হোয়াট’স এক্সপেক্টেড অব আস

এটা একটা সতর্কবার্তা। দয়া করে মনোযোগ দিয়ে পড়ুন।

ইতিমধ্যে আপনি নিশ্চয়ই প্রেডিক্টর বা ভবিষ্যদ্বক্তা যন্ত্র দেখে ফেলেছেন। আপনি যখন এই লেখাটা পড়ছেন, তত দিনে মিলিয়ন মিলিয়ন প্রেডিক্টর যন্ত্র বিক্রি হয়ে গেছে। যারা এখনো দেখেননি, তাদের জন্য বলি। এটা একটা ছোট্ট যন্ত্র। দেখতে গাড়ির দরজা খোলার রিমোটের মতো। শুধু একটা বোতাম ও বড় সবুজ রঙের এলইডি ছাড়া আর কিছু নেই এতে। বোতামে চাপ দিলে বাতিটা জ্বলে ওঠে। ঠিক করে বললে, বোতাম চাপার সেকেন্ড–খানেক আগেই বাতিটা জ্বলে ওঠে।

প্রথম ব্যবহারের পরে অনেকেই একটা কথা বলে। তাদের কাছে পুরো ব্যাপারটা একটা উদ্ভট গেম খেলার মতো মনে হয়েছে, যেখানে মূল কাজটাই হলো বাতিটা দেখার সঙ্গে সঙ্গেই বোতামে চাপ দেওয়া। খেলাটা খুবই সহজ। কিন্তু যখনই আপনি নিয়ম ভাঙতে চাইবেন, পারবেন না। বাতি জ্বলতে না দেখেই আপনি যদি বোতামে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করেন, সঙ্গে সঙ্গেই বাতিটা জ্বলে উঠবে। যত দ্রুতই আপনি হাত নাড়ানোর চেষ্টা করেন না কেন, কোনো লাভ নেই। এক সেকেন্ড পেরোনোর আগে কোনোভাবেই বোতামে চাপ দিতে পারবেন না আপনি। আবার আপনি যদি বাতিটার জ্বলে ওঠার অপেক্ষায় থাকেন এবং ভেবে রাখেন যে বাতি জ্বললেও বোতামে চাপ দেবেন না; তাহলে বাতিটা জ্বলবেই না। সহজ কথায়, যা–ই করেন না কেন, বাতিটা সব সময় বোতামে চাপ দেওয়ার আগ দিয়েই জ্বলবে। প্রেডিক্টরকে বোকা বানানোর আসলে কোনো উপায় নেই।

প্রতিটা প্রেডিক্টরের কেন্দ্রে আছে ঋণাত্মক সময়ক্ষেপণে সক্ষম একটি সার্কিট। এটি সময়ের উল্টো দিকে সিগন্যাল পাঠায়। কিছুদিন পর এই ঋণাত্মক সময়ক্ষেপণের মান এক সেকেন্ডের বেশি করা গেলেই কেবল এই প্রযুক্তির পূর্ণাঙ্গ তাৎপর্য বোঝা যাবে। কিন্তু এই সতর্কবার্তাটা সেটা নিয়ে নয়। মূল সমস্যাটা হলো, প্রেডিক্টর আমাদের স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছে, স্বাধীন ইচ্ছা নামের কোনো কিছুর আসলে অস্তিত্বই নেই।

স্বাধীন ইচ্ছার পুরো ব্যাপারটাই যে একটা বিভ্রম, সেটা নিয়ে প্রাচীনকাল থেকেই নানা ধরনের তর্কবিতর্ক হয়ে এসেছে। এর কিছু ছিল পুরোপুরি পদার্থবিজ্ঞাননির্ভর, আবার কিছু ছিল খাঁটি যুক্তিনির্ভর। যুক্তিগুলো যে অকাট্য, এ ব্যাপারে বেশির ভাগ মানুষ একমত হলেও যৌক্তিক সিদ্ধান্তটা কেউই সত্যিকার অর্থে মেনে নেয়নি। স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা এতই শক্তিশালী যে শুধু যুক্তি দিয়ে এটা বাতিল করে দেওয়া সম্ভব নয়। দরকার ছিল সুস্পষ্ট প্রমাণ। আর প্রেডিক্টর সেটাই করে দেখিয়েছে।

স্বাধীন ইচ্ছার পুরো ব্যাপারটাই যে একটা বিভ্রম, সেটা নিয়ে প্রাচীনকাল থেকেই নানা ধরনের তর্কবিতর্ক হয়ে এসেছে। এর কিছু ছিল পুরোপুরি পদার্থবিজ্ঞাননির্ভর, আবার কিছু ছিল খাঁটি যুক্তিনির্ভর

সাধারণত একজন মানুষ প্রেডিক্টর নিয়ে কয়েক দিন টানা ঘোরগ্রস্তের মতো খেলতে থাকে। বন্ধুবান্ধবকে দেখায়, যন্ত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিয়ম ভাঙার নানা রকম চেষ্টা করে। তারপর মানুষটা হয়তো এতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, কিন্তু এর সত্যিকার অর্থটা কেউই ভুলতে পারে না। পরের কয়েক সপ্তাহ ধরে অপরিবর্তনীয় ভবিষ্যতের ধারণাটা মানুষের মাথায় ধীরে ধীরে গেড়ে বসে। তাদের পছন্দ-অপছন্দ, অনেকগুলো থেকে একটা কিছু বেছে নেওয়াটা যে আসলে নিরর্থক, এটা বুঝতে পেরে কেউ কেউ সিদ্ধান্ত নেওয়াই বন্ধ করে দেয়। বার্টলবাই, দ্য স্ক্রিভেনার গল্পের লোকজন যেমন স্বেচ্ছায় কিছু করা বন্ধ করে দিয়েছিল, এরা সে রকম করতে থাকে। পরবর্তী সময়ে প্রেডিক্টর ব্যবহারকারীদের এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করতেই হয়, কারণ, তারা খাওয়াদাওয়াও বন্ধ করে দেয়। শেষ পর্যন্ত জিনিসটা এসে থামে অ্যাকিনেটিক মিউটিজমে। অর্থাৎ নড়াচড়া বা কথাবার্তা, সব বন্ধ করে নিশ্চল পড়ে থাকে এরা। একরকম জাগ্রত কোমা বলা যায়। সামনে কোনো কিছু নড়লে-চড়লে এরা চোখ নাড়িয়ে দেখে, মাঝেমধ্যে শোয়ার ভঙ্গি বদলায়। এটুকুই। আর কিছুই করে না। নড়াচড়ার শক্তি তাদের থাকে ঠিকই, কিন্তু ইচ্ছাটা চলে যায়।

কোনো ডাক্তার হয়তো বলত, ‘তুমি আজ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছ, সেটা যতটা স্বাধীনভাবে নিয়েছ; এক মাস আগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তো এর চেয়ে বেশি স্বাধীনতা ছিল না, তাই না? এখনো তুমি সেভাবেই সবকিছু করতে পারো

প্রেডিক্টর নিয়ে খেলার আগে অ্যাকিনেটিক মিউটিজম ছিল বিরল। মস্তিষ্কের কর্পাস ক্যালোসামের (মানুষের মস্তিষ্কের ডান আর বাঁ পাশের মধ্যকার যোগসূত্র) সামনের দিকে, অ্যান্টেরিওর সিঙ্গুলেট অঞ্চলে কোনো ধরনের ক্ষতি হলে এ রকমটা হয়। আর এখন এটা কগনিটিভ প্লেগের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। আগে লোকজন এমন সব ভাবনা নিয়ে কানাঘুষা করত, যেটা মানুষকে ধ্বংস করে দিতে পারে। অবর্ণনীয় কোনো লাভক্রাফটিয়ান হরর বা গোডেল সেন্টেন্সের মতো কিছু, যেটা মানুষের যৌক্তিক বিচারবুদ্ধি নষ্ট করে ফেলে। দেখা গেল, আমরা বরং স্বয়ং ভাবনারই অসাড় হয়ে যাওয়া নিয়ে সমস্যায় পড়েছি। স্বাধীন ইচ্ছার অস্তিত্ব নেই, এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে, গেড়ে বসছে আমাদের মাথায়। যতক্ষণ কেউ সেটা বিশ্বাস করছে না, ততক্ষণ কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু বিশ্বাস করলেই শেষ!

রোগীরা যতক্ষণ কথা শুনে সাড়া দিত, ডাক্তাররা তাদের যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করত। তাদের কথা ছিল, আমরা সবাই যখন সুখী ও কর্মময় জীবন যাপন করছিলাম, তখনো তো আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা ছিল না। তাহলে এখন কোনো কিছু পাল্টাবে কেন? কোনো ডাক্তার হয়তো বলত, ‘তুমি আজ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছ, সেটা যতটা স্বাধীনভাবে নিয়েছ; এক মাস আগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তো এর চেয়ে বেশি স্বাধীনতা ছিল না, তাই না? এখনো তুমি সেভাবেই সবকিছু করতে পারো।’ রোগী একই জবাব দিত, ‘কিন্তু এখন আমি সেটা জানি।’ এদের কেউ কেউ এরপর আর কক্ষনো কিছু বলেনি।

কেউ কেউ যুক্তি দিতে পারে, আচরণের এই পরিবর্তন, এটাই তো প্রমাণ করে আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা আছে। একটা স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া তো আর নিরুৎসাহিত করা যায় না। স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি থাকলেই কেবল সেটা সম্ভব। কেউ কেউ অ্যাকিনেটিক মিউটিজমের খাদে পড়ে যাচ্ছে, আর কেউ কেউ পড়ছে না—এটাই তো সিদ্ধান্ত নেওয়ার গুরুত্ব স্পষ্ট করে দেয়।

দুঃখের কথা হলো, এই যুক্তিতে ভুল আছে। যেকোনো ধরনের আচরণই নিয়তিবাদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। একটা পরিবর্তনশীল সিস্টেম (মানে একজন মানুষ) হয়তো এক ধরনের আচরণকে আকর্ষণ করে একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে গিয়ে পড়বে, আবার অন্য আরেকটা সিস্টেম হয়তো প্রচণ্ড এলোমেলো, বিশৃঙ্খল আচরণ বেছে নেবে অনির্দিষ্টকালের জন্য। কিন্তু দুটি জিনিসই নিয়তি দিয়ে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত হতে পারে।

এই সতর্কবার্তাটা আমি আপনাদের এক বছর ভবিষ্যৎ থেকে পাঠাচ্ছি। এটা আসলে মেগাসেকেন্ড পরিসরের ঋণাত্মক সময়ক্ষেপণে সক্ষম সার্কিট ব্যবহার করে যোগাযোগযন্ত্র বানানোর পর গৃহীত প্রথম দীর্ঘ বার্তা। অন্যান্য বিষয় নিয়ে পরে আরও কিছু বার্তা যাবে। আপনাদের জন্য আমার বার্তা হলো, ভান করুন, আপনার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে। আপনার সিদ্ধান্ত যে নিরর্থক, সেটা জেনেও; এরা যে অর্থহীন নয়, এদের যে গুরুত্ব আছে—সেভাবে ভাবা এবং আচরণ করাটা গুরুত্বপূর্ণ। এখন আর বাস্তবতা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, বিশ্বাসটা গুরুত্বপূর্ণ। আর এই মিথ্যাটা বিশ্বাস করাই জাগ্রত কোমা এড়ানোর একমাত্র উপায়। পুরো সভ্যতা এখন আত্মপ্রতারণা-নির্ভর হয়ে পড়েছে। হয়তো সব সময় তা-ই ছিল।

স্বাধীন ইচ্ছা যেহেতু কেবলই বিভ্রম, তাই আমি নিজেও খুব ভালো করেই জানি, কারা অ্যাকিনেটিক মিউটিজমের খাদে পড়বে আর কারা পড়বে না, সেটা পূর্বনির্ধারিত। এ ব্যাপারে কারোরই কিছু করার নেই। প্রেডিক্টর আপনার ওপরে কী প্রভাব ফেলবে, সেটা আপনি চাইলেও বেছে নিতে পারবেন না। কেউ কেউ এর হাত ধরে তলিয়ে যাবে, কেউ কেউ হয়তো টিকে যাবে কোনোভাবে। আমি যে আপনাদের কাছে এই বার্তা পাঠাচ্ছি, তাতে এসবের কিছুই বদলাবে না। তাহলে পাঠালাম কেন?

কারণ, এটা আমার হাতে ছিল না।