অতীতের ছায়া – ৮

তারপর ঘটল আবহাওয়ার বদল। উদ্ভিদ জীবনেও দেখা দিল পরিবর্তন। বড় বড় সরীসৃপ জাতের প্রাণীরা এবার পড়ল বিপদে। নিরামিষাশী যারা, তারা আর আগের মতো প্রচুর স্বাস্থ্যকর খাবার পায় না। খাবার ক্রমশ লোপ পাওয়ায় তারা আর তাদের হিংস্র জাত ভাইরা—দুই দলই পড়ল অসুবিধায়। লোপ পেতে বসল সরীসৃপ। তাদের অবলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে বিজয়ী স্তন্যপায়ী জীব দখল করে নিল পৃথিবী।

গল্প শেষ করে নিকিতিন বলল, ‘একবার ভেবে দেখ, কোটি কোটি বছর ধরে কত প্রাণী জন্ম নিয়েছে, লোপ পেয়েছে। তাদের কারো এতটুকুও বুদ্ধির আলো ছিল না। যা কল্পনার অতীত, তা-ই একবার কল্পনা করতে চেষ্টা করো।

চুপ করে গেল নিকিতিন। অন্ধকার হয়ে আসা আকাশের বহু উঁচু থেকে ডেকে উঠল একটা ঈগল। কারও মুখে কোনো কথা নেই। সবাই স্থিরদৃষ্টে চেয়ে আছে নিকিতিনের দিকে।

নিকিতিনের গলায় বেজে উঠল একটা বিষন্ন সুর। তারপর হঠাৎ সে লাফিয়ে উঠে পড়ল। তার শেষ কথাগুলোয় সবাই একটু মুষড়ে পড়েছে...

নিকিতিন চিন্তামগ্নভাবে হেসে বলল, ‘জীবাশ্মবিদ্যার মহত্ব হচ্ছে তার বিরাট কালচেতনায়। এদিক দিয়ে তার সমকক্ষ হচ্ছে একমাত্র জ্যোতিষ। তবে জীবাশ্মবিদ্যার একটা মস্ত অসুবিধাও আছে। যারা সম্পূর্ণ জ্ঞানের সন্ধানী, তাদের পক্ষে সে অসুবিধাটা বড় কষ্টকর। তা হলো তথ্যের অসম্পূর্ণতা। লুপ্ত প্রাণীর অত্যন্ত স্বল্প এক কণা মাত্র পৃথিবীর মাটিতে সঞ্চিত রয়েছে। তাও টুকরো টুকরোভাবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ আমাদের কথাই ধরো না। আমরা কেবল হাড় খুঁড়ে বের করি। এ কথা সত্যি, ওই হাড়ের সাহায্যেই প্রাণীর চেহারাটা আমরা আঁচ করতে পারি। কিন্তু সেও কেবল সামান্যই। আসল কথাটা হচ্ছে জন্তুটার ভেতরের রূপটা আমরা কখনও জানতে পারব না, তার সত্যিকার চেহারাটা পাব না দেখতে। তার ফলে আমাদের তত্ত্বগুলোর প্রকৃত যাচাই সম্ভব হয় না, ভুলভ্রান্তিও ধরা পড়ে না। জৈব নিয়ম অমোঘ; নিষ্ফল কল্পনার হাতে মানুষের বুদ্ধিকে ছেড়ে দিলে চলে না, প্রতিটি নিয়মকে তার সত্যিকার আলোয় বিচার করে দেখতে হয়।’

নিকিতিনের গলায় বেজে উঠল একটা বিষন্ন সুর। তারপর হঠাৎ সে লাফিয়ে উঠে পড়ল। তার শেষ কথাগুলোয় সবাই একটু মুষড়ে পড়েছে দেখে সে বলে উঠল:

‘বন্ধুরা, বিজ্ঞানের রহস্য সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের মত মেনে নিও না।’

গল্পের অবাধ আর ব্যাপক কল্পনাশক্তির সাহায্যেও হয়তো সেই রহস্যের অন্তস্তলে পৌঁছতে পারো। লেখকরা কখনো তথ্যের সংকীর্ণ গণ্ডিতে বাঁধা পড়ে থাকতে চান না। অতীত কালের প্রাণীজগতের সুস্পষ্ট বিশ্বাস্য ছবি তাঁরা এঁকেছেন। সে জগতকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। কোনান ডয়েলের অজ্ঞাত জগৎ, রসনি আইনের আগুনের জন্য লড়াই আর বিরাট শিকারী জন্তু তোমাদের পড়তে বলি। আইনে আমার প্রিয় লেখক। তাঁর কল্পনাপ্রবণ লেখা, প্রাচীন জীবনের আশ্চর্য সুন্দর বর্ণনা, অতীতকে আবার বাঁচিয়ে তোলার ক্ষমতা, জীবাশ্মবিদদের পক্ষেও মনোমুগ্ধকর।

আলোচনায় আত্মহারা হয়ে নিকিতিন ফরাসি লেখকের লেখা থেকে উদ্ধৃতি শোনাতে শুরু করল, ‘গোধূলির গভীর আলোর সঙ্গে সঙ্গে নেমে এল অতীতের অস্পষ্ট ছায়া। একটা অমঙ্গলে লাল কুয়াশা ঘূর্ণির মতো ছড়িয়ে পড়ল সারা সমতলে...’

মারুসিয়ার চাপা চিৎকার শুনে নিকিতিন ঘুরে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গেই তার হৃৎস্পন্দন যেন বন্ধ হয়ে গেল, ভয়ে সারা শরীর জমে গেল পাথরের মতো।

প্রস্তরীভূত রজনের নীলচে কালো গায়ের কাছে যেন হাঁ করা গহ্বরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা দৈত্যকায় ধূসর-সবুজ প্রাণী। একটা ফাটলের ধার ঘেঁষে চুপ করে শূন্যে ঝুলে আছে বিরাট এক ডাইনোসর। নিচের হতভম্ব দলটার প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচুতে।

জন্তুটার ছায়াশরীরের ভেতর দিয়ে উঁকি মারছিল কালো পাহাড়ের গা। কিন্তু তবু ডাইনোসরের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

ঝুলে পড়া জন্তুটার বাঁকা নাক, মাথাটা তোলা। নিষ্প্রভ নিষ্ঠুর চোখ দুটি একদৃষ্টে দূরে কী যেন দেখছে। ঠোঁটহীন বিরাট মুখটার ভেতর থেকে বেরিয়ে আছে বড় বড় দাঁতের দীর্ঘ সারি। ছোট্ট কুঁজওয়ালা খাড়া পিঠটা এসে শেষ হয়েছে অবিশ্বাস্যরকম শক্তিশালী লেজে। লেজটা আবার পেছন থেকে তার ভার ধরে রেখেছে। থামের মতো পেছনের পা দুটি গাঁটের কাছে ভাঁজ করা। তারাও কম শক্তিশালী নয়। তিন আঙুলের পাতায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিরাট নখগুলো যেমন ছড়ানো, তেমনি বাঁকা। সামনের পা দুটো সরু, ঠিক গলার তল থেকেই নেমেছে, নখগুলো খুব ধারালো। বিরাট শরীর আর মস্ত মাথার তুলনায় সামনের পা দুটো অত্যন্ত ছোট।

জন্তুটার ছায়াশরীরের ভেতর দিয়ে উঁকি মারছিল কালো পাহাড়ের গা। কিন্তু তবু ডাইনোসরের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পিঠ, ফোঁটাকাটা ছোট্ট ছোট্ট হাড়ের আঁশ, রুক্ষ চামড়া, মোটা মোটা মাংসপেশী, এমনকি দুপাশের চওড়া বেগুনি রঙের দাগগুলো পর্যন্ত। অত্যন্ত সজীব ছবি। অত্যন্ত বাস্তব অথচ অশরীরী ওই ছায়াটার দিকে যে সবাই রুদ্ধ নিশ্বাসে চুপ করে চেয়ে রয়েছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

বেশ কয়েক মিনিট কেটে গেল। সূর্যের আলো মিলিয়ে এলে সেই নিস্তব্ধ ছায়াশরীরও ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার জায়গায় রইল কেবল কালো আয়নাটা। তার আগের নীলচে ভাবের জায়গায় দেখা দিয়েছে নিষ্প্রভ তামাটে আভা।

(চলবে…)

 

* ইভান ইয়েফ্রেমভ রুশ জীবাশ্মবিদ ও কল্পবিজ্ঞান লেখক। জীবাশ্মবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ট্যাফোনোমি। ফসিলের প্যাটার্ন—কোনো প্রাণী কীভাবে পচে গিয়ে জীবাশ্মে পরিণত হয় এবং এ জীবাশ্মের প্যাটার্ন কীরকম—সেসব বিষয় নিয়ে এ শাখায় আলোচনা করা হয়। ইয়েফ্রেমভের বেশ কিছু বিজ্ঞান কল্পকাহিনির একটি অনুবাদ সংকলন প্রকাশিত হয় মস্কোর ‘বিদেশি ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ থেকে। ইভান ইয়েফ্রেমভ গল্প সংকলন নামের এ বইয়ের গল্পগুলো বাংলায় অনুবাদ করেছেন শুভময় ঘোষ।