ওরা

অতিথিকে চিড়িয়াখানা ও গবেষণাকেন্দ্র ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে তাঁকে ভালো করে লক্ষ করছিলেন জীববিজ্ঞানী। অতিথি এসেছেন কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে, তাঁদের কাজের অগ্রগতি তদারকির জন্য।

মনোযোগ দিয়ে সবকিছু দেখছিলেন অতিথি। বিজ্ঞানীর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘বেশ ভালো কাজ করছেন আপনারা। এত বিলুপ্ত প্রজাতির প্রাণীকে নতুন করে কৃত্রিমভাবে বানানো আসলেই পরিশ্রমের কাজ।’

‘আমাদের যে পরিমাণ অর্থ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তাতে এর চেয়ে বেশি প্রাণী বানানো সম্ভব ছিল না, স্যার। তারপরও আপনার প্রশংসা শুনে ভালো লাগল,’ এই বলে একটু থামলেন জীববিজ্ঞানী। এরপর আবার বলতে শুরু করলেন, ‘আমরা শুধু উঁচু স্তরের বিলুপ্ত জীবগুলো কৃত্রিমভাবে বানানোর চেষ্টা করছি; যারা হারিয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর বুক থেকে। আমাদের পৃথিবীর অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে, সেই ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি!’

অতিথিকে চিড়িয়াখানা ও গবেষণাকেন্দ্র ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে তাঁকে ভালো করে লক্ষ করছিলেন জীববিজ্ঞানী। অতিথি এসেছেন কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে

অতিথি তখন পরিখা ও কৃত্রিম আবরণের ওপারে চেয়ে রয়েছেন, দেখছেন অদ্ভুত সেই প্রাণীদের, যারা হারিয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর বুক থেকে।

অনেকটা জেব্রার মতো ডোরাকাটা আফ্রিকান ‘কোয়্যাগা’ ঘুরে বেড়াচ্ছে, লাফাচ্ছে, প্রকৃতিকে জানিয়ে দিচ্ছে তার জীবনের অস্তিত্ব।

পানিতে দেখা যাচ্ছে কিছু শুশুক। বাঁশবনের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে বিশাল গরিলা। কিছু পায়রা উড়ে বেড়াচ্ছে এখানে-সেখানে। একটা গন্ডার চুপচাপ শুয়ে রয়েছে। একটা জিরাফ লম্বা গলা বাড়িয়ে সবকিছু দেখছে, যেন পর্যবেক্ষণ করছে সব প্রাণীকে।

‘বেশ ভালো লাগছে তাদের দেখে। আপনাদের অভিনন্দন! আপনি পেরেছেন আমাদের প্রকল্পকে সফলতা দিতে,’ বললেন অতিথি।

‘ধন্যবাদ স্যার। আপনি কি ডোডো পাখির কথা শুনেছেন? তারা পাখি হলেও কিন্তু তাদের ওড়ার ক্ষমতা নেই। থাকত মরিশাস দ্বীপে। তারপর একসময় “ওরা”...এদেরকে...’ হঠাৎ যেন কেঁপে উঠল বিজ্ঞানীর গলা।

‘নিজেকে সামলান, “ওদের” আর ভয় পাওয়ার কারণ নেই। ওদেরকে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত করে দিতে পেরেছি, এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় সফলতা। চলুন, আমি দেখতে চাই আপনারা কীভাবে তাদের কৃত্রিমভাবে জন্ম দিচ্ছেন।’

‘চলুন,’ বললেন জীববিজ্ঞানী।

নিজেকে সামলান, “ওদের” আর ভয় পাওয়ার কারণ নেই। ওদেরকে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত করে দিতে পেরেছি, এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় সফলতা। চলুন, আমি দেখতে চাই আপনারা কীভাবে তাদের কৃত্রিমভাবে জন্ম দিচ্ছেন

গবেষণাকেন্দ্রের ভবনটা বিশাল। বিরাট হলঘরের মধ্যে সারি সারি বিরাট আকৃতির চৌবাচ্চা, সেগুলোর মধ্যে থকথকে জেলির মতো একধরনের তরল দেখা যাচ্ছে।

একটা চৌবাচ্চার কাছে গিয়ে জীববিজ্ঞানী বললেন, ‘ওগুলো হলো হাতির ভ্রূণ। আমরা ভাবছি, হাতির একটা বিরাট দল তৈরি করব।’

‘ওরা থাকবে কোথায়?’

‘কেন্দ্র থেকে সরকারকে জানানো হয়েছে ব্যাপারটা। সরকার আমাদের সংরক্ষিত বনভূমি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।’

‘বেশ বেশ! আপনি মনে হয় জীবজন্তু অনেক পছন্দ করেন, তা–ই না?’

‘সেটাই স্যার। এরাই আমার জীবন।’

‘আচ্ছা, এই প্রকল্পের ব্যাপারে তো প্রথম কথা আপনিই তুলেছিলেন, তা–ই না? আপনার কথাতেই তো কেন্দ্র এটা শুরু করেছিল। তা, আপনার মাথায় এসব এল কীভাবে? আর যেসব তথ্যের ওপর নির্ভর করে কাজ করেছেন, সেগুলোই–বা পেলেন কোথায়?’

‘জাদুঘরে রাখা জীবজন্তুর কঙ্কালগুলোকে প্রধান প্রেরণা বলতে পারেন। আর মাটি খুঁড়ে প্রচুর পুরোনো বই আর প্রাচীন আমলের কিছু চলচ্চিত্র পেয়েছি। ওগুলোর অর্থও আমাদের বিশেষজ্ঞরা বের করতে সক্ষম হয়েছেন। তাই তথ্যের অভাব হয়নি।’

‘আচ্ছা, ওগুলো কী? ওই যে ডিমগুলো!’

না! না! এ হতে পারে না! ওদের কারণেই তো পৃথিবীর এই অবস্থা! কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই ওদের কৃত্রিমভাবে বানাচ্ছেন না...উহহহ! কী ভয়াবহ!
অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক
আরও পড়ুন

‘ওগুলো? মোয়া পাখির ডিম। ওগুলোর মধ্যেই শাবকেরা পুষ্ট হচ্ছে। পাশের চৌবাচ্চায় দেখুন, বাঘের বাচ্চাগুলোকেও বের করার সময় হয়েছে। হিংস্র হয়ে ওঠার আগেই ওদের সংরক্ষিত এলাকাতে নিয়ে যেতে হবে।’

শেষ চৌবাচ্চাটার কাছে এসে থমকে দাঁড়ালেন বিজ্ঞানী। জানালা দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে বললেন, ‘এ তো দেখি একটামাত্র জীবের ভ্রূণ, এটা কী প্রাণী?’

‘বেচারা একদম একা হয়ে যাবে! কিন্তু তারপরও, ওকে কৃত্রিমভাবে বানানো জরুরি। চিন্তা করবেন না, ওর কোনো সঙ্গিনী রাখছি না আমরা। বংশবিস্তার করতে পারবে না,’ ম্লান হেসে বললেন বিজ্ঞানী।

‘মানে কী? ও কি অনেক ভয়াবহ? বাঘ, সিংহ, হাতি—এদের চেয়েও বেশি?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন অতিথি।

‘ওকে সৃষ্টি করার জন্য কেন্দ্রকে সরকারের অনুমতি নিতে হয়েছে স্যার!’ কথা বলতে বলতে কেঁপে উঠল বিজ্ঞানীর গলা।

‘হায় ঈশ্বর! এটা কি তবে...না! না! এ হতে পারে না! ওদের কারণেই তো পৃথিবীর এই অবস্থা! কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই ওদের কৃত্রিমভাবে বানাচ্ছেন না...উহহহ! কী ভয়াবহ! আমাকে বলুন, আমি যা ভাবছি তা ভুল!’ আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে অতিথির মুখ।

বিজ্ঞানী ওপর-নিচে মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন, ‘আপনি ঠিকই ভাবছেন, স্যার!’

গল্পটির মূল নাম: দ্য কিং অব দ্য বিস্টস