হৈটি টৈটি- শেষ পর্ব

অলঙ্করণ: আরাফাত করিম

শেষ পর্ব

১৩. ট্রুয়েন্টের বেয়াদবি

ব্রাউন কিছুটা ভালো হয়ে উঠলেও তখনো হাতি শিকারে যাওয়ার মতো সক্ষম নয়। কক্স আর বাকালা আমার পিঠে চেপে রওনা দিল কয়েক দশক কিলোমিটার দূরে, আগের দিন যে হাতি মারা হয়েছিল, তার দাঁত জোগাড়ের জন্য। মন খুলেই কথা বলছিল ওরা, ভেবেছিল কেউ শুনছে না; ওদের কাছে আমি তো একটা ভারবাহী পশুমাত্র।

‘ওই চকলেট রঙের বাঁদরটা, কী নাম যেন? ওর পাঁচ ভাগের এক ভাগ দিতে হবে ওকে। সেই চুক্তি।’ বাকালা বলছিল। কক্স বললে, ‘বেশ মোটা বখরাই বটে।’

‘যা বাকি রইল, সেটা আবার তিন ভাগ; তুই, আমি আর ব্রাউন। যদি ধরি, এক কিলোগ্রামে পাওয়া যাবে পঁচাত্তর থেকে এক শ মার্ক...

‘অত দাম কেউ দেবে না। ব্যবসার কোনো মাথা নেই তোর। দুই রকমের আইভরি আছে, একটা হলো নরম বা মরা আইভরি, আর একটা শক্ত বা জ্যান্ত আইভরি। প্রথমটা নামেই শুধু নরম, আসলে জিনিসটা খুবই শক্ত, সাদা, আর চিকন বিলিয়ার্ড—বল, পিয়ানোর চাবি, চিরুনি ইত্যাদিতে যা ব্যবহার করা হয়। তার জন্য বেশ দাম মেলে। কিন্তু এখানকার হাতির দাঁত সে রকম না। তা পেতে হলে যেতে হবে পূর্ব আফ্রিকায়—তবে একটি হাতি মারার আগেই তারা সেখানে তোর শক্ত হাড়কে নরম করে ছাড়বে। এখানকার আইভরি শক্ত, জ্যান্ত, স্বচ্ছ। এ কাজে লাগে কেবল ছাতার বাঁট, ছড়ি আর সস্তা চিরুনিতে।’

‘তাহলে দাঁড়াচ্ছে কী?’ গোমড়া মুখে জিজ্ঞেস করল বাকালা, ‘এত যে খাটলাম, সব বেকার?’

‘বেকার হবে কেন? কিছু মিলবে। যদি চারজনে শিকার করে আর লাভটা ভাগ করে নেয় দুজনে, তাহলে মন্দ দাঁড়াবে না...’

‘সত্যি বলছি, আমিও ভেবেছিলাম ব্যাপারটা।’

পরের দিন ভোরে যখন কক্স আর বাকালা ঘুমাচ্ছে, তখন ফিরল ব্রাউন। ম্পেপোর কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখল। পাহারায় ছিল ম্পেপো, দরাজ ঠোঁটে হাসল সে, ঝকঝক করে উঠল দাঁত।

‘ভাবনার ব্যাপার নয়, করার ব্যাপার। আজকালের মধ্যেই ব্রাউন খাড়া হয়ে উঠবে, তখন আর ওকে বাগে আনা যাবে না। হারামজাদাটার গায়ে অসুরের মতো শক্তি। আর ম্পেপোটা মর্কটের মতো ক্ষিপ্র। এক দফায় ওদের শেষ করে দেওয়া দরকার। ভালো হয় রাত্রিতেই। প্রথমটাকে মদ খাইয়ে মাতাল করে দেওয়া ভালো, বলা যায় না। তার মতো যথেষ্ট স্পিরিট এখনো আমাদের আছে।’

‘কখন?’

‘এসে গেছি...’

একটা বিরাট গর্তের মধ্যে কাত হয়ে পড়ে আছে হতভাগ্য হাতিটা, ছুঁচাল খুঁটিতে পেটটা ফেড়ে গেছে তিন দিন আগে। তখনো বেঁচে ছিল। বাকালা গুলি করে মারল তাকে। তারপর কক্সের সঙ্গে নেমে গেল গর্তে, দাঁত খসানোর জন্য। দাঁত খসাতে সারা দিনই লেগে গেল। আমার পিঠের ওপর দাঁত চাপিয়ে যখন রওনা দিল ওরা, তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে।

কক্স যখন তার স্থগিত আলাপ ফের শুরু করল, তখন ছাউনির কাছাকাছি এসে গেছি আমরা।

বললে, ‘ঝুলিয়ে রেখে লাভ নেই। আজ রাতেই শেষ করে দেওয়া যাক।’ কিন্তু হতাশ হতে হলো তাদের। অবাক হয়ে দেখল ব্রাউন ছাউনিতে নেই। ম্পেপো বললে ‘বানা’ বেশ সুস্থ বোধ করছিল, তাই শিকারে গেছে, সম্ভবত রাতে ফিরবে না। বাকালা চাপা মুখে খিস্তি করল। খুনটা তাই পিছিয়ে গেল।

পরের দিন ভোরে যখন কক্স আর বাকালা ঘুমাচ্ছে, তখন ফিরল ব্রাউন। ম্পেপোর কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখল। পাহারায় ছিল ম্পেপো, দরাজ ঠোঁটে হাসল সে, ঝকঝক করে উঠল দাঁত। ব্রাউন তাকে ইশারায় ডেকে নিয়ে এল আমার কাছে, চাপতে বলল। ম্পেপোর ইঙ্গিত পেয়ে আমি হাঁটু গেড়ে বসলাম। দুজনেই ওরা চাপল আমার পিঠে। বনের ধার বরাবর নিয়ে চললাম ওদের।

‘চমৎকার একটা উপহার দেওয়া যাবে ওদের। ভাবছে, আমার অসুখ; আমি কিন্তু ঠিক হয়ে গেছি। চমৎকার দাঁতওয়ালা একটা মস্ত হাতিকে মেরেছি কাল রাতে। চল দাঁত খসাতে সাহায্য করবি আমায়। বাকালা আর কক্স একেবারে অবাক হয়ে যাবে।’

উদীয়মান সূর্যের আলোয় দেখলাম, নদীর ধারে কফিগাছের ঝোপের মধ্যে কাত হয়ে পড়ে আছে হাতির ফুলো লাশটা।

দাঁত খসানোর কাজ শেষ হলে ছাউনির দিকে রওনা দিলাম আমরা, মৃত্যুর দিকে। শিগগিরই মরতে হবে ব্রাউন আর ম্পেপোকে—তার কিছু পরে আমারও ওই একই ভাগ্য। মানুষের কাছ থেকে অবশ্য আমি সর্বদাই পালাতে পারি। আশার কথা হলো, কোনো বিপদ এখনো আমার নেই, ইচ্ছা হচ্ছিল পারলে ব্রাউন আর ম্পেপোকে বাঁচিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে দেখি। তাই পালালাম না। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছিল ম্পেপোর জন্য। এমন হাসিখুশি জোয়ান ছেলে, অ্যাপলোর মতো শরীর। কিন্তু কী করে হুঁশিয়ার করি ওদের। কী বিপদ যে ওদের কপালে আছে, সে কথা তো আমি বলতে পারি না; কিন্তু ছাউনিতে ওদের বয়ে নিয়ে যেতে যদি আপত্তি করি?

সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে সোজা চললাম কঙ্গো নদীর দিকে। ভেবেছিলাম, একবার নদী পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলে হয়তো আমরা মানুষের দেখা পেয়ে যাব। কোনো সভ্য দেশে গিয়ে পৌঁছাতে পারবে ব্রাউন। কিন্তু আমি যে কেন অত একগুঁয়ে হয়ে উঠেছি, সেটা সে বুঝতে পারল না, ধারালো লোহার শিক দিয়ে আমার ঘাড়ে খোঁচাতে লাগল। আমার চামড়া খুবই স্পর্শাতুর, সহজে বিষাক্ত হয়ে উঠতে পারে। নদী থেকে সেই যে ইংরেজটা আমায় গুলি করেছিল, সে গুলির ক্ষত সারতে কত দিন লেগেছিল, আমার তা মনে ছিল। কানে এল ম্পেপো ব্রাউনকে অনুরোধ করছে আমার ঘাড়টা যেন না খোঁচায়। কিন্তু আমার অবাধ্যতায় এত খেপে উঠেছিল ব্রাউন যে কেবলই জোরে জোরে ঘা মারতে লাগল সে।

আমায় বোঝানোর জন্য ম্পেপো তার নিজের ভাষার সবচেয়ে আদুরে কথায় আমায় সান্ত্বনা দিল। কী সব বলল, তার একবিন্দু বুঝলাম না। কিন্তু স্বরটা এমন যে মানুষ ও পশু—সবার কাছেই তা সমান বোধগম্য। সে স্বরটা আমি বেশ বুঝেছিলাম। ঝুঁকে আমার গলায় চুমু খেল সে। বেচারি ম্পেপো! আমায় কী করতে বলছে, তা যদি সে জানত! ‘মেরে ওকে খতম করে দে, চেঁচাল ব্রাউন। ট্রুয়েন্ট যদি মাল বইতে না চায়, তো তার দাঁত দুটো ছাড়া কী দরকার ওকে? বড্ড লাই পেয়েছে। ট্রুয়েন্ট বটে। আগের মালিককে ছেড়ে পালিয়েছে, এখন আমাদের কাছ থেকেও পালানোর ফিকিরে আছে। সেটি হবে না। তার আগে ওর চোখ আর কানের মাঝখান দিয়ে একটি বুলেট চালিয়ে দিচ্ছি, দাঁড়া।’ কথাটা শুনে শিউরে উঠলাম। হাতি শিকারি ব্রাউন, হাতির পিঠ থেকে সে যদি গুলি করে, তবে লক্ষ্যভেদ অব্যর্থ, নিজে মরব নাকি নিশ্চিত মৃত্যুর কাছে নিয়ে যাব ওদের? কানে আসছিল ম্পেপো মিনতি করছে ব্রাউনের কাছে, আমায় যেন না মারে। কিন্তু ইংরেজটা নাছোড়বান্দা, কাঁধ থেকে সে ততক্ষণে রাইফেল টেনে নিয়েছে।

শেষ মুহূর্তে আমি ছাউনির দিকে ফিরলাম।

ব্রাউন হেসে বলল, ‘দেখেছিস, হাতিটা যেন মানুষের ভাষা বুঝে ফেলেছে, টের পেয়েছে কী আমি করতে যাচ্ছিলাম।’ বাধ্যের মতো আমি কয়েক পা এগিয়ে তারপর ঝট করে ব্রাউনকে শুঁড়ে জাপটে নিয়ে ফেলে দিলাম মাটিতে। ম্পেপোকে পিঠে নিয়ে দ্রুত ছুটে গেলাম বনের দিকে। চেঁচাল ব্রাউন, গালাগালি দিল। আসলে বিশেষ জখম হয়নি সে, কিন্তু অসুখের ফলে তখনো সে দুর্বল, চট করে খাড়া হয়ে উঠতে পারেনি। তারই সুযোগ নিয়ে এগিয়ে ঢুকে পড়লাম বনে। ভাবলাম, ‘যদি দুজনকে বাঁচাতে না পারি, তাহলে অন্তত ম্পেপোকে বাঁচাব।’ কিন্তু ম্পেপোও ছাউনির লোকেদের সঙ্গে থাকতেই ব্যগ্র। কয়েক মাস ধরে হাতি শিকারে সে যে নিজের জীবন বিপন্ন করে চলেছে, সে তো খামাখা নয়। পয়সা পাওনা হয়েছে তার। ম্পেপোকে আমার শুঁড় দিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখা উচিত ছিল, কিন্তু সে কথাটা আমার খেয়াল হয়নি। ভেবেছিলাম আমার উঁচু পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়ার সাহস হবে না তার। কিন্তু ছোকরাটা বাঁদরের মতো ক্ষিপ্র। অন্য রকম একটা কাণ্ড করল সে। বন ঘেঁষে আমি চলেছি, ও হঠাৎ একটা ডাল ধরে লাফিয়ে উঠে গেল একটা গাছে, একেবারে আমার নাগালের বাইরে। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে তাই অপেক্ষা করতে লাগলাম...শেষ পর্যন্ত গন্ধ থেকে টের পেলাম চুপি চুপি ব্রাউন এগিয়ে আসছে আমার পেছনে। গুলি করার আগেই ছুটে গেলাম জঙ্গলের ভেতরে।

ওরা তো গেল। কিন্তু ভাগ্যের কবলে ওদের ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছা হচ্ছিল না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরতি পথ ধরলাম। অন্য পাশে চলে গিয়ে ছাউনিতে পৌঁছালাম ওদের আগেই। কক্স আর বাকালা ভারি অবাক হয়ে গেল আমায় দেখে। আরোহী নেই, অথচ চমৎকার দাঁত দুটি চাপানো আছে পিঠে।

বোঝার বাঁধন খুলতে খুলতে কক্স বলল, ‘ব্রাউন আর ম্পেপোর হাত থেকে রেহাই পাওয়ায় কি তাহলে হাতি আর বন্য জন্তুরাই আমাদের সাহায্য করল?’

কিন্তু আনন্দটা টিকল না। গালাগালি দিতে দিতে শিগগিরই এসে হাজির হলো ব্রাউন, তার সঙ্গে ম্পেপো। আমায় দেখে ফের আরেক দফা মুখ খিস্তি শুরু করল সে। শোনাল, কীভাবে আমি ওদের সঙ্গে বেয়াদবি করেছি। তাত্ক্ষণিক আমায় মেরে ফেলার জন্য ওদের রাজি করানোর চেষ্টা করল সে। কক্স চিরকালের হিসাবি, সে প্রস্তাব উড়িয়ে দিয়ে নিজের কাজে মন দিল। সে আর বাকালা বলল, ভারি খুশি হয়েছে তারা, ব্রাউন ভালো হয়ে উঠেছে, নিরাপদে ফিরে এসেছে ছাউনিতে, সঙ্গে আবার এমন চমৎকার এক জোড়া হাতির দাঁত।

আমি কিন্তু ভাগলাম না। কিছুক্ষণ পরে ব্রাউন যখন ফের ঘুমিয়েছে, তখন ওই একই কাণ্ড করলাম আবার। কক্স একেবারে ব্রাউনের কাছে গিয়ে পৌঁছেছে, রিভলবার তৈরি, ঠিক সেই সময় সর্বশক্তিতে শব্দ করলাম আমি।

১৪. চারটে লাশ আর হাতির দাঁত

সকাল সকাল ঘুমাতে গেল সবাই। এ রাতে ম্পেপোর পাহারা দেওয়ার পালা ছিল না, তাই বেহুঁশ হয়ে ঘুমাল সে। ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ব্রাউন, সে–ও নিঃসাড়ে ঘুমাল। পাহারার পালা ছিল কক্সের, আর কম্বলের তলে এপাশ–ওপাশ করছিল বাকালা, বোঝা যায় জেগে আছে। কয়েকবার মাথা তুলে সপ্রশ্ন চোখে সে চাইল কক্সের দিকে। কক্স মাথা নেড়ে বোঝাল, এখনো সময় হয়নি।

বনের ওপারে দেখা দিল কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ, আবছা একটু আলো হয়ে উঠল ফাঁকা জায়গাটা। কচি ছেলের কান্নার মতো একটা করুণ চিৎকার শোনা গেল কোথাও, সম্ভবত বনের মধ্যে কোনো একটা ছোট প্রাণী ধরা পড়েছে বুনো জন্তুর দাঁতে। চিৎকারে ব্রাউন জেগে উঠল না, বোঝা গেল অঘোরে ঘুমাচ্ছে সে। কক্স মাথা নেড়ে সংকেত দিল বাকালাকে, সর্বক্ষণই ও সতর্ক হয়েছিল, সংকেত পাওয়ামাত্র উঠে দাঁড়াল, হাত বাড়াল পেছনকার পকেটের দিকে, নিশ্চয়ই রিভলবারটা বের করার জন্য। ঠিক করলাম, আমাকেও এখনই কাজে লাগতে হবে। শত্রুকে ভয় দেখানোর জন্য ভারতীয় হাতিরা যা করে, আমিও তা–ই করলাম: অর্থাৎ শুঁড়টা মাটিতে চেপে জোরে ফুঁ দিলাম। একটা বিদঘুটে ভয়াবহ শব্দ বেরোল—কেমন একটা ক্যাঁককেকে, ঘড়ঘড়ে, ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ। মরা মানুষও জেগে উঠবে তাতে; আর ব্রাউন তো মরা নয়। ‘কোন হারামজাদা আবার ট্রমবোন বাজাতে শুরু করেছে?’ মাথা তুলে জিজ্ঞেস করল সে, ঘুমে ভরা চোখ দুটো বিস্ফারিত করে। চট করে মাটিতে বসে পড়ল বাকালা।

‘তোর আবার কী হলো, নাচন শুরু করবি নাকি?’ জিজ্ঞেস করল ব্রাউন।

‘আমি মানে ওই হতভাগা হাতিটা আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিল। ভাগ বলছি!’

আমি কিন্তু ভাগলাম না। কিছুক্ষণ পরে ব্রাউন যখন ফের ঘুমিয়েছে, তখন ওই একই কাণ্ড করলাম আবার। কক্স একেবারে ব্রাউনের কাছে গিয়ে পৌঁছেছে, রিভলবার তৈরি, ঠিক সেই সময় সর্বশক্তিতে শব্দ করলাম আমি। ব্রাউন লাফিয়ে উঠে ছুটে এল আমার দিকে, কষে একটা থাবড়া মারল আমার শুঁড়ের ডগায়। আমি চট করে শুঁড় গুটিয়ে সরে এলাম।

‘হতভাগা জানোয়ারটাকে খুনই করব আমি।’ চ্যাঁচাল সে, ‘হাতি নয়, ও একটা পিশাচ! ম্পেপো, জানোয়ারটাকে খেদিয়ে নিয়ে চল তো একটা জলায়...আর রিভলবার নিয়ে কী করছিস তুই?’ হঠাৎ সন্দিগ্ধভাবে কক্সের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল সে।

‘ভাবছিলাম গোটা দুয়েক বুলেট খাইয়ে সরিয়ে দিই ট্রুয়েন্টকে।’ ব্রাউন ফের শুয়ে ঘুমাতে লাগল। আমি কয়েক পা সরে গিয়ে ছাউনির ওপর নজর রাখলাম।

‘হারামজাদা হাতি!’ আমার দিকে ঘুষি দেখিয়ে হিসিয়ে উঠল কক্স। ‘কোনো একটা বুনো জন্তুর গন্ধ পেয়েছে ও,’ ম্পেপো বলল। আমায় সমর্থন করার চেষ্টা করছিল সে। তার ধারণা ছিল না কী সত্যি কথাই না সে বলেছে। সত্যিই আমি হাঁক ছাড়ছিলাম, কারণ জানোয়ারেরই গন্ধ পেয়েছি, নিষ্ঠুর দুপেয়ে জানোয়ার।

প্রায় সকাল হয়ে এসেছে, এমন সময় কক্স সংকেত করল বাকালাকে। দ্রুত ছুটে গেল তারা কক্স ব্রাউনের দিকে, বাকালা ম্পেপোর দিকে, গুলি চালাল একসঙ্গে। একটা করুণ কর্ণভেদী চিৎকার করে উঠল ম্পেপো, প্রথম রাতে সেই যে একটা ছোট জীব চিৎকার করে উঠেছিল বনে, তার মতো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে থরথর করে কেঁপে উঠে ফের পড়ে গেল। খিঁচুনি খেতে লাগল পা দুটো। ব্রাউন কোনো শব্দ করল না। পুরো ব্যাপারটা পলকের মধ্যে ঘটে গেল যে শব্দ করে হতভাগা দুটিকে সতর্ক করে দেওয়ার কোনো সময় পাইনি আমি...

কিন্তু ব্রাউন তখনো মরেনি। কক্স তার ওপর ঝুঁকে আসতেই সে হঠাৎ ডান কনুইয়ে ভর দিয়ে গুলি করল। মাটিতে পড়ে গেল কক্স, ব্রাউন তার দেহের আড়াল নিয়ে গুলি করতে লাগল বাকালাকে। বাকালা চেঁচিয়ে উঠল: ‘আরে শালা লালচুলো শয়তান!’ একবার গুলি করেই সে পালাতে শুরু করল। কিন্তু কয়েক পা যেতে না যেতেই সে এক জায়গায় ঘুরতে লাগল, বুলেট গিয়ে মাথায় বিঁধলে লোকে যেমন করে। তারপর পড়ে গেল মাটিতে।

দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ব্রাউনও ধরাশায়ী হলো। রক্তের একটা তীক্ষ্ণ গন্ধে ভরে গেল বাতাস। সবকিছু চুপচাপ, কেবল গলা দিয়ে একটা ঘড়ঘড় শব্দ বেরোচ্ছে ব্রাউনের। আমি কাছে গিয়ে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম তার দিকে। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে পড়েছে। একটা খিঁচুনির ভঙ্গি করে ফের গুলি করল সে। আমার সামনের ডান পায়ের চামড়া ঘেঁষে ছুটে গেল বুলেটটা।

১৫. সফল চাল

আমার প্রথম সৌভাগ্য দেখা দিল যখন শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছালাম মাথাড়িতে। সময়টা তখন সন্ধ্যা, সমুদ্র আর কঙ্গো অববাহিকার মাঝখানের গিরিশ্রেণির পেছনে অস্ত যাচ্ছে সূর্য। নদী থেকে অনতিদূরে বনের মধ্যে ছিলাম, মনের মধ্যে একরাশ ভাবনা। আফসোস হচ্ছিল গোটা পালের সঙ্গে খেদার মধ্যে কেন যাইনি। তাহলে এমন ফেরারির মতো ঘুরে বেড়াতে হতো না। সে ক্ষেত্রে হয় আমার সব ভবযন্ত্রণা থেমে যেত, নয়তো একটা চাকুরে হাতি হয়ে দিন কাটত। আমার ডান দিকে, নদীতটের জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল অস্তসূর্যের আলোয় লাল হয়ে জ্বলছে নদী, বাঁ দিকে মস্ত মস্ত রবারগাছ; গাছের ছাল কাটা কাটা। তার মানে নিশ্চয়ই কাছেই লোকজন থাকে।

আরও কয়েক শ মিটার এগোতেই এসে পড়লাম ম্যানিওক, জোয়ার, কলা, আনারস, আখ ও তামাকের চষা খেতে। আখ আর তামাকখেতের মাঝখানের পথ ধরে আমি সাবধানে এগিয়ে এসে পৌঁছালাম একটা খোলা মাঠে, তার মাঝখানে একটি বাড়ি। বাড়ির আশপাশে কাউকে দেখা গেল না। শুধু কিছু দূরে খেলা করছিল দুটি শিশু—একটি ছেলে আর একটি মেয়ে, বছর সাত–আট বয়স হবে।

মাঠে এসে যখন পৌঁছাই, তখন ওরা আমায় দেখেনি। আমি পেছনের পায়ে দাঁড়িয়ে যথাসম্ভব মজাদার নানা শব্দ করে নাচ দেখাতে শুরু করি। আমাকে দেখে ওরা দাঁড়িয়ে রইল। পালিয়ে গেল বা চেঁচিয়ে উঠল না, তাতে ভারি আনন্দ হলো আমার; নানা রকম মজার সব খেলা দেখাতে লাগলাম—কোনো ট্রেনিং পাওয়া হাতি, যা কখনো স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। খুশির উচ্ছ্বাসে ছেলেটাই প্রথমে হেসে উঠল খিলখিল করে, আর হাততালি দিতে লাগল মেয়েটা। আমি নেচেকুঁদে চললাম, কখনো সামনের দুই পায়ে দাঁড়াই, কখনো পেছনের দুই পায়ে, কখনো ডিগবাজি খাই।

সাহস পেয়ে ওরা আমার আরও কাছে সরে এল, শেষ পর্যন্ত শুঁড়টা বাড়িয়ে ছেলেটিকে ডাক দিলাম দোলার জন্য। কিছুটা ইতস্তত করে ছেলেটা বসল আমার বাঁকানো শুঁড়ের ওপর, দোল খেতে লাগল। খুকিটিকেও দোল খাওয়ালাম একটু। সত্যি বলতে কি, এই নিশ্চিন্ত শ্বেতকায় খোকাখুকির সাহচর্যে এত আনন্দ হয়েছিল যে একেবারে তন্ময় হয়ে খেলতে লাগলাম ওদের সঙ্গে। লক্ষই করিনি কখন এসে দাঁড়িয়েছে একটা লম্বাটে রোগা লোক। গায়ের চামড়া হলদেটে, কোটরে ঢোকা চোখ। বোঝা যায় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জ্বর থেকে সম্প্রতি উঠেছে। ভয়ানক অবাক ও হতভম্ভ হয়ে সে দেখছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।

ওকে দেখে ইংরেজিতে চেঁচিয়ে উঠল ছেলেটি, ‘বাবা, বাবা, দেখো কেমন একটা হৈটি টৈটি পেয়েছি আমরা।’

‘হৈটি টৈটি!’ ভাঙা গলায় পুনরাবৃত্তি করল লোকটা। দুই পাশে হাত ঝুলিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েই রইল সে। বুঝে পাচ্ছিল না কী করব। আমি সবিনয় অভিবাদন জানালাম তাকে, হাঁটু গেড়েও বসলাম। লোকটা আমার শুঁড়ে হাত বুলিয়ে হাসল।

‘জিতে গেলাম, জিতে গেছি তাহলে,’ উল্লসিত হয়ে উঠলাম আমি...

হাতির কাহিনি এখানেই শেষ। সত্যি বলতে কি, এখানেই সে কাহিনির শেষ হওয়া উচিত, কেননা পরে তার কী হলো, সেটা খুব কৌতূহলের ব্যাপার নয়। যা–ই হোক, ভাগনার, দেনিসভ আর হাতি ভালোই সফর করে সুইজারল্যান্ডে। ট্যুরিস্টদের অবাক করে ভেভের উপকণ্ঠে ঘুরে বেড়াল হাতিটা, আগে রিং এই এলাকাটা খুব পছন্দ করত। মাঝে মাঝে সে স্নান করেছে লেক দে জেনেভ হ্রদে, কিন্তু সে বছর দুর্ভাগ্যবশত শীত এসে পড়ল একটু তাড়াতাড়ি, তাই বিশেষ এক মালগাড়িতে করে বার্লিনে ফিরে আসে আমাদের ট্যুরিস্টরা।

বুশ সার্কাসে এখনো খেলা দেখাচ্ছে হৈটি টৈটি, সদুপায়ে উপার্জন করছে তার দৈনন্দিন তিন শ পঁয়ষট্টি কিলোগ্রাম পথ্য এবং শুধু বার্লিনবাসীদের নয়, অবাক করে দিচ্ছে অনেক বিদেশিকেও, যারা এই ‘হস্তি-প্রতিভা’কে দেখার জন্য বিশেষ সফরে আসে বার্লিনে। এই প্রতিভা নিয়ে এখনো তর্ক করে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। কেউ বলছেন, এসবই একটা বুজরকি, কেউ বলছেন কনডিশনস রিফ্লেক্স, কেউ বলছেন এসবই একটা গণ–হিপনোটিজম।

ভারি অমায়িক আর ভদ্র হয়ে উঠেছে য়ুঙ্গ, ভারি যত্ন করে হাতির। আসলে ভেতরে ভেতরে সে ভয় পায় হৈটি টৈটিকে, ভাবে পুরো ব্যাপারটার মধ্যে ভুতুড়ে কিছু না থেকে পারে না। আপনারাই বলুন: রোজ খবরের কাগজ পড়া চাই হাতির; একদিন তো সে য়ুঙ্গের পকেট থেকে এক প্যাকেট তাসই মেরে দেয়। তারপর কী হলো জানেন? একদিন হাতির কাছে হঠাৎ এসে য়ুঙ্গ দেখে একটা পিপে উল্টিয়ে তার ওপর একমনে তাস বিছিয়ে প্যাশনন্স খেলছে হাতি। ব্যাপারটা য়ুঙ্গ অবশ্য কাউকে বলেনি, কী দরকার, লোকে ভাববে য়ুঙ্গটা মিথ্যাবাদী।

ইভানভিচ দেনিসভের মালমসলা থেকে লেখা। পাণ্ডুলিপি পড়ে ই. স. ভাগনার এই মন্তব্যটি জুড়ে দেন: ‘এ সবই সত্যি ঘটেছিল। অনুরোধ করি, লেখাটা যেন জার্মান ভাষায় অনুবাদ করা না হয়। অন্তত রিংয়ের আশপাশের লোকদের কাছ থেকে রিংয়ের গুপ্ত রহস্য গোপন রাখা উচিত।’

সমাপ্ত

হৈটি টৈটি - প্রথম পর্ব

হৈটি টৈটি - দ্বিতীয় পর্ব

হৈটি টৈটি - তৃতীয় পর্ব

হৈটি টৈটি - চতুর্থ পর্ব

হৈটি টৈটি - পঞ্চম পর্ব

হৈটি টৈটি - ষষ্ঠ পর্ব