সবার বুক থেকে একসঙ্গে ফেটে পড়ল রুদ্ধ নিঃশ্বাস। নিকিতিন তার শুকনো ঠোঁটদুটো জিভ দিয়ে চেটে নিল।
অনেকক্ষণ পর্যন্ত কারো মুখ দিয়ে কোনো কথা সরল না। প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা আর শিক্ষার ফলে জগৎ সম্পর্কে যে ধারণা এদের হয়েছে, এই অবিশ্বাস্য ছায়াশরীর তা একেবারে তছনছ করে দিয়েছে। সবার মনে হলো, এই অলৌকিক ঘটনায় তাদের জীবনের ধারাটা বুঝি সম্পূর্ণ উল্টে-পাল্টে গেল। অদ্ভুত দৃশ্যটা দেখে নিকিতিনই সবচেয়ে বেশি বিচলিত হয়েছিল। নিকিতিন বৈজ্ঞানিক, প্রকৃতির ধাঁধার বিশ্লেষণ ও সমাধান করা তার অভ্যাসের গভীরে শিকড় গেড়েছে। অথচ এখন এই অলৌকিক ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে সে অক্ষম।
সবাই একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগল। রাতে বহুক্ষণ পর্যন্ত ক্যাম্পের সবাই জেগে বসে ওই কথাই আলোচনা করল। শেষে নিকিতিন সবাইকে শান্ত করে বলল, এই মরীচিকার দেশে টিরানোসরের ছায়া দেখা কিছু অসম্ভব ব্যাপার নয়।
বাড়ি ফেরার দীর্ঘযাত্রার আগে ড্রাইভার গাড়ির ইঞ্জিন পরখ করে দেখছে। সমতলের খয়েরি নুড়িভরা জমির ওপরে দেখা দিয়েছে একটা নীলচে কুয়াশা।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিকিতিন দ্রুত পায়ে সরু গলিটার দিকে এগিয়ে গেল।
কালো আয়নাটা তার দিকে গভীর, দৃষ্টিহীন চোখে তাকিয়ে। উপত্যকার সেই সুন্দর নিস্তব্ধতা আর নেই—পেছনের সমতল থেকে ভেসে আসছে ইঞ্জিনের শব্দ। নিকিতিনের মনে একটা অপূরণীয় ক্ষতির বোধ। শুধু শুধু সে গতদিনের অশরীরী ছায়ার আশায় দাঁড়িয়ে রইল। সেই ছায়া আর দেখা দিল না। হয়তো তার আসার ঠিক সময়টা সে আঁচ করতে পারেনি; হয়তো নিকিতিনের আসতে অনেক দেরী হয়ে গেছে।
গভীর ক্ষোভের সঙ্গে নিকিতিন আয়নার পায়ের কাছে ভাঙা পাথরের স্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। অনেকক্ষণ পর হঠাৎ তার খেয়াল হলো, পেছনে বালি মাড়িয়ে কে যেন আসছে। মিরিয়াম।
‘মার্তিন মার্তিনভিচ বলল সব প্রস্তুত,’ নিকিতিনের কাছে এগিয়ে এসে মিরিয়াম হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। ‘আমি আপনাকে ডাকতে এলাম। সেই ফাঁকে আরেকবার দেখে যাব...’
‘এক্ষুণি যাচ্ছি,’ নিকিতিন বেশ অনিচ্ছার সঙ্গে বলল, ‘একটুখানি দাঁড়ান, মিরিয়াম!’
মিরিয়ামও এগিয়ে এসে কালো আয়নাটার দিকে স্থিরদৃষ্টে চেয়ে রইল।
‘ফিরে গিয়ে আপনি কী করবেন, মিরিয়াম?’ নিকিতিন হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।
‘কাজ করব আর পড়ব,’ খুব সংক্ষেপে জবাব দিল মিরিয়াম, ‘আপনি?’
‘আমিও আমার ডাইনোসরদের নিয়ে কাজ করব আর ভাবব...’
