অতীতের ছায়া – ১০

কিন্তু এই যাদু আয়না, অতীতকে দেখার এই জানালাকে এখন এই পাণ্ডববর্জিত পাহাড়ি রাজ্যে ছেড়ে যেতে হবে। হাতে সময় একটুও নেই। যাওয়ার দিন পিছিয়ে দেওয়া বিপজ্জনক। অভিযানের নির্দিষ্ট দিন ফুরিয়ে গেছে। মাল বেশি হয়ে গেছে। তাই নিয়েই দুর্গম পথে বাড়িমুখো ফিরতে হবে। একটা ছায়ার জন্য তো এতগুলো মানুষের জীবন বিপন্ন করা যায় না। না, এখনই তাকে যেতে হবে।

নিকিতিন দ্রুত পায়ে গাড়ির কাছে ফিরে এল। বজ্রের কাছে পৌঁছে নিকিতিন একবার মিরিয়ামের দিকে তাকাল। সে তখন সংগ্রামীর কাছে দাঁড়িয়ে পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে। সেখানেই লুকিয়ে আছে সেই ছোট্ট উপত্যকাটি। আর্কার্লি পাহাড়ে এই ঘটনাবহুল দিনগুলোর শেষ এই ছবিটিই নিকিতিনের মনে গাঁথা হয়ে গেল।

চল! ধড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে নিকিতিন বলে উঠল। ডাইনোসরদের সমাধিক্ষেত্র ছেড়ে গাড়ি চলতে শুরু করল। নিকিতিন একদৃষ্টে চেয়ে আছে চাকার নিচ থেকে ছিটকে ওঠা জিপসামের স্ফুলিঙ্গগুলোর দিকে।

সীসার মতো আকাশের গায়ে মিলিয়ে আসছে ঠান্ডা বিমর্ষ আলো। জানালার জোড়া পাল্লার ভেতর দিয়ে নিকিতিন পাশের বাড়ির ছাদের দিকে তাকাল। বরফে ছাদটা ঢেকে গেছে। চিমনি দিয়ে বেরিয়ে আসা ধোঁয়াটা বাতাসের ঘায়ে ছড়িয়ে পড়ছে।

হাতের বইটা সরিয়ে দিয়ে নিকিতিন আরামকেদারায় বসে আড়ামুড়ি ভেঙে নিল। এই মুহূর্তে জীবনটাকে তার বড় বিস্বাদ বলে মনে হচ্ছে। বিজ্ঞানীর নিকের মন কিছুতেই হার মানতে চায় না, কিন্তু ভীষণ পরাজয়ের আর বেশি বাকি নেই।

নিকিতিন বিষণ্ন মনে ভাবছিল, তার প্রতিষ্ঠার ফলেই তাকে এখনো হাসির পাত্র হয়ে উঠতে হয়নি। পদার্থবিদদের প্রতি তার আবেদনে সবাই প্রশ্রয়ের ভাব দেখিয়েছে—যেন বলতে চায়, হ্যাঁ, তারাও একেক সময় মরীচিকা আর মায়া স্বপ্নের কথা শুনেছে বটে। নিকিতিনও ধীর ও শান্ত অবস্থায় তাদের বক্তব্য মেনে নিয়েছে।

এমনকি ওই ডাইনোসরদের সমাধিক্ষেত্রেও নিকিতিন বুঝেছিল যে কালো রজনের মসৃণ গায়ে রহস্যজনকভাবে একটা ফোটোগ্রাফের ছাপ পড়েছে। কিন্তু ফটোগ্রাফিক প্লেট, তারপর ডেভেলপিং আর ফিক্সিং ছাড়া ফোটোটা উঠবে কীভাবে? আর সবচেয়ে বড় কথা হলো আলো তার স্বাভাবিক বিক্ষিপ্ত অবস্থায় কোনো ছবি গড়তে পারে না। একটা ক্যামেরা অবস্ক্যুরা থাকাই চাই। তার মানে একটা অন্ধকার ঘেরা জায়গায় একটা সংকীর্ণ এপারচার বা খোলামুখ, যার ভেতর দিয়ে আলোর রশ্মি বাইরের লক্ষ্যবস্তুর একটা উল্টো ছবি পাঠিয়ে দেয়। টিরানোসরটাও কালো আয়নার বুকে উল্টো হয়েছিল।

এই সমস্যার সমাধানের জন্য নিকিতিনের বিশেষ রকমের উৎসাহ প্রয়োজন। প্রয়োজন বহু আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর মনোবল আর ইচ্ছাশক্তি। সত্যিই তার প্রেরণার প্রয়োজন। কিন্তু এখানকার এই মাপজোক, অভ্যস্ত জীবনযাত্রায় অনুপ্রেরণা হচ্ছে দুর্লভ অতিথি। আড়াই হাজার মাইল দূরে স্তেপ আর মরুভূমির ওপারে যে ঘটনা ঘটল সেটাই বরং ক্রমে বহুদূরে সরে যাচ্ছে। একেক সময়, শীতের দিনের ম্লান চাপা আলোয় মরীচিকার দেশের সেই দৃশ্য নিকিতিনের নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। আর মিরিয়াম... মিরিয়ামও তার জীবন থেকে ঝরে পড়েছে, মরীচিকার মতোই মিলিয়ে গেছে।

নিকিতিন চোখ বুজে ফেলল। অন্ধকার জানলা, বরফ আর বাইরের ঠান্ডা সবকিছু মিলিয়ে গেল। মনশ্চক্ষে নিকিতিন দেখতে পেল, উজ্জ্বল সাদা দেয়াল, সোনালি আলোয় সবুজ পাতা, কল উচ্ছলিত ‘আরিক’, হলদে ধুলোর মেঘ...আরেকবার গাড়িগুলো এপাশ-ওপাশ দুলে উঠল। ইঞ্জিনের গর্জন। উত্তপ্ত, তরঙ্গায়িত বাতাসে মরীচিকা। রোদে-পোড়া বিরাট উন্মুক্ত সমতলের সেই অলৌকিক মায়াজগতের অস্বচ্ছতার মধ্যে সে স্পষ্ট দেখতে পেল তার প্রিয় মুখটি জলপাইয়ের মতো ত্বক, সাদা পোশাকের ওপর পড়ে আছে কালো বেণি, দীর্ঘ বাদাম আকারের চোখ, ঋজু কালো ভ্র, পুরু ঠোঁট...

(চলবে…)

* ইভান ইয়েফ্রেমভ রুশ জীবাশ্মবিদ ও কল্পবিজ্ঞান লেখক। জীবাশ্মবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ট্যাফোনোমি। ফসিলের প্যাটার্ন—কোনো প্রাণী কীভাবে পচে গিয়ে জীবাশ্মে পরিণত হয় এবং এ জীবাশ্মের প্যাটার্ন কীরকম—সেসব বিষয় নিয়ে এ শাখায় আলোচনা করা হয়। ইয়েফ্রেমভের বেশ কিছু বিজ্ঞান কল্পকাহিনির একটি অনুবাদ সংকলন প্রকাশিত হয় মস্কোর ‘বিদেশি ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ থেকে। ইভান ইয়েফ্রেমভ গল্প সংকলন নামের এ বইয়ের গল্পগুলো বাংলায় অনুবাদ করেছেন শুভময় ঘোষ।