ভিনগ্রহের ক্রিকেটার – পর্ব ৮

১২

আজ ক্লাস সেভেনের সঙ্গে ক্লাস এইটের ক্রিকেট ম্যাচ। সোহান দলীয় অধিনায়ক। সে খুব টেনশন করছে। এর কারণ, তার চিরজনমের বন্ধু ও শত্রু সাবের ক্লাস এইটে পড়ে। দুই বছর আগে তাকে ডাবল প্রমোশন দেওয়া হয়েছিল। সাবেরের সঙ্গে সোহান কেন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভোগে, আল্লাহ জানেন। আল্লাহ তো জানবেনই, তিনি সবই জানেন, তবে সোহান আর সাবেরের বিষয়টা আরও কেউ কেউ জানে। আসলে তাদের উভয়েরই বাবা পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করেন এবং তারা ক্লাস ওয়ান থেকে একই ক্লাসে পড়ে। ছোটবেলা থেকেই সোহানের মা সোহানকে বলে আসছেন, ‘হাতের লেখা ভালো কর, দেখে আয় সাবেরের হাতের লেখা। যা, সাবেরের পা–ধোয়া পানি খা।’ হাতের লেখাতেই ব্যাপারটা সীমিত নয়, পরীক্ষার রেজাল্ট, ছবি আঁকা, বাসার কাজ করা—সবকিছুতেই সোহানকে সাবেরের তুলনা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসতে হচ্ছে। সেই সাবের আগে সোহানের ক্লাসেই ছিল। এখন সে পড়ে এক ক্লাস ওপরে। শুধু তা–ই নয়, ক্লাস এইটের ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেনও আবার সাবেরই। এই অবস্থায় আর যা–ই হোক না কেন, সোহানের টিম হারতে পারে না।

মাঠের চারদিকে উভয় টিমের সমর্থক, অর্থাৎ ক্লাস সেভেন আর এইটের ছাত্ররা ছাড়াও উপস্থিত আছে অন্য ক্লাসের ছেলেরা। তা ছাড়া সাধারণ দর্শকও ভিড় করেছে কিছু। প্রথমে হলো টস। টসে সোহান জিতল এবং ব্যাটিং নিল, এটাই নিয়ম। ক্রিকেট–গুরুরা বলেছেন, যদি তুমি টসে জিতো, প্রথমে ব্যাট নেবে। যদি ভাবো, মাঠের কন্ডিশন ব্যাটিং উপযোগী নয়, তাহলেও ব্যাটের কথাই ভাবো। সুতরাং টসে জিতে ব্যাট না নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।

পরের ওভারে বল তুলে দিল আবদালের হাতে। আর একটা উইকেট পেলে আবদালের হ্যাটট্রিক হতে পারে। সোহান বলল, ‘আবদাল, আরেকটা ওভার কর দেখি। সাবেরকে বের করে দিবি শূন্যতে। পারবি তো?’

প্রথমে উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান আবীর আর শান্ত। ৩০ ওভারের খেলা। ক্লাস এইটের পেসাররা এত জোরে বল করে যে আবীর আর শান্ত কোনোমতে ব্যাট খাড়া করে রেখে দাঁড়িয়ে রইল। তিন ওভারে একবারও বলের সঙ্গে ব্যাটের ছোঁয়া লাগাতে তারা পারল না। এ সত্ত্বেও তারা রান পেল, সেটা হলো বাই রান। ক্লাস এইটের উইকেটকিপার ভালো নয়। অগত্যা তারা বলের গতি দিল কমিয়ে। এই সুযোগে আবীর আর শান্ত পেটাতে শুরু করল। খেলা ভালোই চলল। ১১০ রান করল ক্লাস সেভেন। তবে ওয়ান ডাউনে নামা সোহান আউট হয়েছে ০ রানে। আর ৮ উইকেট পর্যন্ত পড়ার পরই ওভার গেল শেষ হয়ে। ফলে মিজান ব্যাট করার চান্সই পেল না।

এরপর লাঞ্চ ব্রেক। বাটারবান আর কলা। স্কুল থেকেই দেওয়া হয়েছে এই লাঞ্চ। আধঘণ্টা পর শুরু হলো মিজানদের ফিল্ডিং।

প্রথমে বল করল আবদাল। ক্লাস ক্যাপ্টেন হিসেবে তার একধরনের কর্তৃত্ব আছে। সোহান তাকে দিয়েই তাই বোলিং শুরু করল। প্রথম ও তৃতীয় ওভারে বল করল আবদাল। রান হয়ে গেল ২২। এই হারে রান হলে ১১০ ছুঁতে তো ১০ ওভারও লাগবে না। ক্লাস এইটের ছেলেরা খুব লম্ফঝম্প করছে। কোত্থেকে নিয়ে এসেছে ড্রামসেট। ড্রাম বাজিয়ে তারা চিল্লাচিল্লি আর লাফালাফি করছে। আবদাল বলল, ‘ঠিক আছে, এটা আমার লাস্ট ওভার। দেখ কী করি!’ পঞ্চম ওভারে বল হাতে এল আবদাল। শেষ দুই বলে সে দুটি উইকেট দিল ফেলে।

ব্যাট হাতে মাঠে নেমেছে সাবের। সাবের এবার নন–স্ট্রাইকিং এন্ডে। আবদালের ওভারও শেষ। বলে এল সোহান নিজেই। ব্যাটে রান পায়নি। হয়তো সে কারণেই দারুণ বল করল। মোটে ২ রানে ওভার শেষ হলো। সোহানের ওভারে আর আবদাল স্ট্রাইকে আসতে পারল না। পরের ওভারে বল তুলে দিল আবদালের হাতে। আর একটা উইকেট পেলে আবদালের হ্যাটট্রিক হতে পারে। সোহান বলল, ‘আবদাল, আরেকটা ওভার কর দেখি। সাবেরকে বের করে দিবি শূন্যতে। পারবি তো?’

আবদাল বলল, ‘দেখি চেষ্টা করে।’

আর আবদালের প্রথম বলটা হয়ে গেল নো। যদিও বল ব্যাট স্পর্শ করেনি। ফ্রি–হিট বলে সুযোগ বুঝে সাবের ক্রিজের বাইরে এসে এমন হাঁকানোটা হাঁকাল যে মোট ৬ রান হয়ে গেল।

সোহান বেশ দমে গেল। তার এত দিনের প্রতিদ্বন্দ্বী সাবের কিনা ৬ মারল। সে এগিয়ে গেল আবদালের দিকে। বলল, ‘এই আবদাল, দেখেশুনে বল কর।’ আবদাল এবার খুবই যত্ন করে বল করল। যাহোক, ক্লাস এইটের রানের চাকা তাতে শ্লথ করা গেল না। মুশকিল হলো তো।

১৫ ওভার বল শেষে এইটের রান দাঁড়াল ২ উইকেটে ৯০। হাতে আরও ৮টা উইকেট ও ১৫ ওভার। রান করতে হবে আর মোটে ২১। যে কেউ বলে দিতে পারবে, এই খেলায় কে জিতবে! এইটের নাচানাচি দেখে কে?

একটু আগে মাঠের ধারে সপ্তম শ্রেণির ছেলেরা স্লোগান ধরেছিল: ‘ক্লাস সেভেন, সুখের হেভেন।’ এবার তারা চেপে গেছে। পরাজয় নিশ্চিত দেখে অনেকেই কেটে পড়েছে। এখন চিৎকার করছে এইটের সমর্থকেরা। তারা স্লোগান ধরেছে: গাউসুল আজম হু হা, ক্লাস সেভেন গু খা।

দৌড়ে এসে যখন বলটা সে করল, তখন শুধু একটা সাৎ শব্দ হলো। এরপর দেখা গেল, সাবেরের পেছনের মিডল স্টাম্প ভেঙে দুই টুকরা হয়ে অনেক দূরে ছিটকে পড়েছে

সোহানের মেজাজ খারাপ। হাতে তো আর বোলারও নেই। কী করা যাবে। ড্রিল স্যার বসে বসে খেলা দেখছিলেন। তিনি নিরপেক্ষ লোক, এইটের নন, সেভেনেরও নন। কিন্তু সেভেনের এই দুর্দশা দেখেই কি না, তাঁর মায়া হলো। তিনি মাঠের ধারে ফিল্ডিংরত সোহানকে বললেন, ‘মিজানকে দিয়ে বল করা, গাধা।’

আরে আরে, তা–ই তো। মিজানের কথা তো ভুলেই গেছে সোহান। তা তাকেই–বা দোষ দেওয়া যায় কীভাবে, এর আগে মিজানকে নিয়ে তো সে কোনো দিন খেলেওনি, তার পারফরম্যান্স সম্পর্কে তার কোনো অভিজ্ঞতাও নেই। শুধু গেম ক্লাসে আর সিলেকশন টেস্টে মিজানের পারফরম্যান্স সে দেখেছে, তাতেই কি আর হয়। তবে হ্যাঁ, মিজান সেই সময় যা দেখিয়েছে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। ওকেই বল দিতে হবে।

সোহান মিজানের হাতে বল তুলে দিল। ক্লাস এইটের ছেলেরা গর্জে উঠল, ‘মিজান গাধা, খায় শুধু কাদা।’ 

মিজান বলটা হাতে নিয়ে একটু ঘষে নিল। তারপর চলে গেল সীমানার কাছে। এবার সে দৌড় শুরু করবে। দৌড়ে এসে যখন বলটা সে করল, তখন শুধু একটা সাৎ শব্দ হলো। এরপর দেখা গেল, সাবেরের পেছনের মিডল স্টাম্প ভেঙে দুই টুকরা হয়ে অনেক দূরে ছিটকে পড়েছে।

খেলা আপাতত বন্ধ। আরেকটা স্টাম্প দরকার। সেটা পাশের মাঠে অনুশীলনরতদের কাছ থেকে সহজেই পাওয়া গেল। নতুন খেলোয়াড় এল সামনে।

এবার মিজান গেল সীমানার দিকে। খুব জোরে দৌড়ে এসে আস্তে করে একটু সুইং করাল। বল একদিকে পড়ে গেল আরেক দিকে। ব্যস, আবার বোল্ড । পরপর ২ উইকেট। এবার কি হ্যাটট্রিক হবে?

না, পরের বলে আর উইকেট পড়ল না। এলবিডব্লুর আবেদন হয়েছিল। আম্পায়ার আবেদনে সাড়া দিলেন না।

এই মুহূর্তে খেলার রেজাল্ট দাঁড়াল ৯৯ রান, ৭ উইকেট, ১৭ ওভার। হাতে ওভার আছে ক্লাস এইটের, কিন্তু ব্যাটসম্যান কই? ক্লাস সেভেনের সমর্থকেরা এবার জেগে উঠেছে

আবার জোরে বল করল মিজান। এবার বল গিয়ে লাগল ব্যাটে। ব্যাটসম্যান বল দেখেনি। হঠাৎ ব্যাটে বল লেগে গেছে। ক্যাচ উঠল। কিন্তু ফিল্ডার ক্যাচ ধরতে পারল না৷ তবে শেষ বলে ক্যাচআউট হয়ে গেল আরেকজন।

এক ওভারে তিনটা উইকেট নিল মিজান। কোনো রান নয়। আবার সোহান নিজে এল বল হাতে। রান দিল ৫, উইকেট শূন্য। পরের ওভারে মিজান নিল আরও ২ উইকেট। তবে রান দিল ৪টা। সেটা হলো অবশ্য ব্যাটে লেগে নয়, উইকেটকিপারের হাত গলে।

এই মুহূর্তে খেলার রেজাল্ট দাঁড়াল ৯৯ রান, ৭ উইকেট, ১৭ ওভার। হাতে ওভার আছে ক্লাস এইটের, কিন্তু ব্যাটসম্যান কই? ক্লাস সেভেনের সমর্থকেরা এবার জেগে উঠেছে। তারা চিৎকার শুরু করেছে, ‘তোমার জান আমার জান, মিজান মিজান।’

এইটের সমর্থকেরা তার জবাব দিচ্ছে, ‘জানি গাধা খাবে পানি, মিছে কেন হয়রানি। যান যান চলে যান, গাধা গাধা গাধা মিজান।’

আবার বল হাতে নিল সোহান। ২ রানে আটকে রাখল ক্লাস এইটের টেলএন্ডারদের। তবে কোনো উইকেট পেল না। ৭ উইকেটে ক্লাস এইটের রান মোট ১০১। এবার বলে এল মিজান। পেস, সুইং, স্লোয়ার দিয়ে নাজেহাল করল ক্লাস এইটকে। তবে প্রতিরোধ গড়ে তুলল শেষ ব্যাটসম্যান। সে যোগ করল আরও ৬টা রান। তারপর বোল্ড হয়ে ফিরে গেল সাজঘরে। আর সঙ্গে সঙ্গে ক্লাস সেভেনের সাপোর্টাররা দৌড়ে ঢুকে গেল মাঠে, সবার মুখে এক স্লোগান: মিজান মিজান। ক্লাস সেভেন জিতে গেল ৩ রানে।

সবচেয়ে খুশি হলো কিন্তু সোহান। সে মিজানকে কাঁধের ওপর তুলে ফেলল। তখন সবাই এসে কাঁধ পাতল সোহানের সঙ্গে। জয়েন স্যার ঘোষণা করলেন, কাল তিনি নিজের টাকায় ছেলেদের ভালো টিফিন খাওয়াবেন।

চলবে…