পাখিরা পাখি নয়

অলংকরণ: আরাফাত করিম

‘চিন্তাকে যদি নদীর প্রবাহ ধরেন, তাহলে আমাদের বিশ্বাসগুলো একেকটা ডুবোচরের মতো। বিশ্বাস মানেই প্রবাহে বাধা। যত বেশি বিশ্বাস, তত বেশি প্রবাহে বাধা।

‘তবে সমস্যা কী জানেন, আমরা তো স্রোতের মধ্যে বাস করতে পারি না। আমাদের ঘরবাড়ি লাগে। খুঁটি পুঁততে হয়। খুঁটি পুঁততে মাটি লাগে। এ জন্য আমাদের দ্বীপ বা চর লাগে। কোথাও চর জাগলে আমরা তার ওপর ঘরবাড়ি বানাই। কুমড়াগাছ লাগাই, শিরীষগাছ। আমাদের বিশ্বাসের মাটি থেকে রস শুষে এসব গাছ লকলক করে বড় হয়। ডালপালা ছড়ায়। কোনো কোনো গাছ এত বড় হয় যে পানিতে প্রতিবিম্ব পড়ে। তখন বিশ্বাস-গাছের ওই প্রতিবিম্বগুলোকে আমরা বলি সত্য বা ট্রুথ।

‘মাঝেমধ্যে আমরা ঘুরতে বের হই। এক বিশ্বাস থেকে আরেক বিশ্বাসে ভ্রমণ করি আমরা, নৌকায় করে। তা করতে গিয়ে মাঝখানে যুক্তির স্রোত পাড়ি দিতে হয়। আমরা সেটা করি। উজানে যাই। ভাটিতে যাই। অচেনা দ্বীপে নেমে আমরা হাঁটাহাঁটি করি। দেখি সেখানেও লোকে ঘরবাড়ি করেছে। চালতাগাছ লাগিয়েছে। সেখানেও কুয়োতলায়, কলপাড়ে বাঁশের বেড়ায়, মাচায় ঝিঙে ফুল।

‘মাঝেমধ্যে ফেরার পথে ঝড় ওঠে। আকাশ কালো হয়ে আসে। আমাদের নৌকা পথ হারিয়ে ফেলে। আমরা তখন আশ্রয়ের জন্য সবচেয়ে কাছের দ্বীপটাতে, কাছের চরটাতে নামি। নেমে দেখি, সেখানে এখনো মানুষের বসতি গড়ে ওঠেনি। কিছু কেওড়াগাছ আর নলখাগড়া-বেতফলের ঝোপ। আমাদের খুব অস্বস্তি লাগে। কিছু থাকার অস্বস্তি নয়। কিছুই যে নেই, সেই না থাকার অস্বস্তি।’

অরুণ সরকার খাটের ওপরে বসে একটানা বিড়বিড় করছেন, স্বগতোক্তির মতো, যেন কথাগুলো আমার উদ্দেশে বলা নয়। নিজে নিজেকে শোনাচ্ছেন।

অরুণ সরকারের হাতে একটা দুরবিন। সেটার নলে চোখ লাগিয়ে তিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন আর বিড়বিড় করছেন।

আমি চুপ করে বসে আছি তাঁর পাশে, খাটের সামনে টেনে আনা একটা কাঠের চেয়ারে। পাশে পড়ার টেবিলে স্তূপ করা জিনিসপত্রের মধ্যে ওষুধপাতি আর দুটি চায়ের পেয়ালা। আদা আর এলাচি দেওয়া মসলা চা। আজকে চা আমিই বানিয়েছি।

অরুণ সরকার খাটে আধশোয়া হয়ে আছেন। বুক পর্যন্ত একটা কাঁথা টানা। কয়েক দিন ধরে তাঁর শরীর ভালো যাচ্ছে না। ডেঙ্গু। খবর পেয়ে আমি কিছু ফলমূল নিয়ে দেখা করতে এসেছি।

তাঁর হাতের দুরবিনটা বেমানান। দেখে বোঝা যায়, খেলনা নয়। প্রফেশনাল। জার্মানি থেকে আনিয়েছেন এক বন্ধুকে দিয়ে।

অরুণ সরকারের আর্থিক সংগতি ভালো নয়। একটা দামি বাইনোকুলারের পেছনে খরচ তিনি এমনি এমনি করবেন না। তার মানে ব্যাপার আছে। আমি সেটার জন্য অপেক্ষা করছি। দেখি বাইনোকুলারের প্রসঙ্গে উনি আসছেনই না।

যুক্তি আর বিশ্বাস নিয়ে তাঁর এই রূপক নির্মাণ চলছে তো চলছেই। রূপক তৈরির মোহে পড়ে গেছেন তিনি, এমনভাবে হারিয়ে গেছেন সেটার মধ্যে, যেন উপমা বা রূপক কোনো কিছুর প্রতিনিধি নয়, উপমাই সত্য। যেন একটা নদীর কথাই বলছেন তিনি, দ্বীপের কথা, ঝিঙে ফুলের কথা।

আমি বললাম, যেমন?

