তিনজন অথবা একা

অলংকরণ: অসীম চন্দ্র রায়

‘ফ্যানটা ঘোরে না।’

মিজান সাহেব বিরক্ত চোখে মাথার ওপরে তিন ডানা ধরে রাখা গোল চাকতির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। গোল চাকতি ছাড়া এটিকে আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না। যে ফ্যান ঘোরে না, তার ফ্যান তিনি নন।

‘এই দেশে কিছুই ঠিকঠাক চলে না, ভাই সাহেব। ট্রেন ছাড়ার কথা ৯টা ৪০-এ, এখন বাজে ১১টা ১০। ট্রেন এখনো আসেই নাই। বোঝেন অবস্থা।’

মিজান সাহেব এবার ভালো করে সামনে বসে থাকা লোকটার দিকে তাকালেন। ফ্যানটা যে ঘোরে না, এই তথ্য সেই ভদ্রলোকই দিয়েছেন।

দুজনের মধ্যে পরিচয় নেই। তবু লোকটা অনেক দিনের পরিচিতের ভঙ্গিতে কথা বলছে। কিছু লোক আছে গপ্পাটু হয়। মিজান সাহেব এ ধরনের লোকদের দেখতে পারেন না। এমনিতেই মেজাজটা ভাজা ভাজা হয়ে আছে। মেজাজের সেই উত্তাপ সারা শরীরে প্রবাহিত হচ্ছে। মিজান সাহেব দরদর করে ঘামছেন।

এখন নাকি শীত! আবহাওয়া অফিস বলেছিল, আজ থেকে সারা দেশে শৈত্যপ্রবাহ শুরু হবে। মিজান সাহেব কোথায় যেন পড়েছিলেন, আবহাওয়া অফিসের কথা অবিশ্বাস করা যায় না, আর বিশ্বাস করার তো প্রশ্নই আসে না।

বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আসন্ন শৈত্যপ্রবাহের বাড়তি প্রস্তুতি হিসেবে সোয়েটারের ওপর জ্যাকেট চড়িয়েছেন। বউ আর কন্যাকেও বলেছিলেন ডাবল প্রটেকশন নিতে। দুজনই গতকাল মার্কেট থেকে কিনে আনা হাল ফ্যাশনের ফিনফিনে দুটি চাদর জড়িয়ে বেরিয়েছেন। মিজান সাহেবের ক্ষীণ সন্দেহ, ঠান্ডায় সর্দি লাগার ঝুঁকির তুলনায় নতুন চাদর বাকিদের দেখিয়ে বেড়ানোই কন্যা এবং তার মায়ের কাছে বেশি লোভনীয় মনে হয়েছে।তখনই এ নিয়ে মিজান সাহেব দুজনকে বেশ বকেছেন, ‘সর্দি লাগলে বুঝবা। নাক তো তখন হয়ে যাবে ওয়াসার ড্রেন।’ সমস্যা হলো, আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস–বিষয়ক সেই মহান বাণী আজ সত্যি প্রমাণিত হয়েছে।

গরমে মিজান সাহেবের গা কুটকুট করছে। তবু ইগোর কারণে ডাবল প্রটেকশন থেকে বের হয়ে আসতে পারছেন না। এর মধ্যে স্ত্রী আলগা দরদ দেখিয়ে ‘দ্যাও, জ্যাকেটটা অন্তত খুলে দ্যাও, লাগেজে ঢুকায় রাখি। ট্রেনে ঠান্ডা লাগলে আবার বের করে দিব’ বলেছিল। মিজান সাহেব তাতে অপমানিত বোধ করেছেন আরও বেশি। ‘হুঁহ’–টাইপ শব্দ করে স্ত্রীর প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করেছেন। কিছুক্ষণ পর অদূরে দাঁড়িয়ে দুই হাত জোরে জোরে ঘষার অভিনয়ও করেছেন, যেন ঠান্ডা লাগছে খুব। কাঁচা অভিনয় হয়ে গেছে। স্ত্রী-কন্যা ফিক করে হেসে দিয়েছে।

মিজান সাহেব সপরিবারে যাচ্ছেন গ্রামের বাড়ি। গত সপ্তাহে তাঁর মা মারা গেছেন। বয়স হয়েছে, মারা তো যাবেনই। সত্যি বলতে, মিজান সাহেব মা হারিয়ে তেমন একটা শোক অনুভব করেননি। তখন মেয়ের পরীক্ষা ছিল বলে একাই গিয়েছিলেন, পরিবারের কাউকে সঙ্গে নিতে পারেননি। কুলখানির সময়েও হয়তো নিতেন না। কেবল গ্রামের মানুষ যেন কোনো কথা না তুলতে পারে...।

‘ভাইজান কি দেশের বাড়ি যাচ্ছেন?’

মিজান সাহেব সাধারণত কোনো কিছুতে তেমন বিস্ময় প্রকাশ করেন না। এবার করতে বাধ্য হলেন। এখন পর্যন্ত লোকটির সঙ্গে একটি কথাও বলেননি। সত্যি বলতে কি, কমলাপুর রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ছাতার মতো বানিয়ে রাখা কংক্রিটের ছাউনির গোল পাটাতনে বসে থাকা লোকটার খুব একটা কাছেও যে দাঁড়িয়ে আছেন, এমনও নয়। ভদ্রস্থ দূরত্ব আছে। তবু লোকটা যেচে কথা বলছে।

আরও পড়ুন
‘আমার গল্পের শুরু এই স্টেশন থেকেই। তা ধরেন ৫-৬ বছর আগের ঘটনা। তখন মাত্রই বিয়ে করেছি। নাহ্, মাত্রই বলা ঠিক হলো না। তেরো-চৌদ্দ মাস হয়েছে। তখনই আমাদের ঘরে এক কন্যা এসেছে...

মিজান সাহেব বিস্মিত হলেন আসলে অন্য কারণে। লোকটা এর মধ্যে দুবার এমন প্রশ্ন করেছে, যেটা নিয়ে তিনি মনে মনে ভাবছিলেন। যেমন ফ্যানটার কথা। যেমন দেশের বাড়ির কথা। দুবারই লোকটা একেবারে ঠিক সময়ে প্রশ্ন দুটি করেছে।

মিজান সাহেবকে আরও কৌতূহলী করে তুলল লোকটার বেশভূষা। লোকটাও মিজান সাহেবের মতো এই গরমেও মোটা জ্যাকেট পরে আছে। গলায় ক্যাটকেটে রঙের মাফলার। চোখে সানগ্লাস। লোকটা কথা বলছে মুখ ডানে-বাঁয়ে না নাড়িয়ে, সামনে স্থির রেখে। সাধারণত অন্ধেরা এভাবে কথা বলে।

‘ঠিকই ধরেছেন, আমি অন্ধ। তবে এর পেছনে একটা গল্প আছে।’

মিজান সাহেব এবার ফিক করে হেসে দিলেন। শালার বুজরুকি। ঢাকা শহরে তিনি আছেন কম করে হলেও ২০ বছর। ধান্দাবাজ জীবনে কম দেখেননি। আর কমলাপুর স্টেশন তো ধান্দাবাজদের আখড়া। অন্ধ সেজে বুজরুকি দেখানো হচ্ছে!

ট্রেন যেহেতু আসছেই না, ব্যাটাকে একটু বাজিয়ে দেখাই যাক। মিজান সাহেব এগিয়ে গিয়ে লোকটার পাশে বসতে গেলেন। লোকটা মাথাটা ওভাবে স্থির রেখেই বলল, ‘ভাইজান, দেখে বসবেন। কোন হারামজাদা জানি পানের পিক ফেলে গেছে। কোনো সিভিক সেন্স নাই। বাঙালি কবে যে ভদ্রতা শিখবে!’

মিজান সাহেব পানের পিকের ওপরেই বসতে যাচ্ছিলেন একটু হলে! সরে গিয়ে বসলেন। বললেন, ‘বলেন ভাই, কী গল্প।’

‘আমার গল্পের শুরু এই স্টেশন থেকেই। তা ধরেন ৫-৬ বছর আগের ঘটনা। তখন মাত্রই বিয়ে করেছি। নাহ্, মাত্রই বলা ঠিক হলো না। তেরো-চৌদ্দ মাস হয়েছে। তখনই আমাদের ঘরে এক কন্যা এসেছে, বুঝলেন ভাইজান! লোকজন বাঁকা চোখে তাকায়। বিয়ের তারিখ আর কন্যার বয়সের যোগ–বিয়োগ করে নানা কিছু বের করতে চায়। বাবা হয়েছি, এমন একটা সুখের বিষয় যে উপভোগ করব, সেই উপায় নাই। এমন পরিস্থিতিতে তো ভাই পড়েন নাই, পড়লে বুঝতেন।’

মিজান সাহেব এবার কিছুটা অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করলেন। তাঁর সংসারজীবনের শুরুর গল্পটাও একই রকম। অনেকে সন্দেহ করত নিলুফার বিয়ের আগেই...। এ নিয়ে কানাঘুষা হয়েছে। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ বলে সমস্যাটা আরও বেড়ে গিয়েছিল। মিজান সাহেবের মা অনেক চেষ্টা-চরিত্র করেছে নিলুফারের গোপন প্রেমিকের সুলুক সন্ধানের। মিজান সাহেবের নিজেরও যে বিশ্বাসে কিছুটা চিড় ধরেনি, তা নয়। ভাগ্যিস নীলা পুরোপুরি বাপের চেহারা পেয়েছে।

মিজান সাহেব লোকটার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। এমন মিল তো হতেই পারে দুজন মানুষের জীবনে।

লোকটাও ভ্রুক্ষেপহীনভাবে গল্প বলেই চলেছে। ছাউনির দেয়ালটায় ঠেস দিয়ে আয়েশ করে বসা। অন্ধদের কথা বলার সময় আই কন্ট্যাক্টের প্রয়োজন পড়ে না। এ কারণে তারা কথা বলে মাথা প্রায় স্থির রেখেই। কেবল কথা শোনার সময় মাথা এক দিকে কাত করে কান বাড়িয়ে দেয়। মিজান সাহেব এটা আগে খেয়াল করেছেন।

‘বুঝলেন ভাই সাহেব, এ নিয়ে অশান্তি চরমে উঠল। আমার মা তো বউকে রাত-দিন উঠতে–বসতে অপমান করে। তালাক নিতে কয়। এই করতে করতে একদিন আর পারা গেল না। বউ কোলের বাচ্চাকে নিয়ে সোজা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। আমি আবার তখন ছিলাম অফিসে।’

‘খবর পেয়ে আমি ছুটে আসলাম। ততক্ষণে শুনলাম ওরা বের হয়ে চলে গেছে স্টেশনে। আমি স্টেশনে আসতে আসতে ওদের ট্রেন দিছে ছেড়ে। পরের ট্রেনটাও আসল লেটে। আমার তখন পাগলের মতো অবস্থা।’

‘সেই ট্রেন ধরে ছুটলাম ময়মনসিং। শ্বশুরবাড়ি। পৌঁছাইলাম রাতে। সেই সকালে খায়া এককাপড়ে বের হইছি, ভাই। মেয়েকে দেখার জন্য বুকটা ফেটে যাচ্ছে। শ্বশুরবাড়ির গেট ধাক্কাধাক্কি করি, কেউ খোলে না। অনেক ধাক্কাধাক্কি শেষে একটা গোঁফঅলা লোক খুলল, আমি আবার চিনলাম না।’

‘যা–ই হোক, বাড়ির নতুন কাজের লোকটোক হবে। আমি বললাম, নিলুফারকে ডেকে দেন।’

মিজান সাহেব বললেন, ‘নিলুফার?’

লোকটা এবার লাজুক হেসে বলল, ‘জি, আমার স্ত্রীর নাম। বলাই হয় নাই আপনাকে নামটা, না?’