নিকিতিনের কথা ঠেকে গেল। তবু সে শেষ পর্যন্ত বলে ফেলল, ‘ভাবব আপনার কথা!’
মিরিয়াম মাথা নামিয়ে চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘আমি আপনার জায়গায় হলে কালকের সেই অশরীরী ছায়ার কথা ছাড়া আর কোনো কিছু ভাবতাম না। কালকের ওটা কিন্তু মরীচিকা নয়।’
‘আমি তা জানি!’ নিকিতিন ক্ষুব্ধভাবে বলল, ‘কিন্তু আমি তো পদার্থবিদ নই, আমি জীবাশ্মবিদ। শুধু যদি...’
নিজের প্রতি কেমন একটা অস্পষ্ট বিরক্তির ফলে নিকিতিন হঠাৎ থেমে গেল। প্রস্তরীভূত রজনের সেই অপূর্ব খণ্ডটার দিকে এগিয়ে গিয়ে সে অনেকক্ষণ ধরে স্থিরদৃষ্টে তার কালো, নিষ্প্রাণ ত্বকের দিকে চেয়ে রইল। একমুহূর্তের জন্য মানুষের চোখের সামনে খুলে গিয়েছিল কালের দুর্ভেদ্য পর্দা। সারা মানবজাতির মধ্যে কেবল সে আর তার বন্ধুরাই তা দেখতে পেয়েছিল। তাদের মধ্যে একমাত্র সে-ই প্রয়োজনীয় জ্ঞান আর অভিজ্ঞতার অধিকারী। মিরিয়াম ঠিকই বলেছে... প্রকৃতির রহস্যের মর্মভেদ তারই কর্তব্য।
হঠাৎ নিকিতিনের মনে হলো, সে যেন রূপালি ছায়া দেখছে... আয়নার কালো গভীরতা থেকে তারা ভেসে আসছে। নিকিতিন মন দিয়ে ভালো করে ব্যাপারটা দেখতে লাগল। বিচ্ছিন্ন অংশগুলো জুড়ে গিয়ে একটা মূর্তি গড়ে উঠেছে—যেন মস্তবড় একটা ফটো, কিন্তু সেটা ভালো করে ডেভেলপ করা হয়নি। মাঝখানে রয়েছে উল্টো করা একটা টিরানোসরের ছবি, আগের দিনেরটার চেয়ে অনেক ছোট। বাঁদিকে অতিকায় গাছের ঝাড়। পেছনে পাহাড়ের অস্পষ্ট রেখা।
মিরিয়ামের দিকে একবার তাকিয়ে নিকিতিন চট করে তার নোটবইটা বের করে নিল। মিরিয়ামও তখন মন্ত্রমুগ্ধের মতো আয়নাটার দিকে তাকিয়ে। নিকিতিন আয়নার দৃশ্যটা তার খাতায় এঁকে নিতে লাগল, কিন্তু সেই রূপালি ধূসর ছায়া আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হলো না। কিছুক্ষণ পরেই তার ক্লান্ত চোখের সামনে ফুটে উঠল কতগুলো উজ্জল ফোঁটা আর সর্পিল রেখা। কালো আয়নাটা আবার ফাঁকা হয়ে গেল।
নিকিতিন আর কিছুতেই নিজেকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে না। সে বেশ বুঝতে পারছে, এখানে আরও কয়েকদিন থেকে এই জাদু-দর্পণের ছবিগুলোর বিবরণ তার লিখে রাখা উচিৎ।
ভাগ্যের খেয়ালের ফলে সে হঠাৎ এক অদ্ভুত ঘটনার সামনে এসে পড়েছে। আর কদিন পরেই হয়তো রোদ আর হাওয়ায় এই রজন পাথরটার মসৃণ গা যাবে নষ্ট হয়ে। এই ধাঁধারও তবে আর কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না। এই সুযোগ নিয়ে মানবজাতির উপকার করা তার অবশ্য কর্তব্য—তার চেয়েও বেশি, তার জীবনের মহত্তম কাজ।