ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ – ২

আগের পর্ব

বলা বাহুল্য, এ ঘটনার পর আমার মনের শান্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারছিলাম না সেই ভয়ঙ্কর চিৎকারটা—ক্রাফৎশ্‌তুদৎ কোম্পানির পাথুরে দেয়ালটা যেন কেঁপে উঠেছিল তাতে। তা ছাড়া একটা লোক একদিনের মধ্যেই অমন জটিল একটা অঙ্ক কষে দিল, তার ধাক্কাও সামলে উঠতে পারিনি। দ্বিতীয় অঙ্কটার সমাধানের জন্যে উত্তেজিত অপেক্ষায় রইলাম। এটাও যদি কষে দেয়, তাহলে...

দুই দিন পর ক্রাফৎশ্‌তুদৎ কোম্পানির মেয়েটির কাছ থেকে কম্পিত হাতে প্যাকেটটা নিলাম। তার আয়তন দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, অতি জটিল ওই গাণিতিক সমস্যাটার সমাধানই আছে তাতে। সভয়ে তাকালাম আমার সামনে দণ্ডায়মান ক্ষীণ প্রাণীটির দিকে। হঠাৎ একটা চিন্তা খেলে গেল মাথায়।

‘ভেতরে আসুন, আমি টাকাটা এনে দিচ্ছি।’

‘না, না, ঠিক আছে। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব...’ যেন ভয় পেয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল মেয়েটা।

‘ভেতরে আসুন, বাইরে ঠান্ডায় জমে লাভ কী?’ বলে তাকে প্রায় টেনে ভেতরে ঢোকালাম, ‘টাকা দেওয়ার আগে অঙ্কটা একবার দেখে নিতে হবে।’

মেয়েটা দরজায় পিঠ দিয়ে বড় বড় চোখে লক্ষ্য করতে লাগল আমায়।

‘আমাদের বারণ আছে...’ ফিসফিসিয়ে বলল সে।

‘কী বারণ?’

‘খরিদ্দারদের বাড়ির ভেতর যাওয়া... তাই নির্দেশ।’

‘রেখে দিন নির্দেশ। এ বাড়ির কর্তা আমি, কেউ জানবে না আপনি এখানে এসেছিলেন।’

‘না, না, ওরা সব জানতে পারবে... আর তখন...’

‘কী হবে তখন?’ জিজ্ঞেস করলাম ওর কাছে এসে।

‘সে ভয়ঙ্কর ব্যাপার...’

হঠাৎ মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে উঠল সে।

দুই দিন পর ক্রাফৎশ্‌তুদৎ কোম্পানির মেয়েটির কাছ থেকে কম্পিত হাতে প্যাকেটটা নিলাম। তার আয়তন দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, অতি জটিল ওই গাণিতিক সমস্যাটার সমাধানই আছে তাতে

আমি ওর কাঁধে হাত দিলাম, কিন্তু শিউরে উঠে সে পিছিয়ে গেল।

‘সাত শ মার্ক দিয়ে দিন, আমি চলি।’

টাকাটা এগিয়ে দিলাম। সে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে গেল।

প্যাকেটটা খুলে প্রায় বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠতে হলো। ফটোকপিগুলোর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম কয়েক মিনিট। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। অন্য লোকের হাতের লেখা।

আরেকজন গাণিতিক প্রতিভা! প্রথমটির চেয়ে এর কৃতিত্ব বেশি। তিপান্ন পাতাজুড়ে বিশ্লেষণী পদ্ধতিতে সে যে সমীকরণগুলোর সমাধান করেছে, সেগুলো প্রথমবারের অঙ্কের চেয়ে অনেক বেশি জটিল। সমাকলন চিহ্ন, সমাহার চিহ্ন, পরিবর্তন চিহ্ন প্রভৃতি উচ্চতম গণিতের নানা সংকেতগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনে হলো যেন এক আশ্চর্য গণিত-জগতে গিয়ে পড়েছি, যেখানে কোনো সমস্যাই সমস্যা নয়।

দুই সংখ্যার রাশি নিয়ে যোগ-বিয়োগ করা যেমন সহজ, এ গণিতজ্ঞও যেন ঠিক তেমনি সহজে আমার অঙ্কটা কষে দিয়েছেন।

পান্ডুলিপিটা কয়েকবার রেখে গণিতের কোষ-পুস্তকের পাতা উল্টে মিলিয়ে দেখতে হলো। অতি জটিল সব উপপাদ্য ও প্রমাণ সে প্রয়োগ করেছে এমন নৈপুণ্যে যে অবাক হতে হয়। গাণিতিক যুক্তি ও সমাধান পদ্ধতিতে এতটুকু খুঁত নেই। নিউটন, লেইবনিৎস (লিবনিজ), গাউস, এইলার, লোবাচেভস্কি, ভেইয়েরষ্ট্রাস, হিলবার্ট প্রভৃতি সর্বজাতি ও সর্বযুগের সেরা গণিতজ্ঞরাও যদি দেখতেন কী ভাবে সমাধান করা হয়েছে অঙ্কটা, তাহলে তাঁরাও আমার চেয়ে কম অবাক হতেন না।

অঙ্কটা অনুধাবন করার পর ভাবতে বসলাম।

 এই গণিতজ্ঞদের কোথা থেকে জোগাড় করল ক্রাফৎশ্‌তুদৎ। সংখ্যায় এরা যে কেবল দু-তিন জন না, গোটা একটা টিম, সে বিষয়ে এখন আর আমার কোনো সন্দেহই নেই। শুধু দু-তিন জন গণিতজ্ঞ নিয়ে তো আর একটা গোটা কম্পিউটার ফার্ম চালানো যায় না। কিন্তু এত লোক সে পেল কেমন করে? ফার্মটা আবার এর পাগলাগারদের পাশেই-বা কেন? দেয়ালের ওপাশে ওই অমানুষিক চিৎকারটা কার? কেনই-বা চিৎকার করছিল সে?

ক্রাফৎশ্‌তুদৎ, ক্রাফৎশ্‌তুদৎ! নামটা কেবলি গুঞ্জন করতে লাগল মাথার মধ্যে। কোথায় এবং কবে শুনেছি নামটা? কী আছে এ নামের পেছনে? মাথায় হাত দিয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলাম আমি। স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছিলাম।

আরও পড়ুন

তারপর ফের বসলাম, প্রতিভাদীপ্ত অঙ্কটা নিয়ে পড়তে লাগলাম আনন্দে মগ্ন হয়ে, এক একটা অংশ ধরে, অন্তর্বর্তী উপপাদ্য ও সূত্রের প্রমাণে বাহ্যজ্ঞান শূন্য হয়ে। তারপর লাফিয়ে উঠলাম হঠাৎ। ফের মনে পড়ে গেল ওই অমানুষিক আর্তনাদটার কথা, সেই সঙ্গে ক্রাফৎশ্‌তুদৎ নামটা।

এ অনুসঙ্গ অকারণ নয়। ঠিক এই-ই হওয়ার কথা। নির্যাতিত একটা লোকের আর্তনাদ এবং ক্রাফৎশ্‌তুদৎ—এই দুই-ই অঙ্গাঙ্গি জড়িত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গ্রাৎসের এক নাজি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে জেরা করার কাজ চালাত এক ক্রাফৎশ্‌তুদৎ। খুন-জখম ও অমানুষিক নিপীড়নের জন্য ন্যুরেমবার্গ বিচারে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। এরপর তার কথা আর শোনা যায়নি।

মনে পড়ল তার ছবিটা—সব কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। এস এস ওবের-স্টর্মফুয়েরার পোষাক পরা, চোখে পাঁশনে, একটা মোটা সোটা ভালোমানুষ মুখে বড় বড় এমন কি বিস্মিত চোখ! যে মানুষের এমন মুখ, সে অমন জল্লাদ হতে পারে, এ কথা বিশ্বাস হচ্ছিল না। অথচ বিশদ সাক্ষ্য ও পরিপূর্ণ তদন্ত থেকে কোনো সন্দেহের অবকাশ ছিল না।

বিচারের পর কী হলো তার? অন্যান্য অনেক জল্লাদের মতো তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়নি তো?

কিন্তু তার সঙ্গে গণিতের কী সংস্পর্শ? একজন নিপীড়ক পুলিসকর্তার সঙ্গে অন্তরকলন ও সমাকলনের এই প্রতিভাদীপ্ত সমাধানের যোগ কোথায়?

আমার যুক্তির সূত্র এইখানে ছিঁড়ে গেল। এ দুটো জিনিসকে কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না। স্পষ্টতই একটা লুপ্ত সূত্র আছে কোথাও। কোনো একটা রহস্য।

এ নিয়ে বহু মাথা খুঁড়েও কিছুই ঠাহর করতে পারলাম না। তারপর আবার ওই মেয়েটা। বলল, ‘ওরা জানতে পারবে...’ কী ভয়ই না সে পায়!

দিন কয়েক পীড়িত অনুমানের পর বুঝলাম, এ রহস্য ভেদ না করতে পারলে সম্ভবত আমি নিজেই পাগল হয়ে যেতে পারি।

ঠিক করলাম, আগে দেখতে হবে এই ক্রাফৎশ্‌তুদৎ সেই যুদ্ধাপরাধী কি না।

তৃতীয় বার ক্রাফৎশ্‌তুদৎ কোম্পানির সেই নিচু দরজাটার কাছে পৌঁছে কেমন যেন মনে হলো এবার এমন একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে, যাতে আমার গোটা জীবন বদলে যাবে। কেন যে এটা করলাম, সেটা তখনো বুঝিনি, পরেও ভেবে উঠতে পারিনি—ড্রাইভারকে পয়সা মিটিয়ে বেল টিপলাম গাড়িটা মোড়ে অদৃশ্য হওয়ার পর।

মনে হলো যেন সেই তোবড়ানো, প্রায় বুড়োটে মুখওয়ালা যুবকটি আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল। কোনো কথা না বলে সে আমার হাত ধরে তলকুঠরির গলি-ঘুঁজি বেয়ে নিয়ে এল সেই অভ্যর্থনা কক্ষে, যেখানে ইতিমধ্যেই দুবার আমি হাজিরা দিয়েছি।

‘তা এবার আপনার আগমন কীসের জন্য?’ উপহাসের সুরে জিজ্ঞেস করল সে।

‘হের ক্রাফৎশ্‌তুদৎ-এর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আলাপ করতে চাই।’

‘আমাদের ফার্মের কাজে কি আপনি সন্তুষ্ট হননি, প্রফেসর?’ জিজ্ঞেস করল সে।

‘হের ক্রাফৎশ্‌তুদৎ-এর সঙ্গে দেখা করতে চাই আমি,’ লোকটার বড় বড় কালো চোখ দুটো তখন বিদ্বেষ ও উপহাসে জ্বলছিল। সেদিকে তাকাবার চেষ্টা না করে জেদ করলাম আমি।

আরও পড়ুন

‘বেশ, আপনার যা ইচ্ছে,’ বহুক্ষণ আমায় খুঁটিয়ে দেখে সে বলল, ‘এইখানে অপেক্ষা করুন একটু।’

এই বলে সে কাচের পার্টিশনের পেছনের একটা দরজা দিয়ে অদৃশ্য হলো। আধঘণ্টা কেটে গেল।

প্রায় ঢুলছিলাম আমি, এমন সময় একটা খসখস শব্দ শোনা গেল কোণে, আধা অন্ধকারের মধ্য থেকে বেরিয়ে এল একটা সাদা আলখাল্লা পরা মূর্তি, হাতে একটা স্টেথোস্কোপ। ‘একজন ডাক্তার,’ মনের মধ্যে একটা চিন্তা খেলে গেল, ‘আমায় পরীক্ষা করতে চায়? ক্রাফৎশ্‌তুদৎ মশায়ের সঙ্গে দেখা করতে হলে কি তা অপরিহার্য?’

