ভিনগ্রহের ক্রিকেটার – পর্ব ৭

১১

ক্লাস সেভেনের ক্রিকেট টিমে মিজানের জায়গা হয়ে গেল। ব্যাটসমান হিসেবে নয়, বোলার হিসেবে। জয়েন স্যার ক্লাসে এসে দলের নাম ঘোষণা করলেন। 

অধিনায়ক সোহান। সহ-অধিনায়ক আবীর। ১১ নম্বর খেলোয়াড় হলো মিজান। মিজানের দলভুক্তিটা নিয়ে ক্লাসে গুঞ্জন উঠল। মিজান, গাধা মিজান? সে কিনা তাদের দলের ক্রিকেট টিমে। শুক্রবারে খেলা। প্রথম খেলা ক্লাস এইটের সঙ্গে। এক দিনের ম্যাচ। মোট ৩০ ওভারের খেলা। এই খেলা নিয়ে মেতে রইল পুরো ক্লাস। টিফিন পিরিয়ডের পর আর ক্লাস হয় না। তারা সবাই চলে যায় মাঠে। স্কুলের মাঠ বিশাল বড়। মধ্য দিয়ে রাস্তা চলে যাওয়ায় মাঠ আসলে হয়ে পড়েছে দুটো। দুই মাঠে চারটা টিম অনুশীলন করছে। খেলা দেখতে মাঠে আরও এসেছে অন্য ছাত্ররা। মাঠে ছাত্ররা গিজগিজ করছে।

ব্যাটিং দিয়ে ক্লাস সেভেন তাদের প্র্যাকটিস শুরু করল। সোহান বলল, বুঝলি আবীর, মাঠে নেট থাকতে হতো। নেটে প্র্যাকটিস না করলে তুই কোনো দিন বড় খেলোয়াড় হতে পারবি না। 

আবীর বলল, আর লাঞ্চ টি ড্রিংকস এসব ব্রেকে খাওয়াটা ভালো চাই। জানিস, ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়েরা লাঞ্চে কী খায়?

সোহান বলল, কী খায়?

আবীর জবাব দিল, স্পিরুলিনা। 

সে আবার কী?

আছে। আছে। এটা একটা খাবার। ব্যাঙের ছাতার মতো। 

ও। মাশরুম। সে আমি মামার সঙ্গে ঢাকায় গিয়ে চায়নিজে খেয়েছি। বিশ্রী খেতে। 

আরে না। মাশরুম, মাষকালাই সেসব কিছু না। এটা একটা সায়েন্টিফিক খাবার। খেলে কবজিতে জোর হয়। আমার চাচা তো লন্ডনে থাকে। আমি তাকে বলেছি আমার জন্য স্পিরুলিনা পাঠাবে। 

না । 

তোর কোন চাচা লন্ডনে থাকে?

ওই যে... ওই যে... মেজ চাচা। 

মেজ চাচা না সেদিন বললি ঢাকায় সিনেমা করে?

সে তো সেজ চাচা...

চাপা মারিস না আবীর। তোর কথা ইদানীং একটাও আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না।

হ্যাঁ আমি তো চাপাই মারি। আমার সঙ্গে যে ওয়াসিম আকরামের দেখা হয়েছিল, বল সেটাও চাপা।

সেটা চাপা হবে কেন, স্বপ্নে দেখা হয়েছিল, এই তো। 

৩ জন খেলোয়াড় ৩টা ব্যাট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর ৩ জন খেলোয়াড় তাদের থেকে ২০ ফুটের মতো দূরে দাঁড়িয়ে তাদের বল থ্রো করছে।

এই তো বিশ্বাস করলি না। পেপসির কম্পিটিশনে স্লোগান লিখে আমি ফার্স্ট হয়েছিলাম। তখন আমাকে ওরা ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। 

তুই কবে ঢাকা গেলি?

ওই যে সেবার। 

বললি না যে নানাবাড়ি গেছি খয়বারপুর...

খয়বারপুর থেকেই তো ঢাকা গেলাম। ওয়াসিম আকরাম আমাকে এমন একটা কায়দা শিখিয়ে দিয়েছেন যে কী বলব। ওটা দিয়ে বল করলে দেখবি... ক্লাস এইট ৩৩ রানে অলআউট। 

ব্যাটিং প্র্যাকটিসে কিন্তু মিজানকে পাত্তাই দেওয়া হচ্ছে না! ৩ জন খেলোয়াড় ৩টা ব্যাট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর ৩ জন খেলোয়াড় তাদের থেকে ২০ ফুটের মতো দূরে দাঁড়িয়ে তাদের বল থ্রো করছে। বাকিরা বল কুড়াচ্ছে। ব্যাটসম্যানরা বল পাঠিয়ে দিচ্ছে ইচ্ছামতো একেক জায়গায়। এটাই প্র্যাকটিস। ইচ্ছামতো বল একেক জায়গায় পাঠানো শেখা। মিজান এখন ফিল্ডার। ব্যাটসম্যানদের মারা বল সে কুড়িয়ে কুড়িয়ে আনছে।

আজ খুব রোদ উঠেছে। অল্পক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করতেই সবাই ঘেমে গেল। আবীর বলল, সোহান, ড্রিংকসে ব্রেক দে। 

সোহানও এই সুযোগ খুঁজছিল। আসলে খেলার চেয়ে খেলাকে ঘিরে অন্য সব ব্যাপারেই তাদের বেশি মনোযোগ। যেমন ড্রিংকস। পেপসি বা কোকাকোলা খেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এত টাকা কোথায়? এর বদলে তারা করেছে কী, ক্লাসের সবাইকে বলেছে এক চামচ করে চিনি আর একটা করে লেবু দিতে। সবার এই চিনি আর লেবু জমিয়ে তাদের টিমের ড্রিংকস বানানো হবে। দুটো জগে পানিও রেডি। এখন ব্রেক দিয়ে এই অপূর্ব ড্রিংকসটা বানানো হবে। লাঞ্চের সময় তারা খাবে শিঙাড়া। ওই এলাকার বিখ্যাত শিঙাড়া হাউসের শিঙাড়া। 

অধিনায়ক সোহান নির্দেশ দিল, এই এখন ড্রিংকস। চলো সবাই বটের নিচে। বটগাছের নিচে গেল সবাই। দুটো জগে গলা পর্যন্ত পানি। তাতে চিনি ঢালা হলো। লেবুর রস দেওয়া হলো। এখন একটু ঘুঁটা দেওয়া দরকার। বড় চামচ থাকলে ভালো হতো। তা নেই। ফার্স্ট বয় স্বাধীন বলল, বড় চামচ লাগবে না। প্রথমে গেলাস দুটো ভরো। তাহলে একটা জগ খালি হবে। এরপর এক জগেরটা আরেক জগে ঢালো। এভাবে জগ টু গেলাস টু জগ করতে থাকো, তাতেই হয়ে যাবে। 

গুড গুড। সোহান বলল। একজন ভালো ছাত্র সব সময় সঙ্গে থাকলে বেশ বুদ্ধি-শুদ্ধি পাওয়া যায়।

নলেজ ইজ পাওয়ার। বলল একজন।

তারপর সব খেলোয়াড় এক এক করে অর্ধেক গেলাস লেবুর শরবত পেল। কিন্তু মিজানকে দেওয়ার কথা কারও মনে থাকল না। বরং শেষটুকুন তারা দিল স্বাধীনকে। কারণ, স্বাধীনের বুদ্ধিতেই শরবতটা বানানো গেছে। 

মিজান কিন্তু তেমন মন খারাপ করল না। সে যে টিমে ঢুকতে পেরেছে, এতেই সে খুশি।

একটু পর শান্ত চিৎকার করে উঠল। এই জগের মধ্যে এটা কী? জগের মধ্যে এটা কী? আবদাল ক্লাস ক্যাপ্টেন। সে দৌড়ে গেল শান্তর কাছে। জগের মুখে চোখ লাগিয়ে দেখতে পেল, নিচে একটা তেলাপোকা। মনে হয় স্কচটেপ দিয়ে আটকানো। এ তো রীতিমতো স্যাবোটাজ। কে করল? কে করল?

কেউ একজন নিশ্চয় করেছে। কে করতে পারে? হোস্টেল থেকে তারা জগ দুটো এনেছে। হোস্টেলে মোহন আর রাজীব থাকে। ওরা দুজন ক্রিকেট টিমে চান্স পায় নাই। নিশ্চয় ওদের কাজ। 

আবদাল বলল, দেখিস স্যারকে বলে যদি ওর চামড়া না তোলাচ্ছি।

সোহান বলল, স্যারকে বলতে হবে না। ওই দুই শিম্পাঞ্জিকে শায়েস্তা করার দায়িত্ব আমার আর আবীরের ওপরই থাক। 

রাতের বেলা মোহন আর রাজীব মিজানকে জিজ্ঞেস করল, কিরে, কেমন খেলি

তোরা তোদের শরবত।

মিজান বলল, ভালো। 

মোহন বলল, কেমন ভালো। 

মিজান বলল, বেশ ভালো। 

রাজীব বলল, মনে হয় গাধাগুলো টের পায়নি যে ওদের জগের নিচে তেলাপোকা। 

মিজান বলল, টের পাবে না কেন? টের পেয়ে জগ ধুয়ে তারপর শরবত বানানো হয়েছে। 

রাজীব আর মোহনের মুখ গেল শুকিয়ে। 

এমন সময় হায়দার এল। বলল, এই আজকে কী হয়েছে জানো তো। ক্লাস সেভেনের ছেলেরা জগে করে শরবত বানিয়ে খেয়ে দেখে জগের নিচে তেলাপোকা পড়ে আছে। তারপর বমিটমি করে সবার অবস্থা খারাপ। কী মিজান, তুমি বমি করনি?

মিজান বলল, না, আমি তো শরবত খাইইনি। 

রাজীব আর মোহন হাসতে লাগল। খাইইনি বললেই হলো। খেয়েছে, এখন নিশ্চয় অস্বীকার করছে। 

পরের দিন ক্লাসে রাজীব আর মোহনের একপাশে বসল সোহান। আরেকপাশে বসল আবীর। তাদের দুজনের হাতে দুটো সুপারগ্লু। তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন ক্লাসে স্যার আসেন। ফার্স্ট পিরিয়ড। জয়েন স্যারের ক্লাস। স্যার ক্লাসে ঢুকতেই সবাই হাসতে লাগল। এর কারণ স্যারকে দেখতে অদ্ভুত লাগছে। স্যার আজকে ক্লিন শেভ করে এসেছেন। তার আগে গোঁফ ছিল। তিনি আজ গোঁফ কামিয়ে এসেছেন। স্যার আসার সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে দাঁড়াতে হয়, এটাই নিয়ম। স্যার বসলে সবাই বসে। 

স্যারের চেহারা দেখে সবাই হাসছে, তা দেখে স্যারও হাসলেন। তখনো স্যার বসেননি। কাউকে বসতেও বলেননি। ছেলেরা সবাই দাঁড়িয়ে আছে। এই সুযোগ। আবীর আর সোহান তাড়াতাড়ি করে সুপারগ্লু লাগিয়ে দিল রাজীব আর মোহনের সিটে। স্যার হাত দিয়ে ইশারা করলেন, বসো। ছেলেরা সবাই বসল। 

স্যার বললেন, কালকে নাকি তোদের কী সমস্যা হয়েছে?

আবদাল বলল, জি স্যার। আমাদের জগের মধ্যে তেলাপোকা ছিল। আর সেটা স্যার স্কচটেপ দিয়ে জগের তলায় লাগানো ছিল!

স্যার বললেন, ভালোই হয়েছে। তোদের আর হাঁপানি হবে না। 

আবদাল বলল, কিন্তু স্যার যে বা যারা এ কাজ করেছে, তাদের শাস্তি দিতেই হবে। 

স্যার বললেন, দে উইল বি পানিশড বাই দ্য অলমাইটি। 

এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেল রাজীব আর মোহনের পানিশমেন্ট। তাদের প্যান্ট একেবারে আটকে গেছে বেঞ্চের সঙ্গে। তারা চেষ্টা করছে নড়তে চড়তে, পারছে না। 

ছেলেরা যারা জানত ব্যাপারটা, তারা রাজীব আর মোহনের ওপর নজর রাখছে। তাদের দুরবস্থা দেখে হাসতে শুরু করেছে।

একটু পরে রাজীব আর মোহনের পেছনে বসা ছেলেরা ওদের দেখিয়ে দেখিয়ে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে তারা বলল, স্যার, ক্রিমিনাল পাওয়া গেছে স্যার। দেখেন স্যার, ওরা আটকে গেছে।

স্যার বললেন, এই তোরা হাসছিস কেন?

শান্ত বলল, দে আর বিয়িং পানিশড বাই দ্য অলমাইটি স্যার। আল্লাহর মার শুরু হয়ে গেছে। 

স্যার বললেন, মানে কী?

শান্ত বলল, আমাদের ক্লাস টিমের সঙ্গে যারা খারাপ কাজ করেছে, আল্লাহ তাদের পাছার ছাল তোলার ব্যবস্থা করছেন।

স্যার বললেন, মানে কী? এসব কথার মানে কী?

রাজীব আর মোহন চুপ করে বসে আছে। তারা উঠছে না। নড়ছে না। থাকুক। আর মিনিটখানেক বসে থাকুক। তাহলে আর উঠতে হবে না। শান্ত বলল, সবার পেছনটা দেখেন স্যার। ক্রিমিনাল বেরিয়ে আসবে। স্যার বললেন, এই হতভাগা, তোর কথা তো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তখন যারা জানে ব্যাপারটা, তাদের কেউ কেউ বলল, স্যার, বুঝবেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্রিমিনাল ধরা পড়বে। স্যার, আপনি সবাইকে উঠতে বলেন। 

একটু পরে রাজীব আর মোহনের পেছনে বসা ছেলেরা ওদের দেখিয়ে দেখিয়ে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে তারা বলল, স্যার, ক্রিমিনাল পাওয়া গেছে স্যার। দেখেন স্যার, ওরা আটকে গেছে। 

রাজীব আর মোহনের অবস্থা সত্যি শোচনীয়। তাদের প্যান্ট যেন চিরস্থায়ীভাবে আটকে গেছে বেঞ্চের সঙ্গে। তারা নড়তে–চড়তে পারছে না। ওঠার চেষ্টা করলে যেন পুরো বেঞ্চই উঠে আসবে তাদের সঙ্গে। আর বেঞ্চ যদি না ওঠে, তাহলে প্যান্ট যে ছিঁড়ে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। 

স্যার বললেন, মোহন আর রাজীব, তোরা দাঁড়া। 

তারা দাঁড়াতে পারছে না। 

দাঁড়া। আবদাল। বেত দে। 

মোহন বলল, স্যার, বেঞ্চে মনে হয় আঠা ছিল। আমাদের প্যান্ট আটকে গেছে। 

স্যার বললেন, দাঁড়া, তোদের দাঁড়াতেই হবে। 

প্যান্ট ছিঁড়ে যাবে স্যার। 

গেলে আর কী করা যাবে। তোরা কি চিরদিন এই বেঞ্চে বসে থাকবি? ওঠ, চেষ্টা কর। 

মোহন আর রাজীব উঠল। পুরো ক্লাস নিস্তব্ধ। সঙ্গে সঙ্গে পপপড়াৎ করে শব্দ হলো আর দুজনের প্যান্টের পেছনটা সম্পূর্ণ ছিঁড়ে আটেক রইল বেঞ্চের সঙ্গে।

তখন যে হাসিটা পুরো ক্লাস হাসতে লাগল আশপাশের ক্লাস থেকেও ছাত্র-শিক্ষক ছুটে এল ঘটনা কী দেখতে। বাপুরে বাপ, এ রকম হাসির কাণ্ড এর আগে কখনো ঘটেছে নাকি?

স্যার বললেন, যা রাজীব আর মোহন হোস্টেলে যা। প্যান্ট পাল্টে আয়। ছুটির পরে গেলে তো ছেলেরা তোদের খেপিয়েই মেরে ফেলবে। 

তখন রাজীব আর মোহনের অবস্থা হয়ে পড়ল সত্যি শোচনীয়। তলদেশ পুরোপুরি উদোম। সেদিক দিয়ে ঢুকে পড়ছে শীতের হাওয়া। চারদিকে পুরো স্কুলের শত শত চোখ তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। তারা কোনোমতে শার্ট টেনে টেনে ইজ্জত বাঁচানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। স্যার বললেন, তোরা তেলাপোকা লাগিয়েছিলি কেন? এ রকম কাণ্ড কেউ করে? খবরদার আর কখনো করবি না। 

এখন তোদের ক্লাস টেস্ট। পরীক্ষা নেব। নে। সবাই চুপ কর। একদম চুপ। পরীক্ষার কথা শুনে সবাই চুপ করল। 

স্যার বললেন, যা রাজীব আর মোহন হোস্টেলে যা। প্যান্ট পাল্টে আয়। ছুটির পরে গেলে তো ছেলেরা তোদের খেপিয়েই মেরে ফেলবে। 

ওরা উঠল। আবার পুরো ক্লাস হাসছে। তারা দুজন ক্লাসের বাইরে যেতেই অন্য ক্লাসের ছেলেরা বেরিয়ে এসে তাদের পিছু নিল। 

এমন সংকটে এর আগে পৃথিবীর আর কেউ কখনো পড়েছে কি?

চলবে…