নিকিতিনের মুখ দিয়ে একটা চাপা চিৎকার বেরিয়ে এল। তাড়াতাড়ি সে দুহাত দিয়ে তার কপাল চেপে ধরল, যেন হঠাৎ যে কথাটা তার মাথায় এসেছে, সেটাকে বন্ধ করে রাখতে চায়।
‘ওপর থেকে পড়া আলোয় নির্দিষ্ট কোণ থেকে যখন পাওয়া ছবিটিকে পরীক্ষা করে দেখা হলো, একটা অত্যন্ত সুন্দর আর কৌতূহলোদ্দীপক দৃশ্য চোখে পড়ল। এই ঘটনাটাকে রঙিন চক্রের প্রভাব সম্পর্কে নিউটনের মতবাদের সঙ্গে যুক্ত করা উচিত। রজনের (এসফল্ট রজন) ওপর বর্ণালির নির্দিষ্ট কোনো অংশের ক্রিয়া সম্ভব, ফলে স্তরের ঘনত্বের সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটে…’
ডাইনোসরের অশরীরী ছায়ার ব্যাখ্যার দুর্মূল্য সূত্র এভাবে জট খুলে এগিয়ে চলল। শুরুতে যা ছিল ক্ষীণ ও পলকা, সেটাই ক্রমে আরও শক্ত আর নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠল।
নিকিতিন প্রায় দৌড়েই তার ইনস্টিটিউটে চলে গেল। গত তিন মাস বৃথা যায়নি। তার পথ এখন পরিষ্কার হয়ে উঠেছে—যে দক্ষ দৃষ্টিবিদ, পদার্থবিদ আর ফোটোগ্রাফাররা তাকে সাহায্য করেছেন তাঁদের ধন্যবাদ।
পড়তে পড়তে নিকিতিন আবিষ্কার করল, স্থায়ী আলোক তরঙ্গের প্রক্রিয়ায় ফটোগ্রাফিক প্লেটের মসৃণ গায়ে বদল ঘটে। এই তরঙ্গগুলো নির্দিষ্ট রঙিন ছবি তৈরি করে। সিলভার ব্রমাইড লাগানো ফটোগ্রাফিক প্লেটে আলোর রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ফলে সাধারণত সাদাকালোয় যে ছবি ফুটে ওঠে, তা থেকে তার এই ছবি স্বতন্ত্র। আলোক তরঙ্গের এই জটিল প্রতিফলন, তরঙ্গগুলো খুব বড় আকারে বাড়িয়ে দেখলেও অদৃশ্য থেকে যায়। এই প্রতিফলনের ছবির একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য আছে—এরা কেবল একটি নির্দিষ্ট রঙের আলোই প্রতিফলিত করে। তাও যখন প্রোটোটাইপটিতে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট কোণ থেকে আলো এসে পড়ে। এই সব ছায়া মিলেমিশে স্বাভাবিক রঙের একটি চমৎকার ছবি পাওয়া যায়।
নিকিতিন বুঝতে পারল, স্বাভাবিক অবস্থায় বিশেষ বস্তুর ওপর আলোর সরাসরি প্রক্রিয়া সম্ভব। এ অবস্থায় আলো রূপের সংহতি ভেঙে না ফেলেও ছবি রচনা করতে পারে। নিকিতিনের চিন্তাধারায় ঠিক এই ফাঁকটাই থেকে গিয়েছিল।
বাড়ির চাল থেকে বরফ গলে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ছে। নিকিতিন প্রায় দৌড়েই তার ইনস্টিটিউটে চলে গেল। গত তিন মাস বৃথা যায়নি। তার পথ এখন পরিষ্কার হয়ে উঠেছে—যে দক্ষ দৃষ্টিবিদ, পদার্থবিদ আর ফোটোগ্রাফাররা তাকে সাহায্য করেছেন তাঁদের ধন্যবাদ। আজ সে এই প্রথম বৈজ্ঞানিকদের কাছে এই সংবাদ প্রকাশ করবে।
বক্তৃতার বিষয় আর নিকিতিনের নাম দেখে অনেক শ্রোতা জুটেছে। তরুণ জীবাশ্মবিদ নিকিতিন যখন ডাইনোসরের অশরীরী ছায়ার কথা জানাল, শ্রোতাদের মুখে তখন অবিশ্বাসের হাসি ফুটে উঠল, কিছুটা মজারও। নিকিতিনের ভুরু কুঁচকে গেল কিন্তু তবু সে ধীরে ধীরে স্পষ্ট করে তার যা বক্তব্য বলে যেতে লাগল:
‘প্রস্তরীভূত রজনের সেই সদ্য কাটা স্তর, মনে হয় ক্রেটাকিয়াস পর্বের ইতিহাসের একটি মুহূর্তের আলোক ছায়া ধরে রেখেছে। কালো আয়নাটা একটি নির্দিষ্ট কোণ থেকে প্রজেক্টরের মতো আলোকরশ্মি প্রতিফলিত করেছে। তার ফলে মরীচিকা সৃষ্টি করতে পারে এমন বায়ু তরঙ্গে জ্যান্ত ডাইনোসরের খাড়া বিরাট ছবি ফুটে উঠেছে।
‘রজনের ওপর আলোকছায়া ফুটিয়ে তুলতে যে দীর্ঘ এক্সপোজারের প্রয়োজন হয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এও হতে পারে, সে যুগের গ্রীষ্মপ্রধান আবহাওয়ায় সূর্যের আলোকক্ষমতা আরও বেশি ছিল; কিংবা ডাইনোসররাও আধুনিক কালের বড় বড় সরীসৃপ—কুমির, কচ্ছপ, সাপ আর বড় গিরগিটির মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকত। সরীসৃপরা স্তন্যপায়ী জন্তুদের মতো এত চটপটে নয়, তাদের প্রাণশক্তিও তুলনায় কম। এই সম্ভাবনাটা শুধু তত্ত্বীয় নয়, আমাদের ডাইনোসরই তা প্রমাণ করেছে।
‘আমার হিসাব অনুযায়ী দুটি পাহাড়ে স্তম্ভের তল থেকে, সাড়ে চারশ ফুট দূর থেকে, ডাইনোসরটার ছবি তোলা হয়েছে, মানে ছবি উঠেছে।’
বোর্ডের ওপর লাগানো ওই অঞ্চলের বিরাট ম্যাপটা দেখিয়ে নিকিতিন বলল:
‘জোর আলো, মেঘের খেলা, বা অন্য কোনো উপায়ে পাওয়া এই ছবি বোধহয় সঙ্গে সঙ্গেই রজনের পরবর্তী স্তরে চাপা পড়ে সংরক্ষিত থেকে যায়। জলাশয়ে বিস্ফোরণ ঘটানোর ফলে ওপরের স্তরগুলো খসে গিয়ে ছবিটা বেরিয়ে পড়ে।’
সুপ্রাচীন ফটোগ্রাফের উপযোগী যে পরিবেশ বা অবস্থার প্রয়োজন, তা অত্যন্ত জটিল ও দুর্লভ। তাই এই ছবিও অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু অতীতের অনন্ত যাত্রায় বেশ কিছু ছবি নিশ্চয়ই জমা হয়েছে।
নিজের উত্তেজনাকে প্রশমিত করার জন্য নিকিতিন একটু থেমে আবার বলে চলল:
‘মানবজাতির ইতিহাসে এই প্রথম অল্প কয়েকজন লোক প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর সজীব চিত্র দেখতে পেল, এ ঘটনাটা খুব উল্লেখযোগ্য হলেও শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, এটাই সবচেয়ে বড় কথা নয়। আসল কথা হলো, ওরোজেনিক বস্তুতে প্রাগৈতিহাসিক যুগের ছবির অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়েছে। সেই অতীতের ছায়া কোটি কোটি বছর ধরে, সত্যি সত্যিই স্মৃতির অতীতকাল পার হয়ে আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। এদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানতাম না। কখনও এদের খোঁজও করিনি, কারণ প্রকৃতি যে নিজেই ছবি তুলে রাখতে সক্ষম, একথা কারও মাথায় আসেনি।
‘এই সুপ্রাচীন ফটোগ্রাফের উপযোগী যে পরিবেশ বা অবস্থার প্রয়োজন, তা অত্যন্ত জটিল ও দুর্লভ। তাই এই ছবিও অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু অতীতের অনন্ত যাত্রায় বেশ কিছু ছবি নিশ্চয়ই জমা হয়েছে। একথা তো আমরা জানি, জীবাশ্ম সংক্রান্ত যা কিছু আমরা পেয়েছি তা সবই দুর্লভ অবস্থাসংযোগেরই ফল। কিন্তু তবু লুপ্ত প্রাণী সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান বেশ ব্যাপক, জীবাশ্মবিদ্যা সংক্রান্ত অনুসন্ধানের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টান্তের সংখ্যাও ক্রমশ বেড়ে চলেছে।’