ভিনগ্রহের ক্রিকেটার – শেষ পর্ব

আন্তঃস্কুল ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হবে। স্কুল টিম নির্বাচন হচ্ছে। ড্রিল স্যার বললেন, ২০ জনকে ডাকলেই চলবে। আমি তো জানিই কে কেমন খেলে । শুধু একটু চিন্তা মিজানকে নিয়ে । ডান হাতে চোট খেল । 

২০ জনের দলে মিজান থাকল। আবীর সোহান কৌশিক মিনহাজও আছে । মাঠে খানিকটা প্রাকটিস করে স্যার চূড়ান্ত টিম গঠন করে ফেললেন। মিজানকে বললেন অধিনায়ক হবার কথা। মিজান রাজি হলো না। খেলা হলো তাদের স্কুলের মাঠে । জেলা পর্যায়ের খেলা। মিজানদের স্কুল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ফাইনালে উঠল। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দয়ারাম দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়। বলা বাহুল্য, এর আগের ম্যাচগুলোয় মিজান ম্যান অফ দি ম্যাচ হয়েছে। সারা শহরের লোক অবাক হয়ে দেখল, শুধু ব্যাটিং নয়, শুধু বোলিং নয়, ফিল্ডিং-এ পর্যন্ত মিজানের পারফর্মেন্স প্রায় আন্তর্জাতিক মানের । 

ফিল্ডিঙের সময় সে যে পজিশনেই দাঁড়াক না কেন, তার আশপাশ দিয়ে কোনো বল যাওয়ার উপায় নেই। সে ক্যাচ হোক আর নাই হোক, বল দেখলেই মিজান ঝাঁপিয়ে পড়ে, কিংবা উড়ে যায়। একমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকার জন্টি রোডস এত ভালো ফিল্ডিং করে, আর কারো সঙ্গেই মিজানের তুলনা চলে না । 

আস্তে আস্তে সে হয়ে গেছে স্কুল টিমের ওপেনার ব্যাটসম্যান। আবার ওপেনার বোলার। ব্যাট হাতে এক খেলায় সে তো ডাবল সেঞ্চুরি পর্যন্ত করে ফেলেছে। 

এরপর এল ফাইনাল খেলার দিন। স্কুলমাঠে খেলা। খেলার জন্যে আজকে সব ছাত্রকে বাধ্যতামূলকভাবে মাঠে আনা হয়েছে। শিক্ষকরাও এসেছেন। স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক আর জাতীয় পত্রিকার ফটোগ্রাফার এসেছেন ক্যামেরা নিয়ে । এককোণে সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে আর তাতে একটা মাইক লাগিয়ে খেলার ধারাবিবরণী দেওয়া হচ্ছে। 

স্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্র আব্দুল হামিদ নামের অধিকার বলে ধারাভাষ্য দিচ্ছে। চমৎকার রৌদ্রালোকিত আকাশ, ঝকঝকে মাঠ। প্রথমে টস। হ্যাঁ টসে জিতেছে অধিনায়ক কৌশিক। সরকারি স্কুল টসে জিতেছে। মাইকে এ ভাষ্য বলার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল মাঠের ক্ষুদে দর্শকরা। সঙ্গে সঙ্গে দয়ারাম স্কুলের ছেলেরা দুয়ো ধ্বনি দিতে লাগল: হু হা, হু হা, গু খা গু খা । 

সরকারি স্কুল ব্যাট নিয়েছে প্রথমে। ওপেন করা নিয়ে সন্দেহ কী। ব্যাট করবে মিজান। সে ব্যাট হাতে নামল । তার সঙ্গে ব্যাটিঙে নামল মিনহাজ । প্রথম বল করতে বোলার দৌড় ধরেছে। মিজান নির্ভয়ে ব্যাট হাঁকাল। ক্যাচ উঠল। ফিল্ডার ক্যাচ ধরে ফেলল। কিন্তু আম্পায়ার নো না হেঁকে আউট ঘোষণা করে ফেলল। মাইকে আব্দুল হামিদ বলে ফেলল, আমরা দেখলাম নিশ্চিত নো বল, কিন্তু আম্পায়ার আউট দিয়ে দিয়েছেন।

মাঠে মারামারি হবার উপক্রম। খেলাই বুঝি পণ্ড হয়ে যায়। মিজান মাথা নিচু করে মাঠের বাইরে এল। এবং কৌশিক আর ড্রিল স্যারকে বলল, খেলা চালিয়ে যান। বল করার সময় দেখিয়ে দেব। খেলা প্রায় আধঘণ্টা বন্ধ থাকার পর আবার শুরু হলো জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার অনুরোধে। 

৫৪ রান করে অল আউট হয়ে গেল সরকারি স্কুল। ছেলেদের মাথা নিচু হয়ে গেছে। তারা স্তব্ধ । আবদুল হামিদ ধারাভাষ্য দেওয়া বন্ধ রেখেছে। তারপর এল দয়ারামের ব্যাটিঙের পালা।

বল নিয়ে নেমে মিজান প্রথম ওভারে আউট করল দুজনকে। ০ রান। নিজের দ্বিতীয় ওভারে ২ রান দিয়ে নিল ৩ উইকেট। তারপরের ওভারে এক উইকেটের বিনিময়ে দিল ২ রান। এভাবে নিয়মিত উইকেট পড়ছে। মিজানের ওভারের গ্যাপে যারা বল করতে আসে, তাদের ওপর চড়াও হওয়ার চেষ্টা করে দয়ারাম স্কুলের ছেলেরা। কিন্তু ফায়দা তুলতে পারে না। মোট রান হলো ৩৫। উইকেট ৭টি। নিজের চতুর্থ ওভারে এসে প্রথম তিন বলে ৩ উইকেট নিয়ে হ্যাট্রিক করলো মিজান। খেলা শেষ। ৩৫ রানে দয়ারাম স্কুল অল আউট।

আহ। এত আনন্দ আর কোনোদিনও লাভ করেনি সরকারি স্কুলের ছাত্র-শিক্ষকেরা। পুরো স্কুল যেন খুশিতে নাচছে। হেড স্যার পর্যন্ত মিছিলে এসে নাচানাচি করতে লাগলেন। খেলা দেখতে এসেছিলেন এডিসি জেনারেলের স্ত্রী আর মেয়ে আনিকা। তারা বলল, আমরা মিজানের সঙ্গে ছবি তুলব। মিজানকে মধ্যে রেখে একপাশে দাঁড়াল মিসেস এডিসি, আরেক পাশে আনিকা।

মিজান খুব লজ্জা পাচ্ছে আনিকার পাশে দাঁড়াতে। সেরা খেলোয়াড়ের ট্রফি পেল সে। ম্যান অফ দি টুর্নামেন্ট হলো। স্থানীয় ব্যবসায়ী ফয়েজ চৌধুরী মিজানের নামে ১ লাখ হাজার টাকার পুরস্কার ঘোষণা করলেন। একেবারে হৈহৈ কাণ্ড রই রই ব্যাপার । 

সব হৈ হল্লা শেষ করে যখন মিজান তার রুমে এল, তখন বারান্দায় পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। হেড স্যার আসছেন সিরাজ স্যারকে সঙ্গে নিয়ে। মিজান উঠে দাঁড়াল। হেড স্যার তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, মিজান, তোমার হোস্টেলের খরচ এখন থেকে আমি দেব। এই নিয়ে তুমি কোনো চিন্তা করবে না। হেড স্যার তাকে বুক থেকে ছাড়ছেন না। আরে কী মুশকিল । সে তো দম বন্ধ হয়ে মরেই যাবে । 

এবার খেলা পড়েছে ঢাকায়। পুরো টিম যাবে প্লেনে। এয়ারপোর্ট থেকে ডমেস্টিক এয়ার লাইন্সের একটা ফ্লাইটে। টিকেটের দাম দান করেছে স্থানীয় একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ছেলেরা এই নিয়ে বেশ উত্তেজিত। বিমানে চড়া হবে। এর আগে কেউই বিমানে চড়েনি৷

খেলার দিন ভোরবেলা ফ্লাইট। তার আগে টিকেট পাওয়া গেল না। আগে দিন বাসে যাওয়া যায়, কিন্তু তাতে ক্লান্তি আসবে বেশি। বরং ৬টার প্লেনে গিয়ে ৭ টার মধ্যে ঢাকা পৌঁছলে ৯ টায় মাঠে নামা কঠিন হবে না। ডিসি সাহেব ফোন করে নিশ্চিত হলেন বিমানের ফ্লাইট ঠিক সময়ে ছাড়ছে।

যাত্রীরা সবাই এ ওর মুখে, ও এর মুখে তাকায়। আবার সব যাত্রীকে নামানো হলো। আবার চেক করা হবে। মিজান প্রমাদ গুনল। সঙ্গে যাচ্ছেন ড্রিল স্যার।

সবাই সোয়া ৫ টার মধ্যে হাজির এয়ারপোর্টে। চেক ইন হলো। এবার তারা ঢুকে পড়বে ডিপার্চার লাউঞ্জে। সেখানে সবাইকে মেটাল ডিটেক্টর পার হতে হয়। কারো কাছে কোনো ধাতব জিনিস থাকলে সে আটকে যায় । 

সবাই সেই মেটাল ডিটেক্টর পার হলো সহজেই। মুশকিল হলো মিজানের বেলায়। সে যতবার যায়, ততবার মেটাল ডিটেক্টর গর্জে ওঠে টু টু শব্দে। নিরাপত্তারক্ষীরা বলল, পকেটে কিছু আছে নাকি? নেইল কাটার? চাবির রিং। যা ছিল সবই বের করে দিল মিজান। তবুও সে মেটাল ডিটেক্টর পার হতে পারছে না।

শেষে একজন জিজ্ঞেস করল, কোনো একসিডেন্ট হয়েছিল নাকি? হাত-পা ভাঙলে অনেক সময় হাড়ে লোহা লাগিয়ে দেয়। মিজান বলল, হ্যাঁ। তার পায়ে লোহা আছে। একবার পা ভেঙে গিয়েছিল। বিমানবন্দরের কর্মীরা তাকে প্রায় উলঙ্গ করে সার্চ করল, কিছুই পেল না । তারপর তাকে বিমানে আরোহন করার অনুমতি দিল । 

এই ঘটনার সময়ই ছেলেদের মধ্যে গুঞ্জন দেখা দিল, আসলে মিজান কে! কী তার প্রকৃত পরিচয়। মুশকিল আবারও দেখা দিল। বিমানে সবাই উঠেছে। সিটে বসেছে। সিট বেল্ট বাঁধার কায়দা বিমানবালা দেখিয়ে দিয়েছেন। সবাই বেল্ট বেঁধে নিয়েছে। পাইলট বিমান স্টার্ট দিলেন। তারপর তার কম্পিউটারে ইন্টারফেয়ারেন্সের সংকেত আসতে লাগল। কম্পিউটার বলছে, বিমানে কোনো শক্তিশালী ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র আছে, যার প্রভাবে বিমানবন্দরের রাডারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। যাত্রীদের মোবাইল, ল্যাপটপ সব বন্ধ রাখা আছে কি না, আবার চেক করা হলো। 

নাহ! পাইলট ঘামতে লাগলেন। তারপর তার মাইকে বললেন, বিমানে কি কেউ মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ বা অন্যকোনো ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস নিয়ে উঠেছেন? ইন্টারফেয়ারেন্স হচ্ছে। এ অবস্থায় বিমান চলবে না । 

যাত্রীরা সবাই এ ওর মুখে, ও এর মুখে তাকায়। আবার সব যাত্রীকে নামানো হলো। আবার চেক করা হবে। মিজান প্রমাদ গুনল। সঙ্গে যাচ্ছেন ড্রিল স্যার। সে বলল, স্যার আমি তো আমার ব্যাটটা ছেড়ে এসেছি। আমি আমার ওই ব্যাট ছাড়া খেলতে পারি না। আপনারা যান, আমি পরের ফ্লাইটে আসছি। 

কী বলছিস তুই? আর কোনো ফ্লাইট আছে?

আছে। জিএমজির ফ্লাইট আছে ৭টা ৩০-এ । 

টিকেট আছে?

আছে। আমি অলরেডি বুক করেছি। 

টাকা পাবি কোথায়?

ওই যে ১ লাখ টাকা পুরস্কার পেলাম । 

ওদিকে বিমান ছেড়ে দিচ্ছে। ড্রিল স্যার বিমানে উঠে পড়লেন। মিজান বিমানবন্দর ত্যাগ করল । 

ছেলেদের সবার মন খারাপ। মিজানকে ছাড়া তারা খেলতে যাবে, এটা কি হয়? ঢাকায় পৌঁছে হোটেলে গিয়ে সবাই হাতমুখ ধুয়ে নিয়ে নাশতা করল। তারপর বাসে উঠে চলল কলাবাগান মাঠে, খেলতে । 

মাঠে পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে আটটা বেজে গেল। ৯ টায় ম্যাচ শুরু হবে। সবার মুখ কালো। তাদের অধিনায়কই যদি অনুপস্থিত, তাহলে তারা খেলবে কীভাবে?

৯ টা বাজার ৫ মিনিট আগে কৌশিক ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক হিসেবে টস করার জন্যে মাঠে নামছে। ঠিক এমন সময় দেখা গেল দৌড়ে আসছে মিজান। স্যার স্যার আমি এসেছি। ড্রিল স্যার তাকে জড়িয়ে ধরলেন। সবাই আনন্দে কেঁদে ফেলল । মিজান দৌড়ে কাপড়চোপড় পাল্টে নিয়ে নেমে পড়ল মাঠে। বলা বাহুল্য, খেলায় মিজানরা জয়লাভ করল। তারা জিতল ১০ উইকেটে। পরদিন সব কাগজে মিজানের বড় বড় ছবি ছাপা হলো । সে যে বাংলাদেশের ওয়ান্ডার বয়, এ কথাও লিখতে ভুলল না কাগজওয়ালারা। 

কিন্তু ওই সন্ধ্যায় একজন সাংবাদিক তার রুমে এসে তার সাক্ষাৎকার নেবার ছলে একটা মারাত্মক প্রশ্ন করে বসল। আচ্ছা মিজান, তুমি তো আজ সকালে জিএমজির ফ্লাইটে এসেছ, না?

হ্যাঁ।

জিএমজির ফ্লাইটে তো আমিও এসেছি। কই তোমাকে তো দেখলাম না ।

আপনি হয়তো অন্য পাশে বসেছিলেন। 

সাংবাদিক চলে গেল। কিন্তু সে ছাড়বার পাত্র না। সে জিএমজির যাত্রীতালিকা বের করে দেখল, মিজান নামে কেউ ফ্লাইটে ছিল কি না। না, ছিল না।

পরের দিন সে আবার এল মিজানের রুমে। বলল, মিজান, তোমার নাম যাত্রী তালিকায় নাই। বলো, তুমি কে? কী তোমার পরিচয়?

হোটেলের দরজায় গোয়েন্দা নিরাপত্তা কর্মীরা অনেক ধাক্কাধাক্কি করল। কিন্তু দরজা খুলল না। শেষে দরজা ভেঙে ফেলা হলো। ভেতরে গিয়ে দেখা গেল কেউ নেই৷

মিজান বলল, আমি মিজানুর রহমান। আমার বাবার নাম মশিউর রহমান। বাড়ি খলিফাপাড়া। সবাই জানে। এটা কোনো প্রশ্ন হলো।

না। সাংবাদিক ছাড়ল না তার পিছু। সে চলে গেল তার বাবার কাছে। জিজ্ঞেস করল, বলুন, এই ছেলেকে আপনি কোথায় পেয়েছেন।

বাবা স্বীকার করলেন, ছেলেকে তারা জন্ম দেননি। পালিত ছেলে। ছোটবেলা থেকে মানুষ করেছেন। তবে অস্বাভাবিক কিছু তার চোখে পড়েনি।

কদিন পরে সংবাদপত্রে বড় বড় অক্ষরে ছাপা হলো, কে এই মিজান? কী তার পরিচয়? কীভাবে সে ঢাকায় এল মাত্র এক ঘণ্টায়?

ড্রিল স্যার কাগজ নিয়ে মিজানের রুমে এলেন। দেখ কী ছাপা হয়েছে! এই জন্যে তো বাঙালির উন্নতি নাই। একজন উঠতে ধরলে আরেকজন টেনে নিচে নামায়৷

খানিকক্ষণ পরে তার রুমের সামনে তার বন্ধুরা ভিড় করে ফেলল । মিনহাজ, কৌশিক, সোহান, আবীর সবাই রেগে টং। কাল তাদের সেমিফাইনাল খেলা। এর আগে এ রকম খবর তাদেরকে হারানোর চক্রান্ত।

আর হোটেলের লবিতে হলো প্রচণ্ড ভিড়। বিভিন্ন টেলিভিশনের ক্যামেরা এসে গেছে। সাংবাদিকরা আছে। অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন থেকে এসেছে মিলন আর নওরোজ ইমতিয়াজ। তারা মুহম্মদ জাফর ইকবালকে ফোন করছে। জাফর ইকবাল স্যারও চলে আসবেন কিছুক্ষণের মধ্যে। জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার জরুরি একটা মিটিং সেরে আসবেন বলে শোনা গেল।

এদিকে সরকারের নিরাপত্তা সংক্রান্ত গোপন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোতে মেইল এলো আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা থেকে। এটা কারো চক্রান্ত নয় তো! নাসা তৎপর হয়ে উঠল। তাদের রাডারে বাংলাদেশে একটা ভিনগ্রহের মহাকাশযানের ছবি একবার এসেছিল বটে!

মিজান তার রুমের দরজা বন্ধ করে দিল। জানালা খোলা ছিল। একটু পরে তার কাছে চলে এল তিতি। বলল, সর্বনাশ হয়ে গেছে মিজান। তোমাকে আর এখানে রাখা যাবে না। চলো আজই এখনই আমরা এখান থেকে চলে যাব । 

কোথায়?

প্রথমে যাব আমাদের শিপে । 

তারপর?

তারপর আমাদের গ্রহে৷

আমাদের গ্রহ মানে?

দরজার ধাক্কা হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা দরজায় হাজির হয়েছে। 

তিতি বলল, 'সময় নাই। তোমাকে পরে সব বলব। আগে বেল্ট পরে নাও। আসলে আমারই ভুল। আমার উচিত ছিল সেদিন সকালে তোমাকে এভাবে ঢাকায় আসতে না দেওয়া। তারা স্পেস-টাইম কনভারটর বেল্ট পরে নিল। ব্যস, মুহূর্তে তাদের পায়ের নিচের স্পেসটা বদলে গেল। তারা পৌঁছে গেল সেই গোল শিপটার দরজায়।

হোটেলের দরজায় গোয়েন্দা নিরাপত্তা কর্মীরা অনেক ধাক্কাধাক্কি করল। কিন্তু দরজা খুলল না। শেষে দরজা ভেঙে ফেলা হলো। ভেতরে গিয়ে দেখা গেল কেউ নেই৷

এরপর মিজানকে নানাভাবে খোঁজা হলো। না, তার দেখা আর কোথাও পাওয়া গেল না। তিতি আর মিজান স্পেসশিপে ঢুকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার ক্যাপ্টেন বললেন, তোমরা এসেছ। ভালো। আমাদের আর এক মুহূর্ত সময়ও হাতে নেই। আমেরিকার মহাশূন্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক রেড এলার্ট অবস্থা ঘোষণা করেছে। ওরা ওদের পারমাণবিক হানাদারযান নিয়ে এখনই এদিকে রওনা হবে। তার আগেই আমাদের পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। 

মহাশূন্যযানটা উড়াল দিল। মিজানের সামনের পর্দায় সবুজ পৃথিবী আর তার জঙ্গল আর পাহাড় এক ঝলকে বদলে প্রথমে ম্যাপের মতো, ধীরে ধীরে একটা গোলাকার গ্লোব হতে লাগল।

তিনি দৌড় দিলেন। তার হাতে রিমোট। বোতাম টিপে চলছেন। তার মুখের কাছে মাইক্রোফোন। সেটায় তিনি ক্রুদের নির্দেশ দিচ্ছেন। তিতি মিজানকে একটা আসনে বসাল। একটা বেল্টে বাঁধল। তার মাথায় একটা হেলমেটের মতো পরাল। বলল, আমরা এখন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তুমি পৃথিবীকে বিদায় জানাও। তোমার সামনের পর্দায় পৃথিবীর রূপ দেখা যাবে । 

মহাশূন্যযানটা উড়াল দিল। মিজানের সামনের পর্দায় সবুজ পৃথিবী আর তার জঙ্গল আর পাহাড় এক ঝলকে বদলে প্রথমে ম্যাপের মতো, ধীরে ধীরে একটা গোলাকার গ্লোব হতে লাগল। মিজান বুঝল, ওই গোলাকার গ্লোবটাই তার পৃথিবী । মিজান কাঁদতে লাগল। তার কান্নায় তিতি অস্থির। বলল, মিজান, কাঁদছ কেন?

আমার পৃথিবী থেকে আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?

তোমার পৃথিবী বলছ কেন? আমরা আমাদের পৃথিবীতে যাচ্ছি।

আমাদের পৃথিবী?

হ্যাঁ। এই পৃথিবীর মতোই একটা পৃথিবী আছে। আমরা সেটাকে বলি পৃথিবী। আর যেটা আমরা ছেড়ে এলাম সেটাকে আমরা বলি প্রতিপৃথিবী। আমাদের পৃথিবীতেও মানুষ আছে। তুমি হলে আমাদের পৃথিবীর মানুষ । বিজ্ঞানের গবেষণার স্বার্থে তোমাকে জন্মের পর এই প্রতিপৃথিবীতে আনা হয়েছিল। আমাদের পৃথিবীতে এক দুর্ঘটনায় তোমার বাবা-মা দুজনই মারা গিয়েছিলেন। প্রতিপৃথিবীর এক সন্তানহারা বাবা-মায়ের কোলে তোমাকে তুলে দেওয়া হয়েছিল। তবে তোমার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের স্বার্থে তোমার শরীরে আমরা একটা ছোট্ট যন্ত্র বসিয়ে রেখেছিলাম।

তুমি বলছ আমার এতদিনের বাবা-মা আমার বাবা-মা নয়?

হ্যাঁ। আমি তাই বলছি । 

আমরা যে পৃথিবীতে যাচ্ছি, সেখানে কি এরকম স্নেহ ভালোবাসা আছে?

আছে। আর আমরা বিজ্ঞানে অনেক উন্নত। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক আধুনিক। দেখলে না তোমাকে কীরকম করে সারিয়ে তোলা হলো। শুধু তাই নয়, তোমার শরীরে পৃথিবীর সেরা ক্রিকেটারদের জিন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাতেই তুমি এত বড় খেলোয়াড় হয়ে উঠেছিলে। 

আমি জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির কথা শুনতে চাই না। আমি জানতে চাই স্নেহ ভালোবাসার কথা । ওখানে আমি আমার বন্ধু-বান্ধব কোথায় পাব?

বন্ধু-বান্ধব? এখানে তো তুমি অনেক কষ্ট করেছ! আমরা তোমার মস্তিষ্কের অনুভূতি সেলে দেখতে পেয়েছি অনেক দুঃখ । 

মিজান বলল, তিতি আপনি বুঝবেন না। আমার দুঃখই ভালো। তিতি হেসে বলল, বুঝব না কেন? আমিও তো মানুষ। মিজান বলল, মানুষ, তবে পৃথিবীর নয়। প্রতিপৃথিবীর।

তিতি বলল, প্রতিপৃথিবীর নয়। পৃথিবীর। আর তুমিও তাই । 

মিজান মনিটরে তাকিয়ে আছে। পৃথিবীকে এখন দেখা যাচ্ছে চাঁদের মতো। তার শুধু কান্না পাচ্ছে। সে চোখের জল মুছল। তিতি বলল, তোমার অশ্রুর গ্লান্ডটা প্রতিপৃথিবীতে থেকে থেকে খুব বড় হয়ে গেছে। ওটা একটু টাইট দিতে হবে। 

পর্দায় পৃথিবী অনেক ছোট হয়ে এসেছে। কতদূর এই পৃথিবী! কী করছে এখন তার বন্ধুরা। কী করছে তার রুমমেট মোহন আর রাজীব আর হায়দার ভাই। কী করছে তার টিমমেট কৌশিক, মিনহাজ, সোহান আর আবীর ।

মিজান তার পকেটে হাত দিল। একটা চিঠি। ডাকযোগে এই চিঠিটা তাদের হোস্টেলের ঠিকানায় এসেছিল। তাড়াহুড়োয় খামটা খোলা হয়নি। ঘরে পরার শার্টের পকেটে রয়ে গেছে। আর সে কিনা এই শার্টটা পরেই রওনা দিয়েছে। 

খামটা বের করল মিজান। খুলল । ভেতরে একটা লাইনটানা কাগজ৷ তাতে একটা মাত্র বাক্য লেখা৷

বড় হলে আমি তোমাকে বিয়ে করব। 

আর কোনো কিছু লেখা নেই। কারো নামও না৷ মিজান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কে লিখতে পারে এ চিঠি?

তার শুধু এডিসি জেনারেলের মেয়ে আনিকার মুখটা মনে পড়ছে! হতে পারে । আবার নাও হতে পারে । 

তিতি বলল, কী হলো?

মিজান তাকে চিঠিটা দেখাল। তিতি বাঙলা পড়তে জানে। সে হাসল । তারপর বলল, চিন্তা করো না। তোমার বিয়ের বয়স যখন হবে তখন আন্তঃগ্রহ বিয়ে নিশ্চয় চালু হয়ে যাবে। তোমাকে আমরা এই মেয়ের সাথেই বিয়ে দিয়ে দিব । 

মিজান ম্লান হাসল । 

পর্দায় পৃথিবী অনেক ছোট হয়ে এসেছে। কতদূর এই পৃথিবী! কী করছে এখন তার বন্ধুরা। কী করছে তার রুমমেট মোহন আর রাজীব আর হায়দার ভাই। কী করছে তার টিমমেট কৌশিক, মিনহাজ, সোহান আর আবীর । 

আর কী করছেন সিরাজ স্যার। দুদিন আগেও রাতের বেলা মিজানকে তার রুমে নিয়ে গিয়ে তিনি মিষ্টি খাইয়েছেন। বলেছেন, আমার ছেলেটা নিশ্চয় তোর মতো বড় হয়ে গেছে রে। নাকি তুইই আমার ছেলে। কী জানি! আমার ছেলে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে! তুইও আমাকে ছেড়ে চলে যাবি, না?

মিজান স্যারকে বলেছে, স্যার আপনাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।

স্যার। দোয়া করবেন স্যার। যেখানে যাই, যেন আপনাদের এই শুভেচ্ছা আমার সঙ্গে থাকে। চোখের কোণে এক ফোঁটা অশ্রু ফুটিয়ে মিজান বিড়বিড় করল। 

মিজানকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই কথা শোনার পর সিরাজ স্যার কেমন যেন হয়ে গেছেন। প্রচণ্ড শীতের রাতেও তিনি ছাদের ওপর বসে থাকেন। আকাশের তারা দেখেন। সিরাজ স্যার তারার দিকে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করেন, ওই তারাদের কোনো একটা মিজানের বাড়ি। আমার মিজান। 

লোকে বলে, সিরাজ স্যার পাগল হয়ে গেছেন।