সমাপ্তি

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

শেষ ঘনিয়ে আসছে। সমুদ্রে পরিত্যক্ত লাইফবোটের মতো ভাসছে ধাতব ধ্বংসাবশেষ। তারাগুলো ম্লান। হারিয়েছে তাদের ঝিকমিক। আলো–আঁধারের খেলা। অস্বস্তিকর নীরবতা। মৃতদেহ চারদিকে, ভেসে বেড়াচ্ছে যেন স্যুপের বাটিতে বিচলিত পাপড়ি। অচেনা এক দৃশ্য। জাহাজের ভেতর অক্সিজেন নেই বললেই চলে। কড়া রাবার-পোড়া গন্ধ। ইঞ্জিনে ফ্রিয়ন গ্যাস লিক করছে। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ সিসটেম হচ্ছে ক্রমেই নিষ্ক্রিয়। নীরব ধ্যানে এলভান ককপিটে বসা। হাজারো চিন্তা মাথায়। তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো যেন হাইডেফিনেশন ভিডিওর মতো কর্নিয়ার পেছনে হচ্ছে বিকশিত।

এক ঝোড়ো শনিবার সন্ধ্যায় এলভান জন্ম নেয় আলফা প্রাইম মহাশূন্য ঘাঁটিতে। স্পেস রিসার্চ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত একটি ছোট গবেষণা উপনিবেশে কাটে শৈশব। মা–বাবা দুজনই বিজ্ঞানী। তাকে একটি মডেল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলেন।

‘বিপর্যয়ের মুখে আমাদের নিঃস্বার্থ হতে হবে,’ বলতেন বাবা। শিষ্টাচার শেখাতেন মা। আদরে আদরেই বেড়ে ওঠে এলভান। কিন্তু সহৃদয়তা সব জায়গা থেকে পায়নি।  

বড় ফ্রেমের বাইফোকাল পরতে হতো বলে স্কুলের সবাই ‘কানা’ বলে কটূক্তি করত। কারেকটিভ সার্জারি করার মতো বয়স হয়নি তখনো। কোনো বন্ধু ছিল না। অপব্যবহারে টালমাটাল। জন্মগত বিকলাঙ্গের কারণে কৃত্রিম পা দিয়ে হাঁটতে হতো। দিনগুলো কাটত আতঙ্কে। কে কখন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে, অন্যরা ভেঙে পড়বে অট্টহাসিতে।

তারপর জোরে জোরে গায়ক দলের মতো একসঙ্গে কলরব, ‘পঙ্গু, পঙ্গু!’ 

স্কুল শেষে মায়ের বুকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। রাতে চোখ বুজলেই দুঃস্বপ্ন।

‘সবাই দেখো! চার-চোখা খোঁড়া! চার-চোখা খোঁড়া!’  

সংশোধনমূলক সার্জারির পর অবশেষে চশমার প্রয়োজনীয়তার সমাপ্তি ঘটে। অশ্রু যায় মুছে, কিন্তু শৈশবের ক্ষতচিহ্নগুলো থাকে অবিচ্ছিন্ন।

আরও পড়ুন
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
কনকনে ঠান্ডা যানটির ভেতরে বসে আফসোস করল, ‘কেন বললাম না তাকে?’ মেয়েটি ২০ বছর ধরে তার সুখ–দুঃখের সহচরী। গ্রহাণু ঝড়ের সময় তারা ১৪ দিনের জন্য আন্ডারগ্রাউন্ড বাঙ্কারে আটকা পড়েছিল।

নীরবে মেনে নিতে হয় খেলার মাঠের লেজার বার্ন আর ক্ষত, বাঁ হাঁটুতে ইচ্ছাকৃত লাথি। আঘাতের দাগ বাড়তে থাকে একের পর এক। মা-বাবা ছাড়া কেউ এলভানের কষ্টগুলো জানত না। জানতে চাইত না। কিন্তু এক গ্রীষ্মের সকালে পাল্টে যায় তার জীবন। রাহার সঙ্গে হয় পরিচয়। পরবর্তী কয়েক দশকের সহচরী। রাহাই প্রথম সহপাঠী, যে এলভানের অক্ষমতাগুলোকে উপহাস করার হেতু হিসেবে দেখেনি। মৃদুভাষী হলেও রাহা ছিল সাহসী আর দৃঢ়। ক্লাসের মধ্যবর্তী সময়গুলোতে নিগ্রহ থেকে রক্ষা করত সে-ই। একসঙ্গে হেঁটে বাড়ি ফিরত। এমনকি এলভানের মুখে একটু হাসি ফোটাতে বাজাত সুরেলা ভায়োলিন।

বলার সাহস ছিল না, কিন্তু এলভান মনে–প্রাণে ভালোবাসত রাহাকে।

কনকনে ঠান্ডা যানটির ভেতরে বসে আফসোস করল, ‘কেন বললাম না তাকে?’ মেয়েটি ২০ বছর ধরে তার সুখ–দুঃখের সহচরী। গ্রহাণু ঝড়ের সময় তারা ১৪ দিনের জন্য আন্ডারগ্রাউন্ড বাঙ্কারে আটকা পড়েছিল। শুধু শুকনো রেশন আর একে অপরের সঙ্গ। এক মুহূর্তের জন্যও তাদের মনে হয়নি কোনো কিছুর ঘাটতি। দুজনেই গল্প বলতে ভালোবাসত। এলভানের কাল্পনিক কাহিনিসমূহ রাহাকে নিয়ে যেত ঐন্দ্রজালিক সব রাজ্যে। ‘একটা রোমাঞ্চকর গল্প শোনাও,’ আবদার করত রাহা। এলভান হাসত। ‘কোনটা শুনতে চাও?’

