন্ট্রোল কনসোলের কাছে দাঁড়িয়ে আছে একটা সিলিন্ডার বুথ, ওপর নিচ দুটো ধাতু অংশে তা তৈরি।

এই বুথের দিকে নিয়ে আসা হলো আমায়। কনসোলের পেছন থেকে উঠে দাঁড়াল দুজন লোক। এদের একজন সেই ডাক্তার, যে আমায় আগের দিন ক্রাফৎশ্‌তুদতের কাছে নিয়ে এসেছিল, অজ্ঞান করে ফেলেছিল। দ্বিতীয় জন আমার অচেনা এক কুঁজোটে বুড়ো, হলদেটে টাকের ওপর পাতলা চুল কটি পাট করে আঁচড়ানো।

প্রতীকী ছবি

‘বুঝিয়ে রাজি করানো গেল না তো?’ বলল ডাক্তার, ‘সে আমি জানতাম। দেখেই বুঝেছিলাম যে রাউখ হলো সবল টাইপ। পরিণাম আপনার খারাপ রাউখ।’ সে বলল আমায় উদ্দেশ করে।

‘আপনারও,’ বললাম আমি।

‘সেটা এখনো বলা যায় না, কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে অবধারিত।’

খালি পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম চিনেমাটির মেঝের ওপর। মাথার ওপর জ্বলে উঠল একটা বিজলি বাতি। গুঞ্জন করে উঠল জেনারেটর।

আমি কাঁধ ঝাঁকালাম।

‘আপনি কি স্বেচ্ছায় ঢুকবেন, নাকি জোর খাটাতে হবে?’ উদ্ধত দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল সে।

‘স্বেচ্ছায়। পদার্থবিদ হিসাবে আমার বরং কৌতূহলই হচ্ছে।’

‘চমৎকার! তাহলে জুতো খুলুন, কোমর পর্যন্ত জামা খুলে ফেলুন। আগে আপনাকে পরীক্ষা করে দেখব। রক্তচাপ নেব।’

জামা খুলে ফেললাম আমি। স্পেকট্রাম গ্রহণের প্রথম অংশটুকু নিতান্তই একটা ডাক্তারি চেক-আপের মতো ব্যাপার—নিঃশ্বাস নেওয়া, নিঃশ্বাস ছাড়া ইত্যাদি।

চেক-আপ শেষ হলে ডাক্তার বলল:

‘এবার বুথে ঢুকুন। সেখানে একটা মাইক্রোফোন আছে, তাতে আমি যা প্রশ্ন করব জবাব দেবেন। আগেই বলে রাখছি, একটা ফ্রিকোয়েন্সিতে ভয়ানক যন্ত্রণার অনুভূতি হবে। কিন্তু চেঁচিয়ে উঠলেই তা কেটে যাবে।’

খালি পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম চিনেমাটির মেঝের ওপর। মাথার ওপর জ্বলে উঠল একটা বিজলি বাতি। গুঞ্জন করে উঠল জেনারেটর। খুব নিচু ফ্রিকোয়েন্সিতে চলছিল সেটা। বিদ্যুৎ-চুম্বক ক্ষেত্রের টানটা স্পষ্টতই খুব চড়া। সেটা টের পেলাম শরীর বেয়ে তাপ প্রবাহের মন্থর ঢেউয়ে। প্রতিটি বিদ্যুৎ-চুম্বক প্রেরণার সঙ্গে সঙ্গে হাড়ের জোড়গুলোতে একটা অদ্ভুৎ সুড়সুড়ি লাগছিল। পেশীগুলো প্রেরণার তালে তালে সঙ্কুচিত ও শিথিল হতে থাকল।

জেনারেটর বেশ জোরে চলতে লাগল আর তাপ তরঙ্গের লয়ও বেড়ে উঠল। ‘এই শুরু হয়েছে,’ ভাবলাম আমি, ‘সহ্য করতে পারলে হয়।’

ফ্রিকোয়েন্সি যখন সেকেন্ডে ৮ চক্র পর্যন্ত উঠবে, তখন ঘুম পাবে আমার। সে ঘুমকে যদি কোনোক্রমে আটকে রাখতে পারি, কোনো রকমে যদি বোকা বানাতে পারি এদের। ধীরে ধীরে বাড়ছিল ফ্রিকোয়েন্সি। মনে মনে তাপ তরঙ্গের সংখ্যা গুনে দেখছিলাম সেকেন্ডে কত। এক, দুই, তিন, চার, তারপর আরও, আরও... হঠাৎ একেবারে আচমকা ঘুম এসে ভর করল। দাঁতে দাঁত চেপে আমি জোর করে জেগে থাকার চেষ্টা করলাম। একটা প্রচণ্ড জগদ্দল ভারের মতো ঘুম চেপে ধরল আমায়, বুজিয়ে দিচ্ছিল চোখের পাতা। তখনো যে দাঁড়িয়ে রইলাম, আশ্চর্য! দাঁত দিয়ে সজোরে জিভ কামড়াতে লাগলাম আমি। ভাবলাম যন্ত্রণা দিয়ে হয়তো এই ঘুমের ভুতুড়ে বোঝাটাকে আটকে রাখতে পারব। সেই মুহূর্তে যেন বহুদূর থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘রাউখ, কী রকম বোধ হচ্ছে?’

‘বিশেষ খারাপ নয়, ধন্যবাদ। একটু ঠান্ডা এই যা,’ মিছে কথা বললাম আমি। নিজের গলাই আমার কাছে অচেনা লাগছিল। সর্বশক্তি দিয়ে জিভ আর ঠোঁট কামড়াতে লাগলাম।

‘ঘুম পাচ্ছে না?’

চটপট উত্তর দিলাম। মাথাটা আমার একেবারে পরিষ্কার। যেন সবকিছু জানি, সবকিছু ঠোঁটস্থ, এমনি একটা অনুভূতিতে আমি ভরপুর।

‘কই না তো।’ বললাম বটে, কিন্তু টের পাচ্ছিলাম এই বুঝি ঘুমে লুটিয়ে পড়ি। তারপর হঠাৎ কেটে গেল সব ঘুম। নিশ্চয় প্রথম পর্যায়ের সঙ্কট সীমানা ছাড়িয়ে বেড়ে উঠেছে ফ্রিকোয়েন্সি। বেশ তাজা এবং ফুর্তি লাগছিল, ভালো ঘুমের পর যেমন হয়। ঠিক করলাম, এই বার আমায় ঘুমিয়ে পড়তে হবে। চোখ বুজে নাক ডাকাতে লাগলাম। কানে এল ডাক্তার বলছে সহকারীকে:

‘অদ্ভুত। সাড়ে আটের বদলে দশ চক্রে ঘুম। টুকে রাখুন প্‌ফাফ্‌ফ্‌।’ ডাক্তার বলল বুড়োটাকে। ‘রাউখ, কী মনে হচ্ছে এখন?’

জবাব না দিয়ে আমি গা-হাত-পা ছেড়ে বুথের দেয়ালে এলিয়ে পড়ে নাক ডাকাতে লাগলাম।

‘দেখা যাক পরেরটা,’ ডাক্তার বলল, ‘ফ্রিকোয়েন্সি বাড়িয়ে দিন তো প্‌ফাফ্‌ফ্‌।’

মুহূর্তের মধ্যে আমি ‘জেগে উঠলাম’। যে ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডের মধ্য দিয়ে আমি চলেছি, তাতে বদলে যেতে লাগল মেজাজ ও আবেগ। বিষণ্ণ লাগল, তারপর ফুর্তি, তারপর আনন্দ, শেষে অসহ্য দুঃখ।

হঠাৎ ঠিক করলাম, ‘এইবার চেঁচিয়ে ওঠা উচিত।’

জেনারেটরের গর্জন বাড়তেই আমি যথাশক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম। কোন ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডে তা হলো মনে নেই, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার হুকুম দিলেন, ‘অফ করে দিন। এমন বিদঘুটে টাইপ এই প্রথম দেখছি। টুকে রাখুন: সেকেন্ডে ৭৫ চক্রে যন্ত্রণা, স্বাভাবিক লোকের ক্ষেত্রে যেখানে দরকার ১৩০; আচ্ছা চালিয়ে যান।’

সভয়ে ভাবলাম, ‘সে ফ্রিকোয়েন্সিটা ভবিষ্যতে আছে আমার কপালে। সইতে পারব কী?’

‘এবার প্‌ফাফ্‌ফ্‌, ৯৩টা পরখ করে দেখি।’

এ ফ্রিকোয়েন্সিটা স্থিতু হতেই একটা অপ্রত্যাশিত ব্যাপার ঘটল। যে সমীকরণ দুটোর জন্য ক্রাফৎশ্‌তুদৎ কোম্পানিতে আসতে হয়েছিল, তা হঠাৎ মনে পড়ে গেল আমার। আর তার সমাধানের প্রতিটি পর্যায় একেবারে জ্বলজ্বল করে উঠল চোখের সামনে। চকিতে ভাবলাম, গাণিতিক চিন্তা ত্বরান্বিত করার ফ্রিকোয়েন্সি এটা।

‘রাউখ, দ্বিতীয় পর্যায়ের বেসেল ফাংশনের প্রথম পাঁচটা রাশির নাম বলুন,’ বলল ডাক্তার।

চটপট উত্তর দিলাম। মাথাটা আমার একেবারে পরিষ্কার। যেন সবকিছু জানি, সবকিছু ঠোঁটস্থ, এমনি একটা অনুভূতিতে আমি ভরপুর।

‘π-এর প্রথম দশটি মান বলুন।’

জবাব দিয়ে দিলাম আমি।

‘এই কিউবিক সমীকরণটা কষুন।’

বিদঘুটে সব আংশিক কো-এফিশিয়েন্টসহ একটা সমীকরণ দিল ডাক্তার।

দু-তিন সেকেন্ডের মধ্যে আমি উত্তর জানিয়ে দিলাম, তিনটি ঘনমূলও বলে দিলাম নিমিষে।

‘এবার পরেরটা। এ ক্ষেত্রে ওঁর প্রতিক্রিয়াটা স্বাভাবিক লোকের মতো।’ ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল ফ্রিকোয়েন্সি। হঠাৎ একসময় কান্না পেতে লাগল আমার। গলার মধ্যে দলা পাকিয়ে উঠল, জল ঝরতে লাগল চোখ বেয়ে। কিন্তু হাসতে লাগলাম আমি, হাসতে লাগলাম পাগলের মতো যেন কেউ আমায় ভয়ানক সুড়সুড়ি দিচ্ছে, আর ওদিকে জল বেয়ে পড়তে লাগল গাল বেয়ে।

‘ফের আবার একটা বিদঘুটে প্রতিক্রিয়া। মোটেই আর সবার মতো নয়। আমি দেখেই বলেছিলাম এ একটা শক্ত স্নায়বিক টাইপ, নিউরসিঙ্গের ঝোঁক আছে। কাঁদবে কখন?’

যন্ত্রণা দেখা গেল। তারপর লড়াইয়ের সময় যে জায়গাটায় জখম হয়েছিলাম, সেই পুরোনো জখমটা যেন ছিঁড়ে গেল একটা তীক্ষ্ম যন্ত্রণায়।

‘কেঁদে উঠলাম’ যখন এতটুকু ইচ্ছে হচ্ছিল না কাঁদার। হালকা একটু সুরা পানের পর যেমন হয়, তেমনি একটা উচ্ছল খুশিতে তখন মন ভরে উঠেছে হঠাৎ। ইচ্ছে হচ্ছিল গান গেয়ে উঠি, হাসিতে আনন্দে লাফালাফি করি। মনে হচ্ছিল চমৎকার সব লোক এরা—ক্রাফৎশ্‌তুদৎ, বলৎস, ডেনিস, ডাক্তার সবাই—ভারি ভালো লোক। আর ঠিক তখনই প্রচণ্ড ইচ্ছা খাটিয়ে আমি ফোঁপাতে লাগালাম: আমার এ কান্না একান্ত অপ্রতুল হলেও প্রত্যয় জাগাবার পক্ষে যথেষ্ট; ডাক্তারকে মন্তব্য করতে হলো:

‘একেবারেই উল্টাপাল্টা। স্বাভাবিক স্পেকট্রামের সঙ্গে কোনো মিল নেই। একে নিয়ে ভুগতে হবে দেখছি।’

‘কিন্তু কতদূরে সেই ১৩০ ফ্রিকোয়েন্সি?’ আতঙ্কে ভাবতে শুরু করলাম আমি। দিলখোলা ফুর্তির ভাবটার জায়গায় তখন দেখা দিয়েছে কেমন একটা দুশ্চিন্তা, অকারণ আশঙ্কা, আসন্ন সর্বনাশের একটা অনুভূতি... তখন কিন্তু গুনগুন করে একটা সুর ভাঁজতে লাগলাম আমি—যন্ত্রের মতো, বিনা ভাবনায়, অথচ বুকের মধ্যে তখন সাঙ্ঘাতিক, অমোঘ, মারাত্মক কিছু একটার দুর্ভাবনায় ঢিপ ঢিপ করছে।

যন্ত্রণা উদ্রেকের ফ্রিকোয়েন্সিটা কাছাকাছি আসতেই তা টের পেলাম।

প্রথমটা আমার ডান হাতের বুড়ো আঙুলের হাড়গুলোতে একটা ভোঁতা

যন্ত্রণা দেখা গেল। তারপর লড়াইয়ের সময় যে জায়গাটায় জখম হয়েছিলাম, সেই পুরোনো জখমটা যেন ছিঁড়ে গেল একটা তীক্ষ্ম যন্ত্রণায়। তারপরেই শুরু হলো একটা ভয়ঙ্কর দাঁতের যন্ত্রণা, সব দাঁতেই তা ছড়িয়ে পড়ল। সেই সঙ্গে মাথা ছিঁড়ে যাওয়া ব্যথা।

কানের মধ্যে ঝাপটা মারতে লাগল রক্ত। সইতে পারব কি? এই দানবিক যন্ত্রণা সইতে পারার মতো, কোনো রকমেই তা প্রকাশ না করার মতো যথেষ্ট ইচ্ছাশক্তি কি আমার থাকবে? নির্যাতন কক্ষে যন্ত্রণা সইতে সইতে লোকে প্রাণ দিয়েছে, অথচ একটিবারও কাৎরে ওঠেনি, এ রকম ঘটনা তো কম শোনা যায়নি। জীবন্ত দগ্ধ হওয়ার সময়ও লোকে মুখ বুজে থেকেছে এমন ঘটনা তো আছে ইতিহাসে...

ক্রমশ বাড়তে লাগল যন্ত্রণা। শেষ পর্যন্ত আমার গোটা দেহের হাড়ে ছড়িয়ে পড়ল একটা ছিঁড়ে যাওয়া, ফুঁড়ে যাওয়া, থেঁতো করা, মড়মড়ে, টনটনে, দপদপে যন্ত্রণা। প্রায় মূর্ছিত হয়ে পড়েছিলাম আমি, চোখে তারা দেখতে লাগলাম। কিন্তু কোনো শব্দ করলাম না মুখ দিয়ে।

‘কী রকম লাগছে রাউখ?’ ফের যেন কোনো মাটির গভীর থেকে ভেসে এল ডাক্তারের কণ্ঠস্বর:

‘একটা অন্ধ বন্য ক্রোধ,’ দাঁতের ফাঁকে চেপে বললাম আমি। ‘যদি একবার আপনাদের হাতে পেতাম...’

‘আরও দেখা যাক। একেবারে অস্বভাবিক। সবই এর উল্টো।’

প্রায় মূর্ছিত হয়ে পড়েছি তখন, আর্তনাদ করে উঠব, গঙিয়ে উঠব, এমন সময় হঠাৎ অদৃশ্য হলো সব ব্যথা। সারা গায়ে দেখা দিল আঠা আঠা ঠান্ডা ঘাম। থর থর করছিল সমস্ত পেশী।

তারপর, কী একটা ফ্রিকোয়েন্সিতে চোখ ধাঁধানো একটা আলো দেখলাম, চোখ বন্ধ করলেও তা থেকে রেহাই নেই। তারপর একটা রাক্ষুসে খিদে পেল, একপশলা কর্ণভেদী কোলাহল শুনতে পেলাম একসময়, তারপর ভয়ানক শীত করতে লাগল, যেন একেবারে নগ্ন গায়ে বরফের ওপর দিয়ে হাঁটছি। কিন্তু ক্রমাগত ভুল জবাব দিয়ে যেতে লাগলাম ডাক্তারকে, একেবারে ক্ষেপিয়ে তুললাম তাকে।

ব্যাপারটা বুঝেছিলাম পরে, মস্তিষ্কক্রিয়ার কেন্দ্রীয় এনসেফেলিক ব্যবস্থার তত্ত্বটা জানার পর। এই তত্ত্বে বলে যে কর্টেক্সে অবস্থিত সব স্নায়ুকোষ শাসিত হয় একগুচ্ছ কেন্দ্রীয় পরিচালক কোষ দিয়ে

জানতাম এখনো একটা ভয়ঙ্কর পরীক্ষা বাকি আছে আমার—আগের দিন ওয়ার্ডে যা তারা বলাবলি করছিল—ইচ্ছাশক্তি লোপ। এতক্ষণ পর্যন্ত সব সয়ে এসেছি কেবল ইচ্ছাশক্তির জোরে। আমার উৎপীড়ক কৃত্রিমভাবে যে সব অনুভূতি জাগাচ্ছে, তাকে দমন করতে পেরেছি কেবল এই আভ্যন্তরীণ শক্তির সাহায্যে। কিন্তু ওই শয়তান প্রেরণা জেনারেটর দিয়ে শিগগিরই এই ইচ্ছাশক্তির পেছনে লাগবে। কেমন করে ওরা ধরতে পারবে যে আমার ইচ্ছাশক্তি লোপ পেয়েছে? আতঙ্কে সেই ফ্রিকোয়েন্সিটার অপেক্ষা করতে লাগলাম। শেষ পর্যন্ত সেই মুহূর্ত এল।

হঠাৎ সবকিছু কেমন নিস্পৃহ লাগতে লাগল। ক্রাফৎশ্‌তুদৎ দঙ্গলটার হাতে যে পড়েছি তাতে কিছুই এসে যায় না, তার চারপাশের লোকের জন্যও কিছু এসে যায় না, নিজের কী হবে তাতেও নয়। একেবারে শূন্য হয়ে গেল মন। শিথিল বোধ হতে লাগল পেশীগুলোকে। সব অনুভূতি যেন উধাও হলো। দৈহিক ও মানসিক মেরুদণ্ডহীনতার এক পরিপূর্ণ অবস্থা সেটা। কিছুতেই কোনো মানসিক চাঞ্চল্য জাগে না, ভাবতে ইচ্ছে হয় না, এতটুকু নড়াচড়ার শক্তিও নেই। ভয়ানক কেমন একটা ইচ্ছেহীনতা, তাতে যা খুশি করতে পারা যায় লোককে নিয়ে।

তাহলেও চেতনার কোন এক গহন কোণে যেন বেঁচে রইল শুধু একটা চিন্তার ঝলক, অবিরত তা বলে যাচ্ছিল, ‘দরকার... দরকার... দরকার...’

কী দরকার? কীসের জন্য? কেন: ‘দরকার... দরকার... দরকার...’ বলে চলল যেন একটা একক স্নায়ুকোষ, কী এক দৈবচক্রে যেন সেখানে পৌঁছাতে পারেনি সর্বশক্তিমান এই বিদ্যুৎ-চুম্বক প্রেরণা, যা আচ্ছন্ন করেছে আমার সমস্ত স্নায়ুকে, জল্লাদেরা যা চাইছে তাই অনুভব করতে বাধ্য করছে তাদের।

ব্যাপারটা বুঝেছিলাম পরে, মস্তিষ্কক্রিয়ার কেন্দ্রীয় এনসেফেলিক ব্যবস্থার তত্ত্বটা জানার পর। এই তত্ত্বে বলে যে কর্টেক্সে অবস্থিত সব স্নায়ুকোষ শাসিত হয় একগুচ্ছ কেন্দ্রীয় পরিচালক কোষ দিয়ে; বাইরে থেকে চালিত সবচেয়ে শক্তিশালী পদার্থিক ও রাসায়নিক প্রভাবেও এই সর্বোচ্চ মানসিক কর্তৃত্ব অব্যাহত থাকে। তখন বেঁচেছিলাম নিশ্চয় এ কারণেই।

হঠাৎ হুকুম শোনা গেল ডাক্তারের:

‘ক্রাফৎশ্‌তুদতের সঙ্গে সহযোগিতা করবেন আপনি।’

আমি বললাম:

‘করব না।’

‘আমরা যা হুকুম করব, তা পালন করবেন আপনি।’

‘করব না।’

‘দেয়ালে মাথা ঠুকুন।’

‘না।’

‘আরও দেখা যাক। অস্বাভাবিক টাইপ প্‌ফাফ্‌ফ্‌, তবে নিস্তার পাবে না।’ ইচ্ছাশক্তি লোপের ভান করলাম ঠিক যখন একটা প্রবল ইচ্ছাশক্তির বন্যায় আমার সমস্ত সত্তা ভরে উঠল, মনে হচ্ছিল কোনো অসম্ভবই আমার অসাধ্য নয়।

‘স্বাভাবিক’ স্পেকট্রাম থেকে আমার এই বিচ্যুতিটা যাচাই করে নিয়ে ডাক্তার এই ফ্রিকোয়েন্সিতে থামল।

‘জনগণের সুখের জন্য যদি জীবন দিতে হয়, তাহলে জীবন দেবেন?’

‘কী দরকার?’ বললাম নীরস গলায়।

‘আত্মহত্যা করতে পারবেন?’

‘পারব।’

‘যুদ্ধাপরাধী ওবের-শ্‌তার্মফুয়েরার ক্রাফৎশ্‌তুদৎকে খুন করতে চান আপনি?’

‘কী দরকার?’

‘আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করবেন আপনি?’

‘করব।’

‘শয়তান জানে কী ব্যাপার! এমন টাইপ দেখলাম এই প্রথম এবং সম্ভবত এই শেষ। ইচ্ছাশক্তি লোপ ১৭৫ চক্রে; টুকে রাখুন। এবার আরও দেখা যাক।’

এভাবে আরও আধ-ঘণ্টাখানেক চলল। শেষ হলো আমার স্নায়ুব্যবস্থার ফ্রিকোয়েন্সি স্পেকট্রাম। আমার মধ্যে কোন কোন মেজাজ বা অনুভূতি উদ্রেক করাতে হলে কোন কোন ফ্রিকোয়েন্সি দরকার, তা সবই জানা হলো ডাক্তারের। অন্তত ভাবল যে সে জেনেছে। আসলে একমাত্র সঠিক ফ্রিকোয়েন্সি হলো যেটায় আমার গাণিতিক ক্ষমতা উত্তেজিত হয়। আর আমারও সবচেয়ে দরকার এইটাই। আসলে এই দুর্বৃত্ত ফার্মটিকে বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়ার একটা পরিকল্পনা ফেঁদে রেখেছিলাম আমি। আর গণিত হবে আমার ডিনামাইট।

(চলবে…)

* সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত গল্প সংকলন গ্রহান্তরের আগুন্তুক থেকে নেওয়া।

মূল: আনাতলি দনে্‌প্রভ

অনুবাদ: ননী ভৌমিক