হৈটি টৈটি - পঞ্চম পর্ব

১০. দুশমন চারপেয়ে আর দুপেয়ে

দেনিসভ বলল, ‘পড়া হয়ে গেল।’

‘তাহলে এই নিন তার পরেরটুকু’, হাতির ঘাড়ে চাপড় মেরে বললেন ভাগ, ‘আপনি যখন পড়ছিলেন, তখন স্যাপিয়েন্স ওরফে হৈটি টৈটি ওরফে রিং তার অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি শোনাচ্ছিলেন। ওকে জীবন্ত দেখতে পাব, এ আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম, কিন্তু দেখা যাচ্ছে নিজের চেষ্টাতেই ইউরোপে ফেরার ব্যবস্থা করে নিতে পেরেছে সে। এই শর্টহ্যান্ড নোটগুলোর মর্মোদ্ধার করে আমার জন্য টাইপ করে দেবেন।’

ভাগনারের কাছ থেকে নোটবইটা নিল দেনিসভ, ড্যাশ আর কমায় সব ভর্তি। প্রথমে পড়ল, তারপর লিখে ফেলল হাতির নিজের বলা কাহিনিটা। ভাগনারকে স্যাপিয়েন্স যা বলেছিল, সেটা এই:

হাতি হওয়ার পর থেকে যত অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, তা সব আপনাকে বলে উঠতে পারা সহজ নয়। সবচেয়ে উদ্দাম স্বপ্নেও কখনো ভাবতে পারিনি, আমি প্রফেসর টার্নারের সহকারী হঠাৎ রূপান্তরিত হব হাতিতে, জীবনের একাংশ কাটাব আফ্রিকার অরণ্যের গভীরে। যা–ই হোক, পরপর ঘটনাগুলোর রূপরেখা আপনাকে জানানোর চেষ্টা করা যাক।

ছাউনি থেকে বেশ দূরেই চলে গিয়েছিলাম, একটা মাঠের মধ্যে নিশ্চিন্তে ঘাস খাচ্ছিলাম। তুলছিলাম একেবারে গোছা ধরে, শিকড়বাকড়ের মাটিগুলো ঝেড়ে ফেলে রসাল ঘাস চিবুচ্ছিলাম। ওখানকার ঘাস শেষ হয়ে গেলে বনের মধ্যে ঢুকি আরও চারণভূমির সন্ধানে। রাতটা বেশ স্বচ্ছ, জ্যোৎস্নাভরা। জোনাকি, বাদুড় এবং প্যাঁচার মতো আরও কিছু, অজানা নৈশ পাখি উড়ে বেড়াচ্ছিল চারদিকে। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। যেতে অসুবিধা হচ্ছিল না, নিজের দেহের প্রকাণ্ড ভারটা টেরই পাচ্ছিলাম না। চেষ্টা করছিলাম যাতে শব্দ হয় যথাসম্ভব কম। শুঁড় দিয়ে ডানে-বাঁয়ে নানা ধরনের বুনো জন্তুর গন্ধ পাচ্ছিলাম, কিন্তু জানতাম না কোন ধরনের জন্তু। মনে হয় যেন আমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সব জানোয়ারের চেয়ে আমার শক্তি বেশি। সিংহ পর্যন্ত আমায় সম্মান করে পথ ছেড়ে দেবে। অথচ এতটুকু খসখস, পলায়মান ইঁদুর কি শিয়ালের মতো এতটুকু একটা জন্তুর একটুকু শব্দেই কেমন যেন চমকে উঠছিলাম। একটা ছোট বনশুয়োর দেখে আমিই পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ালাম। সম্ভবত নিজের পুরো শক্তি সম্বন্ধে সচেতন ছিলাম না আমি। একটা জিনিসে আশ্বস্ত বোধ করছিলাম: জানতাম লোকজন অদূরেই আছে, আমার সাহায্যে ছুটে আসার জন্য তারা সদাই প্রস্তুত।

তাই ধীরে ধীরে পা ফেলে এলাম একটা ছোট ফাঁকামতো জায়গায়। একদলা ঘাস ছেঁড়ার জন্য শুঁড় নামাতে যাব, এমন সময় একটা বুনো জন্তুর গন্ধ নাকে এল, নলখাগড়ার মধ্যে খসখস শব্দও শুনতে পেলাম। শুঁড় তুলে বেশ গুটিয়ে রাখলাম নিরাপত্তার জন্য, তারপর আশপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল একটা স্রোতের ধারে নলখাগড়ার মধ্যে একটা চিতা বাঘ, লব্ধ হিংস্র চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। পুরো শরীর তার টানটান, ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উন্মুখ। মুহূর্তে দেরি হলেই সে যেন লাফিয়ে পড়বে আমার ঘাড়ে। কী যে আমার হলো বলা কঠিন, সম্ভবত হাতি হওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি, অনুভূতি ও যুক্তি তখনো নিতান্তই মানুষের মতো। কেমন একটা উন্মাদ আতঙ্ক আমি কিছুতেই চেপে রাখতে পারলাম না, ভয়ানক কেঁপে উঠে ছুটতে শুরু করে দিলাম।

হুড়মুড় করে গাছপালা ভেঙে পড়তে লাগল। আমার উদ্দাম ছুট দেখে ভয় পেয়ে গেল বহু জানোয়ার; ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে তারা দিগ্‌বিদিক পালাতে লাগল আর তাতে করে আরও বেড়ে উঠল আমার ভয়। মনে হলো যেন কঙ্গো অববাহিকার সবকিছু, বুনো জন্তু আমায় তাড়া করছে। কতক্ষণ ধরে যে ছুটেছিলাম বা কোন দিকে যাচ্ছিলাম, খেয়াল ছিল না। শেষ পর্যন্ত থমকে দাঁড়াতে হলো এক প্রতিবন্ধকের সামনে—নদী। আমি সাঁতার কাটতে পারি না, মানে যখন মানুষ ছিলাম, তখন সাঁতার জানতাম না। অথচ মনে হলো চিতা বাঘটা আমার পেছনে, তাই নদীতেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম, পা নাড়াতে লাগলাম এমনভাবে যেন তখনো দৌড়ে চলেছি। দেখা গেল সত্যিই সাঁতরাতে শুরু করেছি। জলে মস্তিষ্ক কিছুটা ঠান্ডা হলো, খানিকটা সুস্থির বোধ করলাম। তবু এ অনুভূতিটা কাটেনি, যেন গোটা বন ভরে আছে যত ক্ষুধিত জানোয়ারে, তীরে ওঠা মাত্র আমার ওপর যেকোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়তে তারা ব্যগ্র। তাই সাঁতরেই চললাম, ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

সূর্য উঠছে, অথচ আমি সাঁতরেই চলেছি। নদীতে নৌকা দেখা গেল, তাতে লোকজন। কিন্তু মানুষকে আমার ভয় ছিল না, অন্তত নৌকা থেকে একটা গুলি ছোড়ার শব্দ না পাওয়া পর্যন্ত। প্রথমটা ভাবতেই পারিনি যে আমার দিকে গুলি ছুড়ছে। তাই সাঁতরেই যাচ্ছিলাম। এবার ফের বন্দুকের আওয়াজ হলো, মনে হলো যেন আমার ঘাড়ের ওপরে একটা বোলতা কামড়াল। মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম, একজন সাদা চামড়ার লোক, ইংরেজদের মতো পোশাক, নৌকায় বসে আছে আর দাঁড় টানছে দেশীয়রা। সেই গুলি করছিল আমার দিকে। হায়রে কপাল! মানুষও দেখছি বুনো জানোয়ারের চেয়ে কম বিপজ্জনক নয়!

কী করি তাহলে? ইচ্ছা হলো ইংরেজটাকে চেঁচিয়ে বলি গুলি করা বন্ধ করতে। কিন্তু মুখ দিয়ে কেবল একটা ক্যাঁককেঁকে শব্দ বেরোল। ইংরেজটা তার লক্ষ্যভেদ করলেই আমি গেছি—আপনার মনে আছে আপনি আমাকে বলেছিলেন, কোন জায়গাটা সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক, চোখ আর কানের মাঝখানের জায়গাটা, যেখানে মস্তিষ্ক থাকে। আপনার উপদেশ মনে পড়ে যাওয়াতে ওই জায়গাটা আড়াল করে মাথা ঘুরিয়ে পূর্ণবেগে তীরের দিকে ছুটলাম। যখন তীরে উঠছিলাম, তখন আমার শরীরটাকে গুলিবিদ্ধ করা খুবই সোজা ছিল, কিন্তু মাথাটা আমার অন্তত ছিল বনের দিকে।

বোঝা যায় হাতি শিকারের নিয়ম ইংরেজটা ভালোই জানে, স্থির করল আমার পেছনে গুলি মেরে কোনো ফল হবে না। তাই গুলি বন্ধ করে সম্ভবত অপেক্ষা করতে লাগল আমি মুখ ফিরিয়ে নিই কি না। কিন্তু জন্তু–জানোয়ারের কথা আর একটুও না ভেবে আমি দ্রুত ঢুকে পড়লাম জঙ্গলের মধ্যে।

বন ক্রমশ ঘন হয়ে উঠতে লাগল। লতায় পথ বন্ধ হয়ে গেল আমার। শিগগিরই এমনভাবে জড়িয়ে পড়লাম যে উপায়ান্তর না পেয়ে থামতে হলো। এমন অসহ্য ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম যে কাত হয়ে শুয়েই পড়লাম মাটিতে। হাতিদের সেভাবে শোয়া উচিত কি না, একটুও ভাবলাম না।

তখন একটা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্ন দেখলাম আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, প্রফেসর টার্নারের সহকারী। বার্লিনের আন্টার ডেন লিন্ডেনে আমার ছোট্ট ঘরখানায় বসে আছি। চমৎকার গ্রীষ্মের রাত; জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে কেবল একটি নিঃসঙ্গ তারা। বাইরে থেকে ভেসে আসছে ফুটন্ত লাইমগাছের গন্ধ; ছোট্ট টেবিলটার ওপর একটা নীল ভেনিসিয়ান কাচের গ্লাসে কিছু সুগন্ধি লাল কার্নেশন। এসব সুগন্ধের মধ্য থেকে অনাহূত অতিথির মতো আসছে কেমন একটা তীক্ষ্ণ কটু-মিষ্টি ঘ্রাণ—কালো কারেন্টের ঘ্রাণের মতো। টের পেলাম সেটা কোনো বুনো জানোয়ারের গন্ধ...কিন্তু পরদিনের লেকচার তৈরি করছি আমি। মাথা গুঁজে রেখেছি বইয়ে; তারপর একটু তন্দ্রা এল আমার, লাইম, কর্নেশন আর বুনো জানোয়ারের গন্ধটা কিন্তু তখনো টের পাচ্ছি। তারপর আর একটা অদ্ভুত দুঃস্বপ্ন দেখলাম—আমি হাতি হয়ে গেছি, রয়েছি এক গ্রীষ্মমণ্ডলীর অরণ্যে...বুনো জানোয়ারের গন্ধ তীব্র হয়ে উঠে আমায় বিচলিত করছে। জেগে উঠলাম আমি। কিন্তু এ তো স্বপ্ন নয়, সত্যিই যে হাতি হয়ে গেছি আমি, লসিয়াস* যেমন হয়ে গিয়েছিল গাধা। কেবল আমার বেলায় ব্যাপারটা ঘটেছে আধুনিক বিজ্ঞানের জাদুতে।

দুপেয়ে জন্তুর গন্ধ পেলাম, কোনো এক দেশীয় আফ্রিকানের ঘামের গন্ধ। সেই সঙ্গে মিশে আছে সাদা চামড়ারও একটা গন্ধ; সম্ভবত নৌকা থেকে আমায় যে গুলি করেছিল, সে-ই। তার মানে ফের আমার পিছু নিয়েছে। হয়তো এই মুহূর্তে কোনো একটা ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে সে, বন্দুকের নল তাক করছে আমার চোখ আর কানের মাঝখানে বিপজ্জনক ছোট্ট জায়গাটার দিকে...ঝট করে লাফিয়ে উঠলাম। গন্ধটা আসছিল ডান দিক থেকে, তার মানে আমাকে ছুটতে হবে বাঁ দিকে। তাই ঝোপঝাড় ভেঙে ছুটতে শুরু করে দিলাম। তারপর জানি না কোত্থেকে এ চালটা শিখলাম পশ্চাদ্ধাবককে বিপথে চালিত করার জন্য হাতিরা যা করে, তা–ই করলাম। খুব শোরগোল তুলে খানিকটা পিছু হটে যাওয়ার পর হাতি হঠাৎ খুব চুপচাপ হয়ে যায়। কোনো শব্দ না শুনতে পেয়ে শিকারি ভাবে যে হাতিটা দাঁড়িয়ে পড়েছে।

হাতি কিন্তু ওদিকে তখনো পালাতে থাকে, কেবল পা ফেলে সে অতি সাবধানে, এত আস্তে ডালপালা সরিয়ে যায় যে একটা নিঃশব্দ সঞ্চারী বিড়ালও তা পারবে না। অন্তত দুই কিলোমিটার ছুটে যাওয়ার পর সাহস করে মাথা ফিরিয়ে গন্ধ নিলাম। তখনো লোকের গন্ধ আসছিল, কিন্তু মনে হলো অন্তত কিলোমিটার দূর থেকে। হাঁটা থামালাম না।

নেমে এল গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রাত, গুমোট, অসহ্য গরম, আর সূচিভেদ্য অন্ধকার। অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কও ফিরে এল। সে আতঙ্ক যেন আমায় চারপাশ থেকে জড়িয়ে ধরল, অন্ধকারের মতোই তার যেন শেষ নেই। কোথায় পালালে নিরাপদ হব? কী করব? চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকাটা যেন বেশি ভয়ংকর মনে হলো। তাই অবিচল অক্লান্ত পদক্ষেপে এগিয়েই চললাম।

কিছুক্ষণ পরেই পায়ের নিচে জল ছলাৎ ছলাৎ করতে লাগল। আরও কয়েক পা এগোতেই দেখলাম একটা তীরে এসে পড়েছি। কিসের তীর? নদী নাকি হ্রদ? ঠিক করলাম সাঁতরে যাব। জলের মধ্যে অন্তত বাঘ–সিংহের আক্রমণ থেকে নিরাপদ বোধ করা যাবে। সাঁতরাতে শুরু করলাম, কিন্তু শিগগিরই অবাক হয়ে দেখলাম, আমার পা ঠেকছে তলার মাটিতে, জল গভীর নয়। তাই হেঁটেই চললাম আমি।

পথে অনেক জলা–কাদার নদী পেরোতে হলো। ঘাসের মধ্য থেকে ছোট ছোট অদৃশ্য প্রাণীর হিস হিস শব্দ শোনা গেল। বড় বড় ব্যাঙ ভয় পেয়ে লাফিয়ে ছিটকে যেতে লাগল। সারা রাত ধরে আমি ঘুরে বেড়ালাম। সকাল নাগাদ মানতেই হলো যে একেবারে চূড়ান্ত রকমের বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি।

আরও কয়েক দিন গেল। আগে যাতে আতঙ্ক হতো, এমন অনেক কিছুর ভয় আমার কেটে গেল। আশ্চর্য মনে হবে, আমার নতুন জীবনের প্রথম কয়েক দিন এমনকি কাঁটা দেখেও ভয় হতো, বুঝি বিঁধে যাবে। হয়তো আমার শুঁড়ের ডগায় সেই কাঁটা বিঁধার ঘটনাটা থেকে এই ভয় জমেছিল। যাহোক, অচিরেই আবিষ্কার করলাম, সবচেয়ে কড়া তীক্ষ্ণ কাঁটাতেও আমার কোনো ক্ষতি হয় না, আমার শক্ত চামড়াটা বর্মের মতো আমায় রক্ষা করে। আগে ভয় হতো, দৈবাৎ বুঝি কোনো বিষাক্ত সাপের গায়ে পা দিয়ে বসব। এটা যখন প্রথম ঘটেছিল, সাপটা আমার পা জড়িয়ে কামড়াবার চেষ্টা করেছিল, তখন আমার বৃহৎ হস্তীহৃদয়ও ভয়ে হিম হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তক্ষুনি টের পেলাম সাপে আমার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। তারপর থেকে আমার পথ থেকে সরে যেতে দেরি করলে পায়ের তলে সাপ পিষে মারতে বেশ একটু মজাই লাগে আমার।

তাহলেও ভয় পাওয়ার মতো বস্তু ছিল বৈকি। রাতে ভয় হতো, বড় বড় হিংস্র জানোয়ার, সিংহ বা চিতা বাঘ আক্রমণ করবে। তাদের চেয়ে আমার গায়ের জোর বেশি, কিন্তু লড়াইয়ের কোনো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। তা ছাড়া যেসব সহজ প্রবৃত্তির দৌলতে হাতিরা লড়তে পারে, সেটাও আমার নেই। দিনের বেলায় ভয় পেতাম শিকারিদের, বিশেষ করে সাদা চামড়াদের। আহ্‌, এই সাদা চামড়ারা! সবকিছু, বুনো জানোয়ারের চেয়েও তারা বেশি ভয়াবহ। তাদের ফাঁদ, ফাঁস, হাতি ধরা গর্ত—এসবে আমার ভয় ছিল না। চেঁচামেচি করে আগুন জ্বালিয়ে ভয় পাইয়ে আমাকে খেদায় তাড়িয়ে ঢোকানোও সহজ নয়। আমার পক্ষে ভয় ছিল কেবল ক্যামোফ্লেজ করা গর্ত। তাই সব সময় খুব সতর্ক হয়ে পথ পরীক্ষা করে আমি এগোতাম।

বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরে থেকেই আমি গাঁয়ের গন্ধ পেতাম; সব রকম লোকালয় থেকেই বেশ শতহস্ত দূরে থাকার চেষ্টা করতাম আমি। আমার ঘ্রাণশক্তিতে বিভিন্ন দেশীয় উপজাতিদেরও পার্থক্য ধরতে পারতাম। তাদের কেউ কেউ আমার কাছে বেশি বিপজ্জনক, কেউ অত বিপজ্জনক নয়, কেউবা আবার মোটেই নয়।

একদিন শুঁড় বাড়িয়ে বাতাস শুঁকছি, হঠাৎ একটা নতুন গন্ধ পেলাম। বুঝতে পারলাম না গন্ধটা মানুষের নাকি বুনো জানোয়ারের। খুব সম্ভবত মানুষের। উৎসুক হয়ে উঠলাম। অন্তত জঙ্গলের সবকিছু সম্পর্কে—অভিজ্ঞ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছিলাম আমি। আমার পক্ষে বিপদের কারণ হতে পারে, এমন সবকিছু সম্পর্কেই খানিকটা জ্ঞান আমার থাকা দরকার। গন্ধটা অনুসরণ করে এগোতে লাগলাম আমি খুব সাবধানে। সময়টা তখন রাত। দেশীয়রা সাধারণত তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। যত এগিয়ে যেতে লাগলাম, গন্ধটা ততই জোরালো হয়ে উঠছিল। যাচ্ছিলাম যথাসম্ভব চুপি চুপি, সেই সঙ্গে সামনের পথে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিলাম।

সকাল নাগাদ পৌঁছালাম বনের একটা প্রান্তে। ঘন ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে সামনের ফাঁকা জায়গায় উঁকি দিয়ে দেখলাম। বনের মাথায় একটা পাণ্ডুর চাঁদ, তা থেকে ছাই রঙের জ্যোৎস্না এসে পড়েছে কতকগুলো নিচু ছুঁচলো মতো কুঁড়ের ওপর। মাঝারি লম্বা একটা লোক যদি বসে থাকে, তবেই এ ধরনের কুঁড়েতে তাকে ধরা সম্ভব। চারদিক চুপচাপ, একটা কুকুরও ডাকছে না। বাতাসের উল্টো দিক থেকে আমি এগোলাম। ঘরগুলো মনে হয় যেন ছেলেদের খেলাঘর, কারা থাকে এখানে, ভাবছিলাম মনে মনে।

হঠাৎ মানুষের মতো দেখতে একটা ছোট্ট প্রাণী মাটির একটা গর্ত থেকে বেরিয়ে এল। খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে সে শিস দিল মৃদু স্বরে। তার জবাবে গাছের ডাল থেকে লাফিয়ে নামল আর একটা লোক। কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে এল আরও দুজন। একটা বড় মতো প্রায় দেড় মিটার উঁচু একটা কুঁড়ের কাছে জড়ো হয়ে কী যেন একটা বৈঠক বসাল তারা। সূর্যের প্রথম কিরণ এসে পড়তেই আমি পিগমিগুলোকে দেখতে পেলাম। এই খুদে প্রাণীরাই পিগমি। টের পেলাম দুনিয়ার ক্ষুদ্রতম মানুষের এক গ্রামে এসে পড়েছি আমি। গায়ের চামড়া এদের হালকা বাদামি, চুল প্রায় লাল। বেশ সুঠাম সুগঠিত দেহ, কিন্তু লম্বায় আশি-নব্বই সেন্টিমিটারের বেশি নয়। এই ‘বালক’দের কারও কারও মুখে আবার ঘন কোঁকড়া দাড়ি। খুব তাড়াতাড়ি কিচমিচ করে কী যেন বলছে তারা।

দৃশ্যটা অতি চিত্তাকর্ষক; কিন্তু ভারী আতঙ্ক হলো আমার। এই খুদে বামনদের চেয়ে বরং অতিকায় দানবদের মুখে পড়তেও আমি রাজি। বলতে কি, সাদা চামড়াদের সঙ্গে সাক্ষাতেও আমার আপত্তি নেই। দেখতে অতি খুদে হলেও পিগমিরা হলো হাতির সবচেয়ে মারাত্মক শত্রু। হাতি হওয়ার আগেই সেটা আমি জানতাম। তির আর বল্লম ছোড়ায় এরা ওস্তাদ। তিরে বিষ মাখিয়ে রাখে, তার একটি খোঁচাতেই মারা পড়তে পারে হাতি। চুপি চুপি এগিয়ে আসে পেছন থেকে, হাতির পেছনকার পায়ে ফাঁস লাগায়, নয়তো ছড়ি দিয়ে তার গোড়ালির রগ কেটে ফেলে। গাঁয়ের চারপাশে ছড়িয়ে রাখে বিষাক্ত কাঁটা আর ডান্ডা...

ঝট করে ফিরেই ছুটতে লাগলাম আমি, চিতা বাঘের কাছ থেকে পালাবার সময় যত জোরে ছুটেছিলাম, তত জোরে। পেছনে চিৎকার, তারপর দ্রুত তাড়া করে আসা লোকজনের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। সমান পথ পেলে সহজেই তাদের পিছে ফেলে এগিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু বনের এ পথে অসংখ্য দুর্ভেদ্য প্রতিবন্ধক পাশ কাটিয়ে এগোতে হচ্ছিল আমায়। ওদিকে আমার পশ্চাদ্ধাবকেরা মর্কটের মতো ক্ষিপ্র, টিকটিকির মতো সচল, কুকুরের মতো অক্লান্ত। দ্রুত ছুটে আসতে লাগল তারা, কোনো বাধাই যেন তাদের কাছে বাধা নয়। ক্রমেই কাছিয়ে আসছিল তারা, কয়েকটা বল্লমও ছুড়ল; সৌভাগ্যক্রমে ঘন ঝোপঝাড়ের ফলে গায়ে লাগল না। ততক্ষণে হাঁপিয়ে উঠেছি আমি, ক্লান্তিতে ঢলে পড়ি আরকি। অথচ ওই খুদে মানুষেরা না থেমে, না হোঁচট খেয়ে সমানে পিছু ধাওয়া করে চলেছে।

তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই টের পেলাম হাতি হওয়া সহজ ব্যাপার নয়; হাতির মতো প্রকাণ্ড এক প্রাণীর সারা জীবনই হলো অস্তিত্বের জন্য এক নিয়ত সংগ্রাম, মুহূর্তের জন্যও তার বিরাম নেই। মনে হলো হাতি ১০০ বছর কি তারও বেশি বাঁচে—এ খুবই অসম্ভব। এত দুশ্চিন্তা নিয়ে মানুষের চেয়ে অনেক আগেই তাদের প্রাণ যাওয়ার কথা। কিন্তু আসল হাতি হয়তো আমার মতো এমন দুশ্চিন্তা করে না। আমার মস্তিষ্কটা মানুষের, তা খুবই স্নায়বিক, খুব সহজেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। আপনাকে সত্যি বলেছি, এ সময় মনে হতো, পেছনে অনবরত মৃত্যু তাড়া করে ফিরছে, এমন জীবনের চেয়ে বরং মৃত্যুই ভালো। হাল ছেড়ে দেব কি? দাঁড়িয়ে পড়ব—আমার দুপেয়ে শত্রুদের বিষাক্ত বল্লম আর তিরের সামনে বুক পেতে দেব?...হয়তো তা–ই করতাম, কিন্তু হঠাৎ আমার মনোভাব বদলে গেল। একদল হাতির কড়া গন্ধ পেয়ে গেলাম শুঁড়ে। হাতির দলের মধ্যে গিয়ে বেঁচে যাব হয়তো? ঘন জঙ্গল পাতলা হয়ে এসে ক্রমে তৃণভূমিতে মিলিয়ে যেতে লাগল। সেখানকার ছাড়া ছাড়া উঁচু গাছগুলোর কল্যাণে তখনো তিরের খোঁচা খাইনি।

ছুটতে লাগলাম আঁকাবাঁকা পথে। বনের মধ্যে পিগমিদের যে রকম সুবিধা হয়েছিল, এখানে তেমন হলো না। আমার পায়ে বেশ চওড়া একটা পথ হয়ে গেলেও সাভানাগাছ আর ঘাসের প্রবল ডাঁটায় ধাওয়া করা মুশকিল হচ্ছিল তাদের। হাতির গন্ধ আরও কড়া হয়ে উঠল, যদিও তখনো তাদের দেখতে পাচ্ছিলাম না।

পথে দেখলাম বড় বড় গর্ত, হাতি ধরা পড়ে আছে সেখানে। মনে হচ্ছিল মাটির ওপর থেবড়ে বসে আছে মুরগি। মাঝে মাঝে হাতির নাদি চোখে পড়ছিল। তারপর হঠাৎ এক ঝাড়গাছের কাছে পৌঁছাতেই দেখলাম একদল হাতি মাটিতে বসে জাবর কাটছে। কতকগুলো হাতি গাছের কাছে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে আর পাখার মতো করে শুঁড় দিয়ে দোলাচ্ছে গাছের বড় বড় ডাল। কানগুলো উঁচু হয়ে উঠেছে ছাতার মতো। কতকগুলো হাতি শান্তভাবে স্নান করছে নদীতে। আমি আসছিলাম বাতাসের উল্টো দিক থেকে, তাই আমার গন্ধ পায়নি ওরা। শোরগোল উঠল কেবল আমার পায়ের শব্দ শোনার পর। তখন একেবারে হুলস্থুল পড়ে গেল! নদীর তীরে দাপাদাপি করে পাগলার মতো ডাক ছাড়তে লাগল সবাই। পালের গোদা সবাইকে রক্ষা করার বদলে সবার আগে ছুটল নদীর দিকে। জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে গিয়ে উঠল অপর পাড়ে। মাদি হাতিগুলো বাচ্চাগুলোকে রক্ষা করার চেষ্টা করল, যদিও আয়তনে সে বাচ্চারা পূর্ণ বয়স্ক জানোয়ারের মতোই। পশ্চাৎভাগ রক্ষার দায় আবার পড়ল কেবল মাদি হাতিগুলোর ওপর। আমার হঠাৎ আগমনেই কি এমন ভয় পেয়ে গেল ওরা, নাকি আমি যে কারণে ছুটছি, তা ছাড়া অন্য কোনো একটা বিপদ দেখতে পেয়েছে তারা?

সর্বশক্তিতে আমি জলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। কাচ্চাবাচ্চা সমেত বেশ কয়েকটি মাদি হাতিকে পেছনে ফেলেই পার হয়ে গেলাম নদী। চেষ্টা ছিল সবচেয়ে এগিয়ে যাব, যাতে পেছনে হাতির দলটা থাকার ফলে পশ্চাদ্ধাবকদের হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়ে যেতে পারি। এটা অবশ্য আমার স্বার্থপরতা, কিন্তু দেখলাম, মাদি হাতিগুলো ছাড়া অন্য হাতিগুলোও ঠিক একই ব্যাপার করছিল। কানে এল পিগমিরা নদীর তীর পর্যন্ত ছুটে এসেছে। তাদের ক্যাঁচকেঁচে গলার সঙ্গে শোনা যাচ্ছিল হাতির ডাক। নিশ্চয় খুন–জখম হচ্ছিল সেখানে, কিন্তু পেছন ফিরে তাকাবার সাহস ছিল না আমার। খোলা মাঠের ওপর দিয়ে ছুটেই চললাম। খুদে মানবদের সঙ্গে অতিকায় প্রাণীদের এই নদীতীরের যুদ্ধটার শেষ কী হয়েছিল জানি না।

হাতিদের সঙ্গে মিলে দৌড়ালাম কয়েক ঘণ্টা। এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম যে ওদের সঙ্গে তাল রাখা দায় হয়েছিল। কিন্তু সংকল্প করেছিলাম, কিছুতেই পেছনে পড়ে থাকব না। হাতিরা যদি আমাকে তাদের দলে নেয়, তাহলে অনেকটা নিরাপদে থাকা যাবে। জায়গাটা তারা জানে, শত্রুদের তারা ভালো করে চেনে আমার চেয়ে।

চলবে...

* লসিয়াস প্রাচীন রোমের লেখক আপুলেইয়ের ব্যঙ্গকাহিনি ‘স্বর্ণ গর্দভ’-এর প্রধান চরিত্র।—সম্পাদক

হৈটি টৈটি - প্রথম পর্ব

হৈটি টৈটি - দ্বিতীয় পর্ব

হৈটি টৈটি - তৃতীয় পর্ব

হৈটি টৈটি - চতুর্থ পর্ব