‘একটা বলো। শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাই।’

রাহাকে ছাড়া পথচলা ছিল অভাবনীয়। একাডেমি অব সায়েন্সেস থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের সমাবর্তনে ছিল রাহা। বাবার ক্যানসারের সময় বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে তদারকি। ফিউনারেলে এলভানকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কান্না। জীবনের এমন কোনো ঘটনা ছিল না, যেখানে রাহা এলভানের পাশে ছিল না।

আরও এক ফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। কম্পিউটার কনসোলে লাল বাতি জ্বলছে। লো অক্সিজেন অ্যালার্ট। একটি কম্পিউটারাইজড ভয়েস বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে, ‘লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত।’ এলভান দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল।

যুদ্ধ না বাধলে হয়তো এমনটি হতো না। প্রায় এক শতাব্দী ছিল শান্তিময়। নর্থ স্পেস অ্যালায়েন্স আর সাউথ স্পেস ফেডারেশন মধ্যস্থতা মেনে চলছিল চুক্তি মোতাবেক। সমঝোতা ছিল দুই পক্ষই অস্ত্র-সংবরণ করবে। কিন্তু একজন কূটনীতিকের হত্যা শত বছরের অস্থিরতাকে নিয়ে আসে সম্মুখে। কয়েক মাসের মধ্যে ঘটে উত্তেজনার বর্ধন। অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যা পরে পারস্পরিক নাশের কারণ হয়ে বসে।

আলফা প্রাইমে আইন ছিল কঠোর। যুদ্ধ বাধলে প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব অস্ত্র হাতে নিজ গ্রহকে অমিত্রের হাত থেকে রক্ষা করা। মহাকাশ পরিবহনযানে মা আর রাহাকে পার্শ্ববর্তী এক গ্রহে নিরাপদে পাঠানোর জন্য পদক্ষেপ নেয় এলভান। দুজনের একই বক্তব্য, এলভানকে ছাড়া তারা কোথাও যাবে না। প্রথমে পরামর্শ, তারপর আন্তরিক অনুরোধ। অবশেষে চিৎকার–চেঁচামেচি। ছলচাতুরি করে একটা ট্রান্সপোর্ট শিপে মাকে তুলতে সক্ষম হয়, কিন্তু রাহা কিছুতেই তার পাশ ছাড়বে না।

আরও পড়ুন

একই স্কোয়াড্রনে যোগ দেয় আকাশপথে লড়াই করতে। প্রতিটি মুহূর্ত এলভানের পাশে, যেমনটা সে ছিল সব সময়। লাল রঙের কোঁকড়া চুল আর মহাসাগরের সঙ্গে সাদৃশ্যময় চোখ। এলভানের কাছে রাহা ছিল অপরূপা সুন্দরী। হঠাৎ সে হারিয়ে গেল কল্পনার রাজ্যে। কিন্তু মনশ্চক্ষুর স্বচ্ছ চিত্রটা ঝাপসা হতে লাগল। মহাকাশযানটির স্বচ্ছ ছাদের দিকে তাকাল এলভান। কল্পনার সেই রাহাকে আর সে দেখতে পারল না। হাস্যোজ্জ্বল সেই প্রাণবন্ত মেয়েটি এখন ভাসমান এক মরদেহ। নিশ্চল দুটি চোখ। শুষ্ক ঠোঁট। মহাকাশের নিষ্ঠুর প্রভাবে গায়ের রং হয়েছে ধূসর। গাড়ির ভাঙা কাচের মতো ফাটল ধরেছে চেহারার বিভিন্ন স্থানে। ধাতুঘটিত ধ্বংসাবশেষের মধ্যে ভাসছে যেন কাপড়ের পুতুল। ভালোবাসার মানুষটাকে এ অবস্থায় দেখে এলভান কেঁদে ফেলল। নীরব অশ্রু নয়। শিশুর মতো আর্তনাদ।

যানের ভেতর লাল বাতিটা ক্রমেই জ্বলতে আর নিভতে লাগল। ‘ওয়ার্নিং! ওয়ার্নিং! অক্সিজেন অ্যালার্ট!’ বারবার কম্পিউটারাইজড ভয়েসের ঘোষণা। এলভান রাহার দিকে চুপ করে চেয়ে থাকল কিছু সময়। ককপিটের মধ্যে অক্সিজেন মাত্র এক শতাংশ। মা নিরাপদ স্থানে আছেন চিন্তা করে মনকে মানিয়ে নিল সে।

ইজেক্ট লিভারটা গাড়ির হ্যান্ডব্রেকের মতো। টান দিতেই স্বচ্ছ ছাদটা যান থেকে খুলে আলাদা হয়ে গেল। মাধ্যাকর্ষণ না থাকায় তৎক্ষণাৎ ভেসে উঠল সোজা। আলিঙ্গনে নিল রাহাকে। শেষ তখন কাছাকাছি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সমাপ্তি ঘটবে জীবনের। কিন্তু এলভানের মনে কোনো অনুতাপ ছিল না। ভালোবাসার রাহা তার বুকে। তার তাকিয়ে থাকা চোখ দুটোকে হাতের তালু দিয়ে বন্ধ করল। আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আস্তে আস্তে প্রাণের আলো নিভতে শুরু করল। তারপর হঠাৎ অন্ধকার। এলভান আর রাহা। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত একসঙ্গে। যেমনটি চেয়েছিল দুজনই।

*বিজ্ঞানচিন্তার মে ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত