আইভা – ২

আগের পর্ব

এ ধরনের জেরার মুখে হতচকিত হয়ে আমি সোফা ছেড়ে মুখোমুখি বসলাম আমার সহযাত্রীর সামনে। তার অন্ধকার মুখাবয়বটা মনে হলো লড়াইয়ের জন্যে উদগ্রীব। আমার জবাবের অপেক্ষা না করে সে বলে চলল:

‘বুঝতে পারছেন না, ব্যাপারটা শব্দ নিয়ে নয়, সে শব্দ কী প্রকাশ করছে, আরও সঠিকভাবে বললে—কী মূর্তি, ভাবনা, বোধ, অনুভূতিকে তা ফুটিয়ে তুলছে আমাদের চেতনায়। মানুষের মধ্যে দ্বিতীয় সংকেত ব্যবস্থা নিয়ে পাভলভ যা লিখেছিলেন, তা পড়েছেন কি? নাকি পড়ে থাকলেও তা বোঝেননি? তবে বলি, জীব ও মানুষের উচ্চ নার্ভ ক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করে পাভলভ প্রথম দেখান যে মানুষের মধ্যে আছে একটা দ্বিতীয় সংকেত ব্যবস্থা, তার ভিত্তি হলো কথা, যা অতি জটিলতম অনুভবকেও জাগিয়ে তুলতে পারে। শব্দ হলো বহির্বিশ্বের বিভিন্ন বস্তু ও প্রক্রিয়া নির্দেশের কোড, আর এই কোড প্রায়ই বহির্বিশ্বের আসল বস্তুটার মতোই প্রতিক্রিয়া ঘটাতে পারে মানুষের মধ্যে। ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন?’

‘খানিকটা পারছি...’

‘হঠাৎ একটা গরম ইস্ত্রিতে হাত পড়লে, কিছু ভাবার আগেই আপনি হাতটা টেনে নেন; তা করেন কেন? এ হলো রিফ্লেক্স ক্রিয়া। আর ইস্ত্রিটা ছুঁতে যাবেন এমন সময় যদি কেউ চোঁচিয়ে ওঠে “গরম!”—তাহলেও কি তাই করেন না?’

‘তা করি বৈকি,’ বললাম আমি।

‘তার মানে দাঁড়াল, একটা তপ্ত ইস্ত্রি আর “গরম” কথাটা মারফত একটা সংকেত—এ দুইয়েরই প্রতিক্রিয়া এক রকম!’ সগর্বে সিদ্ধান্ত টানলেন সহযাত্রী।

‘তা বটে।’

‘এবার অন্য একটা জিনিস ভেবে দেখুন। “গরম” কথাটাকে যদি শূন্য দিয়ে কোডবদ্ধ করি এবং এ কোড ওই শব্দের মতোই যদি আপনার অভ্যস্ত হয়ে যায়, তাহলে ইস্ত্রিটা ছোঁয়ার সময় কেউ “শূন্য” বলে চেঁচালেও কি আপনি হাত সরিয়ে নেবেন না?’

মানুষের প্রায় অসাধ্য সব জটিল গাণিতিক হিসাব কষে দেয় যন্ত্র। এমন সব অঙ্ক তা কষতে পারে যে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। এবং কষে দেয় মুহূর্তের মধ্যে, যা মানুষের করতে হলে লাগত কয়েক মাস, এমনকি বছর। এ যন্ত্র তৈরি হয় কী ভাবে, তা আপনাকে বলতে যাচ্ছি না।

আমি চুপ করে রইলাম। লোকটা বলে চলল:

‘এটা যদি মানেন, তাহলে পরেরটাও মানতে হবে। বহির্বিশ্বের যত সংকেত মানুষের ওপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তার সব যদি একটা একরূপ এবং যথাসম্ভব সরল কোডে অনুবাদ করা যায়, তাহলে কতকগুলো দিক থেকে আমাদের খুবই সুবিধা। কী বলতে চাইছি, বুঝেছেন? শুধু শব্দ নয়, সাধারণভাবে সব সংকেত। অসীম বৈচিত্র্য ভরা একটা বিশ্বেই তো আমাদের বাস। সেটাকে আমরা চিনি আমাদের সবকটি বোধ-ইন্দ্রিয় দিয়ে। আমাদের গতি, অনুভূতি, চিন্তা... এসব ঘটাচ্ছে তার বিভিন্ন সংকেত। স্নায়ুপ্রান্ত থেকে এ সব সংকেত বাহিত হচ্ছে স্নায়ুব্যবস্থার উচ্চ কেন্দ্রে, মস্তিষ্কে। পরিবেশ থেকে যে সংকেতগুলো আমরা পাচ্ছি, তা স্নায়ু বেয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছাচ্ছে কী আকারে, তা জানেন কি?’

বললাম, ‘জানি না।’

‘পৌঁছাচ্ছে কোডবদ্ধ রূপে এবং সে কোড কেবল শূন্য আর এক দিয়ে গড়া।’

আরও পড়ুন

আপত্তি করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সহযাত্রী কোনো রকম ভ্রুক্ষেপ না করে বলে গেল:

‘বাইরের জগতের সব সংকেত স্নায়ুব্যবস্থা মারফত কোডবদ্ধ হয় ঠিক একই রূপে। আর আপনার সমালোচক যখন শূন্য-একের মধুর ক্রমান্বয়ের প্রশংসা করছিলেন, তখন তিনি একেবারে সত্য কথাই বলেছেন, কেননা আপনি যখন কবিতা পড়েন বা অন্যের আবৃত্তি শোনেন, তখন আপনার চোখের দৃষ্টিস্নায়ু বা কানের শ্রুতিস্নায়ু মস্তিষ্কে যা পাঠায়, সেটা কেবল ওই শূন্য আর একের সেই মধুর ক্রমান্বয়টাই।’

‘যত বাজে কথা!’ চেঁচিয়ে উঠে আমি দরজার কাছে গিয়ে বাতিটা জ্বেলে দিলাম। তারপর ভালো করে চেয়ে দেখলাম আমার সহযাত্রীর দিকে। সে তখন রীতিমতো উত্তেজিত।

বলল, ‘দয়া করে অমন করে তাকাবেন না। কী ভেবেছেন, আমি একটা পাগল? অন্যের কথার সত্যতায় সন্দেহ করার পক্ষে আপনার নিজস্ব অজ্ঞতাকেই যদি পর্যাপ্ত মনে করেন, তাহলে দোষ আমার নয়। কিন্তু এ আলাপ আপনিই শুরু করেছেন, তাই চুপ করে বসে শুনুন।’

আঙুল দিয়ে আমায় সোফা নির্দেশ করল সে। বাধ্যের মতো আমি বসলাম।

বলল, ‘দিন একটা সিগারেট। ভেবেছিলাম ছেড়ে দেব, কিন্তু দেখা যাচ্ছে সহজ নয়।’

নীরবে সিগারেট এগিয়ে দিয়ে দেশলাই ধরালাম। কয়েক বার জোরে জোরে টান দিয়ে যে আলাপ সে শুরু করল, তেমন আশ্চর্য কাহিনি আমি জীবনে কখনো শুনিনি।

‘ইলেকট্রনিক কম্পিউটার বা পরিগণকের কথা আপনি শুনেছেন নিশ্চয়। আধুনিক বিজ্ঞান ও টেকনোলজির এ এক আশ্চর্য কীর্তি! মানুষের প্রায় অসাধ্য সব জটিল গাণিতিক হিসাব কষে দেয় যন্ত্র। এমন সব অঙ্ক তা কষতে পারে যে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। এবং কষে দেয় মুহূর্তের মধ্যে, যা মানুষের করতে হলে লাগত কয়েক মাস, এমনকি বছর। এ যন্ত্র তৈরি হয় কী ভাবে, তা আপনাকে বলতে যাচ্ছি না। বললেও কিছু বুঝবেন না, কারণ আপনার পেশা সাহিত্য। আমি শুধু একটা জরুরি জিনিসের দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করব: এ যন্ত্র সংখ্যা রাশি নিয়ে কাজ করে না, করে রাশির কোড-সংকেত নিয়ে। কোনো সমস্যা সমাধানের জন্যে পেশ করার আগে সব সংখ্যাকে কোডবদ্ধ করা হয় এবং করা হয় ঠিক ওই শূন্য আর এক দিয়ে, যার বিরুদ্ধে আপনার অত আপত্তি। অবশ্য বলতে পারেন, এই শূন্য আর এক নিয়ে কেন আমি এত বকছি। তার কারণ খুব সহজ। ইলেকট্রনিক যন্ত্র যে সব সংখ্যা যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করে, তা বিদ্যুৎ-প্রেরণার রূপ নেয়। এক হলো “প্রেরণার অস্তিত্ব”, শূন্য হলো “প্রেরণার অনস্তিত্ব” ।’

‘সংখ্যাকে শূন্য এবং এক দিয়ে কোডবদ্ধ করায় আমি আপত্তি করিনি। কিন্তু শব্দের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? এর মধ্যে ওই শূন্য আর এক আসে কোথা থেকে, যা কিনা আপনার মতে কবিতার সৌন্দর্য আর ইস্ত্রির তাপমাত্রা পৌঁছে দেবে আমার মস্তিষ্কে?’

আরও পড়ুন
জীব ও মানুষের উচ্চ নার্ভ ক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করে পাভলভ প্রথম দেখান যে মানুষের মধ্যে আছে একটা দ্বিতীয় সংকেত ব্যবস্থা, তার ভিত্তি হলো কথা, যা অতি জটিলতম অনুভবকেও জাগিয়ে তুলতে পারে। শব্দ হলো বহির্বিশ্বের বিভিন্ন বস্তু ও প্রক্রিয়া নির্দেশের কোড, আর এই কোড প্রায়ই বহির্বিশ্বের আসল বস্তুটার মতোই প্রতিক্রিয়া ঘটাতে পারে মানুষের মধ্যে।

‘দাঁড়ান, দাঁড়ান। সময়ে বুঝবেন। আপাতত শূন্য আর একের উপযোগিতাটা তো বুঝলেন। এবার হিসাবের একটা ইলেকট্রনিক যন্ত্র কল্পনা করুন—বিরাট একটা যন্ত্রব্যবস্থা, যেখানে বিভিন্ন ধরনের গাণিতিক অঙ্ক কষা হচ্ছে দ্রুত বেগে, বিদ্যুৎ-প্রেরণার সাহায্যে।

‘সবাই জানেন যে একটা সহজ পাটিগণিতের অঙ্কেও প্রায়ই একাধিক অপারেশনের প্রয়োজন হয়। আর এ ধরনের বহুবিধ অপারেশনসহ একটা অঙ্ক কষছে যন্ত্র, সেটা কীভাবে হয়? এটাই সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং। একটা জটিল অঙ্ক কষার সময় মেশিনে বিশেষ প্রেরণা-কোডের আকারে কেবল অঙ্কের শর্তগুলোই জোগানো হয় না, কোডবদ্ধ রূপে তার প্রক্রিয়া চক্রের একটা কর্মসূচিও দেওয়া হয়। যন্ত্রটাকে যেন বলা হয়: “প্রথম সংখ্যা দুটো যোগ দিয়ে তার যোগফল মনে রাখো; তারপর পরের দুটো সংখ্যাকে গুণ করে তার ফল মনে রাখো; তারপর প্রথম ফলটাকে দ্বিতীয় ফল দিয়ে ভাগ করে উত্তর বলো।” যন্ত্রকে ভাগ করতে বলা হচ্ছে, সে আবার কী কথা? ফল মনে রাখতে বলছি যন্ত্রকে, অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়। কিন্তু এটা কোনো আজব কল্পনা নয়। তার বিভিন্ন প্রক্রিয়ার কর্মসূচিটা যন্ত্র ভালোই বোঝে, অঙ্কের অন্তর্বর্তী ফলাফলগুলোকে বেশ মনে রাখতে পারে।

‘এই কর্মসূচিটাও যন্ত্রকে দেওয়া হয় কোডবদ্ধ প্রেরণা রূপে। একেক গুচ্ছ রাশি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া হয় পরিপূরণ কোড, যাতে জানিয়ে দেওয়া হয় এ রাশিগুলো দিয়ে কী করতে হবে। কিছুকাল আগেও এই কর্মসূচি তৈরি করতে হতো মানুষকে।’

‘মানুষ নইলে আবার কে করবে?’ বললাম আমি, ‘একটা সমস্যার অঙ্কের সমাধান কীভাবে করতে হবে, সেকি আর যন্ত্র জানতে পারে।’

‘একেবারে ভুল বললেন! দেখা গেছে, এমন যন্ত্র বানানো সম্ভব, যা নিজেই বিভিন্ন প্রক্রিয়ার কর্মসূচি গড়ে নিতে পারে।

আগামীকাল আসছে বিজ্ঞানচিন্তার আগস্ট সংখ্যা। এ সংখ্যায় থাকছে:

‘আপনি নিশ্চয় জানেন, ইশকুলে একেক ধরনের অঙ্ক একেকটা সূত্র বা আমাদের ভাষায় একেকটা কর্মসূচি অনুসারে সমাধান করতে শেখে ছেলেরা। সে কাজটা যন্ত্রকে শেখালেই হলো। দরকার হবে শুধু তার স্মৃতিতে কোড আকারে অতি টিপিক্যাল অঙ্কের কর্মসূচিগুলো দিয়ে রাখা, মানুষের সাহায্য ছাড়াই সে তখন সঠিকভাবে অঙ্ক কষে দেবে।’

‘না, এ হতে পারে না!’ আমি বলে উঠলাম, ‘যন্ত্র সব টিপিক্যাল অঙ্কের কর্মসূচিগুলো মনে রাখতে পারলেও তার কোন সূত্রটা দিয়ে সমাধান হবে, তা বের করবে কী করে?’

‘কথাটা ঠিক! অবস্থাটা তা-ই ছিল। অঙ্কের শর্তগুলো দেওয়া হতো যন্ত্রকে, তারপর জোগানো হতো সংক্ষিপ্ত কোড, যেমন “২০ নং কর্মসূচি অনুসারে সমাধান করো।” যন্ত্রও তাই করত।’

‘আর সেই হলো আপনার যন্ত্রের অপরূপ চিন্তাক্ষমতার শেষ কথা।’ বললাম আমি।

‘ঠিক উল্টো। যন্ত্রকে নিখুঁত করে তোলার সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক কাজটার শুরুই হচ্ছে এখানে। আপনি জানেন কি, অঙ্কের শর্তগুলো পাওয়ার পর যন্ত্র কেন নিজে থেকে তার প্রয়োজনীয় সূত্র বা কর্মসূচিটি বেছে নিতে পারে না?’

‘অবশ্যই জানি,’ বললাম আমি, ‘কারণ পরপর প্রেরণা রূপে যে রাশিগুলো আপনি তাকে দিলেন, তারা নিজেরা নির্বাক। তাদের নিয়ে কী করতে হবে, তা আপনার যন্ত্র জানে না। জানে না সমস্যাটা কী, কী করতে হবে। যন্ত্র তো নির্জীব। সমস্যার বিশ্লেষণ করতে তা অক্ষম। তা পারে কেবল মানুষ।’

চলবে…

মূল: আনাতলি দনে্‌প্রভ

অনুবাদ: ননী ভৌমিক

* সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘প্রগতি প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত গল্প সংকলন গ্রহান্তরের আগুন্তুকথেকে নেওয়া।

আরও পড়ুন