আ সাউন্ড অব থান্ডার

দেয়ালে ঝোলানো সাইনটা দেখে ইকেলিস কয়েকবার পলক ফেলল। সাইনটা জ্বলে উঠল অন্ধকারে।

‘টাইম সাফারি ইনক.’

অতীতের যেকোনো সময়ে শিকারের জন্য পাঠানো হয়!

আমরা শুধু আপনাকে সেখানে নিয়ে যাব!!

আর আপনিই করবেন শিকার!!!

একদলা গরম কফ ইকেলিসের গলার কাছে এসে জমা হলো। ঢোক গিলে আবার সেটাকে নিচে ফেরত পাঠাল সে। একটু হাসার ভঙ্গি করে ডেস্কের পেছনে বসা লোকটার দিকে বাড়িয়ে দিল ১০ হাজার ডলারের চেক।

‘সাফারি কোম্পানি আমার জ্যান্ত ফিরে আসার গ্যারান্টি দিচ্ছে তো, নাকি?’

‘আমরা কোনো কিছুর গ্যারান্টি দিই না,’ লোকটা বলল, ‘শুধু ডাইনোসর ছাড়া।’ তারপর ঘুরে অন্যদিকে ইশারা করল। ‘ইনি মিস্টার ট্রাভিস, অতীত ভ্রমণে ইনি আপনার সাফারি-গাইড হবেন। তিনিই আপনাকে বলবেন কোথায় কী গুলি করতে হবে। তিনি যদি বলেন গুলি করা যাবে না, তাহলে কোনো গুলি করা যাবে না। যদি নিয়ম অমান্য করেন, সে ক্ষেত্রে কঠিন শাস্তি রয়েছে। জরিমানা আরও ১০ হাজার ডলার, সেই সঙ্গে ফেরার পর সরকার থেকেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।’

ইকেলিস বিশাল অফিসে নজর বোলাল। চারদিকে তারের জঞ্জাল ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। স্টিলের বক্সগুলো থেকে গুনগুন শব্দ ভেসে আসছে। সেই সঙ্গে আলো বদলে একবার কমলা, একবার রুপালি, আবার নীল রং ধারণ করছে। কিছুক্ষণ পরপর শোনা যাচ্ছে বিচিত্র সব শব্দ।

বিজ্ঞাপনের লেখাগুলো মনে পড়ল ইকেলিসের।

আপনার আলতো স্পর্শেই এই ধ্বংস হতে থাকা দুনিয়া বদলে গিয়ে চোখের পলকে সুন্দর কিছুতে পরিণত হবে। সোনালি স্যালম্যান্ডারের মতো কয়লা, ধুলো ও ধোঁয়া থেকে বেরিয়ে, পুরোনো দিনের সবুজ সময়ে ফিরে যান। যখন বাতাসে ছিল গোলাপের সুগন্ধ। সব সাদা চুল বদলে যাবে কালো চুলে, মুখের ভাঁজ উধাও হয়ে যাবে। সবকিছু যার যার বীজে ফিরে যাবে। মৃত্যু থেকে নিয়ে ফিরে যাবে তাদের শুরুতে। সূর্য উঠবে পশ্চিম আকাশে, গর্বের সঙ্গে অস্ত যাবে পুবে। চাঁদগুলো তাদের অভ্যাসের বিপরীতে চলবে। সবকিছু শুরুর আগের সময়ে পৌঁছে যাবে। শুধু হাতের স্পর্শেই তা সম্ভব, শুধু একটু আলতো স্পর্শে।

টাইর‍্যানোসোরাস রেক্স। একটা একনায়ক মার্কা গিরগিটি। অতীতের সবচেয়ে ভয়াবহ দানব। এখানে স্বাক্ষর দিন। আপনার কিছু হলে আমরা দায়ী থাকব না
আরও পড়ুন

‘অবিশ্বাস্য।’ ইকেলিস দম টানল, মেশিনের আলো এসে পড়ছে ওর মুখে। ‘একদম সত্যিকারের একটা টাইম মেশিন।’ তারপর মাথা দোলাল। ‘ভেবে দেখেছেন, গতকালের নির্বাচনে যদি খারাপ কিছু ঘটত, তাহলে আমি হয়তো এখন পালানোর চেষ্টায় ব্যস্ত থাকতাম। থ্যাংক গড, কিথ জিতেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তিনি চমৎকার একজন প্রেসিডেন্ট হবেন।’

‘হ্যাঁ,’ ডেস্কের পেছনের লোকটা বলল। ‘আমরা ভাগ্যবান। ডয়েশার জিতলে একদম খবর ছিল। বিচ্ছিরি রকমের একনায়কতন্ত্রের মধ্যে গিয়ে পড়তাম আমরা। সবখানে এ রকম উল্টো ধরনের লোক রয়েছে। শান্তিবিরোধী যুদ্ধবাদী, খ্রিষ্টধর্মবিরোধী, মানবতাবিরোধী, বুদ্ধিজীবীবিরোধী। হাস্যকর মনে হলেও হাসির কিছু না আসলে। লোকজন আমাদের ফোন করে কী বলত জানেন? বলত, ডয়েশার যদি প্রেসিডেন্ট হয়, তাহলে তারা ১৪৯২ সালে গিয়ে বাস করতে চায়। আমাদের ব্যবসা তো লোকজনের পালানোর ব্যবস্থা করা নয়, আমরা শুধু সাফারিতে নিয়ে যাই। যাহোক, কিথ এখন প্রেসিডেন্ট, সুতরাং আপনার উচিত—’

‘কীভাবে আমার ডাইনোসরটা শিকার করব, তা নিয়ে চিন্তা করা।’ ইকেলিস তার কথা কেড়ে নিয়ে বলল।

‘টাইর‍্যানোসোরাস রেক্স। একটা একনায়ক মার্কা গিরগিটি। অতীতের সবচেয়ে ভয়াবহ দানব। এখানে স্বাক্ষর দিন। আপনার কিছু হলে আমরা দায়ী থাকব না। এই ডাইনোসরগুলো সব সময় ক্ষুধার্ত।’

ইকেলিস রেগে গেল—‘ভয় দেখানোর চেষ্টা

করছেন নাকি!’

‘সত্যি বলতে কি, হ্যাঁ করছি। আমরা চাই না এমন কেউ যাক, যে গুলি করার আগেই ভয় পেয়ে যাবে। গত বছর ছয়জন সাফারি লিডার খুন হয়েছে, সেই সঙ্গে ডজনখানেক শিকারিও। আপনার মতো একজন শিকারির জন্য আমরা এখানে ভয়ংকরতম শিকারের সত্যিকারের উত্তেজনার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ছয় কোটি বছর অতীতে গিয়ে সময়ের সবচেয়ে বড় খেলাটা খেলার সুযোগ পাচ্ছেন। আপনার চেক এখনো এখানে আছে। চাইলে কাগজটা ছিঁড়ে ফেলে বাদ দিতে পারেন।’

ইকেলিস চেকটার দিকে তাকাল। তারপর স্বাক্ষর করে দিল।

‘গুড লাক,’ ডেস্কের পেছন থেকে লোকটা বলল, ‘মিস্টার ট্রাভিস, উনি এখন আপনার জিম্মায়।’

অলংকরণ: অপ্সরা চৌধুরী

তারা নীরবে রুম থেকে বেরিয়ে অস্ত্র হাতে টাইম মেশিনের দিকে গেল। এরপর শুরু হলো রুপালি ধাতু আর ঘূর্ণমান আলোর খেলা।

প্রথমে একটা দিন, একটা রাত পার হলো, তারপর আরেকটি দিন, আরেকটি রাত। তারপর সপ্তাহ, মাস, বছর, যুগ পার হতে লাগল। ২০৫৫ খ্রিষ্টাব্দ, ২০১৯, ১৯৯৯, ১৯৫৭! সব পার হলো, টাইম মেশিনটা ততক্ষণে গর্জাতে শুরু করেছে।

অভিযাত্রী সবাই অক্সিজেন হেলমেট পরে নিজেদের ইন্টারকম পরীক্ষা করে নিল।

ইকেলিস প্যাডেড সিটে বসে দুলতে লাগল, ওর মুখটা শুকিয়ে গেছে। নিজের ভেতরের কাঁপুনি টের পেল ও, চোখ সরিয়ে শক্ত করে ধরে থাকা নতুন রাইফেলটার দিকে তাকাল। মেশিনের ভেতর আরও চারজন লোক ছিল—ট্রাভিস, যে কিনা সাফারি-লিডার। তার সহকারী, লেস্পারেন্স। আরও দুজন শিকারি, বিলিংস আর ক্রামার। তারা একে অপরের দিকে মুখ করে বসে ছিল, আর বছরগুলো পার হতে লাগল।

‘এই অস্ত্রগুলো কি সত্যি একটা ডাইনোসরকে সাইজ করতে সক্ষম?’ ইকেলিস টের পেল ওর মুখ নিজে নিজে কথা বলছে।

‘যদি ঠিক জায়গায় গুলি লাগাতে পারেন।’ ট্রাভিস তার হেলমেট রেডিওতে উত্তর দিল। ‘কিছু ডাইনোসরের দুটো করে ব্রেন রয়েছে, একটা মাথায়; আরেকটা স্পাইনাল কলাম থেকে নিচের দিকে। আমরা ওগুলো থেকে দূরে থাকব। ওগুলোকে মারতে পারা স্রেফ ভাগ্যের ব্যাপার। আপনার প্রথম দুটো গুলি হতে হবে ওগুলোর চোখে, যদি লাগাতে পারেন আরকি। প্রথমে অন্ধ করে নিয়ে তারপর ব্রেনে গুলি।’

মেশিনটা গর্জন করে উঠল। সময় চলছে উল্টো দিকে ফিল্ম চলার মতো। সূর্য বারবার পালাচ্ছে, একই সঙ্গে ১০ মিলিয়ন চাঁদ পালাচ্ছে পেছন পেছন। ‘ভেবে দেখুন,’ ইকেলিস বলল। ‘এখন পর্যন্ত যত শিকারি জন্ম নিয়েছে, সবাই আমাদের হিংসা করবে। এই মেশিন আফ্রিকাকে ঘরের কাছে এনে দিয়েছে।’

মেশিনটা একসময় ধীর হয়ে এল; গর্জন কমে পরিণত হলো ফিসফিসে। এরপর থেমে গেল। সূর্যও থেমে

গেল আকাশে।

আমরা ভবিষ্যতে কোনো পরিবর্তন চাই না। অতীতে আমাদের কোনো স্থান নেই। সরকার চায় না আমরা এখানে আসি। না বুঝে আমরা হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রাণী মেরে ফেলতে পারি। হয়তো একটা ছোট্ট পাখি, একটা তেলাপোকা, এমনকি একটা ফুল পর্যন্ত হতে পারে! যা হয়তো একটা পুরো প্রজাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু ধ্বংস করে দিতে পারে

মেশিনের চারপাশে ঘুরপাক খাওয়া কুয়াশা মিলিয়ে গেল। আর ওরা পৌঁছে গেল অতীতে। দুজন সাফারি হেড ও তিনজন শিকারি, নীল রঙের ধাতব অস্ত্র তাদের হাঁটুর কাছে ধরে সুদূর অতীতে দাঁড়িয়ে আছে।

‘ওই জঙ্গলটা,’ মিস্টার ট্রাভিস আঙুল তুলে দেখাল, ‘কিথ প্রেসিডেন্ট হওয়ার ৬ কোটি ২ হাজার ৫৫ বছর

আগের জঙ্গল।’

তারপর সবুজ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া একটা ধাতুর তৈরি রাস্তার দিকে ইশারা করল। ‘ওই পথটা,’ সে বলল, ‘আপনাদের জন্য টাইম সাফারির তৈরি বিশেষ পথ। মাটি থেকে ছয় ইঞ্চি ওপরে ধাতব পথটা ভেসে থাকে, কোনো কিছু স্পর্শ করে না। না কোনো ঘাস, কোনো গাছ কিংবা ফুল—কিচ্ছু না। জিনিসটা আসলে একটা অ্যান্টিগ্র্যাভিটি মেটাল। ওটার কাজ হলো আপনাদের এই পৃথিবীর সবকিছু স্পর্শ করা থেকে বিরত রাখা। সব সময় পথের ওপর থাকবেন। যা–ই হোক না কেন, ভুলেও এর থেকে কোথাও সরে যাবেন না। এর থেকে নিচে নামলে শাস্তি আছে। আর আমরা না বলা পর্যন্ত কোনো প্রাণীকে গুলি করা যাবে না।’

‘কেন?’ ইকেলিস প্রশ্ন করল।

‘আমরা ভবিষ্যতে কোনো পরিবর্তন চাই না। অতীতে আমাদের কোনো স্থান নেই। সরকার চায় না আমরা এখানে আসি। না বুঝে আমরা হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রাণী মেরে ফেলতে পারি। হয়তো একটা ছোট্ট পাখি, একটা তেলাপোকা, এমনকি একটা ফুল পর্যন্ত হতে পারে! যা হয়তো একটা পুরো প্রজাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু ধ্বংস করে দিতে পারে।’

‘পরিষ্কার হলো না বিষয়টা,’ ইকেলিস বলল।

‘আচ্ছা ধরুন,’ ট্রাভিস বলে চলল, ‘আমরা ভুল করে এখানে একটা ইঁদুর মেরে ফেললাম। তার মানে হলো, এই একটা ইঁদুর থেকে ভবিষ্যতে যতগুলো বংশধর হতো সব শেষ, তাই না?’

‘ঠিক।’

‘আর সেসব বংশধরের বংশধরদের কথা চিন্তা করুন! শুধু আপনার পায়ের চাপে একটা ইঁদুরের মৃত্যুর কারণে প্রথমে ডজন, তারপর হাজার, তারপর লাখো কোটি ইঁদুর নিশ্চিহ্ন!’

‘হ্যাঁ, তা হোক না নিশ্চিহ্ন,’ ইকেলিস বলল। ‘সমস্যা কোথায়?’

‘সমস্যা কোথায়?!’ ট্রাভিস আস্তে করে দম ছাড়ল। ‘তাহলে ওই ইঁদুরগুলো খেয়ে যে শিয়ালগুলোর বাঁচার কথা ছিল, তাদের কী হবে? ধরা যাক, প্রতি ১০টা ইঁদুর না থাকার কারণে একটা শিয়াল মরবে। ১০টা শিয়াল না থাকার কারণে মরবে একটা সিংহ। একটা সিংহ না থাকার কারণে সব ধরনের পোকামাকড়, শকুন আর অগণিত জীববৈচিত্র্য বিশৃঙ্খলা ও ধ্বংসের মুখে গিয়ে পড়বে। শেষ পর্যন্ত সব মিলিয়ে যা হবে, তা হলো ৫ কোটি ৯০ লাখ বছর পর সারা পৃথিবীতে থাকা এক ডজন গুহামানবের একজন খাবারের জন্য বন্য শূকর কিংবা দাঁতাল বাঘ শিকার করতে বের হবে। কিন্তু ভাই, আপনি তো এদিকে একটা ইঁদুর মেরে ওই এলাকার সব বাঘ শেষ করে দিয়েছেন। সুতরাং গুহামানবটিকে না খেয়ে মরতে হবে। আর ভালো করে মাথায় রাখুন, এই গুহামানবের কিন্তু কোনো বিকল্প নেই। একদমই না। একটা পুরো জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তার একার ওপর। তার থেকে হয়তো ১০টা পুত্রের জন্ম হতো। ১০ পুত্র থেকে ১০০ পুত্র। এভাবে চলতে চলতে একটা পুরো সভ্যতা। এই গুহামানবের মৃত্যু মানে আপনি একটা পুরো জাতি, একটা ইতিহাস ধ্বংস করে দিয়েছেন। শুধু একটা ইঁদুরের ওপর ভুল করে আপনার পা ফেলার কারণে একটা ভূমিকম্প সৃষ্টি হতে পারে, যার প্রতিক্রিয়া আমাদের পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিতে পারে। সময়ের স্রোতে একসময় আমাদের কাছেও পৌঁছে যেতে পারে। ওই একজন গুহামানবের মৃত্যুর কারণে এরপর যে বিলিয়ন সংখ্যক মানুষের জন্ম হওয়ার কথা ছিল, তাদের আর জন্ম হবে না। সে জন্য হয়তো রোম আর কখনো দাঁড়াতে পারবে না। ইউরোপ হয়তো অন্ধকারাচ্ছন্ন জঙ্গল রয়ে যাবে। শুধু এশিয়া হয়তো উন্নতি করবে। একটা ইঁদুর মেরে ফেলার কারণে আপনি হয়তো পিরামিড গড়ার আগেই ধ্বংস করে ফেলবেন। একটা ইঁদুর মেরে ফেলার কারণে আপনি হয়তো গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মতো কিয়ামত পর্যন্ত আপনার ছাপ রেখে যাবেন। কুইন এলিজাবেথের হয়তো আর জন্মই হবে না, হয়তো যুক্তরাষ্ট্র বলে কোনো দেশই সৃষ্টি হবে না। সুতরাং সাবধান। পথের ওপর থাকুন। ভুলেও বাইরে যাবেন না!’

‘বুঝলাম,’ ইকেলিস বলল। ‘তার মানে ঘাসও স্পর্শ করা ঠিক হবে না।’

‘একদম ঠিক বলেছেন। কিছু ঘাস মাড়িয়ে ফেলায় ভবিষ্যৎ কোন দিকে মোড় নেয়, বলা মুশকিল। একটা মামুলি ভুল ছয় কোটি বছরে জমে বিশাল আকার ধারণ করতে পারে। হয়তো আমাদের সব ধারণা ভুল। হয়তো আমরা সময়ের কোনো অদলবদল করতে পারি না। কে জানে, কী হয়? আমরা শুধু অনুমান করতে পারি। কিন্তু যত দিন না আমরা এর বেশি জানতে পারছি, আমাদের চলাফেরা ইতিহাসে ছোট বা বড় কোনো পরিবর্তন করছে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারছি, তত দিন পর্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। জানেন কি না জানি না, যাত্রা শুরুর আগেই এই মেশিন, এই পথ, আপনাদের পোশাক ও শরীর, সব জীবাণুমুক্ত করা হয়েছে। আমরা এই অক্সিজেন হেলমেটগুলো পরছি, যাতে আমাদের শরীরের ব্যাকটেরিয়াগুলো এই প্রাচীন পরিবেশে কোনোভাবে ছাড়া না পায়।’

‘কোন প্রাণীগুলোকে গুলি করতে হবে, তা আমরা কীভাবে জানব?’

‘ওগুলো লাল রং দিয়ে চিহ্নিত করা থাকবে,’ ট্রাভিস বলল। ‘আজকে আমাদের যাত্রা শুরুর আগে লেস্পারেন্স এসে বিশেষ কিছু প্রাণীকে পর্যবেক্ষণ করে গেছে।’

‘হ্যাঁ।’ লেস্পারেন্স জানাল, ‘আমি ওগুলোর পুরো জীবদ্দশা পর্যবেক্ষণ করি। যখন আমি এমন কোনোটাকে পাই, যেটা কিনা গাছে চাপা পড়ে কিংবা ডোবায় ডুবে মরে, তখন নিখুঁতভাবে সেই সময়টাকে লিপিবদ্ধ করি। এরপর একটা পেইন্ট বম্ব মেরে রাখি, যে কারণে এর শরীরে একটা লাল রঙের ছাপ পড়ে। দেখলেই বুঝতে পারবেন, ভুল হবে না। তারপর ব্যবস্থা করি যেন ওগুলোর প্রাকৃতিক মৃত্যুর দুই মিনিট আগে আমাদের সঙ্গে দেখা হয়। এভাবে আমরা শুধু ভবিষ্যৎহীন প্রাণীগুলোকে নির্বাচন করি। যারা আর কোনো বংশধর সৃষ্টি করতে যাচ্ছে না। বুঝতে পারছেন, আমরা কতখানি সতর্কতা অবলম্বন করছি এখানে?’

ট্রাভিস ধারালো গলায় বলল, ‘সবাই সোজা হয়ে দাঁড়ান!’

সবাই এখন মেশিন থেকে বের হওয়ার জন্য তৈরি।

এভাবে আমরা শুধু ভবিষ্যৎহীন প্রাণীগুলোকে নির্বাচন করি। যারা আর কোনো বংশধর সৃষ্টি করতে যাচ্ছে না। বুঝতে পারছেন, আমরা কতখানি সতর্কতা অবলম্বন করছি এখানে?’

জঙ্গলটা এত বিশাল যে মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবীটাই একটা জঙ্গল। আকাশে তাঁবু উড়ে যাওয়ার মতো শব্দ বাতাসে। ওগুলো আসলে দুঃস্বপ্নের মতো বিশাল সাইজের বাদুড়, টেরোড্যাক্টিলের ধূসর ডানা থেকে সৃষ্ট শব্দ।

ইকেলিস প্রশ্ন করল, ‘আমাদের টাইর৵ানোসোরাস বাবাজি কোথায়?’

লেস্পারেন্স তার রিস্টওয়াচ চেক করল। ‘আসছে, ৬০ সেকেন্ডের মধ্যে দেখা যাবে। না বলা পর্যন্ত কেউ গুলি করবেন না। সবাই পথের ওপর থাকবেন!’

সবাই সামনে এগিয়ে চলল।

‘কী অদ্ভুত!’ বিড়বিড় করছে ইকেলিস, ‘ছয় কোটি বছর পরে, নির্বাচন শেষ। কিথ প্রেসিডেন্ট। সবাই উদ্‌যাপন করছে। আর আমরা এখানে লাখো বছর আগে হারিয়ে গিয়েছি। তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই এখানে। যা কিছু নিয়ে আমরা মাসের পর মাস, সারা জীবন ধরে দুশ্চিন্তা করেছি, সেগুলোর এখনো জন্ম হয়নি। কেউ এখনো চিন্তাও করেনি সেগুলো নিয়ে।’

‘সেফটি ক্যাচ অফ করে নিন, সবাই!’ ট্রাভিস আদেশ দিল, ‘ইকেলিস, প্রথম গুলিটা আপনি করবেন, এরপর বিলিংস, শেষে ক্রামার।’

‘আমি এর আগে বাঘ, বন্য শূকর, মহিষ ও হাতি শিকার করেছি। কিন্তু এখানে এসে আমার হাত-পা শিশুদের মতো কাঁপছে।’

ট্রাভিস হাত তুলে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘সামনে। ওই যে কুয়াশার মধ্যে। ওই যে ওখানে আমাদের জাহাঁপনা।’

জঙ্গলে প্রচুর কিচিরমিচির, খচমচ, কলকাকলি হচ্ছে।

হঠাৎ সব থেমে গেল। যেন কেউ দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।

নিশ্চুপ চারদিক।

তারপর মেঘ গর্জনের মতো শব্দ।

প্রায় ১০০ মিটার দূরে কুয়াশার ভেতর থেকে একটা টাইর‍্যানোসোরাস রেক্স বেরিয়ে এল।

‘ওটা,’ ইকেলিস ফিসফিস করল। ‘ওটা...’

‘চুপ!’

লম্বা, মজবুত পা ফেলে প্রাণীটা এগিয়ে এল। বিশাল অশুভ একটা দানব। তৈলাক্ত বুকের কাছের ধারালো নখরগুলো ভাঁজ করে রাখা। হাঁ করা মুখ থেকে ছুরির মতো একগাদা সুচালো দাঁত বেরিয়ে আছে। উটপাখির ডিমের মতো চোখগুলো ঘুরিয়ে দেখছে, ক্ষুধার্ত দৃষ্টি। মুখ বন্ধ করতেই মনে হলো, মৃত্যু হাসছে। তারপর ছুটে এল। গাছ আর ডালপালাগুলো এদিক–সেদিক ভেঙে পড়ছে। নরম মাটিতে নখরওয়ালা পায়ের চাপে ছয় ইঞ্চি গভীর ছাপ পড়ছে।

লম্বা, মজবুত পা ফেলে প্রাণীটা এগিয়ে এল। বিশাল অশুভ একটা দানব। তৈলাক্ত বুকের কাছের ধারালো নখরগুলো ভাঁজ করে রাখা। হাঁ করা মুখ থেকে ছুরির মতো একগাদা সুচালো দাঁত বেরিয়ে আছে

ব্যালে নর্তকীর মতো দৌড়ে এল দানবটা। ১০ টন ভরের পরও নিজের ভারসাম্য সুন্দর বজায় রেখেছে। খোলা জায়গায় সূর্যের আলোতে এসে এর অসাধারণ সরীসৃপ হাত দিয়ে বাতাস মাপছে।

‘ওটাকে হত্যা করা সম্ভব নয়,’ ইকেলিস যেন রায় ঘোষণা করল। হাতের রাইফেলটাকে ওর কাছে খেলনা বন্দুক বলে মনে হচ্ছে। ‘আমরা এখানে এসে বোকামি করেছি। একে শিকার করা অসম্ভব।’

‘চুপ করুন!’ ট্রাভিস হিসিয়ে উঠল।

‘পুরো ব্যাপারটাই দুঃস্বপ্ন।’

‘চুপচাপ মেশিনে ফিরে যান। আমরা আপনার অর্ধেক ফি ফেরত দিয়ে দেব।’ ট্রাভিস হুকুম দিল।

‘আমি বুঝতে পারিনি জানোয়ারটা এত বিশাল কিছু হবে,’ ইকেলিস বলল। ‘ভুল করেছি। আমি এখান থেকে বেরিয়ে যেতে চাই।’

‘আমাদের দেখে ফেলেছে!’

‘ওই যে বুকের কাছে লাল রং!’

সরীসৃপটা সোজা হয়ে দাঁড়ালে ওর বর্মে ঢাকা মাংসপেশিগুলো চকচক করে জ্বলে উঠল।

‘আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে চলুন।’ ইকেলিস বলল, ‘এর আগে কখনো এমন হয়নি। আমি সব সময় নিশ্চিত ছিলাম জীবন নিয়ে ফিরতে পারব। ভালো গাইড ছিল, ভালো সাফারি ছিল, নিরাপত্তা ছিল। এবার ভুল হয়েছে। আমি বুঝতে পেরেছি, স্বীকার করে নিচ্ছি। এ আমার নাগালের বাইরে।’

‘দৌড়াবেন না,’ লেস্পারেন্স বলল। ‘আস্তে করে ঘুরে দাঁড়ান, মেশিনের মধ্যে গিয়ে লুকিয়ে থাকুন।’

ইকেলিস মনে হলো হতবুদ্ধি হয়ে গেছে। নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে ওগুলো নড়ানোর চেষ্টা করল। চোখ পিটপিট করতে করতে এগোল কয়েক কদম।

‘ইকেলিস! ওদিকে না!’

দানবটা প্রথমে সামনে বেড়ে অস্বাভাবিক একটা গর্জন করল, পরবর্তী ছয় সেকেন্ডে পেরিয়ে এল ১০০ মিটার দূরত্ব। রাইফেলগুলো থেকে গুলি ছুটল। দানবটার মুখ থেকে বের হওয়া ঝোড়ো বাতাসের সঙ্গে ছিটকে বেরোল দুর্গন্ধযুক্ত লালা ও রক্ত। দানবটা হুংকার ছাড়ল। সূর্যের আলো পড়ে চকচক করে উঠল দাঁতগুলো।

রাইফেলগুলো আবার গর্জে উঠলেও সরীসৃপটার তীক্ষ্ণ চিৎকার ও গর্জনের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল সব। বিশাল লেজটা চাবুকের মতো ঝাঁকি খেল, আশপাশের গাছপালা, ডাল-পাতা ভেঙে, ছিঁড়ে ছড়িয়ে পড়ছে

রাইফেলগুলো আবার গর্জে উঠলেও সরীসৃপটার তীক্ষ্ণ চিৎকার ও গর্জনের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল সব। বিশাল লেজটা চাবুকের মতো ঝাঁকি খেল, আশপাশের গাছপালা, ডাল-পাতা ভেঙে, ছিঁড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। ওরা প্রাণীটার ধাতব কালো চোখ লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল।

পাহাড়ের ভূমিধসের মতো ধপাস করে পড়ে গেল টাইর‍্যানোসোরাসটা। মাটিতে পড়ে গর্জন করতে লাগল। ওটার নড়াচড়ায় ধাতুর পথটা বেঁকে গেল। সবাই একটু পিছিয়ে গিয়ে গুলি ছুড়ল আরেক দফা। দানবটার গলা থেকে বেরিয়ে এল একগাদা রক্ত। ভেতরে বোধ হয় কোথাও কোনো থলি ফেটে গিয়েছে। ছিটকে আসা দুর্গন্ধযুক্ত তরলে মাখামাখি হয়ে গেল শিকারিরা।

একসময় মেঘের গর্জন কমে এল।

জঙ্গলে নেমে এল নীরবতা। ধসের পর আবারও সবুজ শান্তি বিরাজমান। দুঃস্বপ্নময় রাতের শেষে আবার

সকালের শুরু।

পাহাড়ের ভূমিধসের মতো ধপাস করে পড়ে গেল টাইর‍্যানোসোরাসটা। মাটিতে পড়ে গর্জন করতে লাগল। ওটার নড়াচড়ায় ধাতুর পথটা বেঁকে গেল। সবাই একটু পিছিয়ে গিয়ে গুলি ছুড়ল আরেক দফা। দানবটার গলা থেকে বেরিয়ে এল একগাদা রক্ত

বিলিং আর ক্রামার পথের ওপর বসে বমি করে দিল। ধোঁয়া বের হওয়া রাইফেল হাতে ট্রাভিস আর লেস্পারেন্স গালিগালাজ করছে। টাইম মেশিনের ভেতর শুয়ে ইকেলিস কাঁপছিল। ও কোনোরকমে পথে ফিরে আসতে পেরেছিল। এখন মেশিনে ঢুকে বসে আছে।

‘সবাই পরিষ্কার হয়ে নিন।’

সবাই নিজেদের হেলমেট থেকে রক্ত মুছে নিল। দানবটা একদলা মাংসের মতো পড়ে আছে। তার ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, কলকবজার শব্দ তখনো শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট। সব ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে থেমে যাচ্ছে। আরেকটা কিছু ভাঙার শব্দ পাওয়া গেল। একটা বিশাল গাছের ডাল শব্দ করে ভেঙে পড়ল দৈত্যটার ওপর।

‘অবশেষে।’ লেস্পারেন্স নিজের ঘড়ি চেক করল। ‘একদম সময়মতো। আসলে গাছটা ভেঙে পড়েই জানোয়ারটার মরার কথা ছিল।’ দুজন শিকারির দিকে ফিরে বলল, ‘এই ট্রফি তো আমরা ভবিষ্যতে নিয়ে যেতে পারব না। একে এখানেই থাকতে হবে, যাতে পোকামাকড়, পাখি, ব্যাকটেরিয়া খেতে পারে—যে রকম হওয়ার কথা। একদম খাপে খাপ। এর দেহ এখানেই থাকবে, কিন্তু আপনারা চাইলে কাছে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে নিতে পারেন।’

শিকারি দুজন একটু চিন্তা করে মাথা নেড়ে

আইডিয়াটা বাদ দিল।

ধাতব পথ ধরে মেশিনে ফিরে এল সবাই। দানবটার দিকে শেষবারের মতো ফিরে দেখা গেল, এরই মধ্যে কিছু অদ্ভুত সরীসৃপ আকৃতির পাখি আর সোনালি রঙের পোকা অচল দানবটাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। টাইম মেশিনের ফ্লোর থেকে আসা একটা শব্দে সবাই চুপ হয়ে গেল। ইকেলিস তখনো সেখানে বসে কাঁপছে।

‘আমি দুঃখিত,’ সে কোনোরকমে বলল।

‘উঠে দাঁড়ান!’ চিৎকার করল ট্রাভিস।

ইকেলিস উঠে দাঁড়াল।

ট্রাভিস রাইফেল উঁচিয়ে বলল, ‘আপনি আমাদের সঙ্গে ফিরে যেতে পারবেন না। আমরা আপনাকে এই অতীতে রেখে যাব! ওই পথে ফেরত যান নিজে নিজে।’

লেস্পারেন্স ট্রাভিসকে বাধা দিতে গেল।

টাইম মেশিনের ভেতর শুয়ে ইকেলিস কাঁপছিল। ও কোনোরকমে পথে ফিরে আসতে পেরেছিল। এখন মেশিনে ঢুকে বসে আছে

‘তুমি এর মধ্যে নিজেকে জড়াতে এসো না!’ ট্রাভিস ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিল। ‘এই গাধা আমাদের প্রায় খুন করে ফেলেছিল। তারপরও যথেষ্ট ছিল না ব্যাপারটা। তার জুতার দিকে তাকাও! দেখেছ? পথ থেকে নিচে পড়ে গিয়েছিল, গাধার বাচ্চাটা! এখন সরকারের কাছে রিপোর্ট করতে হবে ব্যাপারটা। তারা আমাদের লাইসেন্স বাতিল করে দেবে। আল্লাহ জানে, সে ইতিহাসে কী না কী পরিবর্তন করে ফেলেছে।’

‘শান্ত হও, সে স্রেফ খানিকটা কাদা মাখিয়েছে।’

‘নিশ্চিত হব কীভাবে?’ ট্রাভিস চিৎকার করে বলল, ‘নিশ্চিতভাবে কিছুই তো আমরা জানি না! পুরো ব্যাপারটাই রহস্যময়! ইকেলিস! বের হন এখান থেকে!’

ইকেলিস তার শার্ট খামচে ধরল। ‘আমি যেকোনো দাম দিতে রাজি আছি। আরও এক হাজার ডলার দেব!’

ট্রাভিস ইকেলিসের চেকবুকের দিকে তাকিয়ে থুতু ফেলল। ‘নেমে যান এখান থেকে। দানবটা পথের পাশেই পড়ে আছে। ওটার মুখে আপনার কনুই পর্যন্ত ঢোকাবেন। কাজটা করতে পারলে আমরা আপনাকে আমাদের সঙ্গে ফেরত নেব।’

‘কিন্তু এ তো অন্যায় আবদার!’

‘দানবটা এখন মৃত, গাধা কোথাকার! ওই বুলেটগুলো এখানে ফেলে যাওয়া যাবে না। সেগুলোর এই অতীতে থাকার কথা নয়। সেগুলো অনেক কিছু বদলে দিতে পারে। এই নিন আমার ছোরা, বুলেটগুলো কেটে বের করে নিয়ে আসুন। যান।’

ইকেলিস বাতাসের গন্ধ শুঁকছিল। হালকা, খুব হালকা কোনো একটা কেমিক্যালের গন্ধ ভাসছে বাতাসে। শুধু সূক্ষ্ম অনুভূতিতে সেটা ধরা পড়ে। আসবাব, দেয়াল, জানালার বাইরে আকাশের রং…সাদা, ধূসর, নীল, কমলা…কেমন জানি অদ্ভুত একটা অনুভূতি। তার শরীর কেঁপে উঠল। পুরো শরীর যেন অস্বাভাবিকতা টের পাচ্ছে

জঙ্গল ততক্ষণে আবার জীবিত হয়ে উঠেছে, অদ্ভুত সব পশুপাখির কলকাকলিতে মুখর। ইকেলিস ধীরপায়ে প্রাগৈতিহাসিক আবর্জনার স্তূপে পড়ে থাকা পাহাড়সমান দুঃস্বপ্নের দিকে ফিরল। ঘুমের মধ্যে হাঁটতে থাকা একজন মানুষের মতো এগিয়ে গেল ধাতব পথ ধরে।

পাঁচ মিনিট পর ইকেলিস আবার ফিরে এল। তার সারা শরীর তখন কাঁপছে। হাত দুটি কনুই পর্যন্ত লাল হয়ে আছে রক্তে। দুই হাতে সমানসংখ্যক স্টিলের বুলেট ধরে আছে। তারপর সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল সে।

‘ওর সঙ্গে এ রকম না করলেও চলত,’ লেস্পারেন্স বলল।

‘তাই নাকি? দেখা যাবে। এখনো কথাটা বলার সময় আসেনি।’ নিথর শরীরটায় ধাক্কা দিল ট্রাভিস। ‘লোকটা বাঁচবে। কিন্তু আর কখনো শিকারে যাওয়ার সাহস করবে না।’ বুড়ো আঙুল তুলে লেস্পারেন্সকে ইশারা করল। ‘সুইচ অন করো, চলো, বাসায় ফেরা যাক।’

১৪৯২, ১৭৭৬, ১৮১২…

সবাই যার যার হাত–মুখ পরিষ্কার করে নিল। শার্ট আর প্যান্টও বদলে নিল। ইকেলিসের জ্ঞান ফিরেছে। সে চুপচাপ বসে আছে। একসময় থামল টাইম মেশিনটা।

‘বের হন সবাই,’ ট্রাভিস বলল।

রুমটা তারা যেভাবে দেখে গিয়েছিল, সেখানেই আছে, কিন্তু একরকম আর নেই। সেই লোকটাই ডেস্কের পেছনে বসা। কিন্তু লোকটা ঠিক একই ডেস্কের পেছনে বসে নেই।

ট্রাভিস সাবধানতার সঙ্গে চারদিকে তাকাল। ‘সবকিছু ঠিক আছে এখানে?’ প্রশ্ন করল।

‘সবকিছু চমৎকার। ওয়েলকাম হোম!’

ট্রাভিস সহজ হতে পারল না। আরও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল সব।

‘ঠিক আছে ইকেলিস, বেরিয়ে যান এখান থেকে। আর যেন আপনাকে এখানে না দেখি।’

ইকেলিস নড়ল না।

‘কথা কানে যায় না?’ ট্রাভিস বলল, ‘ওভাবে তাকিয়ে কী দেখছেন?’

ইকেলিস বাতাসের গন্ধ শুঁকছিল। হালকা, খুব হালকা কোনো একটা কেমিক্যালের গন্ধ ভাসছে বাতাসে। শুধু সূক্ষ্ম অনুভূতিতে সেটা ধরা পড়ে। আসবাব, দেয়াল, জানালার বাইরে আকাশের রং…সাদা, ধূসর, নীল, কমলা…কেমন জানি অদ্ভুত একটা অনুভূতি। তার শরীর কেঁপে উঠল। পুরো শরীর যেন অস্বাভাবিকতা টের পাচ্ছে। দাঁড়িয়ে গেল সব লোম।

সবার আগে যেটা চোখে পড়ল, তা হলো অফিসের দেয়ালে লাগানো সাইন। সেদিন ঢুকেই প্রথম এই সাইনটা চোখে পড়েছিল। সাইনটা একই থাকলেও কোনোভাবে বদলে গিয়েছে।

‘ঠাইম ষাফারি ইঙক.’

ওতীতেঢ় জেকোনো ষময়ে সিকাঢ়ের যন্য ফাঠানো হোয়!

আমঢ়া সুধু আফণাকে ষেকানে ণীয়ে জাব!!

আঢ় আফণী কোঢ়বেন সিকাঢ়!!!

ইকেলিস টের পেল, সে একটা চেয়ারের ওপর বসে পড়েছে। পাগলের মতো নিজের জুতায় লেগে থাকা কাদা হাতড়াতে লাগল। ‘না, এ হতে পারে না! এত ছোট একটা ব্যাপার থেকে এ রকম কিছু হওয়া অসম্ভব! না, এ সম্ভব নয়!’

কাদার ভেতর একটা সবুজ, সোনালি আর কালো রং মেশানো প্রজাপতি লেগে আছে। খুব সুন্দর। এবং মৃত।

‘এত ক্ষুদ্র একটা জিনিস এ রকম কিছু ঘটাতে পারে না! স্রেফ একটা প্রজাপতি এটা!’ ইকেলিস কেঁদে ফেলল।

তার হাত থেকে মেঝেতে পড়ে গেল প্রজাপতিটা। একটা সুন্দর ছোট প্রাণী কিনা বছরের পর বছর ধরে ডোমিনোর মতো ভবিষ্যতের ভারসাম্য বদলে দিয়েছে। ইকেলিসের মাথা আর নিতে পারছিল না। এত ক্ষুদ্র একটা বিষয় থেকে এত পরিবর্তন! একটা মৃত প্রজাপতি এতটা গুরুত্বপূর্ণ কীভাবে হতে পারে! কীভাবে সম্ভব?

ওর মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করল, ‘গ-গতকালের নির্বাচনে কে জিতেছে?’

আরও পড়ুন

ডেস্কের পেছনে বসে থাকা লোকটা হাসল। ‘মজা করছেন? ভালো করেই তো জানেন। ডয়েশার অবকোর্স! আর কে জিতবে? কিথের মতো একটা দুর্বল গাধা নিশ্চয়ই জিতবে না? আমরা এখন শক্তিশালী এক লৌহমানব পেয়েছি। যার কিনা সত্যিকারের সাহস রয়েছে!’ লোকটা থামল। ‘কী হয়েছে আপনার? কোনো সমস্যা?’

ইকেলিসের মুখ থেকে গোঙানি বেরিয়ে এল। হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল সে। কাঁপতে কাঁপতে তুলে ধরল প্রজাপতিটা। লোকটার দিকে, মেশিনের দিকে তাকিয়ে অনুরোধ করল, ‘আমরা...আমরা কি...আবার ফিরে যেতে পারি না? আবার এটাকে বাঁচিয়ে তুলতে পারি না?...আবার প্রথম থেকে শুরু করতে পারি না? আমরা কি...’

এরপর আর একটুও নড়ল না ইকেলিস। চোখ বন্ধ, কাঁপতে কাঁপতে অপেক্ষা করছে। ট্রাভিসের জোরে শ্বাস ফেলার শব্দ শুনতে পেল। শুনতে পেল ট্রাভিস রাইফেল তুলে সেফটি ক্যাচ অফ করছে।

তারপর একটা বজ্রপাতের শব্দ হলো।