প্রফেসর বার্ণের নিদ্রাভঙ্গ - ১

১৯৫২ সালে যখন বিশ শতকের বৃহত্তম নির্বুদ্ধিতা ‘ঠান্ডা লড়াইয়ে’ গোটা দুনিয়া শ্বাসরুদ্ধ তখন প্রফেসর বার্ণ বিপুল এক শ্রোতৃমণ্ডলীর সামনে আইনস্টাইনের এই বিষন্ন শ্লেষোক্তির পুনরুক্তি করেন, ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি লড়া হয় পরমাণু বোমা নিয়ে, তাহলে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ লড়তে হবে লাঠি দিয়ে...’

প্রফেসর বার্ণ ‘বিশ শতকের সবচেয়ে বিশ্বজনীন বৈজ্ঞানিক’ বলে পরিচিত। তাঁর মুখ থেকে এ কথা বের হওয়ায় যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, সেটা একটা সাধারণ বক্রোক্তির চেয়ে অনেক বেশি। চিঠির বন্যা আসতে শুরু করল, কিন্তু বার্ণ তার জবাব দিতে পারেননি। ওই বছরেরই শরৎকালে, মধ্য এশিয়ায় দ্বিতীয় ভূপদার্থ অভিযানে মৃত্যু হয় তাঁর।

এই ছোট অভিযানটায় তাঁর একমাত্র সঙ্গী ছিলেন ইঞ্জিনিয়র নিমায়ের। তিনি পরে বলেন:

‘হেলিকপ্টর যোগে আমাদের ঘাঁটি আমরা গোবি মরুভূমির আরও ভেতরের দিকে সরিয়ে নিয়ে যাই। যন্ত্রপাতি এবং ভূকম্পন গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক ইত্যাদি চাপানো পর প্রথম ক্ষেপেই যাত্রা করেন প্রফেসর। বাকি সাজসরঞ্জামের জন্যে আমি পেছনে থেকে যাই। হেলিকপ্টর স্টার্ট নেওয়ার পর ইঞ্জিনে কিছু একটা গোলমাল হয়। ইঞ্জিন মিসফায়ার করতে শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত একেবারেই থেমে যায়। হেলিকপ্টরে তখনো স্পিড ওঠেনি। তাই শতখানেক মিটার ওপর থেকে একেবারে খাড়া পড়তে থাকে। মাটিতে ধাক্কা লাগার সঙ্গে সঙ্গে দুটো প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হয়। এত খাড়াভাবে হেলিকপ্টর পড়ে যে হঠাৎ ধাক্কায় কিসেলগুর অর্থাৎ ডিনামাইট জ্বলে উঠে থাকবে। প্রফেসর বার্ণ, হেলিকপ্টর এবং তার সবকিছু, সাজসরঞ্জাম আক্ষরিক অর্থেই ধুলোয় মিশে যায়...’

বালিয়াড়ির সেই একই নিশ্চল তরঙ্গ যাতে বোঝা যায় শেষবার ঝড়টা বয়ে গেছে কোন দিক দিয়ে; দাঁতে পায়ে সেই একই ধূসর সোনালি বালির কিচকিচ; সেই একই সূর্য—দিনের বেলায় চোখ ধাঁধানো সাদা, সন্ধ্যা নাগাদ টকটকে লাল, প্রতিদিন আকাশে প্রায় খাড়া একটা অর্ধবৃত্ত রচনা করে তাঁর যাত্রা।

যত সাংবাদিক নিমায়েরকে ঘিরে ধরেছে তাদের সবার কাছেই নিমায়ের কেবল এই কথারই পুনরাবৃত্তি করে গেছেন, একটা কিছুও নতুন যোগ করেননি, একটা কথাও বাদ দেননি। বিবরণটা বিশেষজ্ঞদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছিল। বাস্তবেই পর্বতের ওপরে, মরুভূমির তপ্ত লঘু বাতাস বোঝাই একটা হেলিকপ্টর অতি দ্রুত পড়তে থাকবে এবং মাটিতে ধাক্কা লাগলে তার প্রতিক্রিয়া ওই রকম মারাত্মক হওয়ারই সম্ভাবনা। অকুস্থলে তদন্তের জন্য যে কমিশন গিয়েছিল তারাও এই অনুমানেরই সমর্থন করেন। একমাত্র নিমায়েরই জানতেন যে ঘটনাটা তা নয়। কিন্তু মৃত্যু শয্যাতেও তিনি প্রফেসর বার্ণের গুপ্তরহস্য ফাঁস করেননি।

গোবি মরুভূমির যে জায়গাটাতে বার্ণের অভিযান পৌঁছেছিল, সেটা পরিপার্শ্ব থেকে মোটেই কিছু তফাৎ নয়। বালিয়াড়ির সেই একই নিশ্চল তরঙ্গ যাতে বোঝা যায় শেষবার ঝড়টা বয়ে গেছে কোন দিক দিয়ে; দাঁতে পায়ে সেই একই ধূসর সোনালি বালির কিচকিচ; সেই একই সূর্য—দিনের বেলায় চোখ ধাঁধানো সাদা, সন্ধ্যা নাগাদ টকটকে লাল, প্রতিদিন আকাশে প্রায় খাড়া একটা অর্ধবৃত্ত রচনা করে তাঁর যাত্রা। একটা গাছ নেই, পাখি নেই, মেঘের একটু আঁচড়ও নেই, বালির মধ্যে নুড়ি পর্যন্ত চোখে পড়বে না।

লক্ষ্যস্থলে পৌঁছিয়ে যখন আগের অভিযানে পাতা সুরঙ্গটা পাওয়া গেল তখন প্রফেসর বার্ণ তাঁর নোটবইয়ের একটা পাতা পুড়িয়ে দেন, তাতে লেখা ছিল এই জায়গাটার সঠিক অবস্থানের তথ্য। পরিপার্শ্ব থেকে এই জায়গাটার তফাৎ তখন শুধু এইটুকু যে সেখানে বার্ণ ও নিমায়ের রয়েছেন। তাঁবুর বাইরে ইজি চেয়ারে বসে ছিলেন তাঁরা। অদূরে হেলিকপ্টরের রূপোলি গাঁ আর প্রপেলারের পাখনা ঝকঝক করছে রোদে, মনে হবে যেন একটা অতিকায় ফড়িং এসে বসেছে মরুভূমির বালিতে। সূর্যের শেষ কিরণ তখন প্রায় সমান্তরাল হয়ে এসেছে আর তাঁবু থেকে ও হেলিকপ্টর থেকে অদ্ভুত লম্বা লম্বা ছায়া এগিয়ে গেছে বালির পাহাড়গুলোর ওপর দিয়ে।

শতাব্দীতে বছর দশেক বেঁচে ফের শরীর জমিয়ে রাখা যাবে ভবিষ্যৎ শুভদিনের জন্যে...কী জন্যে জানি না। আরও হাজার খানেক বছর বাঁচার কোনো ইচ্ছে চিকিৎসকটির ছিল না। ষাটের কোলেই স্বাভাবিক মৃত্যু হয় তাঁর।

প্রফেসর বার্ণ বলছিলেন, ‘মধ্য যুগের একজন চিকিৎসক অনন্তকাল বেঁচে থাকার একটা সহজ উপায় বলে গিয়েছিলেন। নিজের দেহটাকে জমিয়ে ভূগর্ভের কোনো প্রকোষ্ঠে ওই অবস্থায় নব্বই বা একশ বছর কাটাতে হবে। তারপর গরম হয়ে ফের বেঁচে উঠবে। শতাব্দীতে বছর দশেক বেঁচে ফের শরীর জমিয়ে রাখা যাবে ভবিষ্যৎ শুভদিনের জন্যে...কী জন্যে জানি না। আরও হাজার খানেক বছর বাঁচার কোনো ইচ্ছে চিকিৎসকটির ছিল না। ষাটের কোলেই স্বাভাবিক মৃত্যু হয় তাঁর।’

বার্ণের মটকানো চোখে একটা সহাস্য ঝিলিক দেখা গেল। সিগারেট হোল্ডার পরিষ্কার করে আরেকটা সিগারেট ধরালেন তিনি।

মূল: ভ্‌লদিমির সাভ্‌চেঙ্কো

অনুবাদ: ননী ভৌমিক

 

* সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘প্রগতি প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত গল্প সংকলন ‘গ্রহান্তরের আগুন্তুক’ থেকে নেওয়া।

আরও পড়ুন