গ্যাবি ঘুম থেকে উঠে দেখল, তার ঘরে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। সবাইকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে একটু কেশে বলে, ‘আজ কি সেই দিন?’
লোকগুলোর মুখের কোণে এক সূক্ষ্ম হাসি। গ্যাবি বুঝতে পারে, আজই সেই দিন।
‘গ্যাব্রিয়েলা, তুমি প্রস্তুত?’ ওপরের রেডিয়েশন অ্যাবসর্বেন্ট চেম্বারে বসে ক্যাপ্টেন মিলার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সব প্রক্রিয়া তদারক করছেন। ‘ইয়েস, ক্যাপ্টেন’। ক্যাপসুলের ভেতর থেকে গ্যাবি জবাব দেয়। সে টাইটেনিয়াম-সিলজিনিয়াম ধাতুর অ্যালয়ে তৈরি একটি গোলাকার ক্যাপসুলের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে পরানো হয়েছে এক বিশেষ ধরনের পোশাক। শরীরের বিভিন্ন অংশে দেওয়া হয়েছে অনেকগুলো ইনজেকশন। ক্যাপসুলটির ভেতরে থাকা হেলমেটের মতো একটি কন্ট্রোলার আছে। গ্যাবি সেটা পরে নেয়।
‘গ্যাব্রিয়েলা, তোমাকে আমরা এক দিন আগে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আগে গিয়ে তুমি পাঁচ মিনিটের মতো হাঁটবে। তোমার কন্ট্রোলারের অটোমেটিক পোর্টেশন সিস্টেমের মাধ্যমে আমরা তোমাকে সহজেই আবার এই সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসব। বুঝতে পেরেছ?’
‘জি, ক্যাপ্টেন।’
‘সবাই প্রসিডিউর শুরু করো।’
ক্লারা টাইম ক্যাপসুলের ভেতরে বসে থাকা গ্যাবিকে সুপার কন্ডাক্টিং ম্যাগনেট দিয়ে লেভিটেট করে। এদিকে মার্কের দায়িত্ব একটু আলাদা। ক্যাপসুলের ভেতরের সিলিংয়ে লাগানো আছে সিলভারের একটি ছোট্ট অ্যাম্পুল। মার্ক প্রায় ২০০টি লেজারের রশ্মি নিক্ষেপ করে। এতে ফিউশনের মাধ্যমে তৈরি হয় বিপুল শক্তি। সেই শক্তি কেন্দ্রীভূত হয় ক্যাপসুলের ভেতরে, একটি অতি ক্ষুদ্র বিন্দুতে। ক্যাপসুলের ভেতরে শূন্যে ভাসা গ্যাবির চারদিকে একধরনের সুরক্ষাবলয় তৈরি করা হয়। বলয়টির কারণে গ্যাবির সঙ্গে পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। কেন্দ্রীভূত হওয়া সেই শক্তি স্পেস টাইম ফাইবারে একটি ছিদ্র তৈরি করবে।
হঠাৎ ক্যাপ্টেন চিৎকার করেন, ‘হয়েছে! স্পেস টাইমে একটি ছিদ্র হয়েছে! এক্স-রের স্পেকট্রাম রিডারে দেখা যাচ্ছে। ক্লারা, গ্যাব্রিয়েলাকে ছিদ্রের ভেতর ঢুকিয়ে দাও।’
ক্লারা তখন গ্যাবিকে সেই ছিদ্রের ভেতর ধীরে ধীরে নির্দিষ্ট ত্বরণে ঢুকিয়ে দেয়। এই ত্বরণই নির্ধারণ করবে গ্যাবিকে কতটা পেছনে নিয়ে যাওয়া হবে। ক্যাপসুলের বলয়ের ভেতরে মুখ ছাড়া শরীরের কোথাও কোনো অনুভূতি পাচ্ছে না। হঠাৎই সে কোথাও ধপ করে পড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর নিজেকে আবিষ্কার করে খোলা মাঠে। তার মানে, যেখানে যাওয়ার কথা, সেখানে পৌঁছাতে পারেনি!
‘গ্যাব্রিয়েলা, তুমি শুনতে পাচ্ছ? গ্যাব্রিয়েলা?’
‘ইয়েস, ক্যাপ্টেন। শুনতে পারছি। আমি কোথায় এখন?’ চারপাশটা ভালোভাবে দেখে জবাব দেয় গ্যাবি।
‘তোমাকে আমরা লোকেট করতে পারছি না। তুমি...গ্যাব্রিয়েলা শুনতে পাচ্ছ...। তুমি এক্ষুনি...তোমার...না হলে ইপিআর প্যারা...’