এ সেই লোক, খবরের কাগজ থেকে যার চেহারাটা আমার স্পষ্ট মনে আছে
হের ক্রাফৎশ্‌তুদৎ, আপনি নিশ্চয় জানেন, আমি গণিতের একটু চর্চা করি, মানে আধুনিক গণিতের। প্রথমে ভেবেছিলাম ইলেকট্রনিক যন্ত্র নিয়ে একটা সাধারণ কম্পিউটিং কেন্দ্র গড়েছেন আপনি। কিন্তু এখন দুই দৃষ্টান্তে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে যে ব্যাপার তা নয়। আপনার এ কেন্দ্রে অঙ্ক কষে মানুষে এবং কষে একেবারে প্রতিভাধর ব্যক্তির মতো। আর সবচেয়ে আশ্চর্য—অতি অস্বাভাবিক অমানুষিক দ্রুততায়

‘আমার সঙ্গে আসুন,’ কর্তৃত্বের সুরে বলল ডাক্তার। আমিও তার পেছন পেছন চললাম। ভেবে পাচ্ছিলাম না কী হবে, কেনই-বা এর মধ্যে এসে জড়ালাম।

একটা লম্বা বারান্দা দিয়ে আমরা যাচ্ছিলাম, ওপরের কোথা থেকে যেন দিনের আলো এসে পড়ছিল। বারান্দার শেষে একটা উঁচু, জগদ্দল দুয়ার। ডাক্তার থামল সেখানে।

‘এখানে একটু অপেক্ষা করুন। ক্রাফৎশ্‌তুদৎ আপনার সঙ্গে দেখা করবেন।’

মিনিট পাঁচেক পরে দরজাটা হাট করে খুলল ডাক্তার।

‘চলুন তাহলে।’ ও বলল যে সুরে, তাতে যেন আমার ভবিষ্যৎ ভেবে একটু খেদই ঝরে পড়ল।

আমি বাধ্যের মতো চললাম তার সঙ্গে। পৌঁছলাম একটা মন্ডপের মতো জায়গায়, তার চারিদিকে বড় বড় জানালা। অজ্ঞাতেই চোখ বন্ধ করতে হলো।

আমার ঘোর ভাঙল একটা তীক্ষ্ম কণ্ঠস্বরে।

‘এদিকে আসুন প্রফেসর রাউখ।’

ডান দিকে ফিরে দেখলাম, একটা বেতের নিচু আরাম কেদারায় বসে আছে ক্রাফৎশ্‌তুদৎ। এ সেই লোক, খবরের কাগজ থেকে যার চেহারাটা আমার স্পষ্ট মনে আছে।

‘আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন আপনি?’ কোনো রকম সৌজন্য না দেখিয়ে, আসন থেকেও না উঠে জিজ্ঞেস করল সে, ‘কী করতে পারি আপনার জন্য?’

‘তার মানে, পেশা বদলেছেন তাহলে?’ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বললাম আমি। এ পনের বছরে বুড়িয়ে এসেছে সে, লোল ভাঁজ পড়েছে মুখের চামড়ায়।

‘কী বলতে চাইছেন, প্রফেসর?’ মন দিয়ে আমায় নজর করে বলল সে।

‘আমি ভেবেছিলাম, মানে আশা করেছিলাম যে আপনি এখনো...’

‘ওহ, এই ব্যাপার।’

হো হো করে হেসে উঠল ক্রাফৎশ্‌তুদৎ।

‘কাল বদলেছে রাউখ, দিন বদলেছে। যা হোক, আমার আগ্রহ আপনার আশা নিয়ে তত নয়, কী উদ্দেশ্যে আপনি এখানে এলেন তা নিয়ে।’

‘হের ক্রাফৎশ্‌তুদৎ, আপনি নিশ্চয় জানেন, আমি গণিতের একটু চর্চা করি, মানে আধুনিক গণিতের। প্রথমে ভেবেছিলাম ইলেকট্রনিক যন্ত্র নিয়ে একটা সাধারণ কম্পিউটিং কেন্দ্র গড়েছেন আপনি। কিন্তু এখন দুই দৃষ্টান্তে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে যে ব্যাপার তা নয়। আপনার এ কেন্দ্রে অঙ্ক কষে মানুষে এবং কষে একেবারে প্রতিভাধর ব্যক্তির মতো। আর সবচেয়ে আশ্চর্য—অতি অস্বাভাবিক অমানুষিক দ্রুততায়। বলতে কি, আমি এসেছি আপনার গণিতজ্ঞদের সঙ্গে দেখা করতে, অসাধারণ ব্যক্তি তাঁরা।’

বটে? আমাদের কারবার কতটা সৎভাবে চলছে, তাই বুঝিয়ে বলতে হবে আপনাকে? আপনার নির্বোধ অঙ্কগুলো যে কষে দেওয়া হয়েছে বিশ শতকে যে ভাবে কষা উচিত সেইভাবে, তাতে আপনি সন্তুষ্ট নন দেখছি? আপনার নিজেই ভুক্তভোগী হয়ে দেখার সাধ হয়েছে তাহলে?

ক্রাফৎশ্‌তুদতের মুখে প্রথমে একটু হাসি ফুটল, তারপর ক্রমশ সেটা পরিণত হলো অট্টহাস্যে।

‘এতে হাসির কী হলো, হের ক্রাফৎশ্‌তুদৎ?’ বিরক্ত লাগল আমার, ‘আমার এ ইচ্ছেটা কি ভারি নির্বোধ ও হাস্যকর? কিন্তু যে ধরনের সমাধান আমি পেয়েছি, তা দেখে গণিতভক্ত যেকোনো লোকই তো আশ্চর্য হবে।’

‘আমি হাসছি একেবারে অন্য একটা কথা ভেবে। আমি হাসছি আপনার মফঃস্বলী সীমাবদ্ধতায়। আপনি প্রফেসর রাউখ, শহরের একজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি, যাঁর পাণ্ডিত্যের কথায় অপরিণত বালিকা আর অবিবাহিত বৃদ্ধারা উচ্ছ্বসিত, সেই আপনি আধুনিক বিজ্ঞানের দ্রুতগতির কত পেছনেই না পড়ে আছেন!’

প্রাক্তন নাজি-পুলিসকর্তার এই ঔদ্ধত্যে বিমূঢ় হয়ে গেলাম আমি।

চেঁচিয়ে বললাম, ‘থামুন আপনি! মাত্র পনের বছর আগে আপনার পেশা ছিল কেবল নিরীহ লোককে গরম লোহার ছ্যাঁকা দেওয়া। বর্তমান বিজ্ঞানের কথা বলার কী অধিকার আছে আপনার? যদি জানতে চান তবে শুনুন, যে কাজ করতে প্রতিভাধরদের পক্ষেও কয়েক বছর, এমন কি সারা জীবন লেগে যায়, তা আপনি একদিনের মধ্যে আদায় করছেন কী পদ্ধতি প্রয়োগ করে, ঠিক সেটাই জানতে আমি এসেছি। আপনার দেখা পেয়ে আমি খুবই খুশি। একজন বৈজ্ঞানিক ও নাগরিক হিসাবে আমার কর্তব্য শহরের সবাইকে এ কথা জানানো যে একজন প্রাক্তন নাজি-জল্লাদ বিজ্ঞানীদের হেনস্থা করার পেশা বেছেছেন—যে বিজ্ঞানীদের কর্তব্যই হলো মানুষের সুখের জন্য কাজ করে যাওয়া।’

ক্রাফৎশ্‌তুদৎ চেয়ার ছেড়ে ভ্রূকুটি করে এগিয়ে এল আমার দিকে।

‘বলি শুনুন রাউখ। ভালো কথায় বলি, আমায় রাগাবেন না। আমি জানতাম আজ হোক, কাল হোক আপনি আসবেন। কিন্তু আমার আপিসে একজন মুর্খকে দেখব, তা কখনো আশা করিনি। সত্যি বলতে কি, ভেবেছিলাম আপনি হবেন আমাদের একজন সহযোগী ও সহায়।’

‘কী বললেন?’ চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, ‘আগে পরিষ্কার করে বলুন, যে লোকদের কল্যাণে আপনি মুনাফা লুঠছেন, তাদের আপনি শোষণ করছেন সৎভাবে নাকি অসৎভাবে?’

ক্রাফৎশ্‌তুদতের মুখখানা কুঁকড়ে একটা হলদেটে-নোংরা চামড়ার পুঁটলি হয়ে দাঁড়াল। পাঁশনের পেছনকার পাণ্ডু-নীল চোখ দুটো পরিণত হলো দুটো সঙ্কীর্ণ ছিদ্রে, তাতে ঝলক দিতে লাগল কেমন তিক্ত সবজেটে একটা আগুন। মুহূর্তের জন্য মনে হলো যেন আমি একটা বেচা কেনার বস্তু—খরিদ্দার পরখ করে দেখছে আমায়।

অন্ততপক্ষে আমি আপনাকে এখানে আসার নিমন্ত্রণ করিনি। কিন্তু আপনি নিজেই এই মেজাজে যখন এসেছেন, তখন আপনি চান না চান, আমাদের কাজে লাগবেন।

‘বটে? আমাদের কারবার কতটা সৎভাবে চলছে, তাই বুঝিয়ে বলতে হবে আপনাকে? আপনার নির্বোধ অঙ্কগুলো যে কষে দেওয়া হয়েছে বিশ শতকে যে ভাবে কষা উচিত সেইভাবে, তাতে আপনি সন্তুষ্ট নন দেখছি? আপনার নিজেই ভুক্তভোগী হয়ে দেখার সাধ হয়েছে তাহলে?’ হিসিয়ে উঠল ক্রাফৎশ্‌তুদৎ, রাগে-বিদ্বেষে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল তার জঘন্য মুখটা।

‘আমি বিশ্বাস করি না যে এখানকার কারবারটা খুব খাঁটি। আপনার প্রাক্তন খ্যাতিই এ সন্দেহের পক্ষে যথেষ্ট। তা ছাড়া আপনাদের একজন সহকারীর চিৎকার শোনার দুর্ভাগ্য হয়েছিল আমার...’

‘খুব হয়েছে, থামুন!’ হুঙ্কার দিল ক্রাফৎশ্‌তুদৎ, ‘অন্ততপক্ষে আমি আপনাকে এখানে আসার নিমন্ত্রণ করিনি। কিন্তু আপনি নিজেই এই মেজাজে যখন এসেছেন, তখন আপনি চান না চান, আমাদের কাজে লাগবেন।’

খেয়াল ছিল না যে ডাক্তারটি আমায় পথ দেখিয়ে এসেছিল, সে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল আমার পেছনে। ফার্মের কর্তার সঙ্কেত পাওয়ামাত্র একটা পেশীবহুল হাত আমার মুখ চেপে ধরল, ঝাঁঝাল ওষুধে ভেজানো এক টুকরো তুলো গুঁজে দেওয়া হলো আমার নাকে।

জ্ঞান হারালাম আমি।

(চলবে…)

* সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত গল্প সংকলন গ্রহান্তরের আগুন্তুক বই থেকে নেওয়া।

মূল: আনাতলি দনে্‌প্রভ

অনুবাদ: ননী ভৌমিক