ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ – ৬

সবাই জানে হিপনোসিস ও সাজেশন, সম্মোহন ও অভিভাবন সবচেয়ে ভালো খাটে তাদের ওপর, যাদের ইচ্ছাশক্তি দুর্বল। ঠিক এই ব্যাপারটাই কাজে লাগিয়েছিল ক্রাফৎশ্‌তুদৎ কোম্পানির লোকেরা। তারই প্রভাবে পরিগণকদের (যারা হাত দেখে ভবিষ্যত বলতে পারে বলে দাবি করে) মধ্যে ‘গুরুর’ প্রতি বাধ্যতা ও সভয় কৃতজ্ঞতার বোধ প্রবেশ করিয়ে দেয় তারা।

আমাকেও একটা ‘বাধ্যতা’ পাঠক্রমের মধ্য দিয়ে যেতে হতো, কিন্তু আমার অস্বাভাবিক স্পেকট্রামের ফলে তা কিছুদিনের জন্য স্থগিত রইল। আমার জন্য দরকার একটা বিশেষ ব্যবস্থা।

আমার কাজের জন্য একটা আলাদা জায়গা ঠিক হচ্ছিল। ফলে গতিবিধির একটু আপেক্ষিক স্বাধীনতা পেলাম। ওয়ার্ড ছেড়ে বারান্দা দিয়ে যাতায়াত করতে পারতাম আমি। আমার সহকর্মীরা যেখানে পড়াশোনা বা কাজ করত, সেই ক্লাসঘরেও উঁকি দিতে পারতাম।

প্রতিদিন সকালে একটা বিরাট অ্যালুমিনিয়াম কনডেন্সরের দেয়ালের মধ্যে সমবেত প্রার্থনার আয়োজন হতো, আধঘণ্টার জন্য ক্রাফৎশ্‌তুদৎ বন্দীরা শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করত ফার্মের কর্তার প্রতি। ইচ্ছা ও চিন্তাশক্তি না থাকায় ব্রডকাস্টে প্রচারিত কথাগুলোর একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি করে যেত তারা।

‘আত্মজ্ঞানেই আনন্দ ও সুখ,’ বেতারে ঘোষণা করত একটি কণ্ঠস্বর।

‘আত্মজ্ঞানেই আনন্দ ও সুখ।’ নতজানু হয়ে বসা বারোটি মানুষ সমম্বরে প্রতিধ্বনি করত। দেয়ালের অভ্যন্তরে পরিবর্তী বিদ্যুৎক্ষেত্রের প্রভাবে তাদের ইচ্ছাশক্তি আর কিছু নেই তখন।

‘নিউরন সিন্যাপ্সের ওপর প্রেরণা সঞ্চালনের রহস্য অনুসন্ধান করে আমরা আনন্দ ও সুখ লাভ করি।’

‘... আনন্দ ও সুখ লাভ করি।’ পুনরাবৃত্তি করত কোরাস।

‘কী সৌভাগ্য যে সবই এত সরল। প্রেম, ভয়, যন্ত্রণা, হিংসা, ক্ষুধা, দুঃখ, আনন্দ—এ সবই আমাদের দেহে বিদ্যুৎ রাসায়নিক প্রেরণার সঞ্চালন মাত্র—কী অপরূপ এই জ্ঞান।’

‘... অপরূপ এই জ্ঞান…’

‘এই মহাসত্য যে জানে না, তার কপাল মন্দ।’

‘....মহাসত্য…’ একঘেয়ে প্রতিদ্ধনি করত ইচ্ছাশক্তিহীন দাসেরা।

‘এ সুখ আমাদের এনে দিয়েছেন আমাদের গুরু ও ত্রাতা হের ক্রাফৎশ্‌তুদৎ’।

‘আমাদের জীবন দিয়েছেন তিনি।’

‘আমাদের জীবন দিয়েছেন তিনি।’

এই উদ্ভট প্রার্থনাটা আমি শুনতাম একটা ক্লাসঘরের কাচের দরজা দিয়ে উঁকি মেরে।

একদিন এই গাণিতিক উন্মাদনা লক্ষ করছি, হঠাৎ দেখলাম একজন হিসাব কষিয়ে ভেঙে পড়ল। হঠাৎ থেমে গেল তার লেখা, পাগলের মতো তাকাল তার পাশের একজন ক্ষিপ্ত ক্ষিপ্র সহকর্মীর দিকে

নিশ্চল শিথিল দেহে অর্ধমুদ্রিত নয়নে লোকগুলো এই ভুতুড়ে শ্লোক আবৃত্তি করে যেত নির্বিকার গলায়। কয়েক পা দূরের ইলেকট্রিক জেনারেটরটা জোর করে তাদের প্রতিরোধহীন মনের মধ্যে বাধ্যতা গেঁথে দিত। পুরো ব্যাপারটাই কেমন অমানুষিক, চূড়ান্ত রকমের জঘন্য, গন্ডলিকাসুলভ, সেই সঙ্গে আশ্চর্য নিষ্ঠুর। ইচ্ছাহীন এই নরাকার দলটাকে দেখে আপনা থেকেই মনে ভেসে উঠত কেবল শোচনীয় মদ্যপ ও নেশাখোরদের কথা।

প্রার্থনার পর এই বারোটি বলি চলে যেত একটা প্রশস্ত হলঘরে, দেয়াল বরাবর সেখানে বারোটি লেখার টেবিল। প্রতিটি টেবিলের ওপর অ্যালুমিনিয়ামের ছাতার মতো একটা প্লেট—বিরাট কনডেন্সরের অংশ এগুলো। দ্বিতীয় প্লেটটা সম্ভবত মেঝের নিচে।

হলটাকে দেখে মনে হতো একটা খোলা হাওয়ার কাফের মতো, প্রতি টেবিলের ওপরে যেখানে একটা করে চাঁদোয়া। কিন্তু সে চাঁদোয়ার নিচে মানুষগুলোকে দেখা মাত্র এ কাব্যিক ধারণাটা একেবারে উড়ে যেত।

প্রতি টেবিলে থাকত একটা করে কাগজ, তাতে অঙ্কটা লেখা আছে। প্রথম প্রথম এই অঙ্কগুলোর দিকে এরা তাকাত বিহ্বলের মতো। বোঝা যায়, ইচ্ছাশক্তি লোপের ফ্রিকোয়েন্সির প্রভাবটা তখনো কাটেনি। তারপর ১৩ চক্রের ফ্রিকোয়েন্সি চালানো হতো এবং বেতার যোগে হুকুম হতো কাজ শুরু করার।

সঙ্গে সঙ্গে কাগজ-কলম টেনে দ্রুত কলম চালাতে থাকত এরা সবাই। একে কাজ বলা চলে না। এ একটা ক্ষ্যাপামি, একটা গাণিতিক মূর্ছা। কাগজের ওপর হুমড়ি খেয়ে আঁকুপাঁকু করত লোকগুলো, এত দ্রুত হাত চলত যে বোঝাই যেত না কী লিখছে। পরিশ্রমে বেগুনি হয়ে উঠত তাদের মুখ, কোটর ঠেলে বেরিয়ে আসত চোখ।

এটা চলত প্রায় ঘণ্টাখানেক। তারপর যখন তাদের হাতের গতি তির্যক ও বিক্ষিপ্ত হতে থাকত, মাথা নুয়ে পড়ত একেবারে টেবিলের ওপর, বাড়িয়ে দেওয়া ঘাড়ের ওপর সাপের মতো ফুটে উঠত শিরা, তখন জেনারেটর চালানো হতো আটের চক্রে, অমনি গভীর ঘুমে ঢলে পড়ত এই বারো জন। ক্রাফৎশ্‌তুদৎ নজর রাখত যাতে তার দাসেরা কিছুটা মানসিক বিশ্রাম পায়।

এরপর আবার শুরু হতো গোড়া থেকে।

একদিন এই গাণিতিক উন্মাদনা লক্ষ করছি, হঠাৎ দেখলাম একজন হিসাব কষিয়ে ভেঙে পড়ল। হঠাৎ থেমে গেল তার লেখা, পাগলের মতো তাকাল তার পাশের একজন ক্ষিপ্ত ক্ষিপ্র সহকর্মীর দিকে, ফাঁকা চোখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ, যেন কী একটা জিনিস কিছুতেই মনে পড়ছে না।

তারপর ভয়ঙ্কর হেঁড়ে গলায় একটা আর্তনাদ করে সে তার জামাকাপড় টেনে ছিঁড়তে লাগল। নিজেকে কামড়ে আঙুলগুলো চিবুতে লাগল, বুকের চামড়া খামচে খামচে মাথা ঠুকতে লাগল টেবিলে। শেষ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়ে ঢলে পড়ল মেঝের ওপর।

‘কিন্তু এরা নিজেরা তো কিছু বেছে নেয়নি। নিজেদের ডিভিডেন্ডের জন্য আপনারাই আপনাদের প্রেরণা জেনারেটরের সাহায্যে লোকগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন আত্মহননের দিকে!’

অন্য পরিগণকেরা সেদিকে বিন্দুমাত্র নজর দিল না। ক্ষিপ্তের মতো কাজ করে চলল তাদের পেনসিল। এ দৃশ্যে এমন ক্ষেপে উঠেছিলাম আমি যে বন্ধ দরজার ওপর ধাক্কাতে শুরু করি। ইচ্ছে হচ্ছিল এই হতভাগ্য লোকগুলোকে ডাক দিয়ে বলি, আর নয় যথেষ্ট হয়েছে, সবকিছু ভেঙে চুরে ঝাঁপিয়ে পড়ো তোমাদের উৎপীড়কদের ওপর...

‘অত উত্তেজিত হবেন না, হের রাউখ, একটা শান্ত কণ্ঠস্বর শোনা গেল আমার পাশে। লোকটা বলৎস।’

‘আপনারা সব জল্লাদ! দেখুন কী দশা করেছেন মানুষের। এদের নির্যাতন করার কী অধিকার আছে আপনাদের?’

তার সেই মৃদু বিদগ্ধ হাসি হেসে বলল বলৎস, ‘ইউলিসিসের সেই গল্প জানেন তো? দেবতারা তাকে বেছে নিতে বলেছিল একটা দীর্ঘ, শান্ত জীবন কিংবা একটা স্বল্প, উদ্দাম জীবন। স্বল্প, উদ্দাম জীবনটাই বেছেছিল ইউলিসিস। এরাও তাই।’

‘কিন্তু এরা নিজেরা তো কিছু বেছে নেয়নি। নিজেদের ডিভিডেন্ডের জন্য আপনারাই আপনাদের প্রেরণা জেনারেটরের সাহায্যে লোকগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন আত্মহননের দিকে!’

হেসে উঠল বলৎস।

‘আপনি তো শুনেছেন, ওরা নিজেরাই বলে যে ওরা সুখী। সত্যিই সুখী ওরা। দেখুন কেমন তন্ময় হয়ে ওরা কাজ করছে। সৃজনশীল শ্রমেই তো সুখ, তাই না?’

‘আপনার এ যুক্তি আমার কাছে কদর্য বোধ হয়। মানুষের জীবনে একটা স্বাভাবিক কর্মছন্দ আছে, সেটা বাড়ানোর যেকোনো চেষ্টা অপরাধ।’

ফের হেসে উঠল বলৎস।

‘আপনার কথাটা যুক্তিযুক্ত হলো না, প্রফেসর। এক সময় লোকে পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চেপে যেত। এখন যায় জেট প্লেনে। আগে খবর ছড়াত মুখে মুখে, লোকে লোকে, শম্বুক গতিতে পৃথিবীময় ছড়াতে লেগে যেত কয়েক বছর। এখন ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে লোকে সে খবর পেয়ে যাচ্ছে বাড়ির রেডিওতে। বর্তমান সভ্যতা জীবনের ছন্দ বাড়িয়ে তুলছে এবং সেটাকে আপনি অপরাধ গণ্য করেন না। তা ছাড়া কৃত্রিমভাবে আমোদ-প্রমোদ বিনোদনের যত ব্যবস্থা রয়েছে, তাও জীবনের ছন্দ বাড়িয়ে তুলছে না কি? তাহলে একটা জীবন্ত দেহযন্ত্রের কাজের ছন্দকে কৃত্তিমভাবে বাড়ালে তাকে অপরাধ ভাবছেন কেন? এই লোকগুলো এখন যা করছে, স্বাভাবিকভাবে জীবন কাটালে তার লাখ ভাগের একভাগও যে সম্পূর্ণ করতে পারত না, সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। আর জানেনই তো, জীবনের অর্থ হলো সৃজনী ক্রিয়া। ওদেরই একজন যখন আপনি হবেন, তখন তা পুরো হৃদয়ঙ্গম করবেন আপনি। সুখ আর আনন্দ কী জিনিস, তা শিগগিরই জানবেন। বলতে কী, দুই দিনের মধ্যেই। আপনার জন্য একটা আলাদা ঘরের ব্যবস্থা হচ্ছে। সেখানে একলা কাজ করবেন আপনি, কারণ, মাপ করবেন, আপনি স্বাভাবিক লোকেদের চেয়ে খানিকটা অন্যরকম।’

গায়ে পড়া ভাবে কাঁধে চাপড় মেরে বলৎস চলে গেল, আমি ভাবতে লাগল তার অমানুষিক দর্শন নিয়ে।

(চলবে…)

 

* সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘প্রগতি প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত গল্প সংকলন গ্রহান্তরের আগুন্তুক থেকে নেওয়া।

মূল: আনাতলি দনে্‌প্রভ

অনুবাদ: ননী ভৌমিক