অরুণ সরকার থেমে গেলেন। চোখ মেললেন। ‘যেমন…কিসের যেমন?’

বললাম, মানুষের বিশ্বাসের কথা বলছিলেন। বিশ্বাস, যেমন?

অলংকরণ: আরাফাত করিম
আমি চপ্পল খুলে খাটে উঠে পড়লাম। জানালার এক পাশ ঘেঁষে অরুণ সরকার। আরেক পাশ ঘেঁষে বসে আমি বাইনোকুলার হাতে নিলাম। বললাম, কী দেখব?

অরুণ সরকার দুরবিন থেকে চোখ সরালেন। সেটা নামিয়ে রেখে উঠে বসলেন, যেন একটা ঘোরের মধ্য থেকে বের হলেন তিনি। অথবা একটা ট্রেন থেকে নামলেন, যে ট্রেনটা অনেক দূর থেকে এসেছে, সারা রাত ভ্রমণ করে। আমিও একটা রূপকের মতো করে ভাবছিলাম। একটা ট্রেন, প্ল্যাটফর্ম, টি-স্টল। আমিও উপমার মোহে পড়ছিলাম।

কিছুক্ষণ ভাবলেন অরুণ সরকার। তারপর বললেন, যেমন আমরা বিশ্বাস করি পাখি হচ্ছে পাখি।

আমি ফিক করে হেসে ফেললাম। ঠান্ডা হয়ে আসা চা এগিয়ে দিলাম অরুণ সরকারের দিকে।

অরুণ সরকার পেয়ালা নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন চায়ের দিকে। একটা চুমুক দিলেন। তারপর নামিয়ে রেখে বাইনোকুলার তুলে সেটার দিকে ইশারা করলেন।

বললেন, আসুন, দেখুন। বুঝবেন।

আমি বললাম, কী দেখব?

দেখুন না।

আমি চপ্পল খুলে খাটে উঠে পড়লাম। জানালার এক পাশ ঘেঁষে অরুণ সরকার। আরেক পাশ ঘেঁষে বসে আমি বাইনোকুলার হাতে নিলাম। বললাম, কী দেখব?

উল্টো দিকে যে ইলেকট্রিকের খুঁটিটা আছে, সেটার ওপর একটা ট্রান্সফরমার। দেখুন।

আমি বাইনোকুলারে চোখ লাগিয়ে দেখতে শুরু করলাম। বললাম, দেখতে পাচ্ছি।

ওকে, গ্রেট। এবার ওই ট্রান্সফরমারের ওপর কী দেখতে পাচ্ছেন?

কিছু তো দেখতে পাচ্ছি না।

ফোকাস করুন। অ্যাডজাস্ট করুন।

আমি বাটন-টাটন ঘুরিয়ে অ্যাডজাস্ট করলাম।

হুম। দেখতে পাচ্ছি।

কী দেখছেন?

একটা পাখি।

কী পাখি?

মুশকিলে পড়লাম। আমি পাখিটাখি চিনি না। গ্রামে বড় হয়েছি বটে। কিন্তু পাখির দিকে তেমন মনোযোগ কখনো দেওয়া হয়নি। বললাম, টিয়া হতে পারে।

অরুণ সরকার চমকে উঠলেন। ‘বলেন কী’ বলে আমার হাত থেকে বাইনোকুলারটা ছিনিয়ে নিয়ে নিজে তাকালেন। তারপর আবার আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আপনার মাথা! সবুজ হলেই টিয়া পাখি! এটা হলো বসন্তবাউরি। দেখছেন না চড়ুই পাখির মতো সাইজ। আবার তাকান। ভালো করে দেখুন। গলায় নীল রং দেখতে পাচ্ছেন?

পাচ্ছি।

তার ওপর ঝুঁটি?

লাল।

বসন্তবাউরির জাতগুলোর মধ্যে এটা হলো নীলগলা বসন্তবাউরি। ব্লু-থ্রোটেড বারবেট। বৈজ্ঞানিক নাম মেগালাইমা এশিয়াটিকা। এগুলো সাধারণত বুনো এলাকায় থাকে।

গ্রেট। এটা হলো নীলগলা বসন্ত। আরও চার জাতের বসন্তবাউরি আছে দেশে। ইংরেজিতে বলে বারবেট। পুরো দক্ষিণ আর পূর্ব এশিয়ায় দেখবেন এগুলোকে। আগে কখনো দেখেছেন?

না। দেখিনি। কিন্তু আমরা মনে হয় বিশ্বাস নিয়ে কথা বলছিলাম।

আমিও বিশ্বাস নিয়েই বলছি।

আপনি পাখি নিয়ে বলছেন।

না। আমি বলছি, আমরা বিশ্বাস করি, পাখি হচ্ছে পাখি। অন্য কিছু নয়।

পাখিরা পাখি ছাড়া অন্য কিছু নয়। সে জন্যই তো পাখি।

আমি সেটা বলছি না। আমি যেটা বলছি, তা হলো আমরা ধরে নিই, আমাদের চারপাশের সব পাখিই পাখি।

বুঝিনি।

যেমন ধরুন ট্রান্সফরমারের ওপর বসে থাকা ওই বসন্তবাউরিটার কথা। ওটা একটা পাখি। আমরা ধরে নিচ্ছি।

হ্যাঁ। যেমন করে আমরা ধরে নিচ্ছি ওটা একটা বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার। সে রকম।

অরুণ সরকার বিরক্ত হয়ে বাইনোকুলারটা ফেরত নিয়ে নিলেন। বললেন, আমি শুধু পাখির কথাই বলব এখন। ট্রান্সফরমারের নয়।

ঠিক আছে। ওই পাখিটা নিয়ে বলবেন?

শুরুতে ওই পাখিটা নিয়ে বলব। তারপর অন্য কিছু। অন্য কিছু মানে ধরুন আমাদের বিশ্বাসগুলো নিয়ে, আমাদের চিন্তার বায়াসনেস নিয়ে।

ঠিক আছে, বলুন।

বসন্তবাউরির জাতগুলোর মধ্যে এটা হলো নীলগলা বসন্তবাউরি। ব্লু-থ্রোটেড বারবেট। বৈজ্ঞানিক নাম মেগালাইমা এশিয়াটিকা। এগুলো সাধারণত বুনো এলাকায় থাকে। বিশেষ করে অনেক গাছপালা যেখানে। লাউয়াছড়ায় পাবেন। হিমালয়ের পাদদেশের জঙ্গলগুলোয় পাবেন। নেপালে। ভারতেও পাবেন। এমনকি চীন, থাইল্যান্ড, মিয়ানমারে। বুনো ফল খায়।

আপনি যে পাখি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, জানতাম না তো।

ছিলাম না। হয়েছি। দরকারে।

তো? ওটা পাখি না?

বলছি। বসন্তবাউরি সাধারণত আপনি বসন্তকালে দেখতে পাবেন। মানে ওই সময়টায় তারা সক্রিয় হয়। মেটিং সিজন। অন্য সময় কোথায় যে থাকে, বোঝা মুশকিল। এখন বর্ষাকাল। আর তা ছাড়া বড় বড় গাছপালার এই পাখিটা পুরান ঢাকার এই ন্যাড়া হোসেনি দালান এলাকায় কী করছে? এখানে তো এর থাকার কথা নয়। আশপাশে বড় গাছপালা তো দূরের কথা, এটা পেয়ারাগাছও পাবেন না।

তো এই কারণে এটা পাখি না?

আমি বেরিয়েই উল্টো দিকের ইলেকট্রিকের খাম্বায় ট্রান্সফরমারের ওপর আড়চোখে তাকিয়ে নিয়েছি। পাখিটা এখন নেই।

উহু। অত সহজ সিদ্ধান্তের লোক আমি না। লক্ষ করুন পাখিটার আচার-আচরণ। একটানা তাকিয়ে আছে ডান দিকে। অনেকক্ষণ ধরে। কী দেখছে? পাখিরা সাধারণত অস্থিরমতি হয়, প্যাঁচা ছাড়া।

এই পাখিটা হয়তো অসুস্থ।

হতে পারে। তবে আমি মূলত লক্ষ করছি এটার ডাক। বসন্তবাউরিরা কন্টিনিউয়াসলি ডাকে। বাচাল বলতে পারেন। টুক-টুক-টুক-টুক। খুব ডিসটিংকটিভ ডাক। অনেক দূর থেকে শোনা যায়। যেন কামারের হাতুড়িপেটার শব্দ। টুক-টুক-টুক-টুক। আমি ডাকটা চিনি। একটা তাল আছে। ছয় মাত্রার। দাদরা। তিন তিন মাত্রার সমান ভাগে ভাগ। দুটোর মধ্যে একটা আধা মাত্রার ফাঁক। এটা ইউনিভার্সাল। থাইল্যান্ডের একটা বসন্তবাউরিও একই তালে ডাকবে। মিয়ানমারেও আপনি শালবনে গিয়ে শুনবেন টুক-টুক-টুক-টুক।

এটা তো ডাকছেই না।

ডাকছিল। আপনি আসার আগে। দাদরা নয়। মাঝখানের একটা মাত্রা মিসিং। তাতে ঝম্পক আর কাহারবার মিশ্রণ হয়ে গেছে।

আমি চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে থাকলাম।

আমার এ ভঙ্গিটা অরুণ সরকার চেনেন। আমার মধ্যে উনি মাঝেমধ্যে এ ভঙ্গিটা তৈরি করে দিতে পারেন।

আমি খাট থেকে নেমে গেলাম।

দুপুর পেরিয়ে যাচ্ছে। বাইরে থেকে খাবার আনার ব্যবস্থা করতে হবে। ফাই-ফরমাশ খাটার একটা ছেলে আছে। হারুন। ডাকলেই আসে। তাকে দিয়ে বিসমিল্লার চাপ আনাব। অথবা হানিফ বিরিয়ানি।

আপনার কাছে কষ্টকল্পনা বলে মনে হচ্ছে, তাই তো? অরুণ সরকার হাসি হাসি মুখ করে বললেন।

হজম হতে চাইছে না। দুষ্পাচ্য।

তাহলে আপনি বরং এ বাইনোকুলারটা দেখেন। বিশ্বজিতকে দিয়ে আনিয়েছি। রেঞ্জ টোয়েন্টি ফিফটি। হাই রেজল্যুশন। প্রফেশনাল। জার্মান মিলিটারিরা ব্যবহার করে।

দাম কত পড়ল?

অনেক। বলে মুচকি হাসলেন অরুণ সরকার। বললেন, শুনুন। এই জিনিস নিয়ে আমি গত ছয় মাস ঢাকা শহর ঘুরে বেড়িয়েছি দিনরাত একাকার করে। ঢাকার অলমোস্ট সব পাখি আমার দেখা হয়ে গেছে।

তাই নাকি? তো কী দেখলেন? কী বুঝলেন?

কী দেখলাম শুনবেন?

বলুন।

সব পাখি পাখি না।

আমি না শোনার ভান করে দরজা খুলে সিঁড়ির মাথায় ‘হারুন, হারুন’ বলে কয়েকবার হাঁক দিলাম। কোনো সাড়া নেই।

হারুন আসবে না। নিচের সাইদুলরা ওকে লক্ষ্মীবাজার পাঠিয়েছে। চলুন নিচেই যাই। হানিফ বিরিয়ানি।

চলুন।

নিচে নেমে আমি একটা রিকশা নিতে চাইলাম, কিন্তু অরুণ সরকার হাঁটবেন। জ্বরের মধ্যে দুর্বল শরীরে তাঁর নাকি হাঁটতে ভালো লাগবে।

আমি বেরিয়েই উল্টো দিকের ইলেকট্রিকের খাম্বায় ট্রান্সফরমারের ওপর আড়চোখে তাকিয়ে নিয়েছি। পাখিটা এখন নেই।

আমার চাহনি লক্ষ করলেন অরুণ সরকার। বললেন, সামনে তাকান। ওই কার্নিশে।

আমি দেখলাম। সামনের একটা তিনতলার কার্নিশে বসেছে পাখিটা। তাকিয়ে আছে অন্যদিকে। নড়ছে খুব অল্পই।

আমরা হাঁটতে থাকলাম।

রোববার ব্যস্ত দিন। রাস্তাজুড়ে বিপুল লোকজন, গাড়িঘোড়া।

আমাদের এই যে জগৎটা দেখছেন—আটপৌরে, মানডেন: রিকশা চলছে, কেরানিরা অফিস যাচ্ছে, বাচ্চারা ট্যাঁ-ট্যাঁ করে কাঁদছে, লেদ মেশিনের আওয়াজ আসছে। এটা সারফেস। জগৎটা পুরোটাই এ রকম তো নয়।

হাঁটতে হাঁটতে অরুণ সরকার বললেন, পাখিটা যে ওভাবে তাকিয়ে থাকে, ডান দিকে, একটা নিদিষ্ট বাড়ির দিকে, কোন বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে, সেটা আমি বের করেছি। ফোর্টি সিক্স বাই ফোর। মরিয়ম ম্যানসন। ওয়ালি সাহেবের বাড়ি। তিনতলায় ওয়ালি সাহেব থাকেন। তাঁর শ্বশুরবাড়ির এক জ্ঞাতি থাকে দোতলায়। কগহুইলের সাপ্লায়ার। নিচে সিমেন্টের দোকান। ছয়তলার চিলেকোঠায় একজন নতুন ভাড়াটে এসেছে। মাস দুয়েক। সত্তরের ওপরে বয়স। লোকটার দেহের গড়ন এ এলাকার নয়। উচ্চারণেও একটা অচেনা টান আছে। আর এই পাখিটাও মাস দুয়েক হলো এখানে আসছে।

ওটা পাখি নয়। তাহলে কী?

ড্রোন।

‘ক্যাঁ’ করে কর্কশ হর্ন দিয়ে একটা স্কুটি চলে গেল পাশ ঘেঁষে। আর একটু হলে লাগিয়ে দিয়েছিল। আমি লাফিয়ে সরে গেলাম।

আমি থেমে গেছি। অরুণ সরকার টের পাননি। উনি হেঁটে চললেন। ফলে উনি আরও কী কী বললেন, শুনতে পেলাম না।

আমি দাঁড়িয়েই আছি।

আমি যে পাশে নেই, এটা আবিষ্কার করতে করতে অরুণ সরকার গজ দশেক এগিয়ে গেলেন। গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ফিরে এলেন আমার কাছে।

দাঁড়ালেন যে?

ওই পাখিটা ড্রোন?

হ্যাঁ। আরও অনেক পাখিই ড্রোন। আপনার কাছে নতুন তথ্য। আমার কাছে নয়। ঢাকা শহরে ১৭ পারসেন্ট পাখি আসলে পাখি নয়। ড্রোন।

কীভাবে?

আমার ছয় মাসের অবজারভেশন। সারা দিন লাগবে সাজিয়ে বলতে।

কে পাঠাচ্ছে ওদের?

অরুণ সরকার একটা রহস্যময় হাসি দিলেন। বললেন, হানিফ বাদ। আজ শাঁখারীবাজারে যাই। নিরামিষ খাব।

কে পাঠাচ্ছে ওদের?

সত্যি বলতে আমি জানি না। আমাদের এই যে জগৎটা দেখছেন—আটপৌরে, মানডেন: রিকশা চলছে, কেরানিরা অফিস যাচ্ছে, বাচ্চারা ট্যাঁ-ট্যাঁ করে কাঁদছে, লেদ মেশিনের আওয়াজ আসছে। এটা সারফেস। জগৎটা পুরোটাই এ রকম তো নয়। নিচে স্তরের পর স্তর আছে। আপনি চোখটা খুলতে শিখুন। দেখতে শিখুন। বিশ্বাসের ওই দ্বীপটা থেকে বেরিয়ে আসুন। ১৭ পারসেন্টের বেশিও হতে পারে। আমার অবজারভেশন এখনো শেষ হয়নি। আমার ধারণা, ৩০ পারসেন্ট হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। অ্যাই রিকশা!

আমরা একটা ব্যাটারিচালিত রিকশায় চেপে বসলাম।

যেতে যেতে অরুণ সরকার বললেন, বিশ্বজিৎকে আরেকটা জিনিস অর্ডার দিয়েছি।

কী?

একটা এয়ারগান, টেলিস্কোপ এইমার লাগানো।

আমরা যখন শাঁখারীবাজারের গলিতে ঢুকছি, ওপরে তাকিয়ে দেখি নিচু হয়ে আসা মেঘেরও নিচ দিয়ে, প্রায় ভবনগুলোর ডিশের অ্যানটেনা ছুঁয়ে একটা চিল উড়ছে। খুব বেমানান সেটার ওড়ার ভঙ্গি।

চিলটা আমাদের রিকশার চারপাশে চক্কর খেতে খেতে এগোচ্ছে যেন।

আমি দেখলাম অরুণ সরকারও আড়চোখে চিলটাকে দেখছেন।

*লেখাটি ২০২২ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত