স্মার্টফোন

প্রজেক্টের কাজ দেখতে গিয়ে অসাবধানতায় সেলফোনটা পড়ে গিয়েছিল কাদামাটিতে। তারপর থেকে স্ক্রিনে কোনো লেখা স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে না। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে ব্যাপারটা আবিষ্কার করল আরমান। সেলফোন ছাড়া আধুনিক মানুষ একেবারেই অচল। আর আরমান যেহেতু শহরের উপকণ্ঠে, এই বিরান জায়গায় একেবারেই একলা থাকে, আর তার এই ব্যাচেলর বাড়িতে টেলিভিশন, রেডিও, ঘড়ি, ক্যালেন্ডার, পত্রিকা ইত্যাদি কিছুই নেই; স্মার্টফোন ছাড়া তাই তার পক্ষে এক দিনও টেকা মুশকিল। কাল অনেক জরুরি কাজ আছে, ফোন ছাড়া কী করে হবে? ধারেকাছে কোনো বড় শপিং মলও নেই, একটা ভালো ফোন কিনতে হলে যেতে হবে সেই ঢাকা পর্যন্ত—সে কয়েক ঘণ্টার মামলা। পুরাই বেকুব হয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর হঠাৎ তার মনে হলো অনলাইনে অর্ডার দিলেই হয়। ল্যাপটপটা তো আছে। সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকটা অনলাইন শপ খোঁজাখুঁজি করতে শুরু করল আরমান।

সবচেয়ে কম সময়ে ডেলিভারি দিতে পারবে, এমন একটা অনলাইন শপ বেছে নিল। ফিউচারিস্টিক ডটকম। দেখেশুনে অর্ডার প্লেস করল আরমান। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ডেলিভারি করা হবে বলে জানানো হলো সঙ্গে সঙ্গেই। পেমেন্ট ভার্চ্যুয়ালি করা যাবে বা ক্যাশ অন ডেলিভারি। আরমান ক্যাশে করাই মনস্থির করল, নামকরা কোনো শপ নয় বলে শুধু শুধু রিস্ক নিল না। তারপর জামাকাপড় পাল্টে একটা শাওয়ার নিয়ে এক গ্লাস দুধ আর দুই পিস ব্রেড বাটার দিয়ে খেয়ে অগত্যা শুয়ে পড়ল সে। নির্জন এই জায়গায় আশপাশে কোনো ঘরবাড়ি নেই, কারও সঙ্গে সময় কাটানোর ব্যবস্থা নেই, আরমানের ঘরে কোনো বিনোদনের উপকরণও নেই। এই সন্ধ্যাবেলা শুয়ে পড়া ছাড়া আর কী করার আছে! কিন্তু তার ঘুম ভাঙল উপর্যুপরি কলবেলের শব্দে।

কাঁচা ঘুমটা ভেঙে যাওয়ায় প্রথমে কিছুক্ষণ কোনো কিছুই মনে করতে পারছিল না আরমান। সে কোথায়, কেন এখানে শুয়ে আছে, কেন বারবার দরজায় ডিং ডং শব্দ হচ্ছে—গোটা ব্যাপার হৃদয়ঙ্গম করতে মিনিটখানেক লাগল ওর। এখন কয়টা বাজে? মাথার কাছ থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে শূন্য সাদা স্ক্রিন দেখে রাগ হলো ওর। একটা হাতঘড়ি পর্যন্ত নেই। কী একটা অবস্থা! কিন্তু এত রাতে কে আসতে পারে এই বাড়িতে?

গায়ে একটা টি-শার্ট গলিয়ে কোনোমতে দরজার কাছে এসে সে গলা উঁচু করে জিজ্ঞাসা করল, কে?

—আমি প্রোডাক্ট ডেলিভারি দিতে এসেছি। আপনার একটা পার্সেল ছিল।

এত তাড়াতাড়ি! তা–ও এই গভীর রাতে? কী আশ্চর্য। চোর-ডাকাত নয় তো? সে গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোন কোম্পানি?

—স্যার, ফিউচারিস্টিক ডটকম। মিস্টার আরমান রহমানের নামে প্যাকেজ।

এবার দরজা না খুলে উপায় নেই। দরজার ওপারে মাথায় লাল ক্যাপ পরা হালকা–পাতলা কম বয়স্ক একটি ছেলে দাঁড়িয়ে। রাস্তার আলো তার পেছনে থাকায় মুখটা অন্ধকার। চেহারা ভালো বোঝা যায় না। ছেলেটার হাতে একটা সাদা বাক্স।

—আজকেই আসবেন, তা আশা করিনি।

—স্যার, আপনার আর্জেন্ট দরকার বলে আজই ডেলিভারি দিতে বলা হয়েছে।

—তাই বলে এত রাতে?

—খুব একটা রাত হয়নি, স্যার। মাত্র সাড়ে ১১টা বাজে। আর আগামীকাল না হয় একটু দেরি করেই সাইটে গেলেন, স্যার। ছেলেটা ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল।

এরা সব সময় অতিরিক্ত কথা বলে। কথা না বাড়িয়ে আরমান জিনিস বুঝে নিয়ে পেমেন্ট করে দিল। ছেলেটাকে ২০০ টাকা বকশিশও দিল। এত রাতে এত দূর এসেছে! তবে ভালোই হয়েছে। ফোনটা ওর সত্যি আর্জেন্ট দরকার ছিল। কিন্তু অর্ডার করার সময় এ ধরনের কোনো কথা কি জানিয়েছিল? অনলাইন বাজারে এখন কম্পিটিশন অনেক। এরা নতুন শপ, হয়তো দ্রুত ডেলিভারি দিয়ে সুনাম কুড়াতে চায়। কাল ওদের পেজে গিয়ে একটু প্রশংসা করে আসা যাবে ত্বরিত রেসপন্সের জন্য।

কিন্তু ঘুমটা পুরাই টুটে গেছে। বারান্দায় বসে নতুন ফোনটা সেট করে খানিকক্ষণ ফেসবুকিং করল আরমান। তারপর মেইল চেক করল। অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোয় ঢুঁ মারল। কোনো নতুন খবর নেই। রেখে দেওয়ার আগে ফিউচারিস্টিক ডটকম থেকে আসা টেক্সটটা চোখে পড়ল ওর—আমাদের কাছে কেনাকাটা করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আশা করি সঙ্গেই থাকবেন।

রুটিন মেসেজ। বেশ ভালো সার্ভিস এদের। আরমান ওদের ওপর খুশি। কিন্তু এই টেক্সটটা পড়া শেষ হতে না হতেই দ্বিতীয় টেক্সট টুং করে উঠল। এটাও ফিউচারিস্টিক থেকে। আর এবারকার টেক্সটটা পড়ে রীতিমতো বেকুব হয়ে গেল আরমান।

আগামীকাল প্রজেক্টে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সাবধানে থাকবেন। ধন্যবাদ।

এর মানে কী? ভ্রু কুঁচকে গেল আরমানের। ফাজলামো করছে না তো এরা? আশ্চর্য!

রাগে মুখ লাল হয়ে উঠল আরমানের। কয়েকবার চেষ্টা করল নম্বরটাতে রিচ করতে। কিন্তু বারবারই বন্ধ পেল। এসবের মানে কী? কেউ একজন তাকে বিপদে ফেলতে চাইছে। কিন্তু কে?

রাতে ঘুম আসতে আসতে দেড়টা বেজে গিয়েছিল। সকালে তাই উঠতে দেরি হয়ে গেল আরমানের। ঘুম ভেঙে দেখে তার সহকারী জুম্মন মিয়া এসে গেছে। সাহেবের জন্য পরোটা আর ডিম পোচ করে সাজিয়ে রেখেছে টেবিলে। আরমান গায়ে শার্ট গলাতে গলাতে বলল, তাড়াতাড়ি এক কাপ চা দাও, জুম্মন মিয়া। ইশ্‌, কত দেরি হয়ে গেল।

—দিতেছি স্যার। আপনি নাশতা করতে থাকেন।

—জুম্মন মিয়া, বেডসাইড টেবিল থেকে আমার ফোনটা এনে দাও। প্রজেক্টে একটা ফোন করতে হবে। আজ চিফ ইঞ্জিনিয়ারের আসার কথা। দেরি করে ফেললাম।

জুম্মন মিয়া ফোনটা হাতে নিয়ে বলল, নতুন কিনছেন স্যার? সুন্দর।

‘হুম্‌’ বলে আরমান তাড়াহুড়ো করে সুপারভাইজারের নম্বর টেপার আগেই উল্টো দিক থেকে ফোন। সে বলল, মিস্টার জামান, আমার একটু দেরি হয়ে গেল। এক্ষুনি আসছি। স্যার কি চলে আসছেন?

—স্যার, জামানের গলা কাঁপছে, আপনি শোনেননি স্যার? ব্রিজের স্ল্যাব ভেঙে আমাদের দুজন লেবার মারা গেছে। অরুণ স্যার গুরুতর আহত, ওনাকে হাসপাতালে নেওয়া হইছে। আমি ওই সময় একটা ফাইল আনতে একটু অফিস রুমে আসছিলাম। আজকে অরুণ স্যারের সঙ্গে আপনারও ওখানে থাকার কথা ছিল, স্যার। বড় বাঁচা বেঁচে গেছেন!

আরমান অনেকক্ষণ বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল ফোনটা হাতে নিয়ে। কী বলছে এসব জামান?

দিনটা গেছে নানা ঝামেলায়। পুলিশ, আহত ও নিহত শ্রমিকদের স্বজন, সাংবাদিক, হেড অফিসের কমিটি—সবকিছু সামলে বাসায় ফিরতে ফিরতে আবার রাত আটটা। শরীরটা ভেঙে আসছিল আরমানের। বাথরুমে ঢুকে অনেকক্ষণ শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে রইল সে। তখনই মনে পড়ল কাল রাতের মেসেজটার কথা। এটা কি কোনো ষড়যন্ত্র? এরা কি দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত? পুলিশকে কি এ কথা জানানো উচিত ছিল ওর?

বাথরুম থেকে বেরিয়ে ফিউচারিস্টিকের পেজে ঢোকার চেষ্টা করল আরমান। আশ্চর্য, এই নামে কোনো অনলাইন পেজ পাওয়া গেল না। গুগলেও নয়। এই শীতের রাতেও ঘামতে শুরু করল আরমান। এটা নিশ্চয়ই একটা কন্সপিরেসি। থানায় রিপোর্ট করা উচিত। ঠিক তক্ষুনি ফোনে টুং আওয়াজ। টেক্সট মেসেজ।

অযথা নিজের বিপদ ডেকে আনবেন না। পুলিশ এমনিতেই আসবে।

রাগে মুখ লাল হয়ে উঠল আরমানের। কয়েকবার চেষ্টা করল নম্বরটাতে রিচ করতে। কিন্তু বারবারই বন্ধ পেল। এসবের মানে কী? কেউ একজন তাকে বিপদে ফেলতে চাইছে। কিন্তু কে?

পরদিন প্রজেক্ট অফিসে একজন সাদা শার্ট, নীল জিনসের প্যান্ট আর কালো সানগ্লাস পরা লোক এসে হাজির।

—আপনি আরমান রহমান? প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার?

—জি।

—আমি সিআইডি থেকে এসেছি। এসপি জহিরুল ইসলাম। ইউ মে কল মি জহির।

—বসেন।

সামনের চেয়ারে বসে চোখ থেকে সানগ্লাস খুললেন এসপি জহির—আমি এই দুর্ঘটনাটা ইনভেস্টিগেট করছি। আচ্ছা মিস্টার আরমান, আপনি তো প্রতিদিন সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে প্রজেক্টে চলে আসেন, তাই না?

—জি, চেষ্টা করি।

আরমানের ইচ্ছা হলো ফোনটা ছুড়ে ফেলে মেঝেতে। কিন্তু সে অনেকক্ষণ মেসেজটার দিকে চেয়ে রইল। তাকে কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু সেটা কী? তার ফোনটা কি তাকে সাহায্য করতে চায়?

—ঘটনার দিন চিফ ইঞ্জিনিয়ার অরুণ কর্মকার ভিজিটে আসবেন বলে আপনিই তো সবাইকে পইপই করে বলে দিয়েছিলেন কেউ যেন দেরি না করে, নয়টার মধ্যে সবার উপস্থিতি চাই?

—জি। স্যারের সাড়ে নয়টায় আসার কথা ছিল।

—অথচ সেই আপনিই দশটা পর্যন্ত বাড়িতে বসে রইলেন? আপনার প্রজেক্টের অ্যাকসিডেন্টের ঘটনা আপনি প্রথম শুনলেন সুপারভাইজারের ফোনকলে? এমনকি চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব গুরুতর আহত হলেন অথচ আপনার কোনো খবর নেই। ব্যাপারটা একটু অ্যাবসার্ড না?

আরমান একটা ঢোঁক গিলল। তারপর ফ্যাকাশে মুখে বলল, আমার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছিল। আগের রাতে ভালো ঘুম হয়নি।

—কেন? একটু সামনে ঝুঁকে এলেন জহির, কোনো কারণে স্ট্রেসে ছিলেন? কোনো মানসিক চাপ?

—না, ঠিক তা নয়।

—তাহলে ঠিক কী?

এসপি জহির সাহেব প্রজেক্টের আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে চলে গেলে আরমানের মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেল। কী মনে করে নিজের ফোনের ইনবক্সটা খুলল সে। মেসেজগুলো কি ডিলিট করে দেওয়া উচিত হবে? কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ইনবক্স আঁতিপাঁতি করে এ রকম কোনো মেসেজ খুঁজে পেল না সে। এমনকি গত রাতেরটাও না। মাথাটা আরও ধরে গেল আরমানের। এসবই কি তার কল্পনা? সে কি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে?

এদিকে প্রজেক্ট সাইটে অসন্তোষ বাড়ছে। নিহত শ্রমিকদের পরিবার সংবাদ সম্মেলন করেছে। মানবাধিকারকর্মীরা তাদের পাশে আছেন। ক্ষতিপূরণ হিসেবে এরই মধ্যে এক লাখ টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কর্মস্থলে নিরাপত্তা কেন নিশ্চিত করা হয়নি, তা নিয়ে হুলুস্থুল আন্দোলন হচ্ছে। প্রজেক্টের কাজ আপাতত বন্ধ। কিন্তু আরমানের ব্যস্ততার শেষ নেই। এত কিছু সামলাতে হচ্ছে ওকে। চিফ ইঞ্জিনিয়ার অরুণ কর্মকার মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছেন। তাঁকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হবে প্রজেক্টের টাকায়। এ নিয়েও অসন্তোষ। আহত চারজন শ্রমিকও কেন একই রকম উন্নত চিকিৎসা পাবে না, তা নিয়ে মিছিল করছে সংগঠনগুলো।

জুম্মন মিয়া একদিন বলল, স্যার, আপনি একলা একলা থাকেন, জিনিসটা ভালো না। আপনে কয় দিন ঢাকায় আপনার ফ্যামিলির কাছে চইলা যান। এখন তো কাজ বন্ধ।

আরমান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তা হয় না জুম্মন মিয়া। অরুণ স্যার হাসপাতালে। এখন আমিই ইনচার্জ। সবাইকে ফেলে আমি চলে যেতে পারি না। তা ছাড়া...

তা ছাড়া আরও একটা কারণ যে আছে, তা চেপে গেল আরমান। এসপি জহির বলেছেন, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে যেন এই জায়গা ছেড়ে না যায়।

সে রাতেই তৃতীয় মেসেজটা এল।

অরুণ কর্মকারের মৃত্যুর পর আপনিই বস হবেন। তাই কেয়ারফুলি ব্যাপারটা সামলান।

আরমানের ইচ্ছা হলো ফোনটা ছুড়ে ফেলে মেঝেতে। কিন্তু সে অনেকক্ষণ মেসেজটার দিকে চেয়ে রইল। তাকে কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু সেটা কী? তার ফোনটা কি তাকে সাহায্য করতে চায়?

প্রশ্নটার জবাব পেতে দেরি হলো না। তার সেলফোনই জানিয়ে দিল একটু পর।

ফোরম্যান হাবিব!

সাইট থেকে একটু দূরে নদীর পাড়ে একটা চেয়ার নিয়ে বসে ছিল আরমান। সানগ্লাসের ভেতর দিয়ে দেখল দূর থেকে হেঁটে আসছে ফোরম্যান হাবিব। এই লোকই তাহলে নেতৃত্ব দিচ্ছে আন্দোলনের। এর মধ্যে এর সম্পর্কে হোমওয়ার্ক করে ফেলেছে আরমান। বাড়িতে বুড়া বাপ–মা আছে। স্ত্রী আর দুই ছেলে–মেয়ে নিয়ে সাইটের কাছেই টিনের বাসা ভাড়া করে থাকে। ছেলেটা এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। মেয়ে স্কুলে পড়ে। আরমান খবর নিয়েছে, হাবিবের ছেলেটা মেধাবী।

—আসসালামু আলাইকুম স্যার।

হাবিবের মুখ–চোখ শক্ত।

—খবর দিছিলেন।

—ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছ হাবিব?

—কেমুন আর থাকমু? দেখতেছেন তো। আমাদের জীবনের কুনো দাম নাই। তিনজন লেবার মইরা গেল, কারও কুনো নড়াচড়া নাই।

—নড়াচড়া অবশ্যই আছে হাবিব। ওদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।

—জীবনের দাম কি টেকা দিয়া হয়, স্যার? ওগো পরিবার, পোলা–মাইয়া, একেকটা সংসার...

—নিশ্চয়ই জীবনের দাম টাকা দিয়ে পরিশোধ করা যায় না। জীবন অমূল্য। তবে আমরা তাদের পরিবারের খোঁজখবর রাখব।

—হুহ। কত দিন খোঁজখবর রাখবেন জানা আছে।

—ওসব কথা থাক। আমি এই জন্য তোমাকে ডাকি নাই হাবিব। আমি তোমাকে অভিনন্দন জানাতে ডাকছি। শুনলাম তোমার ছেলে জিপিএ–৫ পাইছে! ওকে আমার তরফ থেকে এই গিফটটা দিয়ো।

আরমান একটা দামি হাতঘড়ি বাড়িয়ে দিল হাবিবের দিকে। সেদিকে তাকিয়ে হাবিব মাটিতে থুতু ফেলে বলল, আপনের উপহারের দরকার নাই, স্যার। হাবিবরে অত সস্তা ভাইবেন না।

—সস্তা কেন ভাবব, হাবিব? যার এত বড় একটা সম্পদ আছে। তোমার ছেলে। আমি চাই তোমার ছেলে একদিন ইঞ্জিনিয়ার হোক। মেধাবী ছেলে। নিশ্চয়ই তার সেই পটেনশিয়ালিটি আছে। তোমাকে জানায়ে রাখি, আমাদের অরুণ স্যারের বাবা কিন্তু একজন চা–শ্রমিক ছিলেন। চা–বাগানের কুলি, বুঝছ? আমাকে নিজের মুখে বলছেন।

হাবিব একটু হকচকিয়ে যায়। কথাবার্তা এদিকে মোড় নেবে সে বোধ হয় কল্পনা করেনি।

আরমান চেয়ার ছেড়ে উঠে হাবিবের কাঁধে হাত রাখে। নরম সুরে বলে, আমি তোমার ছেলের পড়াশোনার ভার নিতে চাই। জানোই তো, আমি একা মানুষ। তোমাদের সন্তান মানে আমারও সন্তান। একটা প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি করে দিচ্ছি ওকে। আমি সিটের ব্যবস্থা করে রেখেছি। আমি ওদের পরিচালনা পর্ষদের মেম্বার, আমার কোটা আছে। স্কলারশিপের ব্যবস্থাও করা যাবে। আর বাদবাকি সব খরচাপাতি আমার।

হাবিব উদ্‌ভ্রান্তের মতো তার দিকে চেয়ে থাকে। কিছু বলতে পারে না। আরমান ওকে আরেকটু সময় দেয়। তারপর বলে, আমরা আর কয় দিন বাঁচব, হাবিব? ছেলেমেয়েরাই তো আমাদের ভবিষ্যৎ, তাই না? এ রকম একটা ব্রাইট ছেলে! সে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ ডিজার্ভ করে।

সিঙ্গাপুর থেকে অরুণ কর্মকারের ডেডবডি এসে পৌঁছাল আরও সাত দিন পর। তত দিনে প্রজেক্টের পরিবেশ শান্ত হয়ে গেছে। আবার পুরোদমে কাজ শুরু হয়ে গেছে ব্রিজে। মালিকপক্ষ আরমানের স্কিলের প্রশংসা করে তাকে প্রজেক্ট ডিরেক্টর করার ঘোষণা দিয়ে গেছেন। শ্রমিকদের পক্ষ থেকে মামলা উঠিয়ে নেওয়ায় এসপি জহিরুল ইসলামও আর বিরক্ত করছেন না।

আগের বাসা ছেড়ে পিডির বিরাট বাংলোয় উঠে এল আরমান। এই বাড়ির বারান্দা থেকে নদী আর ব্রিজটা দেখা যায়। এখানে হু হু হেমন্তের বাতাস। ব্রিজের ওপর জ্বলজ্বল করছে আলো। ক্ষতি পোষাতে রাতের শিফটেও কাজ চলছে এখন। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে শ্রমিকদের কোলাহল।

আকাশের দিকে চেয়ে তারাদের দেখে আরমান। এই কয়েক মাসে সে অনেক বদলে গেছে। নিজেই টের পায় এখন। সে এমন ছিল না। কে তাকে এতটা বদলে দিল?

টুং করে উঠল ফোনটা।

কংগ্র্যাচুলেশনস!

কী মনে করে এই প্রথম মেসেজের একটা উত্তর লিখল আরমান। কে তুমি?

জবাব আসতে দেরি হলো একটু। যেন ভেবেচিন্তে উত্তর দিচ্ছে ফোনটা।

—আমি তোমার এআই। তোমার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এখন থেকে সব সময় তোমার পাশে থাকব। ফিউচারিস্টিক স্মার্টফোনের জগতে তোমাকে স্বাগত।