ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ – ৭

আমার ‘স্পেকট্রাম’ অনুসারে আমাকে ‘মানুষ করতে’ তারা শুরু করল সেই ফ্রিকোয়েন্সিতে যাতে যেকোনো কীর্তি দেখার মতো ইচ্ছাশক্তি দেখা দিত আমার মধ্যে। সুতরাং, ইচ্ছাশক্তি লোপের ভান করার মতো কৃতিত্বটা অনায়াসেই অর্জন করা গেল। হাঁটু গেড়ে বসে যথাসম্ভব শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকতাম আমি, রেডিও যোগে প্রচারিত ক্রাফৎশ্‌তুদৎ প্রশস্তির পুনরাবৃত্তি করে যেতাম। একেবারে আনকোরা বলে, প্রার্থনা ছাড়াও নিউরোকিবারনেটিক বিদ্যার কিছু কিছু তত্ত্বও আমাকে শেখানো হলো। কোন কোন ফ্রিকোয়েন্সিতে কোন কোন আবেগ দেখা দেয় প্রধানত তা মনে রাখাই এই উদ্ভট শিক্ষার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ। আমার পরিকল্পনার পক্ষে বিশেষ জরুরী ছিল দুটি ফ্রিকোয়েন্সি: যেটাতে গাণিতিক চিন্তার উত্তেজনা হয়, এবং আর একটি, যেটি সৌভাগ্যবশত ৯৩ চক্র থেকে বেশি দূরে নয়।

এক সপ্তাহ শিক্ষা চলল আমার। ধরা হলো এবার আমি কাজে লাগার মতো যথেষ্ট বাধ্য হয়েছি। প্রথম যে হিসাবটা আমায় দেওয়া হলো সেটা একটা আন্তর্মহাদেশীয় রকেটকে জমির ওপর শূন্যেই বিধ্বস্ত করার সম্ভাবনা নিয়ে।

করতে লাগল ঘণ্টা দুয়েক। প্রতিরক্ষা মন্ত্রিদপ্তরের পক্ষে তার ফলটা খুব আহ্লাদজনক হওয়ার কথা নয়। কেননা, যে সব পরিস্থিতি নির্দিষ্ট করা হয়েছিল, তাতে তা করা যায় না।

দ্বিতীয় সমস্যাটাও সামরিক। এটা হল প্রতিপক্ষের পরমাণু বোমা ধ্বংসের জন্যে একটা নিউট্রন গুচ্ছের একটা হিসাব। এর জবাবটাও সুখকর হলো না। যেসব হিসাব দেওয়া হয়েছে, তাতে একটা নিউট্রন কামান গড়তে হলে তার ওজন হবে কয়েক হাজার টন।

এসব সমস্যা সমাধান করতে আমার সত্যিই আনন্দ হচ্ছিল এবং অন্য সবার মতোই উন্মাদনাগ্রস্ত বলে আমায় দেখিয়েছিল নিশ্চয়, তবে একটা তফাৎ ছিল। জেনারেটর যে ফ্রিকোয়েন্সিতে চলল, তাতে একটা বাধ্য ক্রীড়নক হওয়ার বদলে আত্মবিশ্বাস ও প্রেরণায় উদ্দীপিত হয়ে উঠেছিলাম আমি। ঘুমের জন্যে বিরতির সময়েও আত্মশক্তি ও ভরসার একটা সানন্দ অনুভূতি আমায় ছেড়ে যায়নি। ঘুমের ভান করছিলাম আমি, কিন্তু আসলে প্রতিশোধের পরিকল্পনাটা গড়ে তুলছিলাম।

সমর দপ্তরের অঙ্কগুলো কষার পর মনে মনে (কেউ যেন না জানে) কষতে লাগলাম আমার নিজস্ব অঙ্কটা-- ক্রাফৎশ্‌তুদৎ কোম্পানিকে কী করে ভেতর থেকে উড়িয়ে দেওয়া যায়।

উড়িয়ে দেওয়ার কথাটা বলছি অবশ্য রূপকে, কেননা ডিনামাইট, ডিএনটি, কিছুই আমার কাছে ছিল না। এই পাগলাগারদের পাথুরে জেলখানাটায় তা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই। অন্য একটা মৎলব ছিল আমার।

ঠিক করলাম, প্রেরণা জেনারেটর যখন যে কোনো মানবিক আবেগের উদ্রেক করতে পারে, তখন এই হতভাগ্যদের মনে মানবিক মর্যাদা বোধ জাগাবার জন্যে তা ব্যবহার করার চেষ্টা করা যাক না? প্রাক্তন নাজী অপরাধীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উত্তেজিত হয়ে উঠুক ওরা। সেক্ষেত্রে এই বৈজ্ঞানিক ডাকাতদের চূর্ণ করতে বাইরের কোনো সাহায্যও লাগবে না। কিন্তু তা কি করা যায়? অর্থাৎ, যে ফ্রিকোয়েন্সিতে গাণিতিক চিন্তা উত্তেজিত হয় তাকে এমন একটা ফ্রিকোয়েন্সিতে বদলে দেওয়া, যাতে মানুষের মধ্যে ক্রোধ ও ঘৃণা জেগে ওঠে—এ কি করা সম্ভব?

জেনারেটরটা চালাতে তার বৃদ্ধ স্রষ্টা ডা. প্‌ফাফ্‌ফ্‌—ইনি বোঝা যায় ধর্ষকামী প্রবৃত্তির লোক, নিজের সৃষ্টির ব্যভিচারেই যার আনন্দ। তার ইঞ্জিনিয়রিং কীর্তির লক্ষ্যই হলো তা মানুষের নিপীড়নে উপভোগ করা। তার কাছ থেকে কোনো সাহায্যের প্রত্যাশা একেবারে বৃথা। ওকে আমার হিসাবের বাইরেই রাখতে হলো। আমার বাঞ্ছিত ফ্রিকোয়েন্সিতে জেনারেটরটা চালাতে হবে তার সাহায্য ছাড়াই, তার ইচ্ছা বিনা।

প্রেরণা জেনারেটরে যদি বেশি ভার চাপানো যায়, অর্থাৎ ডিজাইনে যা আছে তার চেয়ে বেশি শক্তি যদি টানা হয়, তাহলে তার ফ্রিকোয়েন্সি প্রথমে ধীরে ধীরে, তারপর দ্রুত নেমে যায়। এর অর্থ রেজিস্টেন্স হিসাবে একটা বাড়তি লোড যোগ করলে জেনারেটর ডায়েলে যে ফ্রিকোয়েন্সি দেখা যাচ্ছে তার চেয়ে নিচু ফ্রিকোয়েন্সিতে চলবে।

ক্রাফৎশ্‌তুদৎ কোম্পানি ৯৩ চক্রের ফ্রিকোয়েন্সি দিয়ে গাণিতিক চিন্তাকে কাজে লাগায়। ক্রোধ ঘৃণা উত্তেজিত হয় ৮৫ চক্রের ফ্রিকোয়েন্সিতে। তার মানে ৮ ফ্রিকোয়েন্সি কমালেই চলবে। তার জন্যে কী পরিমাণ বাড়তি লোড দরকার হতে পারে, সেই হিসেব করতে লাগলাম আমি।

টেস্ট ল্যাবরেটরিতে আমায় যখন নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তখন ভোল্টমিটার আর অ্যামিটারের কাঁটা লক্ষ্য করে দেখেছিলাম। এ দুইয়ের গুণফলই হল জেনারেটরের শক্তি। বাকি রইল কেবল কতটা বাড়তি ভার চাপানো দরকার সেই গাণিতিক হিসেবটা...

প্রথমে মনে মনে ছবিটা স্পষ্ট করে নিলাম যে বিরাট বিরাট কনডেন্সরের ভেতরে এই সব বেচারারা ভূতের বেগার খেটে যায় সেগুলো জেনারেটরের সঙ্গে ঠিক কী ভাবে সংযুক্ত। চল্লিশ মিনিটের মধ্যে আমি মনে মনে ম্যাক্সওয়েল সমীকরণটা কষে নিলাম, সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় অন্যান্য সব জটিল হিসাবও কষে ফেলা গেল।

দেখা গেল মাত্র দেড় ওয়াট শক্তিই উদ্বৃত্ত রয়েছে হের প্‌ফাফ্‌ফের! সুতরাং, ৯৩ ফ্রিকোয়েন্সি ৮০ ফ্রিকোয়েন্সিতে নামিয়ে আনার হিসাবটায় আর অসুবিধা হলো না। দরকার শুধু ১ হাজার ৩৫০ ওম রেজিস্টেন্স, একটা কনডেনসর চাকতির সঙ্গে তা যোগ করে আর্থ করতে হবে।

আনন্দে চিৎকার করে ওঠার ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু ওই রেজিস্টেন্সের মাপ অনুযায়ী একটা তার পাই কোথা থেকে? রেজিস্টেন্সটা খুব সঠিক হওয়াও দরকার, নয়তো ফ্রিকোয়েন্সি বদলে যাবে আর বাঞ্ছিত ফল লাভ হবে না।

ক্ষিপ্তের মতো মনে মনে হাতড়ে বেড়াতে লাগলাম নানা রকম সব ফন্দি, কিন্তু কিছুই ভেবে উঠতে পারলাম না। একটা অক্ষমতার জালায় মন ভরে উঠেছে, দুই হাতে মাথা চেপে অমানুষিক গলায় চেঁচিয়ে উঠার ইচ্ছে হচ্ছিল। এমন সময় চোখে পড়ল কাঁপা কাঁপা হাতে আমার টেবিলের ওপর একটা কালো প্লাস্টিকের কাপ রেখে গেল কে যেন। তাকিয়ে বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠি আর কি। আমার সামনে দাঁড়িয়ে সেই ভীতচক্ষু রোগা মেয়েটি, ক্রাফৎশ্‌তুদৎ কোম্পানির ডাক নিয়ে যে এসেছিল আমার বাড়িতে।

‘কী করছেন এখানে। জিজ্ঞেস করলাম চাপা গলায়।

‘কাজ করছি।’ ঠোঁট তার প্রায় নড়ল না। ‘আপনি তাহলে বেঁচে আছেন?’ ‘হ্যাঁ, আপনাকে আমার খুব দরকার।’

শঙ্কায় চোখ চঞ্চল হয়ে উঠল তার।

‘শহরের সবার ধারণা আপনি খুন হয়েছেন। আমিও তাই ভেবেছিলাম।’

‘শহরে যান আপনি?"

‘যাই, প্রায় প্রত্যেক দিনই, কিন্তু....’

আমি তার ছোট্ট হাতখানা চেপে ধরলাম।

‘শহরের সবাইকে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বলবেন যে আমি বেঁচে আছি, জোর করে আমায় খাটাচ্ছে এখানে। এখান থেকে মুক্তি লাভের জন্যে আমার বন্ধুদের এবং আমার সাহায্য প্রয়োজন।’

মেয়েটির চোখে আতঙ্ক ফুটে উঠল।

‘বলছেন কী আপনি। ফিসফিসিয়ে বললে সে, ‘হের ক্রাফৎশ্‌তুদৎ যদি জেনে ফেলেন, আর সবই উনি জানতে পারেন...’

‘কী রকম ঘন ঘন আপনাকে জেরা করা হয়?’

‘পরশু জেরার দিন।’

তার মানে পুরো একটা দিন হাতে আছে। সাহস রাখুন, ভয় নেই। অনুরোধ করছি যা বললাম করুন।’

সজোরে হাত ছিনিয়ে নিয়ে দ্রুত চলে গেল মেয়েটা।

টেবিলে যে কাপটা সে রেখে গিয়েছিল সেটা পেনসিলের কাপ। বিভিন্ন কাজের জন্যে বিভিন্ন রঙের দশটা পেনসিল। কিছুই না ভেবে প্রথম পেনসিলটা তুলে নিয়ে নাড়তে লাগলাম। ‘২বি’ মার্কা—খুব নরম পেনসিল। এতে গ্রাফাইট আছে অনেক, বিদ্যুৎ পরিবহন করে ভালো। ‘৩বি’ ‘৫বি’ পেনসিলও রয়েছে। তারপর ‘এইচ’ মার্কা শক্ত জাতের পেনসিল এগুলো কপি করার জন্যে। পেনসিলগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে আমার মস্তিষ্ক পাগলের মতো সক্রিয় হয়ে উঠল। তারপর বিদ্যুৎ ঝলকের মতো হঠাৎ মনে পড়ে গেল পেনসিল গ্রাফাইটের রেজিস্টেন্স কত: ‘৫ এইচ’ একটা পেন্সিলের রেজিস্টেন্স ২ হাজার ওম। সঙ্গে সঙ্গে ‘৫ এইচ’ একটি পেন্সিল তুলে নিলাম। ম্যাক্সওয়েল সমীকরণের শুধু গাণিতিক নয়, ব্যবহারিক সমাধানও মিলে গেল। হাতে আমার কাঠে ঢাকা এমন এক টুকরো গ্রাফাইট যা দিয়ে আধুনিক বর্বরদের একটা গোটা দলকে খতম করে দেব।

অমূল্য একটা সম্পদের মতো সাবধানে কোটের ভেতরের পকেটে লুকিয়ে রাখলাম পেনসিলটা। ভাবতে লাগলাম দুই টুকরা তার পাওয়া সম্ভব কোত্থেকে—একটা তার দিয়ে কনডেন্সর চাকতিটাকে সংযুক্ত করতে হবে, অন্যটা লাগাতে হবে কোণের ঘর গরমের পাইপের সঙ্গে। মাঝখানে থাকবে গ্রাফাইটটা।

মনে পড়ে গেল, যে ওয়ার্ডে আমি এবং অন্যান্য পরিগণকেরা থাকি, সেখানে একটা টেবিল ল্যাম্প আছে। এর তারের দাড়িটা লম্বায় প্রায় দেড় মিটার এবং নমনীয়। তার মানে সরু সরু অনেক তার দিয়ে তা গড়া। ওপরের আবরণটা কেটে তা থেকে মিটার দশেক লম্বা সরু তার বেশ বানানো যায়। আমার কাজের পক্ষে সেটা যথেষ্ট।

হিসেবগুলো সবে শেষ করেছি এমন সময় মাইকে ঘোষিত হল, দিবাভোজনের সময় হয়েছে।

আমার একক কক্ষ ছেড়ে খুশি মনে চললাম ওয়ার্ডের দিকে। করিডরে তাকিয়ে দেখলাম ডাক্তার মুখ ব্যাজার করে আমার কষা সমাধানগুলো দেখছে। বোঝা যায় যে আন্তর্মহাদেশীয় রকেটকে ঠেকাবার উপায় নেই বা শত্রুর পরমাণু-বোমাকে নিউট্রোন কামান দিয়ে বিস্ফোরিত করা সম্ভব নয় সেটা তার মনঃপুত হয়নি।

কিন্তু একটা কপি পেনসিলের সাধারণ গ্রাফাইট দিয়ে যে কী করা সম্ভব তার কোনো ধারণাই তার ছিল না!

(চলবে…)

* সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘প্রগতি প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত গল্প সংকলন গ্রহান্তরের আগুন্তুক থেকে নেওয়া।

মূল: আনাতলি দনে্‌প্রভ

অনুবাদ: ননী ভৌমিক