গ্যাবি বুঝতে পারে, ক্যাপ্টেনের সঙ্গে তার যোগাযোগ বিছিন্ন হয়েছে। তখনই তার কন্ট্রোলার তার চোখ দুটি ঢেকে দেয়। সে অনুধাবন করে, সে আবার শূন্যে ভাসছে।
মাথা ছাড়া শরীরের আর কোনো অঙ্গে জোর পাচ্ছে না গ্যাবি। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর অনুভব করে, মস্তিষ্কও যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
গ্যাবির চোখ খোলে ওর মায়ের গলা শুনে। সে দেখে, তার হাতে একটি দুধের ফিডার। সর্বনাশ! অতীতে ফিরতে গিয়ে একেবারে মায়ের কোলে ফিরে গেছে। তার সবকিছুই শিশুদের মতো। কিন্তু মগজটা বড়দের মতো। সবকিছু ভাবতে পারছে, বুঝতেও পারছে। প্রচণ্ড ঘাবড়ে যায় গ্যাবি? কী করবে এখন। মাথার পেছন দিকে একটা কন্ট্রোলার লাগানো। কিন্তু অজানা কারণে তার মা সেটা দেখতে পারছেন না। হঠাৎ চেষ্টা করে সুইচে চাপ দেওয়ার। সফল হয়। এ স্থান-কাল থেকে বের হতে পারবে। কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টা করেও সুইচ অবধি তার ছোট্ট হাত পৌঁছায় না। সে আবার দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। হঠাৎ সে তার হাতের পাশে পড়ে থাকা ফিডারটা লক্ষ করে। ওটার সাহায্যেই সুইচে চাপ দেয়। তখন হঠাৎ চারদিক অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে যায় গ্যাবির। মাথাব্যথা করছে। চোখ খোলা, তবু পরিষ্কারভাবে দেখতে পারছে না। পরক্ষণেই সে লক্ষ করে, তার নাকের ডগায় একটি চশমা ঝুলে আছে। চশমাটা ঠিক করে পরে নেয় গ্যাবি। তখন ঝাপসা দৃশ্যগুলো পরিষ্কার হয়ে ওঠে। সামনে একটা বাগান। হরেক রকম ফুল ফুটে আছে। দুটি ছোট ছেলেমেয়ে খেলে বেড়াচ্ছে। অন্য কেউ যদি দেখত, তাহলে দেখত, হুইলচেয়ারে বসে আছেন এক বৃদ্ধা। তার সাদা চুলগুলো উড়ে উড়ে মুখে গিয়ে পড়ছে বারবার। সেই বৃদ্ধাই আসলে গ্যাব্রিয়েলা নিজে। নিজের শীর্ণ হাত দিয়ে কন্ট্রোলারের সুইচে চাপ দেয়। আবার তার চারপাশে অন্ধকার নেমে আসে।
আবার চোখ খুলে গ্যাবি অনুভব করে, একটা তরল পদার্থের মধ্যে ভাসছে সে। এবার কোথায় এসে পড়েছে বুঝতে পারে না। কিন্তু বুঝতে পারে, ইপিআর প্যারাডক্সের ভেতর তলিয়ে গেছে সে। চোখ খোলার চেষ্টা করে আবার। কিন্তু কিছুতেই চোখ খুলতে পারে না। তবে বাবার গলার আওয়াজ শুনতে পায়। যেন বহুদূর থেকে আসছে সে আওয়াজ। এতক্ষণ যে ভাবনা-দুর্ভাবনাতেও আসেনি, সেই ভাবনা সত্যি হয়েছে। সে আসলে এখন মায়ের গর্ভে। পরক্ষণেই সে কাঁপতে লাগল। কেন কাঁপছে, সেটা বুঝে ওঠার আগেই তার কন্ট্রোলারের সুইচে চাপ পড়ে। তারপর আবার এক অতল অন্ধকার গহ্বরে যেন তলিয়ে যায়।
মাথা ছাড়া শরীরের আর কোনো অঙ্গে জোর পাচ্ছে না গ্যাবি। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর অনুভব করে, মস্তিষ্কও যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। টাইম আর রিয়েলিটির মধ্যে তার অস্তিত্ব লোপ পাচ্ছে ধীরে ধীরে। নিজেকে অতি ক্ষুদ্র, অতি সূক্ষ্ম, অতি দুর্বল মনে হয় তার। বুঝতে পারে, এমন এক জগতে পতিত হচ্ছে যেখানে সময়, বাস্তব জগৎ—কিছুই কাজ করে না। সাব–অ্যাটমিক কোয়ান্টাম রিয়েলিটিতে পৌঁছে গেছে। হঠাৎ সে একটা আলোর কিরণ দেখতে পায়। তারপর আবার জেগে ওঠে।
গ্যাবি তার মায়ের হাতে হাত রাখতেই, চারদিক আবার আলোকিত হয়ে গেল। জ্ঞান হারানোর আগে গ্যাবি ক্যাপ্টেন আর তার সহকর্মীদের উল্লাস শুনতে পায়।
এবার আর বেশি পেছনে যেতে হয়নি গ্যাবিকে। পাঁচ বছর আগে হারানো পরিবারকে দেখতে পায়। কিন্তু অতীতের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া তার মা-বাবাও যেন কীভাবে কীভাবে জেনে গেছে, গ্যাবি টাইম ট্রাভেল করছে।
‘গ্যাবি, মা আমার, তুই চলে যা।’ অনুনয় করেন ওর মা।
বাবাও মুখ খোলেন, ‘হ্যাঁ, মা। তুই চলে যা। আমরা জানি, তুই আমাদের ফিরিয়ে আনতেই এ কাজ করেছিস।’
‘কিন্তু তোমাদের ছাড়া তো আমি থাকতে পারছি না।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে গ্যাবি। ‘আমি জেনেশুনেই এখানে এসেছি। কিন্তু কী যে হয়ে গেল? আমি যেতে চেয়েছিলাম সেই দিন, যেদিন আমার জন্য তোমরা মারা গিয়েছিলে। কিন্তু কোথায় কোন সময় এসে পড়লাম বুঝতে পারছি না।’
‘মা, সেটা নিছক এক দুর্ঘটনা ছিল। তাতে তোর তো কোনো দোষ ছিল না। তুই চলে যা মা, জেদ করিস না।’ গ্যাবির বাবা বলেন।
‘নে মা, আমার হাতটা ধর।’
গ্যাবি তার মায়ের হাতে হাত রাখতেই, চারদিক আবার আলোকিত হয়ে গেল। জ্ঞান হারানোর আগে গ্যাবি ক্যাপ্টেন আর তার সহকর্মীদের উল্লাস শুনতে পায়।
‘শাবাশ গ্যাব্রিয়েলা! তুমি ইপিআরকে হারিয়ে দিলে!’
লেখক: শিক্ষার্থী, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা