ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ - ১

ব্যাপারটার সূচনা এক শনিবারের সন্ধ্যায়। আমার গাণিতিক সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করতে করতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। স্থানীয় সান্ধ্য পত্রিকাটায় চোখ বুলাতে গিয়ে শেষ পাতায় এই বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়ল:

 ক্রাফৎশ্‌তুদৎ কোম্পানি

হিসাব, বিশ্লেষণ ও সর্ববিধ পরিগণক কাজের জন্য

ব্যক্তিবিশেষ ও প্রতিষ্ঠানের নিকট হইতে

অর্ডার গ্রহণ করে।

উচ্চ শ্রেণির গ্যারান্টি যুক্ত কাজ। আবেদন করুন

১২ ভেলতস্ত্রাস্‌সে।

ঠিক এটাই আমার দরকার। একটা বিশেষ গঠনের বিষম মাধ্যমে বিদ্যুৎ-চুম্বক তরঙ্গের আচরণ সংক্রান্ত ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ নিয়ে আমি কয়েক সপ্তাহ ধরে মাথা ঘামাচ্ছিলাম। শেষ পর্যন্ত অনেকগুলো স্থূলায়ন ও সরলীকরণ করে হিসাবটাকে এমন এক আকারে দাঁড় করানো গেল, যা একটা বৈদ্যুতিক কম্পিউটারে কষা যায়। ভাবছিলাম রাজধানীতে গিয়ে হিসেবটা কষে দেওয়ার জন্য কম্পিউটারকেন্দ্রের কর্মকর্তাদের কাছে কাকুতি-মিনতি করতে হবে। হাতে পায়ে ধরারই ব্যাপার। কেননা কম্পিউটারকেন্দ্র সামরিক সমস্যা নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত, মফঃস্বল শহরের এক পদার্থবিদ রেডিও-তরঙ্গের গতি নিয়ে যেসব তাত্ত্বিক অনুশীলন করছে, তার দিকে কেউ নজরই দেবে না।

অথচ আমাদের এই ছোট শহরটার মধ্যেই দেখছি একটা কম্পিউটার কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, অর্ডারের জন্য বিজ্ঞাপন দিচ্ছে স্থানীয় কাগজে!

এ কোম্পানির সঙ্গে অবিলম্বে যোগাযোগ করার জন্য টেলিফোন তুলে নিলাম। তখন খেয়াল হলো বিজ্ঞাপনটায় ঠিকানা দেওয়া আছে, কিন্তু কোনো টেলিফোন নম্বর দেয়নি। গুরুগম্ভীর কম্পিউটারকেন্দ্র, অথচ টেলিফোন নেই! এ হতে পারে না। কাগজের সম্পাদকীয় বিভাগে ফোন করলাম।

সেক্রেটারি জবাব দিলেন, ‘মাপ করবেন, বিজ্ঞাপনের জন্য ওইটুকুই আমরা পেয়েছিলাম। কোনো টেলিফোন নম্বর দেওয়া ছিল না।’

টেলিফোন ডাইরেক্টরিতেও ক্রাফৎশ্‌তুদৎ কোম্পানির নাম নেই।

অধীর হয়ে সোমবারের জন্যে অপেক্ষা করতে হলো। জটিল পদার্থিক প্রক্রিয়া নিহিত রয়েছে এই যে সমীকরণগুলোর মধ্যে, তা থেকে চোখ ফেরালেই মনে হচ্ছিল ক্রাফৎশ্‌তুদৎ কোম্পানির কথা। ‘ভবিষ্যৎ দৃষ্টি আছে বটে। আমাদের এ কালে প্রতিটি ভাবনাকেই যখন এক একটা গাণিতিক রূপ নিতে হচ্ছে, তখন এর চেয়ে লাভজনক কারবার কল্পনা করা কঠিন।’

আরও পড়ুন
অপ্রীতিকর বিস্ময়েই লক্ষ করলাম ক্রাফৎশ্‌তুদৎ কোম্পানির অবস্থানটা জ্ঞানীগৃহেরই একাংশে। ‘সর্ববিধ গাণিতিক কাজের’ জন্য ক্রাফৎশ্‌তুদৎ কোম্পানি পাগলাদের লাগায়নি তো?

কিন্তু কে এই ক্রাফৎশ্‌তুদৎ? এ শহরে আমি অনেক দিন আছি, কিন্তু এ নাম প্রায় অজানা। অথচ কেমন যেন মনে হয়, কবে যেন এরকম নাম শুনেছি। কিন্তু কবে, কোথায়, কী উপলক্ষ্যে—কিছুই মনে পড়ল না।

অবশেষে সোমবার এলো। সমীকরণের কাগজপত্র পকেটে পুরে আমি বেরুলাম ১২ নং ভেলতস্ত্রাস্‌সের সন্ধানে। অল্প অল্প বৃষ্টি পড়ছিল। তাই ট্যাক্সি নিতে হলো।

‘বেশ দূর আছে,’ ড্রাইভার বলল, ‘নদী পেরিয়ে, মানসিক হাসপাতালের পাশে।’

আমি চুপ করে মাথা নাড়লাম।

যেতে লাগল প্রায় চল্লিশ মিনিট। শহরের ফটক পেরিয়ে নদীর ওপরকার ব্রিজ দিয়ে একটা হ্রদের পাশ দিয়ে পৌঁছলাম ফাঁকা মাঠের এলাকায়। কোথাও কোথাও নব বসন্তের সবুজ দেখা দিয়েছে। রাস্তাটা বাঁধানো নয়, প্রায়ই ঢিপির মধ্যে থামতে হচ্ছিল গাড়ি, কাদায় পিছলে যাচ্ছিল পেছনের চাকা।

শেষ পর্যন্ত ঘরবাড়ির চালা দেখা গেল, তারপর একটু নিচুতে মানসিক হাসপাতালের লাল ইটের দেয়াল। হাসপাতালটাকে লোকে ঠাট্টা করে বলে ‘জ্ঞানীগৃহ’।

লম্বা ইটের দেয়ালের ওপর ভাঙা কাচ গাঁথা। তারই গা বরাবর একটা খোয়া ঢালা রাস্তা। কয়েকবার মোড় নিয়ে গাড়ি থামল একটা অনতিবৃহৎ দরজার সামনে।

‘এইটে বারো নম্বর।’

অপ্রীতিকর বিস্ময়েই লক্ষ করলাম ক্রাফৎশ্‌তুদৎ কোম্পানির অবস্থানটা জ্ঞানীগৃহেরই একাংশে। ‘সর্ববিধ গাণিতিক কাজের’ জন্য ক্রাফৎশ্‌তুদৎ কোম্পানি পাগলাদের লাগায়নি তো? ভেবে হাসি পেল।

দরজার বেল টিপলাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো, মিনিট পাঁচেক! পরে দরজা খুলে দেখা দিল ফ্যাকাশে মতো একটা লোক, মাথায় একরাশ এলোমেলো চুল, দিনের আলোয় চোখ মিটমিট করছিল।

আমার দিকে চেয়ে বলল, ‘কী চাই বলুন?’

‘এইটাই ক্রাফৎশ্‌তুদৎ-এর গণনা কোম্পানি?’

‘হ্যাঁ।’

‘আপনারাই কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন...’

‘হ্যাঁ।’

‘আপনাদের কাছে আমার একটা অর্ডার দিতে চাই।’

‘বেশ তো, আসুন ভেতরে।’

ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বলে আমি মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকলাম। দরজা বন্ধ হতেই সূচীভেদ্য অন্ধকারে পড়ে গেলাম।

‘আমার পেছন পেছন আসুন। হুঁশিয়ার—এইখানে সিঁড়ি। এবার বাঁয়ে। ফের সিঁড়ি। এবার চলুন ওপরে...’

পথপ্রদর্শক লোকটি আমার হাত ধরে অন্ধকার বারান্দা বেয়ে কখনো নেমে, কখনো সিঁড়ি বেয়ে উঠে নিয়ে চলল আমাকে।

আরও পড়ুন

অবশেষে একটা আবছা হলদেটে আলো দেখা গেল মাথার ওপর। একটা খাড়াই পাথরের সিঁড়ি বেয়ে উঠে পৌঁছলাম একটা ছোট হলে।

যুবকটি তাড়াতাড়ি পার্টিশনের ওদিকে গিয়ে টিকিট ঘরের মতো একটা চওড়া জানলার ঢাকা খুলে বলল:

‘বলুন...’

কেমন মনে হচ্ছিল ভুল জায়গায় এসে পড়েছি। এই আধো অন্ধকার, এই মাটির তলার গোলকধাঁধা, শেষ পর্যন্ত জানলাহীন এই গহনকক্ষ, সিলিঙে একটা মিটমিটে বিদ্যুতের আলো—এর ফলে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল আমার।

হতভম্বের মতো তাকিয়ে দেখলাম চারিদিকে।

‘বলুন কী বলছিলেন,’ জানলা দিয়ে মাথা বের করে লোকটা বলল:

‘ও হ্যাঁ, মানে, ক্রাফৎশ্‌তুদৎ কোম্পানির পরিগণককেন্দ্র তাহলে এখানেই?’

‘হ্যাঁ এখানেই,’ একটু বিরক্ত হয়েই বলল লোকটা, ‘আপনাকে তো আগেই বলেছি। আপনার অর্ডারটা কী?’

পকেট থেকে সমীকরণের কাগজটা বের করে জানালা দিয়ে এগিয়ে দিলাম।

‘এটা হচ্ছে ওই সমীকরণগুলোর আংশিক ডেরিভেটিভের একটা রৈখিক স্থূলায়ন...’ অনিশ্চিতভাবে শুরু করলাম আমি, ‘অন্তত সংখ্যাগতভাবে তার সমাধান হলেও চলবে, মানে দুই মাধ্যমের ঠিক সীমারেখাটায়... বুঝতে পারছেন তো? এটা একটা ডিসপার্সন সমীকরণ, রেডিও তরঙ্গের বিস্তারের গতিবেগ এখানে প্রতি বিন্দুতে বদলে যাচ্ছে।’

কাগজটা আমার হাত থেকে ঝট করে টেনে নিয়ে লোকটা বলল:

‘বুঝতে পেরেছি। কবে চাই?’

‘কবে মানে?’ অবাক লাগল আমার, ‘সেটা আপনারা আমায় বলবেন, কবে পারবেন।’

‘কাল হলে চলবে?’ গভীর কালো চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল সে।

‘কাল?’

‘হ্যাঁ কাল, ধরুন বেলা বারোটা নাগাদ...’

‘সে কী! এ কী ধরনের পরিগণক যন্ত্র আপনাদের? আশ্চর্য স্পিড!’

‘তাহলে কাল বেলা বারোটায় আপনার সমাধান পাবেন। চার্জ চারশ মার্ক। নগদ।’

একটি কথা না বলে আমি আমার ভিজিটিং কার্ডের সঙ্গে টাকাটা এগিয়ে দিলাম। কার্ডে আমার নাম-ঠিকানা লেখা ছিল।

ভূগর্ভের গোলকধাঁধার মধ্য দিয়ে আমায় এগিয়ে দিতে দিতে লোকটা বলল:

‘তার মানে আপনিই প্রফেসর রাউখ?’

‘হ্যাঁ, কিন্তু কেন?’

‘এমনি। আমরা জানতাম, আজ হোক কাল হোক আপনি আমাদের কাছে আসবেন।’

‘কেমন করে জানতেন?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।

‘তা ছাড়া আর কে-ই বা আমাদের এখানে অর্ডার দিতে আসবে এই পাণ্ডববর্জিত শহরে।’

জবাবটা বেশ যুক্তিযুক্ত মনে হলো।

বিদায় জানাতে না জানাতেই বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

‘জ্ঞানীগৃহের’ পাশাপাশি এ রকম একটা অদ্ভুত পরিগণককেন্দ্র! সারা রাস্তা সেই কথাই ভাবলাম। কিন্তু ক্রাফৎশ্‌তুদৎ—কবে কোথায় শুনেছিলাম এ নামটা?

আরও পড়ুন
পাতার পর পাতায় যে হিসেব করা হয়েছে, তার মৌলিকতা ও চমৎকারিত্বে আমার প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। এ সমাধান যে কষেছে, তার অঙ্কের জ্ঞান অসাধারণ সর্বাগ্রগণ্য গণিতবিদরাও হিংসে করতে পারেন।

দুই

পরের দিন অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলাম দিনের ডাকের জন্যে। সাড়ে এগারোটায় ঘণ্টা বাজতেই লাফিয়ে উঠে ছুটে এগিয়ে গেলাম পিয়নের প্রত্যাশায়। তার বদলে অবাক হয়ে দেখলাম, একটি ফ্যাকাশে রোগা মেয়েকে, হাতে তার একটা মস্ত নীল খাম।

‘আপনিই কি প্রফেসর রাউখ?’ জিজ্ঞেস করল সে।

‘হ্যাঁ, আমিই।’

‘ক্রাফৎশ্‌তুদৎ কোম্পানি আপনাকে এই প্যাকেটটা পাঠিয়েছে। সই করে দিন।’

যে পিয়ন খাতাটা সে এগিয়ে ধরল, তার প্রথম পাতায় কেবল একটি নাম—সেটা আমার। সই করে একটা বখশিস দিতে গেলাম।

লাল হয়ে উঠে সে বলে উঠল, ‘না, না,’ তারপর অস্ফুট স্বরে বিদায় জানিয়ে চলে গেল।

ঘেঁসাঘেঁসি করে লেখা পান্ডুলিপির ফটোকপিগুলো দেখে হতভম্ব লাগল। ইলেকট্রনিক কম্পিউটার থেকে অন্য জিনিস আশা করেছিলাম আমি: লম্বা সারি ভরা সংখ্যা—তার এক সারিতে আর্গুমেন্টের ভ্যালু, অন্য সারিতে সমাধানের ভ্যালু।

তার বদলে যেটা পেলাম, সেটা আমার সমীকরণগুলোর একেবারে সঠিক ও নিখুঁত সমাধান!

পাতার পর পাতায় যে হিসেব করা হয়েছে, তার মৌলিকতা ও চমৎকারিত্বে আমার প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। এ সমাধান যে কষেছে, তার অঙ্কের জ্ঞান অসাধারণ সর্বাগ্রগণ্য গণিতবিদরাও হিংসে করতে পারেন। গণিতের প্রায় সব সাম্প্রতিক তত্ত্বই কাজে লাগানো হয়েছে; রৈখিক ও অরৈখিক অন্তরকলন ও সমাকলনের তত্ত্ব, জটিল পরিবর্তী বিদ্যুতের ফাঙ্কশন তত্ত্ব, গ্রুপ ও বহুলতার তত্ত্ব, এমনকি টপলজি, রাশিতত্ত্ব, গাণিতিক যুক্তি ইত্যাদি বাহ্যত অপ্রাসঙ্গিক বিদ্যার প্রয়োগও বাদ যায়নি।

হিসাবের শেষে অসংখ্য উপপাদ্য, অন্তর্বর্তী হিসাব, সূত্র ও সমীকরণের সংশ্লেষ করে যে চূড়ান্ত সমাধানটি দেওয়া হয়েছে, তা দেখে আমি আনন্দে অভিভূত হয়ে গেলাম। সে সমাধান হলো পুরো তিন লাইন জুড়ে একটি গাণিতিক সূত্র।

কিন্তু সবচেয়ে অপূর্ব, অজানা এই গণিতবিদ দীর্ঘ সূত্রটিকে সহজতর সূত্রে রূপান্তর করার কষ্টও স্বীকার করেছেন। এমন একটা সংক্ষিপ্ত ও নিখুঁত রূপের সন্নিকটে তাকে পরিবর্তিত করেছেন, যাতে কেবল প্রাথমিক বীজগণিত ও ত্রিকোণমিতি ছাড়া আর কিছুর প্রয়োজন হবে না।

সব শেষে একটা অনতিবৃহৎ গ্রাফ-কাগজের ওপর সমাধানের লৈখিক চিত্রও দেওয়া আছে।

একেবারে আশাতীত ব্যাপার। যে সমীকরণটা চূড়ান্ত রূপে কখনো সামাধান করা যাবে না বলে ভেবেছিলাম, তার সমাধান করা হয়েছে।

আরও পড়ুন
পরদিন একটু শান্ত হয়ে আমি পুরো সমাধানটা আর একবার পড়ে দেখলাম—এবার পড়লাম কেবল পড়ার আনন্দেই, লোকে যেমন ভালো সঙ্গীত বার বার শুনতে চায়।

আমার প্রাথমিক বিস্ময় ও অভিভূতি কিছুটা কাটলে ফের ফটোকপিগুলো দেখতে লাগলাম। লক্ষ্য করলাম, যে অঙ্কটা কষেছে, তার হাতের লেখাটা খুব তাড়াতাড়ি আর ঘেঁসাঘেঁসি—যেন কাগজের প্রতিটি টুকুরো, সময়ের প্রতিটি সেকেন্ড সে বাঁচাতে চায়। সব মিলিয়ে সে লিখেছে ২৮ পাতা। এটা যে কী বিপুল পরিশ্রমের কাজ, সেটা কল্পনা করলাম মনে মনে। একদিনে ঘেঁসাঘেঁসি করে লেখা ২৮ পাতার একটা চিঠি লেখার কথা একবার কল্পনা করে দেখুন। তাও নয়—কিছু না ভেবেচিন্তে একটা বই থেকে নকল করুন তো আটাশ পাতা। দেখবেন কী ভুতুড়ে মেহনত।

অথচ আমার সামনে যে জিনিসটা রয়েছে, সেটা বন্ধুর কাছে লেখা চিঠিও নয়, বই থেকে নকল করা একটা উপন্যাসও নয়। এ হলো অতি জটিল একটা গাণিতিক সমস্যার সমাধান এবং তা করা হয়েছে চব্বিশ ঘণ্টায়!

ঘেঁসাঘেঁসি লেখা পাতাগুলো চোখ বড় বড় করে খুঁটিয়ে দেখলাম কয়েক ঘণ্টা ধরে। কেবলই বিস্ময় বাড়তে লাগল আমার।

এমন এক গণিতবিদকে ক্রাফৎশ্‌তুদৎ পেল কোথা থেকে? কোন শর্তে সে কাজ করে? কে সে লোক? অজানা একজন প্রতিভা? নাকি স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিকের সীমারেখায় যা মাঝেমধ্যে দেখা দেয়, মানব প্রকৃতির তেমন এক বিস্ময়? ‘জ্ঞানীগৃহ’ থেকে কোনো একটা অদ্বিতীয় মস্তিষ্ক খুঁজে বের করেছে কি ক্রাফৎশ্‌তুদৎ?

চমৎকার গণিতবিদ শেষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছেন উন্মাদ হাসপাতালে, এরকম ঘটনা তো কম নেই। আমাদের এই গণিতজ্ঞটিও হয়তো তাদেরই একজন?

সারা দিন এই প্রশ্নগুলোই আমায় অস্থির করতে লাগল।

কিন্তু একটা জিনিস পরিষ্কার। অঙ্কটা যন্ত্রে কষা হয়নি, অঙ্ক কষেছে মানুষ, গণিতের এক যাদুকর, যার কথা পৃথিবী এখনো জানে না।

পরদিন একটু শান্ত হয়ে আমি পুরো সমাধানটা আর একবার পড়ে দেখলাম—এবার পড়লাম কেবল পড়ার আনন্দেই, লোকে যেমন ভালো সঙ্গীত বার বার শুনতে চায়। সমাধানটা এত সঠিক, এত নিখুঁত, এত চমৎকার স্বচ্ছ যে ঠিক করলাম...আর একবার পরীক্ষা করে দেখব। সমাধানের জন্য আরও একটা সমস্যা দেব ক্রাফৎশ্‌তুদৎ কোম্পানিকে।

তার কোনো অসুবিধা ছিল না। তেমন সমস্যার কমতি ছিল না আমার। এমন একটা সমীকরণ বাছলাম, যা চূড়ান্তরূপে সমাধান করা তো দূরের কথা, কম্পিউটার যন্ত্রে ফেলার মতো আকারে ভেঙে নেওয়াও সম্ভব বলে ভাবিনি।

এটাও রেডিও তরঙ্গের বিস্তার নিয়ে, কিন্তু খুবই জটিল ও বিশেষ ধরনের একটা পরিস্থিতিতে। এটা সেই ধরনের একটা সমীকরণ, যা তাত্ত্বিক পদার্থবিদরা নেহাৎ মাথা থেকে বের করেন ও অচিরেই তা ভুলে যান। কারণ, অতি জটিল বলে তা কারো কাজে লাগবে না।

দিনের আলোয় চোখ মিটমিট করা সেই যুবকটির সঙ্গেই দেখা হলো। একটা অনিচ্ছুক হাসি দেখা গেল তার মুখে।

বললাম, ‘আর একটা সমস্যা এনেছি আমি...’

সংক্ষেপে মাথা নেড়ে সে আমায় ফের সেই অন্ধকার বারান্দার গলি-ঘুঁজি দিয়ে নিয়ে এলো সদর ঘরে।

পদ্ধতিটা এবার আমার জানা ছিল। তাই জানালার কাছে গিয়ে অঙ্কটা এগিয়ে দিলাম।

‘এ সব কাজ তাহলে এখানে যন্ত্র দিয়ে করা হয় না?’

‘দেখতেই পাচ্ছেন,’ আমার সমীকরণটা থেকে চোখ না তুলেই সে বলল।

‘আমার প্রথম সমীকরণটা যে কষেছে, সে খুবই গুণী গণিতজ্ঞ,’ আমি বললাম।

কোনো জবাব দিল না লোকটা, আমার সমীকরণটায় মগ্ন হয়ে ছিল সে। ‘কেবল কি ওই একজন লোকই আপনাদের আছে, নাকি একাধিক?’ ‘আপনার যা দরকার তার সঙ্গে এর সম্বন্ধ কী? কোম্পানি গ্যারান্টি দিচ্ছে যে...’

কথাটা শেষ করতে পারল না সে, ঘরের গভীর নীরবতা ছিঁড়ে গেল একটা অমানুষিক আর্তনাদে। চমকে উঠে কান পাতলাম আমি। শব্দটা আসছিল কাচের পার্টিশনের ওপাশের দেয়ালের ভেতর থেকে। মনে হচ্ছিল যেন কারো ওপর অবর্ণনীয় দৈহিক নির্যাতন চলছে। আমার অঙ্কটার কাগজপত্র মুঠো করে লোকটা চকিতে একবার পাশে চেয়ে আমায় টানতে টানতে নিয়ে গেল বাইরে যাবার দরজায়।

হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, ‘ওটা কী ব্যাপার?’

জবাব না দিয়ে সে বলল, ‘উত্তরটা পাবেন পরশু বারোটায়। টাকাটা দিয়ে দেবেন বেয়ারাকে।’

এই বলে ট্যাক্সির কাছে আমায় ফেলে রেখে সে চলে গেল।

(চলবে…)

* সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত গল্প সংকলন গ্রহান্তরের আগুন্তুক বই থেকে নেওয়া।

মূল: আনাতলি দনে্‌প্রভ

অনুবাদ: ননী ভৌমিক