গ্রহান্তরের আগন্তুক

বরিস ইয়েফিমোভিচ আমায় একদিন জানালেন, ‘আজ সন্ধ্যায় বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে একটা আসর করা যাবে।’

জানতাম জাহাজে পলিয়নটলজিস্ট নিজোভস্কি ছাড়াও ভাসিলিয়েভ নামে একজন ভূগোলবিদও এসেছেন। দূর দ্বীপপুঞ্জে অভিযানের দায়িত্ব তাঁর। তাছাড়া একজন... জ্যোতির্বিজ্ঞানীও ছিলেন।

‘সেদোভ’এ তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল যখন জাহাজটা থেমেছিল ‘উসতিয়েতে। একজন ভাগ্যহত ক্যাপ্টেন তার জাহাজের বোটগুলো হারিয়ে বসে। তাকে কতকগুলো বোট দেওয়া হচ্ছিল জাহাজ থেকে।

সেদিন ভোরেই আমি এসে দাঁড়িয়েছিলাম ডেকে। তীরভূমিটা যদি দূর থেকেও খানিকটা দেখা যায় এই লোভে। কয়েক মাস কেটে গেছে তীর চোখে পড়েনি।

দিগন্তে ধুধু করছিল কেবল একটা ফালির মতো...

তবু ওইটেই মহাভূমির তট!

ভোরবেলাকার আকাশের মতোই জলটা কমলা রঙের, তার ওপর দেখা গেল একটি মোটর বোট। এগিয়ে আসছিল তীর থেকে।

বোট নামানোর তদারক করছিল যে ফ্যার্স্ট মেট, সে বললে, ‘নতুন প্যাসেঞ্জার আসছে তিনজন। জ্যোতির্বিজ্ঞানী অভিযানের লোক।’

‘জ্যোতির্বিজ্ঞানী অভিযান, এই উত্তরে? সে কী?’

ফ্যার্স্ট মেট অবশ্য কিছুই বোঝাতে পারলে না।

এসে পৌঁছল মোটর বোট, ঝুলন্ত সিঁড়ি বেয়ে ডেকে উঠে এল তিনটি লোক।

প্রথম জন বিশেষ লম্বা নয়, মোটা মোটা হাড়, তবে খানিকটা রোগাটে। মুখটা রোদপোড়া, গালের হাড় বের করা, চোখে সিঙের ফ্রেমের চশমা, ঢিপ মতো কপালটায় কেমন অদ্ভুত লাগে চেহারাটা। অস্বাভাবিক লম্বাটে চোখ দুটো যেন নরুনে চেরা।

দূর থেকেই অমায়িকভাবে আমায় নমস্কার করলেন তিনি। তারপর এগিয়ে এসে পরিচয় দিলেন:

‘ইয়েভগেনি আলেক্সেয়েভিচ ক্রিমোভ, জ্যোতির্বিদ। উচ্চ-অক্ষ একটা অভিযান চালাচ্ছি আমরা। ইনি নাতাশা গ্লাগোলেভা... মানে নাতালিয়া গেওর্গিয়েভনা। উদ্ভিদবিদ।’

তুলোভরা জ্যাকেট ও ট্রাউজার পরা মেয়েটি আলগোছে করমর্দন করল। মুখটা ক্লিষ্ট, চোখের কোণে কালি। ডেক অফিসার তাকে তৎক্ষণাৎ নিয়ে গেল তার পূর্বনির্দিষ্ট কেবিনে।

তৃতীয় যাত্রীটি তরুণ, ছেলেমানুষ বললেই হয়। মোটর বোট থেকে মাল ওঠানোর তদারক করছিল সে খুব গুরু গম্ভীর ভাব করে।

‘হুঁশিয়ার! যন্ত্রপাতি আছে ওতে, বৈজ্ঞানিক ইনস্ট্রুমেন্ট! চেচাল সে, ‘বলছি ইনস্ট্রুমেন্ট—হুঁশ নেই?’

যাহোক, যন্ত্রপাতি সবই উঠল ডেকে। টেলিস্কোপের মতো কিছুই কিন্তু আমার চোখে পড়ল না।

উত্তর মেরুতে কী জ্যোতির্বিজ্ঞানী অভিযান করছে এরা? গ্রহ নক্ষত্র কি ভালো দেখা যায় এখান থেকে?

দিকি দ্বীপের বন্দরে জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে, এই সুযোগে বরিস ইয়েফিমোভিচ তাঁর বৈজ্ঞানিক অতিথিদের সেলুনে আমন্ত্রণ জানালেন।

গ্রহান্তরের আগন্তক বইয়ের প্রচ্ছদ

বুফে পরিচারিকা কাতিয়া স্প্র্যাট মাছ বার করলে তার কোন একটা গোপন মজুদ থেকে। টেবলির ওপর রাখা হল ক্যাপ্টেনের নিজস্ব কনিয়াক।

ঘুমের পর উদ্ভিদবিদ নাতাশার গালে রঙ ফিরেছে, চাঙ্গা হয়ে উঠেছে সে। খাদ্য পানীয়ের প্রতি সুবিচার প্রদর্শনে বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে সেও সানন্দে যোগ দিল।

ক্রিমোভকে জিজ্ঞেস করলাম:

‘আচ্ছা, আপনাদের এই অভিযানটির লক্ষ্য কী?’

মাছের দিকে হাত বাড়িয়ে ক্রিমোভ বললেন:

‘মঙ্গলগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব প্রমাণ করা।’

‘মঙ্গলগ্রহে?’ চেয়ার ছেড়ে প্রায় লাফিয়ে উঠলাম আমি, ‘ঠাট্টা করছেন না তো?’

গোল গোল চশমার মধ্যে দিয়ে ক্রিমোভ অবাক হয়ে চাইলেন আমার দিকে:

‘ঠাট্টা করব কেন?’

‘এখান থেকে মঙ্গলগ্রহ পর্যবেক্ষণ করা কি সম্ভব নাকি?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।

‘না, এই সময় সাধারণভাবেই মঙ্গলগ্রহ বিশেষ দৃষ্টিগোচর থাকে না।’

‘জ্যোতির্বিদ, উদ্ভিদবিদ এরা সব আকাশের দিকে না তাকিয়ে মঙ্গলগ্রহ পর্যবেক্ষণ করছেন উত্তর মেরুতে!’ অবাক হয়ে হাত ওল্টালাম আমি।

‘মঙ্গলগ্রহ আমরা পর্যবেক্ষণ করছি আমাদের নিজেদের মানমন্দিরে, আলমা-আতায়, আর এখানে...’

‘আর এখানে?’

‘এখানে আমরা খুঁজছি মঙ্গলগ্রহে যে জীবন আছে তার প্রমাণ।’

‘আর মাঝামাঝি এলাকায়,’ ক্রিমোভ বলে চললেন, ‘শীতকালে (মঙ্গলগ্রহের ঋতুচক্র পৃথিবীর মতোই)... শীতকালে সেখানে দিনে রাত্রে ৮০০ সেন্টিগ্রেড।’

‘ভারি ইন্টারেস্টিং!’ উল্লসিত হয়ে উঠলেন নিজোভস্কি, ‘মঙ্গলগ্রহের ক্যানেলগুলো সেই ছেলেবেলা থেকেই আমায় টানছে। স্কিয়াপারেল্লি, লওয়েল! মঙ্গলগ্রহ নিয়ে এই সব বৈজ্ঞানিকেরাই তো কাজ করে গেছেন?’

‘তিখোভ,’ রায় দেবার ভঙ্গিতে বললেন ক্রিমোভ, ‘গাভ্রিইল আন্দ্রিয়ানভিচ তিখোভ।’

‘নতুন বিজ্ঞান গড়েছেন তিনি—জ্যোতিরুদ্ভিদ, অস্ট্রোবোটানি!’ সোৎসাহে বললে মেয়েটি।

‘জ্যোতিরুদ্ভিদ বিজ্ঞান?’ ফের জিজ্ঞেস করলাম আমি। ‘জ্যোতিষ—অর্থাৎ নক্ষত্র, তার সঙ্গে হঠাৎ উদ্ভিদবিদ্যা! কী ব্যাপার সেটা, মাথায় ঢুকছে না।’

খিলখিলিয়ে হেসে উঠল নাতাশা।

‘তারার উদ্ভিদবিদ্যাই বটে,’ নাতাশা বলল, ‘অন্যান্য জগতের উদ্ভিদ নিয়ে চর্চা করে এ বিজ্ঞান।’

‘মঙ্গলগ্রহের উদ্ভিদ,’ যোগ দিলেন ক্রিমোভ।

‘আমাদের কাজাখস্তান বিজ্ঞান আকাদমিতে এই নতুন সোভিয়েত বিজ্ঞান, জ্যোতিরুদ্ভিদ বিদ্যার একটা বিভাগ খোলা হয়েছে।’ সগর্বে জানালো নাতাশা।

‘জ্যোতির্বিদ, তা এই উত্তর মেরুতে কেন?’ জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন।

ক্রিমোভ বললেন, ‘ব্যাপারটা এই, মঙ্গলগ্রহে যে রকম অবস্থা, সেই রকম একটা পরিস্থিতি পাওয়া দরকার আমাদের। সূর্য থেকে পৃথিবী যত দূর, মঙ্গলগ্রহ তার চেয়ে দেড়গুণ দূরে। ওখানকার বাতাস যে পরিমাণ বিরলীভূত সেটা আমাদের ভূপৃষ্ঠের ওপর ১৫ কিলোমিটার উঁচুতে যা মেলে সেই রকম। আবহাওয়া কঠোর ও চরম ধরনের।’

নাতাশা বাধা দিল, ‘ভেবে দেখুন সেখানকার বিষুবরেখায় দিনে +২০ ডিগ্রি  আর রাত্রে মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড!’

‘একটু কড়া গোছেরই বটে,’ বললেন ক্যাপ্টেন।

‘আর মাঝামাঝি এলাকায়,’ ক্রিমোভ বলে চললেন, ‘শীতকালে (মঙ্গলগ্রহের ঋতুচক্র পৃথিবীর মতোই)... শীতকালে সেখানে দিনে রাত্রে ৮০০ সেন্টিগ্রেড।’

‘আমাদের তুরুখানস্ক এলাকার মতো,’ বললেন ভূগোলবিদ। এতক্ষণ পর্যন্ত চুপ করে ছিলেন তিনি।

‘হ্যাঁ, মঙ্গলগ্রহের আবহাওয়া কঠোরই। কিন্তু এখানে এই উত্তর মেরুতেও কি তেমন তাপমাত্রা মেলে না?’ সাগ্রহেই আলাপ শুরু করলেন ক্রিমোভ। বোঝা যায় নাক্ষত্রিক উদ্ভিদবিদ্যায় তাঁর নেশা মন্দ নয়।

‘এই বার বোঝা গেল, কেন আপনারা এখানে,’ বললেন ক্যাপ্টেন। ক্রিমোভ বলে চললেন, ‘অথচ উত্তর মেরুতে জীবন বর্তমান। কিন্তু মঙ্গলগ্রহে তো এর তুলনায় পরিস্থিতি বেশি অনুকূল। যেমন, মেরুবৃত্তে মাসের পর মাস সূর্য ডোবে না। দিনে রাতে সেখানে তাপমাত্রা +১৫০ ডিগ্রির কাছাকাছি বজায় থাকে। উদ্ভিদের পক্ষে এ তো চমৎকার পরিস্থিতি!’

আমি বলে ফেললাম, ‘কিন্তু তাতে কী হলো? মঙ্গলগ্রহে উদ্ভিদ আছে এই তো?’

‘এখনো পর্যন্ত আমাদের কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই...’ এড়িয়ে যাবার মতো জবাব দিলেন ক্রিমোভ।’

সবাইকে কনিয়াক এগিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন।

বরিস ইয়েফিমোভিচ বললেন: ‘জ্যোতির্বিদ্যা এটা চমৎকার পেশা বই কি। আমাদের মধ্যে, নাবিক আর মেরু অভিযানীদের মধ্যে আত্মকাহিনী শোনানোর কিন্তু খুব চল। তাই আপনি, কমরেড ভূগোলবিদ আর আপনি কমরেড নিজোভস্কি, আর বিশেষ করে আপনারা জ্যোতির্বিদরা যদি শোনান, কী ভাবে আপনারা বৈজ্ঞানিক হয়ে উঠলেন, তাহলে ভারি ভালো হয়।’

‘বলবার আবার কী আছে,’ জবাব দিলেন নিজোভস্কি, ‘স্কুলে পড়লাম, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে, পোস্টগ্রাজুয়েট গবেষককর্মী হিসাবে টিকে গেলাম... ব্যস।’

‘আমি বিজ্ঞানী হয়ে উঠি আমার নেশার ঝোঁকে,’ বললেন ভালেন্তিন গাভ্রিলোভিচ ভাসিলিয়েভ। ‘নতুনের নেশা, গতির তৃষ্ণা। আমাদের এই অপরূপ দেশটার সবখানি ঘুরে বেড়িয়েছি আমি। আর এখন তো এই উত্তর মেরুতে। অথচ ভাবতে বসলে মনে হয়, কত জায়গাই তো এখনো দেখিনি, কত বিরাট এলাকাতেই তো পৌঁছইনি... বেশ লাগে ভাবতে। আসুন আমাদের সীমাহীন, সুন্দর স্বদেশের জন্য পান করি।’ ভূগোলবিদ গ্লাস ওঠালেন তাঁর।

সবাই অনুসরণ করল তাঁর দৃষ্টান্ত।

‘আর আপনি,’ ক্রিমোভকে জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন, ‘আপনার কাহিনী শুনতে চাই আমরা।’

অস্বাভাবিক সিরিয়স হয়ে উঠলেন ক্রিমোভ।

‘খুবই জটপাকানো ব্যাপার,’ চিন্তিতভাবে ঢিপ কপালটায় হাত ঘষে শুরু করলেন তিনি, ‘অনেক সময় লাগবে বলতে।’

সবাই মিলে অনুরোধ শুরু করে দিলাম। নেতার দিকে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইল নাতাশা। বোঝা যায়, এ জীবন কাহিনী তার অজানা।

‘বেশ, তাহলে বলি শুনুন।’ শেষ পর্যন্ত রাজী হলেন ক্রিমোভ, ‘আমার জন্ম এক এভেঙ্কী যাযাবর ছাউনিতে। এভেঙ্কদের আগে বলা হত তুঙ্গুস।’

‘আপনি এভেঙ্ক?’ চেচিয়ে উঠল নাতাশা।

মাথা নাড়লেন ক্রিমোভ।

‘এভেঙ্কী ছাউনিতে আমি জন্মাই সেই বছর যখন তাইগায়... তুঙ্গুস উল্কার কথা আপনারা সবাই নিশ্চয় জানেন, যেটা তাইগায় এসে পড়েছিল?’

‘কিছু কিছু শুনেছি। কিন্তু আপনি বরং সব বলুন, ভারি কৌতূহল হচ্ছে,’ অনুরোধ করলেন নিজোভস্কি।

‘খুবই অসাধারণ একটা ঘটনা।’ হঠাৎ উদ্দীপিত হয়ে উঠলেন ক্রিমোভ। ‘তাইগার হাজার হাজার লোকে স্বচক্ষে দেখেছিল সেই আগুনের গোলাটাকে, তার উজ্জলতায় সূর্য পর্যন্ত অন্ধকার হয়ে যায়। আকাশে মেঘ ছিল না, আগুনের একটা মস্ত স্তম্ভ যেন ফুঁড়ে আসে সেই আকাশ থেকে; যে জোরে তা ধাক্কা মারে, তার তুলনা হয় না... সারা পৃথিবী জুড়ে অনুভূত হয় সে ধাক্কার স্পন্দন। অকুস্থল থেকে হাজার কিলোমিটার দূরেও তার শব্দ পৌঁছায়। রেকর্ডে আছে যে ৮০০ কিলোমিটার দূরে কানস্কের কাছে একটা ট্রেন থেমে যায়। ড্রাইভারের মনে হয়েছিল, বুঝি কিছু একটা বিস্ফোরণ ঘটেছে ট্রেনের মধ্যে। অভূতপূর্ব একটা ঝড় শুরু হয়ে যায় পৃথিবীতে। অকুস্থলের চারশ কিলোমিটারের মধ্যে ঘরবাড়ির চালা উড়ে যায়, বেড়া ভেঙে পড়ে... আরও দূরে ঝনঝন করে ওঠে বাসনপত্র, ঘড়ি বন্ধ হয়ে যায়, ভূমিকম্পের সময় যা হয়। তার ধাক্কা রেকর্ড হয় বহু ভূকম্পন যন্ত্রে। তাশখন্দে, ইয়েনায় (জার্মানি), ইর্কুৎস্কে চাক্ষুষ দর্শকদের সাক্ষ্য নেওয়া হয় এখানে।’

‘ব্যাপারটা কী ঘটেছিল?’ জিজ্ঞেস করলেন নিজোভস্কি, ‘পৃথিবীর সঙ্গে উল্কার ধাক্কার ঝাঁকুনি?’

জবাব এড়িয়ে গিয়ে ক্রিমোভ বললেন, ‘লোকে তাই ভেবেছিল। বিপর্যয় থেকে যে বায়ু তরঙ্গ জাগে, তা দুবার ঘুরে যায় সারা পৃথিবী। লন্ডন এবং অন্যান্য জায়গার ব্যারোগ্রাফে তা ধরা পড়ে।

‘তাইগায় এই উল্কাপাতটার পরে পুরো চার দিন চার রাত ধরে অদ্ভুত সব ব্যাপার দেখা যায় গোটা দুনিয়ায়। আকাশের অনেক উচুতে দেখা যায় ভাম্বর মেঘ, গোটা ইউরোপ এমন কি আলজেরিয়া পর্যন্ত তাতে এতই আলো হয়ে ওঠে যে মাঝরাত্রেও খবরের কাগজ পড়া চলত, লেনিনগ্রাদে শ্বেতরাত্রির সময় যেমন হয়...’

‘কবে ঘটেছিল সেটা?’ জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন।

‘যে বছর আমার জন্ম, ১৯০৮ সালে,’ জবাব দিলেন ক্রিমোভ, ‘তাইগায় তখন দেখা দিয়েছিল একটা আগুনে ঝড়। ষাট কিলোমিটার দূরে ভানোভার কুঠিতে লোকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে, তাদের বোধ হয়েছিল যেন কাপড় চোপড়ে সব আগুন ধরে গেছে। ঝড়ের দাপটে বহু হরিণ উড়ে যায় মাটি থেকে, আর গাছ... বিশ্বাস করুন, আমি ওই এলাকারই লোক, বহু বছর উল্কাপিণ্ডের সন্ধানে কাটিয়েছি। ৩০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সমস্ত গাছ শিকড়শুদ্ধ উপড়ে আসে, সমস্ত এলাকাটায়! ষাট কিলোমিটার ব্যাস জুড়ে সমস্ত উচু জায়গার গাছ উল্টে পড়ে।

‘ঝড়ে অভূতপূর্ব বিপর্যয় হয়। নিজেদের নিজেদের হরিণ, সম্পত্তি ভাঁড়ারের খোঁজে তাইগায় ঢুঁড়ে বেড়ায় এভেঙ্করা। পায় কেবল পোড়া লাশ। আমার দাদু লুচেৎকানের ছাউনিতেও শোক ঘনায়। ছারখার হওয়া তাইগায় গিয়ে আমার বাবা দেখতে পান, মাটি থেকে একটা মস্ত জলস্রোত উঠছে। এর কয়েকদিন পরে ভয়ানক যন্ত্রণায় ভুগে মারা যান তিনি। কেউ যেন তাঁকে পুড়িয়ে মারছিল... অথচ চামড়ার ওপর কোনো দাহের চিহ্ন ছিল না। ভয় পেয়ে গেল বুড়োরা। ছারখার হওয়া তাইগায় যাওয়া নিষেধ করে দিলে তারা। তার নাম দিলে অভিশপ্ত জায়গা। ওঝারা বললে, আগুন আর বজ্রের দেবতা অগ্নি সেখানে আকাশ থেকে অবতরণ করেছেন। ওখানে কেউ গেলেই তাকে অদৃশ্য আগুনে পুড়িয়ে মারছেন তিনি। ‘বিশের দশকের গোড়ায়,’ বলে চললেন ক্রিমোভ, ‘ভানোভার কুঠিতে আসেন একজন রুশ বৈজ্ঞানিক, কুলিক। উল্কাপিন্ডটার তল্লাস করতে চান তিনি। কোনো এভেঙ্ক তাঁর সঙ্গে যেতে রাজী হয় না। দুজন আঙ্গারা ব্যাধকে তিনি ভাড়া করেন, আর আমিও যোগ দিই। আমার বয়স কম, রুশ ভালো জানতাম। কুঠিতে কিছু কিছু শিক্ষাও পেয়েছিলাম। দুনিয়ায় কিছুই ভয় করতাম না।

‘কুলিকের সঙ্গে আমরা পৌঁছলাম বিপর্যয়স্থলটার কেন্দ্রে। দেখলাম অসংখ্য গাছ, লাখ লাখ গাছ যা উল্টে পড়েছিল তাদের সকলের শিকড়ের দিকটা সবই এক দিকে বিপর্যয়স্থলের ঠিক কেন্দ্রে। এই কেন্দ্রস্থলটা পরীক্ষা করে আমরা হতভম্ব হয়ে যাই। কেননা উল্কাপিণ্ড পড়ার জায়গাটায় সবচেয়ে বেশি ধ্বংস হওয়ার কথা, অথচ... সেখানকার অরণ্য খাড়া দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা শুধু আমার কাছেই নয়, রুশ বৈজ্ঞানিকের কাছেও ব্যাখ্যাতীত। সেটা আমি তাঁর মুখ দেখেই টের পাচ্ছিলাম।

‘খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো, কিন্তু সে সবই মরা গাছ। ডাল নেই, পালা নেই, ঠিক যেন মাটিতে পোঁতা খুঁটির মতো।

‘এই গাছের বনটার মাঝখানে জল দেখা গেল মতো—একটা দীঘি বা জলার মতো।

‘কুলিক ধরে নিলেন, উল্কাপিন্ড পড়ে যে গর্ত হওয়ার কথা, সেটা এটা।

‘সহজ ভাষায় আমাদের বনের ব্যাধদের তিনি বোঝালেন এমন ভাবে যেন আমরা তাঁর বৈজ্ঞানিক সহকারী। বললেন, আমেরিকার কোন একটা জায়গায় আরিজোনা নামে এক মরুভূমির মধ্যে মস্ত একটা গর্ত আছে, ব্যাস তার দেড় কিলোমিটার লম্বা, গভীর ২০০ মিটার। গর্তটা হয়েছে হাজার হাজার বছর আগে, কোনো একটা উল্কাপাতে, ঠিক এখানে যে উল্কাটা পড়েছিল তার মতো। উল্কাটা খুঁজে পাওয়া একান্ত দরকার। সেই থেকে রুশ অধ্যাপককে সাহায্য করার জন্য একটা ভয়ানক ইচ্ছা পেয়ে বসে আমায়।

‘পরের বছর কুলিক তাইগায় এলেন একটা বড়ো অভিযাত্রীদল নিয়ে। কাজের জন্যে লোক ভাড়া করলেন তিনি। স্বভাবতই প্রথম জুটলাম আমি। উল্কাটার চূর্ণ খণ্ডের সন্ধান চালালাম আমরা। মরা বনটার মাঝের জলাটার জল নিকাশ করা হল। প্রতিটি খানা খোঁদল খুজে দেখা হল, কিন্তু... উল্কার কোনো পাত্তা তো পাওয়াই গেল না, উল্কার আঘাতে যে গর্ত হবার কথা তারও কোনো চিহ্ন মিলল না।

‘দশ বছর ধরে প্রতিবছর একবার করে তাইগায় এসেছেন কুলিক, দশ বছর ধরে এই নিষ্ফল সন্ধানে আমি ছিলাম তাঁর সঙ্গী। উল্কাটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। ‘কুলিক ভেবেছিলেন উল্কাটা পড়েছিল জলার মধ্যে, আর গর্তটা বুঁজে গেছে জলায়। কিন্তু মাটিতে ড্রিল করার ফলে পাওয়া গেল একটা চিরকাল জমে থাকা অক্ষত স্তর। সেটা ড্রিল করায় ফুটো দিয়ে বেগে বেরিয়ে এল একটা জলের ফোয়ারা। উল্কাটা যদি এই স্তর ভেদ করে ঢুকে থাকে, তাহলে এই জমাট স্তরটা গলে যাওয়ার কথা, এবং একবার গললে তা আর জমে যেতে পারে না। কেননা শীতকালেও এখানে দুই মিটার নিচে মাটি কখনো শীতে জমে না।

‘কিন্তু বাতাসে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে কীভাবে। এক্ষেত্রে গতি তাপে রূপান্তরিত হওয়ার কথা নয়, এবং তা হয়নি। সমস্যাটা ভাবিয়ে তুলল আমায়।

‘দ্বিতীয় বছরের সন্ধানকাজের পর আমি কুলিকের সঙ্গে মস্কো এসে পড়াশুনা করতে শুরু করি। কিন্তু প্রতি গ্রীষ্মে আসতাম আমার আদি বাসের আশেপাশে উল্কার সন্ধানের জন্য। কুলিক হাল ছাড়েননি। আমি সঙ্গে থাকতাম তাঁর। তখন আর একটা তাইগার আধাশিক্ষিত ব্যাধ আর আমি নই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, অনেককিছু পড়াশুনা করেছি, বিজ্ঞানের ব্যাপারে নিজের সমালোচনাও হাজির করতে শুরু করেছি। কিন্তু কুলিককে সে কথা কিছু বলিনি। জানতাম, কী ব্যগ্রতায় তাঁর উল্কাপিণ্ডের সন্ধানে আছেন তিনি। তা নিয়ে কিছু কবিতা পর্যন্ত লিখেছেন... কী করে তাঁকে বলি যে আমি স্থির নিশ্চিত হয়ে উঠেছি যে কদাচ কোনো উল্কা ছিল না সেখানে।’

‘ছিল না মানে?’ চেচিয়ে উঠলেন নিজোভস্কি, ‘বিপর্যয়টা হলো কীভাবে, ছারখার গাছগুলো?’

‘বিপর্যয় ঠিকই, কিন্তু উল্কা নয়,’ জোর দিয়েই বললেন ক্রিমোভ। ‘বিপর্যয়ের ঠিক কেন্দ্রে গাছের শিকড়গুলো ঠিকই রইল। এ নিয়ে অনেক ভেবেছি আমি। উল্কা পড়ার সময় বিস্ফোরণ হয় কেন? পৃথিবীর বায়ু মণ্ডলের মধ্যে দিয়ে উল্কা ছুটে আসে সেকেন্ডে তিরিশ থেকে ষাট কিলোমিটারের মতো একটা মহাজাগতিক গতিতে। বিপুল ভার ও প্রচণ্ড গতির ফলে উল্কার কাইনেটিক এনার্জি বা গতিতেজ প্রচণ্ড। পৃথিবীর সঙ্গে ধাক্কায় এই সমস্ত তেজ পরিণত হয় তাপে; ফলে ওই প্রচণ্ড রকমের বিস্ফোরণ। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে সেটি ঘটেনি... পৃথিবীর সঙ্গে উল্কাটির সংঘাত হয়নি। আমার কাছে এটা খুব স্পষ্ট। মরা গাছগুলির অস্তিত্ব থেকে এটা আমি বুঝেছি যে, বিস্ফোরণটা ঘটে বাতাসে প্রায় তিনশ মিটার ওপরে, এবং ঠিক এই গাছগুলোর মাথায়!’

‘বাতাসে কী করে?’ অবিশ্বাসের সুরে জিজ্ঞেস করলেন নিজোভস্কি। ‘বিস্ফোরণের তরঙ্গ ছুটে গেছে সব দিকে,’ খুব প্রত্যয়ের সঙ্গেই বলে চললেন ক্রিমোভ, ‘উল্কার ঠিক নিচে গাছগুলো যেখানে ছিল ঠিক সমকোণে খাড়া দাঁড়িয়ে, সেখানে বিস্ফোরণ তরঙ্গে গাছ উল্টে পড়েনি, কেবল ডালপালাগুলো খসে পড়েছে। কিন্তু যেখানে এ তরঙ্গের ধাক্কা লেগেছে, কোণাকুণি সেখানে তিরিশ থেকে ষাট কিলোমিটার ব্যাসার্ধ জুড়ে সমস্ত গাছ উল্টে পড়েছে। সেক্ষেত্রে বিস্ফোরণ ঘটা সম্ভব কেবল হাওয়ায়!’

‘তা বটে... ঠিক বলেই মনে হচ্ছে,’ চিন্তিতভাবে থুতনিতে হাত বুলিয়ে বললেন নিজোভস্কি।

‘কিন্তু বাতাসে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে কীভাবে। এক্ষেত্রে গতি তাপে রূপান্তরিত হওয়ার কথা নয়, এবং তা হয়নি। সমস্যাটা ভাবিয়ে তুলল আমায়।

‘বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্গ্রহ যোগাযোগ চক্র ছিল একটা। তরল অক্সিজেন হাইড্রোজেন সমেত আন্তর্গ্রহ রকেটের যে প্রকল্প দিয়েছিলেন ও ৎসিওলকভস্কি, তাতে খুব আগ্রহ ছিল আমার। একদিন একটা কথা মনে হলো আমার। খুবই দুঃসাহসী কথা। কুলিক আমার সঙ্গে থাকলে তক্ষুনি তাঁকে বলতাম। কিন্তু... যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। বেশ বয়স হলেও লিওনিদ আলেক্সেয়েভিচ কুলিক স্বেচ্ছাসেবক হয়ে চলে যান ফ্রণ্টে, বীরের মতো মারা যান...’

একটু চুপ করে ফের বলে চললেন ক্রিমোভ:

‘আমি ছিলাম ফ্রণ্টের অন্য একটা এলাকায়। বড় বড় শেল বাতাসে ফাটছে এটা প্রায়ই লক্ষ্য করে দেখতাম আমি। আর ক্রমেই বেশি করে নিশ্চিত হয়ে উঠছিলাম যে তাইগার ও বিস্ফোরণটা সত্যি সত্যিই বাতাসে হয়েছে। আর তা হতে পারে কেবল কোনো একধরনের ব্যোমযানের জ্বালানির বিস্ফোরণ যা পৃথিবীতে নামার চেষ্টা করছিল।’

‘অন্য গ্রহ থেকে আসা একটা ব্যোমযান?’ চেয়ার ছেড়ে প্রায় চীৎকার করে উঠলেন নিজোভস্কি।

ভূগোলবিদ চেয়ারের পিঠে হেলান দিলেন। ক্যাপ্টেন একটা অস্ফুট শব্দ করে শেষ করলেন তাঁর কনিয়াক। নাতাশা চোখ বড় বড় করে তাকাল ক্রিমোভের দিকে, যেন তাঁকে সে দেখছে এই প্রথম।

‘হ্যাঁ, মহাকাশ থেকে কোনো আগন্তুক, অন্য কোনো গ্রহ থেকে আসা ব্যোমযান, খুব সম্ভবত মঙ্গলগ্রহ থেকে। জীবনের অস্তিত্ব কেবল মঙ্গলগ্রহেই আছে বলে ধারণা করা যায়... তখন আমি ভেবেছিলাম তরল অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন, মহাজাগতিক যানের পক্ষে যা একমাত্র উপযোগী জ্বালানি, তাতে বিস্ফোরণ ঘটেছে। তখন তাই মনে হয়েছিল...’

‘তার মানে,’ নাতাশা চেচিয়ে উঠল, ‘এখন অন্য কিছু ভাবছেন?’ তার গলার স্বরে স্পষ্টই হতাশা ফুটে উঠল। বোঝা যায় মহাকাশ থেকে আগন্তুকের এই প্রকল্পটা তার বেশ মনে ধরেছিল।

‘হ্যাঁ, এখন অন্যরকম মনে হয়।’ শান্ত স্বরে পুনরাবৃত্তি করলেন ক্রিমোভ, ‘জাপানের ওপর পরমাণু বোমা বিস্ফোরণে নিশ্চিত হয়েছি, কী ধরনের জ্বালানি ছিল ব্যোমযানে।’

‘যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মঙ্গলগ্রহের সমস্যা নিয়ে কাজ শুরু করি। ও গ্রহে জীবনের অস্তিত্ব প্রমাণ করা আমার দরকার। তিখোভের নেতৃত্বে চর্চা শুরু করি... আর এখন এই তো দেখছেন এসেছি অভিযাত্রীদলে, উত্তর মেরুর উদ্ভিদ তাপকিরণ আত্মস্থ করে কী ভাবে, তার তথ্য সংগ্রহের জন্য।’

‘কিন্তু কী প্রমাণ হবে তাতে?’ এবার শোনা গেল ক্যাপ্টেনের গলা। ‘গত শতাব্দীতেই তিমিরিয়াজেভ মঙ্গলগ্রহে ক্লোরোফিল আছে কি না, তা খোঁজ করে দেখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাতে প্রমাণ হতো, মঙ্গলগ্রহে যে সবুজ দাগ দেখা যায়, বছর ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে যার রং বদলায়, যেমন রং বদলায় পৃথিবীর গাছপালার, সেগুলো আসলে উদ্ভিদে ঢাকা এলাকা।’

‘কিন্তু কী হলো? ক্লোরোফিল আবিষ্কার হয়েছে?’

‘না, আবিষ্কার এখনো সম্ভব হয়নি। ক্লোরোফিল সৌরবর্ণালীর একটা বিশেষ তরঙ্গ শোষণ করে, ফলে সেখানে একটা শূন্য ব্যান্ড দেখা যায়। কিন্তু মঙ্গলগ্রহের বর্ণালীতে তা মেলেনি। তাছাড়া অতিলাল কিরণে পৃথিবীর উদ্ভিদের ছবি নিলে তা সাদা দেখায়। অথচ অতিলাল কিরণে নিলে মঙ্গলগ্রহের সবুজ এলাকার ছবি সাদা দেখায় না।

‘সবকিছু থেকেই মনে হচ্ছিল মঙ্গলগ্রহে আদৌ কোনো উদ্ভিদ নেই। কিন্তু গাভ্রিইল আন্দ্রিয়ানভিচ তিখোভ একটা চমৎকার প্রস্তাব দিয়েছেন। অতিলাল কিরণের ফটোগ্রাফে পৃথিবীর উদ্ভিদ সাদা দেখায় কেন? কারণ যে তাপ-রশ্মি উদ্ভিদের প্রয়োজন নেই, সেটা তারা প্রতিফলিত করে। কিন্তু মঙ্গলগ্রহে সূর্যের তেজ বেশি নয়। সেখানে সবরকম সম্ভব তাপ কাজে লাগাবার চেষ্টা করবে উদ্ভিদ। অতিলাল কিরণে সবুজ দাগগুলো যে সাদা দেখায় না, তা এই কারণে হতে পারে না কি?

‘আসলে আমরা জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যে এখানে এসেছি, সেটা এই কারণেই। আমরা যাচাই করে দেখতে চাই, উত্তর মেরুর উদ্ভিদ তাপ-কিরণ প্রতিফলিত করে কি না।’

‘কী দেখলেন, প্রতিফলিত করে?’ সমম্বরে জিজ্ঞেস করলাম সবাই।

‘না, প্রতিফলিত করে না! উত্তরের উদ্ভিদ তা শোষণ করে, ঠিক মঙ্গলগ্রহের উদ্ভিদের মতো।’ চেচিয়ে উঠল নাতাশা। চোখ তার জ্বলজ্বল করছে, ‘আমরা প্রমাণ করে দিতে পারি মঙ্গলগ্রহে জীবন আছে, সবুজ দাগগুলো হলো কনিফার বন। তথাকথিত মঙ্গলগ্রহের ক্যানেলগুলো হল ১০০ থেকে ৬০০ কিলোমিটার চওড়া উদ্ভিদ এলাকা।’

‘একটু দাঁড়ান নাতাশা, সহকারিণীকে থামিয়ে দিলেন জ্যোতির্বিদ। ‘ক্যানেল?’ জিজ্ঞেস করলেন নিজোভস্কি, ‘ক্যানেল তাহলে সত্যিই আছে? কিন্তু কিছু কাল আগে যে লোকে বলত ওগুলো আলোক বিভ্রম।’

‘মঙ্গলগ্রহের ক্যানেলগুলোর ফোটো নেওয়া হয়েছে, আর ফটো তো কখনো মিথ্যা বলে না। আর ফটো নেওয়া হয়েছে হাজার হাজার। সেসব পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। প্রমাণ হয়েছে যে মঙ্গলগ্রহের মেরু তুষার যে পরিমাণে গলতে থাকে, সেই পরিমাণে তা দেখা দেয় ও ক্রমশ মেরু থেকে বিষুবরেখার দিকে বাড়তে থাকে।’ ‘উদ্ভিদের এই ফিতেটা লম্বা হতে থাকে ঘণ্টায় সাড়ে তিন কিলোমিটার গতিতে,’ কিছুতেই চুপ করে থাকতে না পেরে বলে ফেলল নাতাশা। ‘তার মানে ঘূর্ণির জল ঠিক যে গতিতে চলে?’ অবাক হয়ে বললেন ভূগোলবিদ।

‘ঠিক ওই গতিতে,’ বললেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী। ‘খুব অবাক লাগে যে এই সব উদ্ভিদ বেল্ট একেবারে নিখুঁত সরল রেখায় গড়া, আর এর মধ্যে প্রধানগুলো শিরার মতো আসছে গলন্ত মেরু তুষার থেকে বিষুবরেখার দিকে।’

‘তার মানে মঙ্গলগ্রহবাসীরা সব উড়ে আসতে চাইছিল আমাদের পৃথিবীটাকে দখল করার জন্যে!’ সিদ্ধান্ত টানলেন নিজোভস্কি, ‘আমাদের ফুটন্ত গ্রহটা ওদের দরকার!’

নিজোভস্কি ততক্ষণে জমে গেছেন বিষয়টায়। বললেন, ‘তাহলে কোনো সন্দেহই নেই যে ওগুলো হল ক্ষেতে পানি দেওয়ার জন্যে একটা মস্ত সেচ ব্যবস্থা, মঙ্গলবাসীরাই গড়েছে, আর আমরা ভেবে এসেছি খাল। খাল অবশ্যই নেই, পৃথিবীর ওপর পাতা টিউব।’

মৃদু হেসে ক্রিমোভ সংশোধন করলেন: ‘পৃথিবীর ওপর নয়, মঙ্গলগ্রহের ওপর।’

‘তার মানে মঙ্গলগ্রহে জীবন আছে! তার মানে আপনার ভাবনা ঠিক,’ বলে গেলেন নিজোভস্কি।

‘আপাতত এটুকু নিশ্চিত করেই বলা যায় মঙ্গলগ্রহে জীবন অসম্ভব নয়।’

‘যা দেখছি তাতে ১৯০৮ সালে মঙ্গলগ্রহবাসীদের সত্যিই পৃথিবীতে আসা অসম্ভব ছিল না,’ ক্যাপ্টেন বললেন।

‘হ্যাঁ, আসা সম্ভব,’ এতটুকু বিব্রত না হয়ে জবাব দিলেন ক্রিমোভ।

‘কালে কালে কত কি শুনব!’ পাইপ ধরিয়ে বিড়বিড় করলেন বরিস ইয়েফিমোভিচ।

‘মঙ্গল হলো একটা মুমুর্ষ প্রাণের গ্রহ। পৃথিবীর চেয়ে আকারে ছোটো ও মহাকর্ষ টান কম বলে মঙ্গলগ্রহ তার আদি বায়ুমণ্ডলকে ধরে রাখতে পারেনি। বায়ুকণা গ্রহ থেকে খসে মহাশূন্যে উড়ে গেছে। মঙ্গলগ্রহের বায়ু হয়ে উঠেছে বিরলীভূত, মহাসাগরের জল বাষ্প হয়ে উড়ে যেতে থাকে, আর বায়ু মিলিয়ে যায় মহাশূন্যে... মঙ্গলগ্রহে জল অবশিষ্ট আছে এত কম যে, তার সবটা আমাদের বৈকাল হ্রদটাতেই এটে যাবে।’

‘তার মানে মঙ্গলগ্রহবাসীরা সব উড়ে আসতে চাইছিল আমাদের পৃথিবীটাকে দখল করার জন্যে!’ সিদ্ধান্ত টানলেন নিজোভস্কি, ‘আমাদের ফুটন্ত গ্রহটা ওদের দরকার!’

ক্যাপ্টেন বলে উঠলেন, ‘হিটলার, ট্রুমান, ম্যাকআর্থারেও হলো না, আবার দেখছি মঙ্গলগ্রহওয়ালাদের সঙ্গেও মোকাবেলা করতে হবে।’

‘আমি কিন্তু বলব যে আপনাদের ভুল হচ্ছে। ওয়েলস এবং পশ্চিমের অন্যান্য সব লেখক যখন দুই দুনিয়ার সাক্ষাতের কথা ভাবেন, তখন লড়াই করে দখল করা ছাড়া আর কিছু কল্পনা করতে পারেন না। ওঁদের মাথাটাই গড়ে উঠেছে ওই ভাবে। পুঁজিবাদের সেই পাশবিক নিয়মগুলোকে ওরা চাপাতে চান সমস্ত তারকামণ্ডলীতে। আমার ধারণা, পানির ব্যাপারে মঙ্গলগ্রহের যা অবস্থা আর মঙ্গলবাসীরা যে প্রকাণ্ড সেচ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, তা দেখে তাদের সমাজব্যবস্থ্য সম্বন্ধে অন্য সিদ্ধান্ত করা উচিত। এমন সমাজব্যবস্থা যাতে গোটা গ্রহ জুড়ে ও ধরনের পরিকল্পিত অর্থনীতি চালানো সম্ভব।’

‘আপনি বলতে চাইছেন যে খুব একটা নিখুঁত ধরনের সমাজব্যবস্থা সেখানে বর্তমান?’ জিজ্ঞেস করলেন নিজোভস্কি।

‘বুদ্ধিমান প্রাণীদের সমাজব্যবস্থা আর অন্য কিছু হতে পারে না,’ প্রত্যয়ের সুরে বললেন ভূগোলবিদ।

ক্রিমোভ সায় দিয়ে বললেন, ‘তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু মঙ্গলগ্রহ থেকে ক্রমাগত জল অন্তর্ধান করছে। অধিবাসীদের দেখতে হবে বৈকি যাতে ভবিষ্যৎ পুরুষেরাও বেচে থাকে, যেমন এখানে আমাদের সমসাময়িকরাও নজর রাখেন ভবিষ্যৎ পুরুষদের জন্যে। মঙ্গলগ্রহে জল পেতে হবে মঙ্গলগ্রহবাসীদের... সে জল আছে। জল আছে মঙ্গলগ্রহের কাছাকাছি গ্রহগুলোতে, আছেও প্রচুর পরিমাণে এবং তা আছে পুরো পৃথিবীতে। গ্রীণল্যান্ডের কথা ধরুন। তিন কিলোমিটার পুরু বরফে তা ঢাকা। এ বরফ সরিয়ে নিলে ইউরোপের আবহাওয়াই অনেক ভালো হয়ে উঠবে। মস্কোর আশপাশে কমলালেবু ফলবে। অথচ এ বরফ যদি মঙ্গলগ্রহে চালান দেওয়া যায়, তাহলে গলে গিয়ে গোটা গ্রহটাকে ৫০ মিটার পুরু একটা ত্বকে তা ঢেকে ফেলতে পারে, অতীত মহাসাগরগুলোর সমস্ত গহ্বর তাতে ভরে উঠবে এবং আরো লাখ লাখ বছর ধরে জীবন চলতে থাকবে সেখানে!’

‘মঙ্গলগ্রহবাসীরা তাহলে পৃথিবীটাকে চায় না, চায় কেবল তার পানি?’ জিজ্ঞেস করলেন নিজোভস্কি।

‘নিশ্চয়। মঙ্গলগ্রহের চেয়ে পৃথিবীর অবস্থা এতই আলাদা যে মঙ্গলগ্রহবাসীরা পৃথিবীতে স্বচ্ছন্দে নিঃশ্বাস নিয়ে চলা ফেরা করতে পারবে না। এখানে তাদের ওজন বেড়ে উঠবে দ্বিগুণ। নিজের ওজনটা হঠাৎ দ্বিগুণ বেড়ে গেল, ভেবে দেখুন। পৃথিবী জয় করার কোনো কারণ নেই মঙ্গলবাসীদের। তাছাড়া ওদের সংস্কৃতি যেহেতু খুব উচু স্তরের, সমাজব্যবস্থাও নিখুঁত, তাই যুদ্ধের কথা সম্ভবত তারা জেনে থাকবে কেবল তাদের নিজস্ব ঐতিহাসিক গবেষণা থেকে। আমাদের কাছে তারা তাই আসবে বন্ধুর মতো, সাহায্যের জন্যে, বরফের জন্যে।’

‘গ্রহে গ্রহে বন্ধুত্ব!’ বলে উঠলেন নিজোভস্কি, ‘কিন্তু গ্রিনল্যান্ডের বরফ মঙ্গলগ্রহে চালান দেওয়া সে কী করে সম্ভব?’

‘একটা লোহার ব্যোমযান যদি গ্রহান্তরে যাত্রা করতে পারে, তাহলে বরফে তৈরি অথবা বরফে ভর্তি একটা ব্যোমযানও তা করতে পারবে। লাখ লাখ এ ধরনের ব্যোমযান যাবে পৃথিবী থেকে মঙ্গলগ্রহে। সবই একসঙ্গে নয় অবশ্য, ধরা যাক কয়েক শতক ধরে। তাতে শেষ পর্যন্ত গ্রিনল্যান্ডের সব বরফ পৌঁছে যাবে মঙ্গলগ্রহে, আর মঙ্গলগ্রহও সেই সঙ্গে নতুন উন্নততর পরিস্থিতিটার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে থাকবে। এর জন্যে যে শক্তি দরকার সেটা অন্তর্গ্রহ জাহাজ জোগাড় করবে পরমাণু তেজ থেকে।’

‘পরমাণু তেজ?’ বললেন ভূগোলবিদ, ‘তার মানে আপনার দৃঢ় বিশ্বাস যে তুঙ্গুস তাইগায় যে বিস্ফোরণটা হয়েছিল সেটা পরমাণু জ্বালানির?’

‘কোনো সন্দেহ নেই আমার। অনেক প্রমাণ আছে তার। আগেই যা বলেছি তাছাড়া আরো কিছু যোগ করি। ভাস্বর মেঘগুলোর কথা মনে আছে? প্রতিফলিত সূর্য রশ্মির চেয়েও বেশি কিরণ আসছিল সেখান থেকে। রাতে একটা সবজে গোলাপী আলো দেখা গিয়েছিল যা মেঘ ভেদ করেও আসত। নিশ্চয় বাতাসের ভাস্বরতার ফল তা। ব্যোমপোতটায় বিস্ফোরণ হতেই তার সব পদার্থ বাষ্প হয়ে আকাশে উড়ে যায়, সেখানে বাদ বাকি তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলো তখনো বিশ্লিষ্ট হতে থাকে, ফলে জ্বলতে থাকে বাতাস। মনে আছে, লুচেৎকানের ছেলে মারা যায় কী ভাবে, গায়ে তার কোনো পোড়া ক্ষত ছিল না। সন্দেহ নেই যে ওটা তেজষ্ক্রিয়তার ফল, পরমাণু বিস্ফোরণের পর যা ঘটে।’

‘নাগাসাকি আর হিরোশিমায় যা ঘটেছিল তার সঙ্গে দেখছি অনেক মিল!’ বললেন ভৌগোলিক।

‘কিন্তু ওতে করে কারা আসছিল আমাদের কাছে, মরলই বা কেন?’ জিজ্ঞেস করল নাতাশা।

কী যেন ভাবলেন ক্রিমোভ।

‘আরে দাঁড়ান, সবটা বলিনি এখনো। নক্ষত্রবিদদের হিসাব থেকে একটা অদ্ভুত রকমের মিল চোখে পড়ছে।’

‘বিশিষ্ট নাক্ষত্রবিদদের কাছে আমি একটা হিসেব চেয়েছিলাম, মঙ্গলগ্রহ থেকে পৃথিবীতে আসতে কোন সময়টা সবচেয়ে বেশি উপযোগী। মানে, মঙ্গলগ্রহ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি আসে কেবল পনের বছরে একবার।’

‘আর ঘটনাটা ঘটেছিল কোন সালে?’

‘১৯০৯ সালে!’ চট করে বলে উঠল নাতাশা।

‘তাহলে তো খাটছে না।’ ক্যাপ্টেন বললেন হতাশ হয়ে।

‘যদি শুনতে চান তবে বলি, খাটছে। মঙ্গলবাসীদের পক্ষে সবচেয়ে সুবিধাজনক হত ১৯০৭ কিংবা ১৯০৯ সাল। কিন্তু কোনোক্রমেই ১৯০৮ সালের ৩০শে জুন নয়।’

‘কী আফশোস!’ নিজোভস্কি বললেন।

হাসলেন ক্রিমোভ।

‘আরে দাঁড়ান, সবটা বলিনি এখনো। নক্ষত্রবিদদের হিসাব থেকে একটা অদ্ভুত রকমের মিল চোখে পড়ছে।’

‘কী রকম, কী রকম মিল?’

‘আন্তর্গ্রহ ব্যোমযান যদি শুক্রগ্রহ থেকে রওনা দেয়, তাহলে পৌঁছনোর সবচেয়ে যোগ্য দিন হত ১৯০৮ সালের ৩০ জুন।’

‘আর তাইগার বিপর্যয়টা ঘটেছিল কবে?’

‘১৯০৮ সালের ৩০ জুন!’

‘বলেন কী!’ চেচিয়ে উঠলেন নিজোভস্কি, ‘শুক্রগ্রহের লোক তাহলে?’

‘মনে হয় না তা... প্রসঙ্গত বলি যে, নক্ষত্রবিদরা বলেছিলেন যে শুক্রগ্রহ থেকে পৃথিবীতে আসার পক্ষে অবস্থা ওই সময়টাতেই সবচেয়ে অনুকূল। ১৯০৮ সালের ২০শে মে যাত্রা করে রকেটটা শুক্রগ্রহ ও পৃথিবীর মাঝ থেকে ওদের সঙ্গে একই দিকে উড়ে গেলে পৃথিবীতে যখন পৌঁছত সেটা শুরু ও পৃথিবীর মুখোমুখি হবার কয়েক দিন আগে।’

‘ও নিশ্চয় শুক্রগ্রহের লোক। কোনো সন্দেহই নেই, নিজোভস্কি বললেন উত্তেজিতভাবে।

‘মনে হয় না তা...’ দৃঢ়ভাবেই আপত্তি করলেন জ্যোতির্বিদ, ‘শুক্রগ্রহে কার্বন ডাই-ক্সাইড খুব বেশি, বিষাক্ত গ্যাসের লক্ষণও দেখা গেছে। সেখানে খুব উচ্চবিকশিত প্রাণীর অস্তিত্ব কল্পনা করা কঠিন।’

‘কিন্তু উড়ে যখন এল, তার মানে সে রকম প্রাণীর অস্তিত্ব আছেই।’ তর্ক করলেন নিজোভস্কি, ‘শুক্রগ্রহ থেকে তো আর মঙ্গলবাসীরা আসতে পারে না।’

‘ঠিকই ধরেছেন, আমার ধারণা তাই ঘটেছে।’

‘মানে, কী বলছেন! হতভম্ব হয়ে উঠলেন নিজোভস্কি, ‘তার কী প্রমাণ আছে আপনার?’

‘প্রমাণ আছে। এ অনুমান করা খুবই যুক্তিসিদ্ধ যে কাজে লাগাবার মতো জলের সন্ধানে মঙ্গলবাসীরা প্রতিবেশী দুটি গ্রহেই সন্ধান চালাবার কথা ভেবেছিল, যেমন শুক্র আর পৃথিবী। প্রথমে সবচেয়ে অনুকূল সময়ে তারা যায় শুক্রে, তারপর... ১৯০৮ সালের ২০শে মে শুক্র থেকে যাত্রা করে পৃথিবীর দিকে... বোঝা যায় যাত্রাপথেই মহাজাগতিক কিরণ অথবা উল্কার সঙ্গে সংঘাত অথবা অন্য কোনো কারণে অভিযাত্রীরা মারা পড়ে। কোনো পরিচালক ছিল না ব্যোমযানটার, পৃথিবীর দিকে আসছিল ঠিক একটা উল্কার মতোই। সেই জন্যই ব্রেক কষে গতি না কমিয়েই তা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে। বায়ুর সংঘর্ষে তা গরম হয়ে ওঠে ঠিক উল্কার মতোই। বাইরের আবরণ গলে যায় আর পরমাণু জ্বালানির ফলে পরম্পর প্রতিক্রিয়ার অবস্থায় গিয়ে পৌঁছয়। বিস্ফোরণ ঘটে আকাশেই। তাই নিখুঁত হিসাবে যা দেখা যাচ্ছে, তাদের রকেটটার যেদিন পৃথিবীতে পৌঁছবার কথা, সেই দিনই গ্রহান্তরের আগন্তুকরা মারা যায়... খুব সম্ভব যে মঙ্গলগ্রহে সেদিন লোকে সশঙ্কে অপেক্ষা করে দেখছিল।’

‘একথা ভাবছেন কেন বলুন তো?’

‘ব্যাপারটা এই যে ১৯০৯ সালে দুই গ্রহ মুখোমুখি হবার সময় পৃথিবীর বহু জ্যোতির্বিদ মঙ্গলগ্রহে আলোর ফুলকি দেখে খুবই আলোড়িত হয়ে উঠেছিলেন’

‘সিগন্যাল নাকি?’

‘হ্যাঁ, কেউ কেউ বলেছিল সিগন্যাল, কিন্তু সন্দেহবাদীদের আপত্তিতে তাদের কথা ডুবে যায়।’

‘নিজেদের যাত্রীদের সিগন্যাল দিচ্ছিল ওরা,’ বললে নাতাশা।

জ্যোতির্বিদ বললেন, ‘সম্ভবত। ১৫ বছর কাটল তারপর। তখন ১৯২৪ সাল। রুশ বৈজ্ঞানিক পপোভের আবিষ্কৃত রেডিও ততদিনে ব্যবহৃত হচ্ছে। দুই গ্রহের মুখোমুখি হবার সময় বহু রেডিও সেটে অদ্ভুত সব সঙ্কেত ধরা পড়েছিল! মঙ্গলগ্রহ থেকে রেডিও সঙ্কেত নিয়ে খুব সোরগোল উঠেছিল তখন। লোকে বলাবলি করত, মার্কনির রসিকতা। কিন্তু তিনি তা অস্বীকার করেন। যা-ই হোক, হুজুগে পড়ে তিনিও মঙ্গলগ্রহ থেকে সঙ্কেত ধরার চেষ্টা করেছিলেন। বিশেষ একটা অভিযান সংগঠন করেন তিনি, কিন্তু... কিছু পাননি। পৃথিবীর রেডিও কেন্দ্রগুলো যে ধরনের দীর্ঘ তরঙ্গ নিয়ে কাজ করে না, সেই তরঙ্গে কিছু সঙ্কেত এসেছিল, কিন্তু তার পাঠোদ্ধার করতে পারেনি কেউ।’

‘পরের বার মুখোমুখি হওয়ার পালা ১৯৫৪ সালে,’ একটু চুপ করে থেকে বললেন ক্রিমোভ, ‘ততদিনে আন্তর্গ্রহ যাত্রায় জীবসত্তাকে মহাজাগতিক কিরণ থেকে রক্ষার উপায় মঙ্গলগ্রহবাসীরা পেয়ে যাবে কি না জানি না...।

‘পরের বার যখন মুখোমুখি হয়েছিল, তখন কী ঘটেছিল?’ উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন নিজোভস্কি।

‘১৯৩৯ সালে জ্যোতির্বিদ বা রেডিও বিশেষজ্ঞ কেউ কিছুই দেখেননি। মঙ্গলগ্রহবাসীরা আগের দুই বারে তাদের ব্যোমযাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে থাকবে, কিন্তু পরে সম্ভবত স্থির করে যে তাদের মৃত্যু হয়েছে।’

‘খুবই যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়... আর সত্যিই উত্তেজিত করার মতো,’ বললেন নিজোভস্কি।

‘পরের বার মুখোমুখি হওয়ার পালা ১৯৫৪ সালে,’ একটু চুপ করে থেকে বললেন ক্রিমোভ, ‘ততদিনে আন্তর্গ্রহ যাত্রায় জীবসত্তাকে মহাজাগতিক কিরণ থেকে রক্ষার উপায় মঙ্গলগ্রহবাসীরা পেয়ে যাবে কি না জানি না...। ব্যক্তিগতভাবে আমার আশা অন্যরকম। পরমাণু তেজের ব্যাপারটা আমরা সোভিয়েতের লোক ইতিমধ্যে বুঝে নিয়েছি। আমাদের দেশটা জেট গতির জন্মভূমি। বিস্ময়কর গতি অর্জনের সম্ভাবনা দিচ্ছে আমাদের জেট ইঞ্জিনগুলো। আগামীকাল আন্তর্গ্রহ যাত্রা নিয়ে ভাবনার দায়টা এই আমাদের বলশেভিকদেরই কাঁধে।’

‘মঙ্গলগ্রহে যাবেন আপনি?’ প্রায় ভয় পেয়েই জিজ্ঞেস করল নাতাশা।

‘হ্যাঁ, যাব। মঙ্গলগ্রহে যে আমি যাবই, সে বিষয়ে খুবই নিশ্চিত আমি।

মেধাবী প্রাণীর বিকাশ, বিজ্ঞানের বিকাশ পৃথিবীতে ঘটছে মঙ্গলগ্রহের

চেয়ে অনেক অনুকূল পরিস্থিতিতে। ওদের চেয়ে আমরাই ওদের গ্রহে উড়ে

যাব আগে, আর অনেক সাফল্যের সঙ্গে...’। থামলেন ক্রিমোভ, তারপর হাসলেন।

‘দেখছেন তো, জ্যোতির্বিদ আমি হয়েছি কী জন্যে। যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি কথাই বোধ হয় বললাম। কিন্তু দোষটা কনিয়াকের।’

‘মাফ করবেন,’ বললেন নিজোভস্কি, ‘পেশায় আমি পলিয়নটলজিস্ট .... টুকরো টাকরা হাড় থেকে আমরা অতীত কালের জীবজন্তুদের মূর্তি গড়ে তুলতে পারি। মঙ্গলগ্রহের বৃদ্ধিপ্রবণ প্রাণীরা দেখতে কেমন সেটা কি আন্দাজ করা যায় না? আপনি তো সেখানকার পরিস্থিতি সবই জানেন। বলুন না একটু, গ্রহান্তরের আগন্তুকদের কেমন লাগবে দেখতে।’

ক্রিমোভ হাসলেন।

‘আমিও ভেবেছি তা নিয়ে। বেশ, শুনুন। ভালো কথা, আপনাদের জনৈক সহকারী পলিয়নটলজিস্ট ও লেখক ইয়েফ্রেমভ এ বিষয়ে যা বলেছেন সেটা আমি পড়েছি। তাঁর সঙ্গে অনেক বিষয়েই আমি একমত... একটা মস্তিষ্ক কেন্দ্র, তার কাছেই স্টেরিওস্কোপিক দৃষ্টি ও শ্রবণ ইন্দ্রিয়.... এতো বটেই। তারপর, খাড়া হয়ে দাঁড়ানো, যাতে অনেকখানি দেখা যায়। তারপর বাইরের চেহারা, মঙ্গলগ্রহের আবহাওয়া অতি কঠোর, চূড়ান্ত রকমের বদল হয় তাপ মাত্রায়। তাই সম্ভবত তারা সুদর্শন নয়। কোনো একটা রক্ষণী আবরণ তাদের থাকার কথা। পুরু, এক থাক চর্বি, গা ভরা ঘন লোম নয়ত বেগুনী রঙের চামড়া, যা মঙ্গলগ্রহের উদ্ভিদের মতোই তাপ রশ্মি শোষণ করবে। লম্বা হওয়ার কথা নয় তাদের... মাধ্যাকর্ষণ টান সেখানে বেশি নয়... পেশী আমাদের চেয়ে কম বিকশিত। আর কী? ও হ্যাঁ!.. শ্বাসযন্ত্র। খুবই বিকশিত শ্বাসযন্ত্র থাকবে তাদের, কেননা মঙ্গলগ্রহের বায়ুমণ্ডলে যে নিতান্ত স্বল্প পরিমাণ অক্সিজেন আছে, তা টেনে নিতে পারা চাই... অবশ্য এসবের সঠিকতা সম্পর্কে গ্যারান্টি দেওয়া সম্ভব নয়...’

‘আর শুক্রগ্রহে যারা বাস করে, তাদের চেহারাটা কী রকম হবে?" চিন্তিতভাবে জিজ্ঞাসা করলেন নিজোভস্কি।

হো হো করে হেসে উঠলেন জ্যোতির্বিদ।

‘এ ব্যাপারে কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারব না। ও গ্রহটা সম্পর্কে খুবই কম জানি আমরা...’

‘তাহলেও শুক্রগ্রহ থেকেই তো ওরা উড়ে এসেছিল,’ মৃদুস্বরে বললেন নিজোভস্কি।

ক্রিমোভ মাথা নাড়লেন।

আসর ভাঙল যখন, তখন মাঝ রাতও পেরিয়ে গেছে। বরিস ইয়েফিমভিচ তো একেবারে গদগদ।

‘এই না মানুষ! কী এক লক্ষ্যেই না জীবন চালাচ্ছে। আমাদের এই উত্তর মেরুর অভিযানে অমনি ধারা লোক পেলে তবেই না!’

মনে পড়ে জ্যোতির্বিদের সঙ্গে বিদায়ের পালাটা। নাতাশার সঙ্গে উনি নেমে গেলেন খোলদনায়া জেলিয়ায়, সেখানকার স্থানীয় উদ্ভিদের প্রতিফলন ক্ষমতা যাচাই করবেন।

মোটরবোটে নামানো হলো যন্ত্রপাতি। নাতাশা আর ক্রিমোভ হাত নেড়ে বিদায় জানালেন। জাহাজ থেকে বিদায় ভোঁ বাজালেন ক্যাপ্টেন। এটিতে ওর কখনো অন্যথা হয় না, এসব বিষয়ে ভারি মনোযোগী আমাদের ক্যাপ্টেন, বরিস ইয়েফিমোভিচ!

জাহাজের রেলিং থেকে ঝুঁকে নিজোভস্কি চ্যাঁচালেন।

‘ওরা কিন্তু এসেছিল শুক্রগ্রহ থেকেই!’

‘মঙ্গলগ্রহ থেকে!’ চেচিয়ে জবাব দিলেন ক্রিমোভ। হাসছিলেন না তিনি। মুখটা তার গম্ভীর।

ঢেউয়ে নাচতে নাচতে ছোটো হয়ে এল মোটরবোটটা। দূর উপকূলের খাঁজকাটা তীরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সেটা।

এক ঘণ্টা পরে বোট ফিরে এল।

‘গেওর্গি’ সেদোভ’ তোড়জোড় শুরু করল, যাত্রার জন্যে।

* সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত গল্প সংকলন ‘গ্রহান্তরের আগুন্তুক’ থেকে নেওয়া।