ভিনগ্রহের ক্রিকেটার - পর্ব ৪

মিজান বাসায় ফিরল বেলা তিনটায়। বাইরে তখন বেশ রোদ। ক্রিকেট মাঠেও বেশ রোদ ছিল। ঘরের শীতল ছায়ায় শরীরটা বেশ আরাম পাচ্ছে। মা ঘুমাচ্ছেন। ময়না ঘুমাচ্ছে তার পাশে। বুড়ি দাইমাও মেঝেতে শুয়ে। তার নাক ডাকছে। মিজানের খিদে লেগেছে। ময়নার জন্মের আগে হলে এই সময় মিজানের জন্য বরাদ্দ ছিল দুধভাত। সাদা থালায় দুধভাত নিয়ে যখন সে গুড় দিয়ে মাখত, তখন বেশ লাল হয়ে যেত থালাটা। এখন আর তার জন্য দুপুরে দুধভাত বরাদ্দ নয়। কিন্তু আজকে কিছু একটা না খেলেই নয়। পেটটা ভীষণ জ্বালা করছে। ঘরে একটা তাকের ওপর মুড়ির টিন আছে। সেটা খুলে কিছুটা মুড়ি বের করে খাওয়া যায়।

মিজান চুপি চুপি একটা টুল এনে রাখল তাকের কাছে। তারপর উঠে গেল টুলের ওপর। মুড়ির টিনটা তার নাগালের মধ্যে এসে গেল। টিনটা এক হাতে নিয়ে আরেক হাতে তাকটা ধরে সে মাত্র নামতে গেছে, ঠিক এ সময়ে ঘটে গেল একটা ছোট্ট দুর্ঘটনা, হাত থেকে পড়ে গেল মুড়ির টিন। বেশ বড় ধরনের একটা শব্দ হলো। মিজানের বুক কাঁপতে লাগল—এই বুঝি মা উঠে পড়েন।

না, মা উঠলেন না। বরং ঘুম ভেঙে গেল ময়নার। সে কেঁদে উঠল। কান্না আর তার কিছুতেই থামছে না। আরে কী মুশকিল, চুপ করো না বাবু। মুড়ির টিনটা তাড়াতাড়ি আগের জায়গায় রেখে মিজান টুল থেকে নেমে পড়ল। তারপর টুলটা রেখে এল যথাস্থানে।

লোকটা তখন তার চশমাটা খুলে ফেলল। তার চোখ বেগুনি রঙের। এমন চোখ এর আগে কখনো মিজান দেখেনি

ময়না কিন্তু কেঁদেই চলেছে। মিজান এগিয়ে গেল তার কাছে। ব্যাপার কী! হাত দিয়ে দেখল, ময়না পেশাব করেছে। আহারে বেচারা, ঠান্ডায় কষ্ট পাচ্ছে। এখন সে কী করবে? মাকে ডাকবে? বরং একটা কাজ করা যায়, ময়নাকে কোলে তুলে নিয়ে কাঁথাটা বদলে দেওয়া যায়। এটাই করতে হবে। মিজান ময়নাকে আস্তে করে কোলে তুলে নিল। এখন এক হাতে পিচ্চিকে সামলাতে হবে, আরেক হাত দিয়ে ভেজা কাঁথা তুলে ফেলে দিতে হবে। শুকনা কাঁথা বিছাতে হবে। মিজান যত্ন নিয়ে খুবই সাবধানে কাজটা করছে, তা সত্ত্বেও দুর্ঘটনাটা ঘটেই গেল। তার হাত থেকে ময়না ধপাস করে পড়ে গেল মেঝেতে। লাল রঙের শানের মেঝে। ময়না মনে হয় বেশ আঘাত পেয়েছে। সে এত জোরে কেঁদে উঠল যে একই সঙ্গে মা আর দাইমা বুড়ির ঘুম গেল ভেঙে। মা উঠেই আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘ওরে আমার ময়নাকে মেরে ফেলল রে। ওই ডাকাতটা রে।’ তিনি এক ছোঁয়ে ময়নাকে তুলে নিয়ে বুকে চেপে ধরলেন। ‘ওরে বাবারে এ কোন ডাকাত আমার পিছে লেগেছে রে’ বলে মা বিলাপ চালিয়েই যেতে লাগলেন।

মিজান কী করবে, বুঝে উঠছে না। সে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল। মায়ের কোলে উঠে বাচ্চা আস্তে আস্তে চুপ করে গেল। তখন মা ময়নাকে রাখলেন বিছানায়। তারপর সোজা এসে ধরলেন মিজানের চুলের মুঠি। প্রচণ্ড রাগে তিনি ফুঁসছেন। এক হাতে মিজানের চুল ধরে গায়ের জোরে টানতে টানতে আরেক হাতে শুরু করলেন কিল-ঘুষি, চড়-থাপ্পড়। ধাক্কা দিয়ে মিজানকে ফেলে দিলেন মেঝেতে। তারপর স্যান্ডেলসমেত তার এক পা তুলে দিলেন মিজানের গলায়। মিজানও ‘ওরে বাবারে মেরে ফেলল রে, মা মা, আমাকে মেরো না’ বলে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। দাইমা বুড়ি এলেন ছুটে। এই বুবু, কী করো, ছাড়ো ছাড়ো বলে মায়ের হাত থেকে মিজানকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু বুড়ির শরীরে কি আর অত শক্তি আছে। মা তাকে এক ধাক্কা মারার সঙ্গে সঙ্গে তিনি গেলেন পড়ে। মা বিপুল বিক্রমে আবার এসে চেপে ধরলেন মিজানকে। মিজান বলল, ‘মা, আমাকে ছেড়ে দাও। আমি আর কোনো দিন এ রকম করব না!’

মা বললেন, ‘ওরে খুনি। তোকে বিশ্বাস নাই। তুই ঠিকই আমার ময়নাকে মেরে ফেলবি। আজ তোকে আমি মেরেই ফেলব।’ 

মিজান বলল, ‘আমাকে ছেড়ে দাও। আমি এ বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি। আর কোনো দিনও আসব না।’

মা তখন তাকে মারতে মারতে নিয়ে গেলেন গেটের বাইরে। এক ধাক্কা দিয়ে বললেন, ‘সোজা চলে যা। আর কোনো দিনও যদি এ বাড়িতে আসিস, বঁটি দিয়ে তোকে জবাই করে ফেলব। মনে থাকে যেন।’ 

মিজান কাঁদতে কাঁদতে চলল দুচোখ যেদিকে যায়। তার গায়ের শার্টের দুটো বোতাম আর পকেটের কাছটা ছিঁড়ে গেছে মায়ের অত্যাচারে। গালে–পিঠে–হাতে মায়ের আঁচড়ের আর মারের দাগ। খালি পা। সে কোনো দিকে না তাকিয়ে চলল একমনে। আস্তে আস্তে তার কান্না এল মিইয়ে।

সে এখন কোন দিকে যাবে? কোনো কিছু না ভেবেই সে চলে এসেছে নদীর ধারে। 

ছোট্ট শহর। নতুন জেলা। কিছুদিন আগে শহরটা ছিল থানা সদর। তারপর হলো মহকুমা শহর। তারপর হলো জেলা শহর। শহরের পাশেই নদী। মাঠের পরে পাহাড়। পাহাড়ের ওপাশে কী আছে কেউ জানে না। মিজানরা নানা কথা শুনতে পায়। শোনা যায়, পাহাড়ের ওপারে আছে ঘন জঙ্গল। সেই জঙ্গল সাপে-বিচ্ছুতে ভরা। আর আছে নানা ভূত-প্রেত। মিজান কখনও পাহাড়ের ওই পারে যায়নি। কেউ গেছে, তাও শোনেনি কখনও ।

নদীর ধারে একটা বটগাছ আছে। তার ঝুরিগুলো মাটিতে এমনভাবে নেমে এসেছে যে কতগুলো মজার জায়গা তৈরি হয়েছে। তাতে বসা যায়, শোয়া যায়। দোল খাওয়া যায়। মাঝেমধ্যে মন খারাপ থাকলে মিজান এই বটের নিচে গাছের ডালের আসনে এসে বসে থাকে।

আজও সে তা–ই করল।

চুপচাপ বসে বসে তার কপালটার কথা ভাবতে লাগল। আহা, তার ভাগ্যেই এত দুঃখ কেন? সে তো ভালোই করতে চায়। কিন্তু কেন বারবার শুধু খারাপই হয়। সে তো ময়নাকে ফেলতে চায়নি। সে তো ড্রিল স্যারকেও ব্যাট দিয়ে মারতে চায়নি।

তবু কেন এসব ঘটে গেল। আর দেখো, তার মা তাকে কী মারটাই না মারল। কই ড্রিল স্যার তো মারল না? মা কেন মারে? তাহলে কি দাইমা বুড়ির কথাই সত্যি। মা তার নিজের মা নয়!

মিজানের খুব কান্না পাচ্ছে। খুব। সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। তার চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল অঝোরে। হেঁচকি উঠছে। কাঁদতে কাঁদতে সে শুয়ে পড়ল গাছের ডালে। পেটে তার খিদে। শরীরটাও খুব দুর্বল লাগছে।

তার গলার স্বর শুকিয়ে আসছে। তার মনে হলো, এই মা যদি তার মা না–ই হবে, তাহলে তার আসল মা কে? আসল মা তো তার একজন থাকবে, নাকি? সে কোথায়? মিজান করুণস্বরে ‘মা’ ‘মা’ বলে ডাকতে লাগল। 

মা বলে ডাকতে ডাকতে সে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল গাছের ডালেই। 

ঘরের সামনে দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সারা শরীর অবশ্য কাপড়ে ঢাকা। এমনকি মাথা আর মুখটাও হেলমেটের মতো জিনিস দিয়ে ঢাকা

ঘুম ভাঙল অচেনা এক লোকের স্পর্শে। চোখ মেলে সে প্রথমে বুঝতেই পারছিল না যে সে কোথায়। আস্তে আস্তে তার হুঁশ হলো। সে বুঝল যে সে গাছের ঝুলে পড়া ডালে শুয়ে আছে। 

কিন্তু লোকটাকে সে চিনতে পারল না। 

লোকটার চোখে একটা কালো রঙের চশমা। তবে মুখটা তার হাসি হাসি। লোকটা বলল, ‘তোমার মনে অনেক দুঃখ, নয় কি?’

মিজান একটু আশ্চর্য হলো। তার মনে দুঃখ আছে কি নেই, লোকটা তা জানবে কী করে? হ্যাঁ, তার মনে অনেক দুঃখ আছে বটে, কিন্তু সে কথা সে সবাইকে বলে বেড়াবে নাকি!

মিজান বলল, ‘না, আমার মনে কোনো দুঃখ নাই।’

লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বলল, ‘তোমার তো খিদে পেয়েছে, নাকি?’

মিজান এবার আর অস্বীকার করতে পারল না। বলল, ‘তা একটু পেয়েছে। খুব বেশি না।’

লোকটা বলল, ‘চলো, তোমাকে খাওয়াই।’

মিজান বলল, ‘কোথায় যাব?’

লোকটা বলল, ‘এই তো এখানে। তোমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার কী?’

মিজান বলল, ‘দুধভাত। গুড় দিয়ে মাখানো। লাল রঙের। আর আলুপুরি।’

লোকটা বলল, ‘ঠিক আছে। তোমাকে দুধভাতই খাওয়ানো হবে। চলো আমার সঙ্গে।’ 

মিজান বলল, ‘বেশি দূরে না হলে চলুন।’

লোকটা তার ব্যাগ থেকে একটা বেল্ট বের করে বলল, ‘এটা একটু পরে নাও।’

মিজান বলল, ‘এটা পরতে হবে কেন?’

লোকটা বলল, ‘আমরা ওই পাহাড়ের ওপারে যাব। এই বেল্টটা পরলে দেখবে আমরা এক সেকেন্ডেই সেখানে পৌঁছে গেছি।’ 

মিজান বলল, ‘আপনি কে? আমার মনে হচ্ছে, আপনি একজন দুষ্ট জাদুকর।’

লোকটা বলল, ‘না, আমি দুষ্ট জাদুকর নই। আমি কারও কোনো ক্ষতি করি না। আমি তোমার বন্ধু। আমি তোমার উপকার করতে চাই।’

মিজান বলল, ‘না, আমি আপনার সঙ্গে কোথাও যাব না। আপনি নিশ্চয়ই কোনো ছেলেধরা।’ 

মিজান তার সঙ্গীর হাত ধরে রইল। তাদের সামনের গোল ঘরের দরজা গেল খুলে। তারা ভেতরের দিকে পা বাড়াল। খানিক যেতেই পেছনের দরজা গেল বন্ধ হয়ে। ভেতরে একটা অদ্ভুত রঙের আলো

লোকটা তখন তার চশমাটা খুলে ফেলল। তার চোখ বেগুনি রঙের। এমন চোখ এর আগে কখনো মিজান দেখেনি। লোকটা তার চোখ রাখল মিজানের চোখে। মিজান অভিভূত হয়ে পড়ল। লোকটা তার হাতের বেল্ট-মতন জিনিসটা বাঁধল মিজানের কোমরে। তারপর নিজের বেল্টের একটা ঘড়ির ডায়ালের মতন দেখতে অংশে কী কী সব অ্যাডজাস্ট করল। শেষে পকেট থেকে বের করল একটা রিমোট কন্ট্রোল ধরনের জিনিস। সেটার ডিজিটে চাপ দিয়ে সেটা সে ধরল মিজানের কোমরের বেল্টে। 

এক দুই তিন।

মিজানের মনে হলো সে যেন শূন্যে খুব দ্রুত কোথাও ছুটছে। একপলক পায়ের নিচে একটা পাহাড় দেখতে পেল বলেই তার ধারণা। এবং তার এ–ও মনে হলো যে তারা পাহাড়টা ডিঙাচ্ছে।

ঘটনা ঘটল খুবই দ্রুত। মিজান দেখতে পেল, একটা ফাঁকা প্রান্তর। তার চারদিকে পাহাড়। তারই মধ্যে একটা গোল ধাতব ঘরের সামনে সে দাঁড়িয়ে। ঘরটা তাদের স্কুলের হলঘরের সমান হবে বলে তার ধারণা। 

ঘরের সামনে দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সারা শরীর অবশ্য কাপড়ে ঢাকা। এমনকি মাথা আর মুখটাও হেলমেটের মতো জিনিস দিয়ে ঢাকা। 

মিজান তার সঙ্গীর হাত ধরে রইল। তাদের সামনের গোল ঘরের দরজা গেল খুলে। তারা ভেতরের দিকে পা বাড়াল। খানিক যেতেই পেছনের দরজা গেল বন্ধ হয়ে। ভেতরে একটা অদ্ভুত রঙের আলো। এই রং এর আগে কোনো দিনও মিজান দেখেনি। সামনের দিকেও দেয়াল। একটা ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে তারা আটকে আছে।

মিজানের সঙ্গীটি সামনে এগিয়ে গেল। কী একটা সুইচ টিপতেই একটা কম্পিউটারের পর্দা আর কি–বোর্ডের মতো জিনিস বেরিয়ে এল। সঙ্গীটি সেই কি–বোর্ডে এটা–ওটা টিপল। সাংকেতিক ভাষায় কী একটা কথা বলাবলি হলো ওই যন্ত্রে আর বেগুনি রঙের চোখওয়ালা মানুষটায়। তারপর লোকটা মিজানের দিকে এগিয়ে এল। মিজানকে একটা কাচের টুকরা দিয়ে বলল, এখানে একটু থুতু ফেলো। মিজান থুতু ফেলল। ভদ্রলোক কাচের টুকরাটা নিয়ে ঢুকিয়ে দিল একটা ফুটোয়। মুহূর্তকয়েক সময় লাগল। তারপর সবুজ রঙের আলো এসে ভরিয়ে দিল এই প্রকোষ্ঠখানি। সামনের দরজা খুলে গেল। মধুর গন্ধ আর সংগীতে প্রশান্ত হয়ে গেল মিজানের সারা শরীর। শুধু তা–ই নয়, শব্দ, গন্ধ, আলো, স্বাদ, স্পর্শ—এসবের বাইরে আরেক অনুভূতি যেন অনুভব করতে পারছে মিজান। 

‘এটাকে কী বলে? আমার এ রকম লাগছে কেন?’ মিজান জিজ্ঞাসা করল।

লোকটা বলল, ‘তুমি একটা নতুন অনুভূতি পাচ্ছো তো। এটাকে বলা হয় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। নখ দিয়ে আর চুল দিয়ে এটা পাওয়া যায়। এটাকে বলা হয় নখ। এই অনুভূতিটা এই শিপের বাইরে পাবে না। ও ভালো কথা মিজান, তোমাকে তো আমার নামই বলা হয়নি। আমার নাম তিতি। তোমার কি জায়গাটায় ভালো লাগছে?’

হুঁ। মিজান সংক্ষেপে সারল।

‘ভালো। তোমার ভালো লাগুক, আমরা তা–ই চাই। আসলে তুমি ওই নদীর ধারে বটগাছের ডালে শুয়ে এমনভাবে কাঁদছিলে যে আমরা আর থাকতে পারিনি। তোমার দুঃখ কমানোর জন্য আমরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। সে কারণেই তোমাকে এখানে আনা হয়েছে।’ 

মিজান বলল, ‘কিন্তু আমার তো কোনো দুঃখ নাই।’

তিতি বলল, ‘কী জানি। ঠিক আছে, আমরা তোমার সেন্সেশন চেম্বারটা একটু স্ক্যান করে দেখি। কোথাও কোনো দুঃখ পাওয়া যায় কি না’

(চলবে…)