মিজান সাহেব একটু একটু করে ভয় পেতে শুরু করলেন। এতটা মিল! দুজনের বউয়ের নামও মিলে যাবে! এ বাড়াবাড়ি।

‘তারপর, কী হলো?’ মিজান সাহেবের আবার সন্দেহ হতে শুরু করল। এ আবার নতুন বুজরুকি নয় তো? তাঁর জীবনের গল্প অনেকেই জানে। এমন কেউ সেটা এক্সপ্লয়েট করার জন্য এই ব্যাটাকে সেট করে রাখে নাই তো? অফিসে এমনিতেই নানা রকম পলিটিকস চলছে। লোকটা একটানা বলে যেতে লাগল নিজের গল্প:

কাজের লোকটা বলল, নিলুফার নামে এই বাসায় কেউ থাকে না। আমি বুঝে গেলাম, নিলুফার অভিমান করেছে। আমাকে নিশ্চয়ই দেখতে পেয়েছে বাসার ভেতর থেকে। তাই এভাবে বলে পাঠিয়েছে। আমি লোকটাকে বললাম, আচ্ছা, আম্মাকে ডাকেন। লোকটা কিছুক্ষণ বোঝার চেষ্টা করল আম্মাটা কে। তারপর কিছু না বলে ভেতরে চলে গেল। মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে।

আরও পড়ুন
বাড়িওলা খুবই বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, নিলুফার কে? এই সব গল্প আপনাকে আর বানানো লাগবে না। এই জন্যই ব্যাচেলারদের ভাড়া দিতে চাই না।

আমারও জেদ চেপে গেল। যদি না খোলে, সারা রাত দাঁড়ায় থাকব দরজার সামনে। নিলুফারকে না নিয়ে, মেয়েকে না নিয়ে যাব না। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ নাই। আবার দরজায় ঠকঠক করব কি না, ভাবতেছি, এমন সময় দরজা খুলে গেল। আমি সালাম দিলাম, আম্মা, সালামালাইকুম। ভদ্রমহিলা ঘোমটা কিছুটা টেনে বলল, আপনি কে, কাকে চান। এবার আমার অবাক হওয়ার দশা। দেখলাম, মহিলা নিলুফারের মা নন!

আমি বললাম, আম্মা নাই? মানে নিলুফারের মা?

মহিলা বলল, এটা নিলুফারদের বাসা না।

আমি ভাবলাম, টেনশনে তাড়াহুড়ায় ভুল বাসায় আসছি বোধ হয়। সরি বলে নামতে যাব, খেয়াল করলাম, না তো, এটাই তো নিলুফারদের বাসা। বাড়ির নেমপ্লেটও ঠিক আছে। ভুল বানানে লেখা: রযনীগন্ধা। এমন তো হওয়ার কথা না।

বড় অভিমান হলো বুঝলেন, ভাইজান। অনেক রাত পর্যন্ত থেকে ফিরে আসলাম ঢাকায়। পৌঁছাইলাম একদম প্রায় ভোররাতে। খুবই ছোট একটা বাসায় ভাড়া থাকি, গেটে দারোয়ান থাকে না। ১২টার পর বাড়িওলা নিজে গেট লাগায় দেয়। ২০ মিনিট ধরে কলিংবেল বাজানোর পর বাড়িওলা বিরক্ত মুখে দরজা খুলল। সারা দিনের ক্লান্তিতে, টেনশনে আমার তখন পাগল হওয়ার দশা।

বাড়িওলাকে খুলেই বললাম, সরি কাদের ভাই, আসলে সকালে নিলুফার মেয়েটাকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছিল। ওদের ফিরায় আনতে ময়মনসিংহ গেছিলাম।

বাড়িওলা খুবই বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, নিলুফার কে? এই সব গল্প আপনাকে আর বানানো লাগবে না। এই জন্যই ব্যাচেলারদের ভাড়া দিতে চাই না।

আমার মাথা তখন কাজ করতেছে না, বুঝলেন! কোনোভাবে সিঁড়ি দিয়া ছয়তলায় উঠলাম, ছাদের কোনায় এক রুমের একটা ঘরে থাকি। দরজা খুলতেই মনটা ভালো হয়ে গেল। দেখি নিলুফার বিছানায় বসেই আছে। মেয়েটা শুয়ে শুয়ে পা নাড়তেছে। আমাকে দেখে কিছুই হয় নাই ভঙ্গিতে নিলুফার বলল, বাথরুমে গরম পানি রেডি করাই আছে, যাও গোসলটা করে ফেলো।

কী যে বলব, ভাই, আমার চোখ দিয়াই তখন গরম পানির ধারা বের হইতেছে।

মিজান সাহেব লোকটার চোখের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালেন। আচ্ছা, অন্ধেরা কি কাঁদে? কাঁদলে ওদের চোখেও কি এ রকম পানি বের হয়। মিজান সাহেব উত্তর পেলেন না। লোকটার সানগ্লাসের আড়ালে পানির অস্তিত্ব আছে কি না, ঠিক বোঝা গেল না। মিজান সাহেব যেমন আরও অনেক কিছুর উত্তর পাচ্ছেন না। গল্পটাই গোলমেলে।

লোকটা আদৌ অন্ধ তো? অন্ধের ভড়ং ধরে নাই তো? ফ্যান যে ঘোরে না, পানের পিক যে পড়ে আছে, এসবই বা সে কীভাবে টের পেল?

লোকটা বলেই চলেছে:

যাকেই গল্পটা বলি, তারাই এই পর্যায়ে এসে আমাকে পাগল বলে সন্দেহ করতে শুরু করে। কী এক গল্প, মাথামুণ্ডু নাই! আপনিও যদি এমন ভাবতে থাকেন, আপনাকে দোষ দিব না। কেন দিব না, একটু পরেই বুঝবেন।

ঝামেলাটা দেখা দিল সেদিনই। আগের দিনের এত ধকলের কারণে ঠিক টাইমে অফিস যাইতে পারি না। গেলাম বেশ দেরিতে। তখন একটা ভালো কোম্পানিতেই জব করতাম। সকালের অফিস কেউ দুপুর টাইমে গেলে বস খেপবেই। আমাকে ডেকে পাঠাল। আমি বসকে সব খুলে বললাম। বস বললেন, সুজন সাহেব, আপনি বিবাহিত, বাচ্চা আছে, তা-ই তো জানতাম না!

আমি বললাম, কেন স্যার। আমার বিয়ের সময় না আপনিই ৫ দিনের ছুটি দিলেন। বস বললেন, সেটা আবার কবে? আমি দিন-তারিখ বললাম। বস বললেন, তখন না আপনি ছুটি নিলেন আপনার মা মারা গেছেন বলে! বিয়ের জন্য তো না!

আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল, জানেন। আসলেই তো। আমার মা তো মারা গেছে। নিলুফার, নিলুফারের বাচ্চা নিয়ে তার তো ঝগড়াঝাঁটি করার কথা না! আমি প্রায় অজ্ঞানমতো হয়ে গেলাম। বস শরীরের অবস্থা দেখে বাসায় পাঠায় দিলেন।

বাসায় এসে দেখি নিলুফার নাই। ওয়ার্ডরোবের ওপরে একটা চিরকুট লিখে গেছে: তোমার মা আবার যেভাবে অপমান করল, এভাবে আমার পক্ষে থাকা সম্ভব না। আমি বাপের বাড়ি গেলাম। এবার আর আমাকে নিতে এসে লাভ নাই। আমি আসব না।

চিঠিটা পড়ে আমি ধপাস করে পড়ে গেলাম।

সেদিন কীভাবে পার করছি, জানি না। পরের দিন গেলাম পরিচিত এক ডাক্তারের কাছে। তিনি সব শুনে পাগলাদের ডাক্তারদের কাছে পাঠায় দিল। ওই যে সাইকিয়াট্রিস্ট বলে না, ওদের কাছে। সব শুনে, আমার মোবাইল থেকে দেশের বাড়ির পরিচিতদের কারও কারও নম্বর নিয়ে কথা বলল ওরা। তারপর কিছুদিন ট্রিটমেন্ট করে বের হইল, আমি নাকি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। হা...হা...হা। আমি ভাবছিলাম, এই সব অসুখ বড়লোক আর সিনেমায় নায়ক-নায়িকাদের হয়।

মা ছাড়া আসলে দুনিয়ায় আমার তেমন কেউ ছিল না। মায়ের প্রতি খুব যে টান ছিল, এমনও না। তবে ডাক্তাররা বললেন, বাইরে থেকে অনেক সময় আন্দাজ করা যায় না। আমাদের ডিপ সাবকনশাস মাইন্ডে নাকি এমন অনেক কিছু পোঁতা থাকে, আমরা নিজেরাই বুঝি না। মা চলে যাওয়ার পর আমি মেন্টালি এতটাই নাকি ডিপ্রেসড হয়ে পড়ছিলাম, তার শূন্যতা ভোলার জন্যই নিলুফার, তার মেয়েকে তৈরি করে নিয়েছে আমার ব্রেন। বোঝেন, কী একটা অবস্থা! বাইরের দুনিয়ার কারও কাছেই নিলুফার নাই। অথচ আমি দিব্যি তার সঙ্গে সংসার করতেছি। মানে, আর দশটা স্বামী-স্ত্রীর মতোই।

প্রথম প্রথম কারও কথাই মানতে চাইলাম না। চাব কেন বলেন? বাসায় ফিরতেই দেখি নিলুফার, তার মেয়ে। আমার সংসার। সবাই বোঝাতে লাগল। অফিসের কলিগরা, ডাক্তার, থেরাপির লোকজন...কিন্তু মন মানল না। বুঝলেন, ভাইজান। ওদেরই মনে হতে লাগল শত্রু। মনে হতে লাগল, কোথাও আমার বিরুদ্ধে গভীর একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে। অফিস পলিটিকস। আমি ঠিক করলাম পালাব।

আরও পড়ুন
‘বুঝলেন ভাই, সমস্যা সেদিন থেকে আরও বাড়ল। নিলুফার আর তার মেয়ে এভাবেই কদিন পরপর ঝগড়া করে চলে যায়, আবার কোথা থেকে যেন আসে।

একদিন সত্যি সত্যি নিলুফার, তার মেয়েকে নিয়ে ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে স্টেশনেও চলে আসলাম। কোথায় যাব ঠিক নাই। যে ট্রেনটা ছেড়ে যাবে, ওইটারই দুইটা টিকিট কাটলাম, মেয়ে তো ছোট, তার টিকিট লাগে নাই। টিকিট কাটতে কাটতেই ট্রেনটা ছেড়ে দেওয়ার সাইরেন বাজাল। কোনোমতে বউ-বাচ্চা নিয়ে তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে গিয়ে ট্রেনে উঠলাম। ফার্স্ট ক্লাস কেবিন নিছিলাম।

কেমন একটা চোর চোর ভাব। সামনের সারিতে তিনটা লোক বসা। আমার দিকে কীভাবে যেন তাকাচ্ছে। নিলুফার সাধারণত আমার সাথে ঘরের বাইরে একটা কথাও বলত না। লম্বা ঘোমটা টেনে বসে থাকত। সেদিনও ছিল। কোলে মেয়ে। এক সময় টিটি আসল। আমি টিকিট দিলাম। টিটি বলল, দুইটা টিকিট কেন, আরেকটা কার জন্য? আমি পাশে বসা নিলুফারকে দেখিয়ে দিলাম। টিটি আবারও জিজ্ঞেস করল যখন, বুকটা ধক করে কেঁপে উঠল। এবার পাশে তাকায় দেখি, নিলুফার নাই!

একটানা গল্প বলার ক্লান্তি পেয়ে বসল লোকটাকে। গলাও শুকিয়ে গেছে বোধ হয়। লোকটা ব্যাগ হাতড়াচ্ছে। মিজান সাহেব নিজের পানির বোতলটা বাড়িয়ে দিলেন। লোকটা টের পেল না। ব্যাগ হাতড়েই চলেছে। মিজান সাহেব বললেন, নেন, আমার পানিটা নেন।

লোকটা অনুমানে হাত বাড়িয়ে কয়েকবারের চেষ্টায় পানির বোতলটা খুঁজে পেল। মুখ খুলে ঢকঢক করে পানি গলায় ঢালল। প্ল্যাটফর্ম কাঁপিয়ে একটা ট্রেন ঢুকল স্টেশনে। মাইকে ঘোষণা ভেসে এল: ঢাকা থেকে ময়মনসিংহগামী অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস আর কিছুক্ষণের মধ্যেই...।

‘বুঝলেন ভাই, সমস্যা সেদিন থেকে আরও বাড়ল। নিলুফার আর তার মেয়ে এভাবেই কদিন পরপর ঝগড়া করে চলে যায়, আবার কোথা থেকে যেন আসে। কেউ দেখতে পায় না, শুধু আমি দেখতে পাই। কীভাবে যে আমার সেই সময়ের অনুভূতি আপনাকে বুঝায়ে বলি! একবার কল্পনা করেন তো, আপনি যে সংসার, যে জীবন, যে চাকরি, যে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে প্রতিদিন চলাফেরা করতেছেন, জীবনযাপন করতেছেন; হঠাৎ যদি একদিন আবিষ্কার করেন, এর কিছু কিছু অংশ কিংবা পুরাটাই শুধু আপনার বিভ্রম? সত্যিকারের দুনিয়ায় এসবের কোনো অস্তিত্ব নাই!’

মিজান সাহেব দেখতে পেলেন, মেয়ে আর তার মা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে। নিশ্চয়ই এতক্ষণ এসির যাত্রীদের বিশ্রামকক্ষে হাওয়া খাচ্ছিল। এবার যে উঠতে হয়। লোকটার জন্য এবার মায়াই হতে লাগল।

লোকটার কণ্ঠেও কেমন ক্লান্তি, ‘চিকিৎসায় কোনো লাভ হচ্ছিল না ভাইজান জানেন। সাইকিয়াট্রিস্টরা বারবার বলতেছিল, আমাকে আগে নিলুফারের প্রতি মায়া ছাড়তে হবে। না হলে কোনো কাজ হবে না। এভাবে চলতে থাকলে পাগল হয়ে যাব। যাব কী, আসলে পাগল হয়েই গেছিলাম। আমি নিজেই বুঝতে পারতেছিলাম, মাঝেমধ্যে এমন কিছু করে ফেলি, পাগল ছাড়া আর কেউ...আমি নিজেও তাই মন থেকে বের হয়ে আসতে চাইছিলাম। কিন্তু পারতেছিলাম না। চোখের সামনে স্পষ্ট দেখি, মেয়ে আর তার মা, আমার ছোট্ট সংসার। শেষে নিজেই একটা বুদ্ধি বাইর করলাম। সব সমস্যার সমাধান!’

কী বুদ্ধি?

লোকটা এবার সানগ্লাস খুলল। বন্ধ চোখের পাতা। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, পেছনে কিছু নেই। পাতা দুটো ভেতরের দিকে দেবে গেছে। লোকটার চোখের মণিই কি নেই!

মিজান সাহেবের গা শিউরে উঠল। লোকটা তামাটে দাঁত বের করে গর্বের হাসি হেসে বলল, নিজেই ফিনিশ কইরা দিছি ভাই সাহেব, এক্কেরে!

মিজান সাহেবের গা গুলিয়ে আসছে। তিনি পারলে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচেন। কিন্তু লোকটা বন্ধ চোখেই একদম নির্ভুল নিশানায় মিজান সাহেবের হাত খপ করে ধরে বলল, ‘তীব্র যন্ত্রণা হয়েছিল, ভাইজান, কিন্তু মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম। নিলুফার আর তার মেয়েকে তো দেখতে হইত না। কিন্তু কিছুদিন পরেই, জানেন ভাইজান, বুকের মধ্যে হাহাকার করে উঠল। কেমন জানি চিনচিন করে। মনে হয়, কী যেন নাই। এই জন্যই মাঝেমধ্যে স্টেশনে আসি। স্টেশনেই তো শেষবার নিলুফার আর তার মেয়েকে...। যান, আপনার বউ আর মেয়ে চলে এসেছে। ট্রেনও ছেড়ে দেবে। মায়ের কবরে গিয়া মন থেকে জিয়ারত করবেন। মায়ের জন্য পারলে দুই ফোঁটা অশ্রু ফেলবেন। মা থাকতে আমরা মায়ের মায়া বুঝি না। চলে গেলেই কেবল বুঝি।’

মিজান সাহেব পাথরের মূর্তি হয়ে গেছেন। পা জোড়া যেন নড়ছে না। স্ত্রী কয়েকবার ইশারায় স্বামীকে ডেকেছেন। কাজ হচ্ছে না দেখে নিলুফার বিরক্ত হয়ে হাঁক দিলেন, ‘কই, তাড়াতাড়ি আসো, সব সময় তো শুধু আমাদেরই ঝাড়ি মারো, ট্রেন তো এখনই ছেড়ে দিবে।’

মিজান সাহেব গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেন। দ্রুত পায়ের কাছে রাখা ব্যাগটা নিয়ে উঠে পড়লেন। ‘আপনার গল্পটা শুনে খারাপ লাগল, ভাই, সত্যি খারাপ লাগল। ভালো থাকবেন। আসি তাইলে’ বলে দ্রুত বিদায় নিলেন।

অদ্ভুত কারণে লোকটার জন্য তাঁর মায়া হতে থাকল। সাধারণত নিজের ভেতরের আবেগ লুকিয়ে রাখতে ভালোবাসেন। কিন্তু এবার পারলেন না। চোখে হালকা জলধারা, কাছে এসে পরম মমতায় স্ত্রীর হাতটা ধরে বললেন, ‘বুঝলা নিলু, পেছনে ওই যে অন্ধ লোকটা বসে আছে না, লোকটার জীবনে একটা গল্প আছে, বলব তোমাকে ট্রেনে।’

নিলুফারকে এই আবেগ একদমই স্পর্শ করল না। স্বামীকে তাড়া দিতে দিতেই বলল, ‘অন্ধ লোক? কই, কোথায়? চলো তো, কয়দিন থেকে তোমার যে কী হইছে, শুধু আজগুবি কথা বলো।’

মিজান সাহেব পেছন ফিরে তাকালেন। যেখানে এতক্ষণ বসে ছিলেন, জায়গাটা পুরো ফাঁকা। এদিক–ওদিক তাকালেন, প্ল্যাটফর্মের কোথাও লোকটাকে দেখতে পেলেন না।

ট্রেন শেষবারের মতো হুইসেল দিল। তিনি দ্রুত নিজের কামরার দিকে পা বাড়ালেন।

কামরার দরজার মুখেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে সাদা ইউনিফর্মের এক লোক যাত্রীদের টিকিট দেখছে আর বগি দেখিয়ে দিচ্ছে। নতুন মন্ত্রী আসার পর রেলের সেবা আর নিয়মকানুন বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। মিজান সাহেবের মুড আগের অবস্থায় ফিরে এল। শালারা, পারো শুধু এই সব করতে। নয়টা ৪০-এর ট্রেন আসল ১২টায়, ওইটা আগে ঠিক করো।

টিটির কাছে এসে নিজের তিনটা টিকিট বাড়িয়ে দিলেন।

টিটি ডানে বাঁয়ে মাথা ঘুরিয়ে জানতে চাইল, ‘বাকি দুজন যাত্রী?’

*লেখাটি ২০১৯ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত