ঘুম

পার্পল কুইন হাসল, ‘কী? কোনো চিন্তা করো না, অ্যারো। ৪ হাজার বছর পর ঘুম থেকে উঠে তুমি সবই মনে করতে পারবে। তোমার ব্রেন খুবই রহস্যময়।'

পার্পল কুইনের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

আজব একধরনের অস্বস্তি বোধ করছে অ্যারো। গেজেট দেখে সময় কাটিয়েছে এবং আগের সভ্যতার একটা ফিকশন পড়েছে। এই মানবসভ্যতার আগের সভ্যতা। তখনকার কিছু বই কিছুদিন আগে ‘ওরাকল’ নিলামে উঠিয়েছিল। ১ মিলিয়ন ৬৫ হাজার ইউনিট ডেকে দুটো বই কিনতে পেরেছে অ্যারো। সে একজন বই সংগ্রাহক। এই মুহূর্তে ৪৮ হাজার ২টি সত্যিকার বই আছে তার সংগ্রহে। কাগজের বই। সব বই সে পড়েছে তা নয়, সংগ্রহের নেশায় কিনেছে বেশির ভাগ।

২ লাখ বছর আগে একটা মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেছে। সব দিক থেকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল তারা। নিজেদের রহস্যময়তা এবং জাদুময়তা হারিয়ে ফেলেছিল। কখনো মুশকিলে পড়বে ভাবেনি। আনন্দের সঙ্গে তারা নিজেরাই একদিন ধ্বংস করে দেয় তাদের সভ্যতা। মাত্র ১৩ মিনিট ১৭ সেকেন্ডে।

সেই সভ্যতার বই। একটা ফিকশন, ন্যারেটিভ অব আ নো বডি। একটা নন-ফিকশন, ফ্রানত্স কাফকা: আনটোল্ড স্টোরিজ। বই দুটো ফোবোসের পুরোনো মানুষের কলোনি ভার্না থেকে সংগ্রহ করেছে ‘ওরাকল।’ ধ্বংস সভ্যতার বেঁচে যাওয়া গুটিকয়েক মানুষের বংশধর ভার্নায় আছে এখনো। পরিবর্তিত হয়ে। ওরাকলের নিলামদার জায়োকা বিশ্বাসযোগ্যভাবে বলেছে। আর সবাই বিশ্বাস করেছে হয়তো, অ্যারো বিশ্বাস করতে পারেনি। ওসব বানানো কিছু ধারণা। পার্পল কুইন চায় মানুষ এ রকম বিভ্রমের মধ্যে আনন্দে থাকুক। বিজ্ঞান পরিষদ মাত্র ১১ বছর আগে ফোবোসের এই কলোনি আবিষ্কার করেছে। পরিবর্তিত মানুষের কলোনি। পরিবর্তন কেমন ঘটেছে? মানুষ মানুষের মতো নেই আর; বিশেষ করে মানুষের কান ছোট বাদুড়ের ডানার মতো হয়ে গেছে। এটাও বিরাট ধাপ্পাবাজি মনে হয়। পার্পল কুইন মানুষকে একটা ফ্যান্টাসির জগতে রেখে দিতে চায়। পরিবর্তিত সেসব মানুষের কোনো ইমেজ নাহলে দেখায় না কেন? স্ক্রিনে সার্চ করে দেখেছে অ্যারো। ফোবোসেই ঢোকা যায় না, আর ভার্না। কেন? ফোবোস কি এতটাই দূষিত হয়ে গেছে যে ইমেজ দেখেও আক্রান্ত হতে পারে মানুষ? ধাপ্পাবাজি সব।

৩১ নম্বর শহরের বাসিন্দা অ্যারোর বয়স এখন ৪৮। বিশ্বের সেরা দুজন টাউন প্ল্যানারের একজন বলা হয় তাকে। দ্বিতীয়জন ইভাকোভা। ১৩ নম্বর শহরের বাসিন্দা ইভাকোভার বয়স মাত্র ২৮। তার গবেষণা গাইড ছিল অ্যারো। টট ইভাকোভার বন্ধুদের একজন। সে একদিন অ্যারোকে বলেছে, ‘তুমি এখনো বিয়ে করোনি?’

‘তাই তো মনে হয়।’

‘এটা খুব ভালো হয়েছে।’

‘কী ভালো হয়েছে?’

‘ইভাকোভা তোমাকে বিয়ে করবে।’

‘কে বলেছে?’

‘সে নিজে আমাকে বলেছে।’

তাই যদি বলে থাকে, তবে ছিট আছে ইভাকোভার মাথায়। ২৮ বছর বয়স হয়ে গেছে, তারও এত দিনে বিয়ে করে ফেলার কথা। করেনি কেন?

২ মাস আগে শেষবার ৩১ নম্বর শহরে এসেছিল ইভাকোভা।

‘চলো, অ্যারো।’

‘কী? কোথায়!’

‘তোমাকে একটা মজার জিনিস দেখাব।’

নিয়ে গিয়েছিল সিনেপ্লেক্সে। মজার জিনিস হলো একটা মারদাঙ্গা সিনেমা। দেখে যথেষ্টই মজা পেয়েছে অ্যারো। ২৮-২৯ বছর পর সে এ রকম পাক্কা বাণিজ্যিক ছবি দেখল।

সত্যি যদি বিয়ে করতে চায়, ইভাকোভা কী করবে আগে? যা বলার অ্যারোকে বলবে? নাকি পার্পল কুইনকে বলবে?

আর সবার মতো ইভাকোভাও মনে করে, পার্পল কুইন সব পারে! আসল কথা হলো পার্পল কুইন অনুমোদনই করবে না ব্যাপারটা। ২০ বছর বয়সের ফারাক বিরাট ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে।

অ্যারো কি ইভাকোভাকে কিছু বলবে?

ইভাকোভা যদি হেসে দেয়! হয়তো টটকে সে কিছুই বলেনি। টট বদমায়েশ বোকা বানিয়েছে অ্যারোকে।

কাহিনি নেই, ৪৮ বছর বয়স হলেও এমনি বিয়ে করেনি অ্যারো। ডেট করেছে, বিয়ের চিন্তা মাথায় আসেনি কখনো। ইভাকোভা যদি বলে, সে কি বিয়ে করবে ইভাকোভাকে?

ইভাকোভা রূপবতী। চোখ বড় বড়, ঠোঁটে টান আছে। বোঁচা নাকটা। তাতে মেয়েটাকে আরও রূপবতী দেখায়। জ্ঞানী মেয়ে অবশ্য মনোকল পরে এবং খুব সিরিয়াস একটা ভাব নিয়ে থাকে। অথচ আচার-আচরণে এখনো ভারি ছেলেমানুষ সে। কেউ বিশ্বাস করবে মারদাঙ্গা ছবির ফাইটিং সিকোয়েন্স দেখে এই মেয়ে সিটি দিয়ে উঠতে পারে।

সত্যি যদি বিয়ে করতে চায়, ইভাকোভা কী করবে আগে? যা বলার অ্যারোকে বলবে? নাকি পার্পল কুইনকে বলবে?

মন্দ না।

‘অ্যারো।’

যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর।

অ্যারোর সহকারী রোবট নিওকোর।

অ্যারো বলল, ‘বলো।’

‘তুমি প্রস্তুত?’

‘নিওকো, তুমি কখনো পার্পল কুইনকে দেখেছ?’

‘না, অ্যারো। পার্পল কুইনের দেখা কেউ সহজে পায় না। যারা দেখে তারাও ভুলে যায়। স্মৃতি থাকে না।’

‘মুছে দেওয়া হয়? আমি যদি সেটা হতে না দিই?’

‘সেটা তুমি পারবে, অ্যারো। বিশেষ কিছু ক্ষমতা নিয়ে তুমি জন্মেছ। বিজ্ঞানী ফ্যারন তোমার ব্রেনকে “আ ইউ থিং” বলেছেন। “ইউ” ফর আনসলভড, তুমি জানো। তোমার কী মতলব? তুমি কি পার্পল কুইনের স্মৃতি মাথায় নিয়ে ফিরতে চাও?’

‘দেখি।’

‘ইভাকোভা যদি আসে কী বলব? বসতে বলব?’

‘বসতে বলো। তবে তোমার ঝুল পড়া জোকসগুলো শোনাতে যেয়ো না দয়া করে। ইভাকোভা খুবই বিরক্ত হয়। ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলে না।’

‘এটা তুমি ঠিক বললে না, অ্যারো। ইভাকোভা চমত্কার মেয়ে। আমার জোকস খুবই পছন্দ করে সে। প্রাণ খুলে হাসে।’

‘প্রাণ খুলে হাসা কী জিনিস, সেটাও তুমি বোঝো? আচ্ছা, জোকস শুনিও ইভাকোভাকে। আচ্ছা, যাই। ফিরে কী কী হলো শোনাব।’

টি-সেন্টারে যেতে হবে আগে।

টি-সেন্টারের অপারেটর মানুষ। বলল, ‘অ্যারো?’

‘হ্যাঁ।’

‘তেরো-উনিশে তুমি কেন যাচ্ছ?’

‘তেরো-উনিশ! আমি কি তেরো-উনিশে যাচ্ছি?’

‘তাই তো দেখতে পাচ্ছি এন্ট্রিতে।’

‘অ।’

‘হতাশ হলে নাকি?’

‘নাহ্!’

‘সভ্যতাকে ধ্বংস হতে হয়, অ্যারো। না হলে সভ্যতা একদিন পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেবে। দিচ্ছে না এখন? তুমি তোমার কথা বলো, অ্যারো। তুমি কেন বেঁচে থাকতে চাও?’
পার্পল কুইন এত ছোট একটা মেয়ে। ১২-১৩ বছর হবে বয়স। মিষ্টি পার্পল রঙের বালিকা। মায়াবী মুখ

মানুষজন বলে তেরো-উনিশ। লেখে ১৩/১৯। ১৯ লাখ ১৩ নম্বর নগর আসলে। টি-সেন্টারের রোবটরা একটা এলিভেটরে উঠিয়ে দিল অ্যারোকে। কিছুক্ষণ ধরে অ্যারো বুঝতে পারল না সে কি সে আছে, নাকি অজস্র কণা হয়ে গেছে? একটু পর দেখল একটা সাদা ঘরে সে। জাহাজের কেবিনের মতো ঘরটা। দরজা-জানালা দিয়ে অদূরের পাহাড় দেখা যায়। ঘরে একটা টেবিল, ছয়টা চেয়ার। সব সাদা। সে একটা চেয়ারে বসল। দরজা দিয়ে আর পাহাড় দেখল না, বরফ দেখল, যত দূর চোখ যায়।

ঠান্ডা হাওয়ায় কোথাও উইন্ডচাইম বাজছে।

‘অ্যারো!’

অ্যারো তাকাল এবং বিস্মিত হলো। এটা সে চিন্তাও করেনি। পার্পল কুইন এত ছোট একটা মেয়ে। ১২-১৩ বছর হবে বয়স। মিষ্টি পার্পল রঙের বালিকা। মায়াবী মুখ। চোখ বড় বড়। স্ক্লেরা হলুদ, মণি কালো। অল্প বোঁচা নাক দেখে একবার মনে পড়ল ইভাকোভাকে। অ্যারো বলল, ‘তুমি পার্পল কুইন?’

‘হ্যাঁ, অ্যারো।’

‘তুমি একটা প্রোগ্রাম।’

‘সব মানুষই প্রোগ্রাম, অ্যারো। ১৮/৮৬ এবং ১৯/০/১৯ নগরের পরিকল্পনা তুমি চমত্কার করেছ।’

‘আগের সভ্যতার এক মহান আর্কিটেক্টের কিছু ইন্টারভিউ পড়েছি বইয়ে। একটা ইন্টারভিউয়ে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছে, তোমাকে যদি একটা নগর বানাতে দেওয়া হয়, তবে সে নগর কী রকম হবে? আর্কিটেক্ট উত্তর দিয়েছেন, সেই নগরের রাস্তায় দাঁড়ালে যেকোনো শিশুও বুঝতে পারবে ভবিষ্যতে তার কী হওয়া উচিত। আগের সভ্যতার মহান সেই আর্কিটেক্ট হলেন লুই কান।’

‘তুমি অনেক বই পড়ো, অ্যারো। পুরোনো বই সংগ্রহ করো। পৈতৃক সূত্রে অঢেল সম্পত্তি পেয়েছ। নিজেও কম বিত্ত করোনি। আয়েশে দিন কাটাতে পারতে।’

‘কাটাই না বলে তোমার কি সমস্যা হচ্ছে? এ কথা বলতে তুমি আমাকে ডেকেছ? সত্যি তুমি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করো? তুমি সিদ্ধান্ত নিলে মুহূর্তে বর্তমান মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে?’

‘সভ্যতাকে ধ্বংস হতে হয়, অ্যারো। না হলে সভ্যতা একদিন পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেবে। দিচ্ছে না এখন? তুমি তোমার কথা বলো, অ্যারো। তুমি কেন বেঁচে থাকতে চাও?’

‘সেটা কে না চায়, পার্পল কুইন? আমি একটু বেশি চাই শুধু। আমার বাবা মহান গণিতবিদ জুয়ুরান, অবসরে প্রচুর পাল্প ফিকশন পড়তেন। আমি তখন এতই ছোট, ফিকশন আর বাস্তব বুঝি না। আজব একটা বই পড়েছিলাম, ‘ভ্যাম্পায়ারস প্ল্যানেট’। তুমি জানো, ভ্যাম্পায়াররাও মানুষ। মানুষের রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকে তারা। ২ হাজার, ৩ হাজার, ৪ হাজার বছর ধরে বাঁচে। বইটা পড়ে আমি মহা রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। ওই সময়ই ঠিক করে ফেলেছিলাম, বড় হয়ে আমি অবশ্যই ভ্যাম্পায়ার প্ল্যানেটে যাব। ভ্যাম্পায়ার হয়ে হলেও অন্তত ৪ হাজার বছর বাঁচব।’

‘বাঁচলে কী হবে?’

‘এমনি! হাজার বছর পরের একটা পৃথিবী দেখে মরলাম।’

‘চমত্কার! তেমন একটা ব্যবস্থা যদি হয়ে যায়?’

‘আহ্! তুমি একটা ছোট মানুষ, পার্পল কুইন। অথচ ছোট মানুষ না। আর যারা তোমাকে দেখে, তারা কি এই মেয়েটাকেই দেখে?’

‘তুমি একজন বুদ্ধিমান মানুষ, অ্যারো। অতি মাত্রায় বুদ্ধিমান মানুষ। আমি একটা প্যাকেজ অফার করছি তোমাকে। ৪ হাজার বছর ঘুমিয়ে থাকতে পারলে তুমি ৪ হাজার বছর বেঁচে থাকতে পারবে। ঘুম থেকে উঠে দেখতে পাবে ৪ হাজার বছর পরের পৃথিবী। তুমি কি ঘুমাবে?’

‘ঘুমাব।’

আমি একটা প্যাকেজ অফার করছি তোমাকে। ৪ হাজার বছর ঘুমিয়ে থাকতে পারলে তুমি ৪ হাজার বছর বেঁচে থাকতে পারবে। ঘুম থেকে উঠে দেখতে পাবে ৪ হাজার বছর পরের পৃথিবী। তুমি কি ঘুমাবে?

‘ভালো। এই মুহূর্তে কি তুমি প্রস্তুত?’

‘এই মুহূর্তে মানে?’

‘এই মুহূর্তের মানে একটাই, অ্যারো। সেটা হলো এই মুহূর্তে। তুমি কি এই মুহূর্তে ঘুম দিতে প্রস্তুত?’

‘এখন! তুমি কি মজা করছ, পার্পল কুইন?’

‘অ্যারো, না। এখন না হলে আর কখনো না। পৃথিবীর মাত্র ছয়জন মানুষকে এই দীর্ঘ ঘুমের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এমন যেকোনো সভ্যতার আয়ু সামান্য দীর্ঘ করার ক্ষমতা রাখে এই ছয়জন।’

‘তাতে কী?’

‘অ্যারো, আরও সভ্যতার দরকার এদের।’

‘আরও সভ্যতা? বুঝতে পারলাম না।’

‘ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এমন যেকোনো সভ্যতা। তুমি হচ্ছ মহা ক্ষমতাধর বিশেষ সেই ছয়জনের একজন, অ্যারো। তুমি প্রস্তুত?’

‘মহা ক্ষমতাধর! ভালো বলেছ।’

অ্যারো হাসল।

পার্পল কুইন বলল, ‘তা নয় কি?’

অ্যারো বলল, ‘আচ্ছা, ৪ হাজার বছর পর আমি কি আরেকটা সভ্যতায় ঘুম থেকে উঠব নাকি? উঠে কী করব?’

‘তুমি একজন টাউন প্ল্যানার, অ্যারো। সভ্যতার অনিবার্য ধ্বংস কিছুদিন ঠেকাতে আরও কিছু নগর-পরিকল্পনা করবে। এই মুহূর্তে পার্পল কুইন কিন্তু কথা বলছে বিশেষ আর পাঁচজনের সঙ্গেও। তাদের চারজন রাজি হয়ে গেছে। দোনোমনা করছে একজন। সে একটা মেয়ে। ছয়জনের মধ্যে এই একজনই মেয়ে।’

‘মেয়ে! দোনোমনা করছে?’

‘হ্যাঁ। সেই মেয়ে আর তুমি। সে-ও এই কথা বলছে, যে কথা এখন তুমি আমাকে বলবে।’

‘আমি! কী বলব? আমি দোনোমনা করছি না, পার্পল কুইন। আমার একটা ছোট কাজ ছিল শুধু।’

পার্পল কুইন হাসল, ‘কী? কোনো চিন্তা করো না, অ্যারো। ৪ হাজার বছর পর ঘুম থেকে উঠে তুমি সবই মনে করতে পারবে। তোমার ব্রেন খুবই রহস্যময়।'

পার্পল কুইন হাসল, ‘কী? কোনো চিন্তা করো না, অ্যারো। ৪ হাজার বছর পর ঘুম থেকে উঠে তুমি সবই মনে করতে পারবে। তোমার ব্রেন খুবই রহস্যময়।’

‘তার মানে এখান থেকে আমি আর বাইরে যেতে পারছি না, বলো। আমাকে ঘুমিয়ে পড়তে হবে ক্যাপসুলে।’

‘তুমি অত্যন্ত বুদ্ধিমান একজন মানুষ।’

‘তুমি কী? অত্যন্ত বুদ্ধিমান একটা প্রোগ্রাম?’

‘তাতে কিছু যায়-আসে না, অ্যারো। তুমি এখন ঘুমিয়ে পড়বে। ৪ হাজার বছর ধরে ঘুমাবে। তোমার একটা ভালো ঘুম হোক।’

‘শোনো, পার্পল কুইন! মাত্র ৪ হাজার বছর পর কী করে আরেকটা সভ্যতা হয়ে যাবে, আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না।’

পার্পল কুইন উত্তর দিল না।

অদৃশ্য হয়ে গেছে অমানবিক মেয়েটা।

তাও অ্যারো বলল, ‘তুমি একটা ছোট্ট বদমাইশ, পার্পল কুইন।’

পার্পল কুইন কি কোথাও থেকে হাসল?

অ্যারো দেখল চেয়ারে না, একটা ক্যাম্পঘাটে বসে আছে সে। সাদা ঘর না, কাঠের একটা কেবিন। পুরোনো কেবিন। আমাজনের গহিন অরণ্যে। রাত গভীর। জন্তু-জানোয়ারের ডাকে শিহরিত অরণ্য। দূরের গাঁয়ে ডিজেম্বে বাজাচ্ছে অরণ্যের আদিম মানুষেরা। অ্যারো খাটে শুয়ে পড়ল এবং ইভাকোভার কথা একবার মনে পড়ল তার। ঘুমিয়ে পড়ল সে। টানা ৪ হাজার বছর ঘুমাল ক্যাপসুলে। গভীর গাঢ় ঘুম। স্বপ্ন দেখল না। ঘুম ভাঙার আগমুহূর্তে দেখল। স্বপ্নে ইভাকোভা তাকে বলল, ‘তুমি যদি সম্মত হও, আমি তোমাকে বিয়ে করব, অ্যারো।’

অ্যারো লাজুক গলায় বলল, ‘আমি সম্মত, ইভাকোভা।’

আমাজনের গহিন অরণ্যে। রাত গভীর। জন্তু-জানোয়ারের ডাকে শিহরিত অরণ্য
আরও পড়ুন

তার ঘুম ভাঙল সাদা সেই ঘরে। নাকি এটা আরেকটা ঘর? দরজা-জানালা আটকানো ঘরের। জানালা খুলে সেই পাহাড় দেখল অ্যারো। দরজা খুলে সেই মরুভূমি দেখল। মানে কী এর?

পার্পল কুইন?

আছে।

অ্যারো বলল, ‘পার্পল কুইন!’

পার্পল কুইন হাসল, ‘অ্যারো, কী?’

‘হাসছ কেন তুমি?’

‘অ্যারো, দুঃখজনক একটা ভুল হয়ে গেছে।’

‘সে জন্য তুমি হাসছ!’

‘অ্যারো, হ্যাঁ। তবে দুঃখজনক ভুল থেকেও কখনো কখনো ভালো কিছু হয়ে যায়।’

‘তুমি মানুষের মতো কথা বলছ।’

‘অ্যারো, মানুষের সঙ্গে কথা বলছি তো।’

ছোট্ট পার্পল কুইন আবার হাসল।

অ্যারো ভাবল ৪ হাজার বছরে কতটা বদলেছে পৃথিবী? পার্পল কুইন সেই আগের মতো আছে। ৪ হাজার কয়েক শ বছরের ‘বাচ্চা’ একটা মেয়ে। হাসছে বলে তাকে আরও রূপবতী দেখাচ্ছে। এ একটা প্রোগ্রাম! এটা কিছু হলো? মুগ্ধ অ্যারো বলল, ‘ভুলের কথা বলো। তুমি ঠিক কী ধরনের ভুলের কথা বলছ, পার্পল কুইন?’

পার্পল কুইন আবারও হাসল, ‘অ্যারো, এটা খুবই দুঃখজনক ভুল। ৪ হাজার বছর না, দুঃখজনক সেই ভুলের কারণে ৪ লাখ বছর ঘুমিয়েছ তুমি।’

‘৪ লাখ বছর!’

‘অ্যারো, হ্যাঁ। তুমি ঘুমিয়ে পড়ার ৭০০ বছরের মধ্যেই তোমাদের সভ্যতা, মানে তোমাদের মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আবার এক সভ্যতার পত্তন হয়েছে ২ লাখ বছরের কিছু আগে। তুমি এই সভ্যতায় ঘুম থেকে উঠেছ।’

‘আর তুমি? তুমি এই ৪ লাখ বছর ধরে আছ?’

‘না। সেই সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পার্পল কুইনও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আমি এই সভ্যতার পার্পল কুইন।’

তার ঘুম কি আসলে এখনো ভাঙেনি? স্বপ্ন দেখছে? না হলে এটা কী করে সম্ভব। কোথায় ৪ হাজার বছর আর কোথায় ৪ লাখ বছর! এতটা গড়বড় হয়ে গেল কীভাবে? পার্পল কুইন এই ভুল করেছিল? এ না, আগের মেয়েটা!

এখনকার পার্পল কুইন বলল, ‘অ্যারো, ভুল না আসলে। তোমাদের পার্পল কুইন সব জানত। জানত তোমাদের সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে। সেই সভ্যতার বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন ছয়জন মানুষকে এ জন্য ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল সে, ৪ লাখ বছরের জন্য।’

আরও পড়ুন

‘৪ হাজার বছর বলেছিল সে।’

‘অ্যারো, সে বলেছিল। কিন্তু তা হলে কি খুব ভালো হতো বলো? ৪ হাজার বছর পর তুমি তো ঘুম থেকে উঠতে একটা উত্তপ্ত মরুভূমিতে। একফোঁটা সবুজ কোথাও দেখতে না। আমিও কি তোমার বা তোমাদের কথা জানতাম? সংকেত রেখে গিয়েছিল তোমাদের পার্পল কুইন। মাত্র ৮ দিন আগে সেই সংকেতের অর্থ ধরতে পেরেছে বর্তমান সভ্যতা। ৬টা ক্যাপসুলই আমরা অক্ষত পেয়েছি।’

‘৬টা কেন?’

‘অ্যারো, সে রেখে গিয়েছিল।’

‘কিন্তু কেন? ৬টাই কেন? তোমার আগের পার্পল কুইনকে আমি জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম। ৬টা ক্যাপসুল কেন? ছয়জন কেন?’

‘অ্যারো, সেটা আমি বলতে পারব না। কোনো সভ্যতায় ছয়জনের বেশি অতি ক্ষমতাধর মানুষ থাকে না। এটা একটা ডিজাইন হয়তো।’

‘তুমি কি সত্যি পার্পল কুইন?’

‘অ্যারো, কেন?’

‘পার্পল কুইন কখনো হয়তো বলে না, এটা আমি বলতে পারব না, বলে না।’

‘অ্যারো, বলে। তুমি শোনোনি। এই সভ্যতা আর কদিন? আমিও একই কাজ করব। বিশেষ ছয়জন মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখব ক্যাপসুলে। অ্যারো, তাদের মধ্যে হয়তো তুমিও থাকবে। আবার ৪ লাখ বছর পর ঘুম ভাঙবে তোমাদের। আরও একটা নতুন সভ্যতায়। কিন্তু এটা আমি কেন করব? অ্যারো, সত্যি কথা হলো আমি জানি না।’

‘পার্পল কুইন সম্পর্কে তুমি আমার যাবতীয় ধারণা পাল্টে দিচ্ছ মেয়ে, যদি তুমি সত্যি পার্পল কুইন হও। আচ্ছা, আমার সঙ্গের আর পাঁচজন কোথায়? তারা কারা?’

পার্পল কুইন হাসল, ‘অ্যারো, এতক্ষণে! তাদের একজনকে কি তুমি এখনই দেখতে চাও?’

‘দেখতে চাই। কে সে?’

‘দেখো।’

‘অ্যারো!’

কে ডাকল? কার গলা এটা? কার? কার?

অ্যারো ইভাকোভাকে দেখল দরজায়। ৪ লাখ বছর আগের ইভাকোভা। সেই একই রকম, একই রকম। ইভাকোভা তাহলে সেই মেয়েটা, ঘুমাতে দোনোমনা করেছিল যে। সর্বনাশ হয়েছিল আরকি। বুকের রক্ত ছলকাল অ্যারোর। রক্তকণিকা রিমঝিম করে উঠল বুঝি। ৪ লাখ বছর ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে, ভুলে গেল অ্যারো। ভুলে গেল। দ্রুত ভুলে গেল।

*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত