অতীতের ছায়া – ১১

লাফিয়ে উঠে নিকিতিন সশব্দে আরামকেদারাটা সরিয়ে দিল।

‘আমি কী বোকা।’ ঘরের ভেতর পায়চারী করতে করতে নিকিতিন ভাবতে লাগল, ‘সবকিছু, তখনই ওকে বলিনি কেন? এখনও নিশ্চয়ই বেশি দেরি হয়নি। চিঠি লেখা যেতে পারে, সোজা চলে গেলেও হয়।’

নিকিতিনের উত্তেজনা বেড়ে উঠল—ব্যাপারটার এখনই একটা সুরাহা করে ফেলতে হয়। সোজা গিয়ে মিরিয়ামকে সব কথা সে বলবে। এখনি।

নিকিতিন হাত ছুঁড়তেই ডেস্কের ধারে রাখা ডাইনোসরের কশেরুকার মোটা হাড়টা ছিটকে পড়ে গিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। শান্ত হয়ে হাঁটু গেড়ে টুকরোগুলো নিকিতিন তুলতে লাগল। ভীষণ লজ্জাও পেয়ে গেল যেন বাইরের কেউ তার এই বিচলিত ভাব দেখে ফেলেছে। চারপাশটা একবার চেয়ে দেখেও নিল সে। ঘরের পরিচিত দৃশ্য আবার তার মনে চেপে বসল। এই তো তার জগৎ, শান্ত, বাস্তব, তৃপ্তিকর, তবে একেক সময় অত্যন্ত সংকীর্ণ। কাচ লাগানো ওই আলমারীটায় রয়েছে প্রাচীন প্রাণিজগতের রত্নাবলী, তাদের নিয়ে কাজকর্ম, পড়াশুনো এখনও বাকি রয়েছে...।

তাছাড়া রয়েছে সেই বিরাট ধাঁধা—অতীতের ছায়া। তাকে ব্যস্ত রাখার পক্ষে এই তো অনেক। মাস্টারমশাই তো আগেই বলেছেন, যে কাজ শুরু করার ব্যাপারে সে বড়ই মন্থর। মিরিয়ামের বেলায়ও সে অত্যন্ত দেরি করে ফেলেছে। আর্কার্লি পাহাড়ে সেই বাঁশি বাজানো ঘাসের উপত্যকায় সে তার সুযোগ হারিয়েছে...। এখন মিরিয়ামকে পাওয়ার জন্য তাকে একাগ্র মনে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। তবু এই অতীতের ছায়া নিয়ে কাজে অনেক সময় ও উৎসাহ প্রয়োজন। মিরিয়ামও যে তাকে ভালবাসে এ বিষয়ে সে অত নিশ্চিত হয় কিসের জোরে? মিরিয়াম তো আর কাউকেও ভালবাসতে পারে? 

হঠাৎ তার উত্তেজনা কোথায় উবে গেল, নিকিতিন আবার বসে পড়ল। খুবই দুঃখের কথা, কিন্তু তবুও উপায় নেই। ধাঁধার সমাধানের কাজে এখন মিরিয়ামকে ত্যাগ করতেই হবে। অজ্ঞেয়কে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। ডাইনোসরের ওই অশরীরী ছায়ার যে কোনো বাস্তব কারণ আছে, সে বিষয়ে সে নিশ্চিত! এই কঠিন কাজ আর অন্ধ কুসংস্কারের কাছে হার মানলে মানুষের বুদ্ধিশক্তির ওপরে আস্থা হারাতে হয়।

কিন্তু নিজের অজ্ঞাতসারেই নিকিতিন মরুভূমির সেই অভিযানের কথাই ভাবতে লাগল। প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় সে মনে করে চলল, বিশেষত শেষদিকে মস্কো ফিরে আসার ঠিক আগের দিনগুলো। প্রকৃতিবিজ্ঞানীর প্রখর স্মরণশক্তির ফলে তার সুবিধাও হলো।

মনে পড়ল সেই দিনটির কথা। বহু দূরের এক শহরের হোটেলে সে তার গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে। একটা চওড়া ডিভানে সে শুয়ে। দক্ষিণের সূর্যালোকে ভেসে যাওয়া রাস্তার দিকে মুখ করা জানলার খড়খড়িগুলো বন্ধ। মাত্র একটি সরু আলোর রেখা ছুরির মতো এসে বিঁধেছে প্রায় অন্ধকার ঘরটাকে। 

জানলার উল্টোদিকের দেয়ালে একটা আলোর চমক নিকিতিনের চোখে পড়ে। কাছ থেকে ভালভাবে নজর করে দেখে একটা ছোট্ট ছবি পড়েছে। রাস্তার একটা উল্টো ছবি। নিষ্পত্র পপলার ডাল, নতুন চালওয়ালা একটা নিচু বাড়ি। একটা লোহার গেটের রেলিং, আর একজন অদ্ভুত বেঁটে মানুষ বাতাসে তার গাউনের প্রান্তটা উড়িয়ে হেটে চলেছে... 

এক ঝলক খোলা বাতাসের মতো একটা কথা নিকিতিনের মাথায় এসে গেল—আর্কার্লি পাহাড়ে ঘেরা সেই বিচ্ছিন্ন ছোট্ট উপত্যকা, সংকীর্ণ অলিন্দটি একটা বিস্তৃত সমতলে গিয়ে পড়েছে আর তার ঠিক সামনেই রজনের আয়নাটা...মস্ত এক ক্যামেরা, তার ফোকাস সহজেই নির্দেশ করা যায়! ছায়াটা কী করে পড়ল তা সে আগেই বুঝতে পেরেছে। কিন্তু সেটা কেমন করে স্থায়ী হলো, আলো ছায়ার আকস্মিক খেলা এত শতাব্দী পরেও কেমন করে রয়ে গেল সেটাই সে বুঝতে পারছে না। ফোটোগ্রাফি নিয়ে সে পড়াশুনা করছে কিন্তু এখনও কোনো ফল পায়নি। 

পরের দিন নিকিতিন বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক ঘুচিয়ে একটা মোটা বই নিয়ে পড়ল। রঙের তত্ত্ব আর মানুষের চোখের দৃষ্টির বিশ্লেষণ শেষ করে সে শেষ পরিচ্ছেদটায় এসে দেখল লেখা রয়েছে...
আরও পড়ুন

দাঁড়াও! নিকিতিন লাফিয়ে উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারী করতে লাগল। সেই ছায়াটা ছিল রঙিন। রঙিন ফোটোগ্রাফি নিয়েই তবে পড়াশুনা করতে হয়! 

পরের দিন নিকিতিন বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক ঘুচিয়ে একটা মোটা বই নিয়ে পড়ল। রঙের তত্ত্ব আর মানুষের চোখের দৃষ্টির বিশ্লেষণ শেষ করে সে শেষ পরিচ্ছেদটায় এসে দেখল লেখা রয়েছে, ‘রঙিন ফোটোগ্রাফির বিশেষ পদ্ধতি’। গত শতাব্দীর ত্রিশের ঘরে লুই দাগুয়েরকে লেখা জোসেফ নিয়েপচের এই চিঠিটি তাতে তুলে দেওয়া আছে: 

‘... দেখা গেল আলোর প্রক্রিয়া অনুসারে প্লেটের ইমালসনও (এসফল্ট রজন) বদলে যায়। ফিকে হয়ে আসা আলোয় স্লাইডের ছবির মতো ছবি দেখা দেয়, রঙের প্রতিটি বর্ণালীও পরিষ্কার ফুটে ওঠে।’

(চলবে…) 

* ইভান ইয়েফ্রেমভ রুশ জীবাশ্মবিদ ও কল্পবিজ্ঞান লেখক। জীবাশ্মবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ট্যাফোনোমি। ফসিলের প্যাটার্ন—কোনো প্রাণী কীভাবে পচে গিয়ে জীবাশ্মে পরিণত হয় এবং এ জীবাশ্মের প্যাটার্ন কীরকম—সেসব বিষয় নিয়ে এ শাখায় আলোচনা করা হয়। ইয়েফ্রেমভের বেশ কিছু বিজ্ঞান কল্পকাহিনির একটি অনুবাদ সংকলন প্রকাশিত হয় মস্কোর ‘বিদেশি ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ থেকে। ইভান ইয়েফ্রেমভ গল্প সংকলন নামের এ বইয়ের গল্পগুলো বাংলায় অনুবাদ করেছেন শুভময় ঘোষ।