ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ–শেষ পর্ব

১০

যে টেবিল ল্যাম্পটার কথা ভেবেছিলাম সেটা কেউ ব্যবহার করত না। কোণে একটা উঁচু টুলের ওপর বসানো ছিল সেটা, ধুলোভরা, দাগ ফুটকিতে কলঙ্কিত। তারের লেজটা স্ট্যান্ডের সঙ্গে জড়ানো।

ভোরবেলায় ঘরের লোকেরা যখন মুখ হাত ধুতে গেছে তখন তারটা আমি খাবার টেবিলের ছুরি দিয়ে কেটে পকেটে ভরলাম। প্রাতরাশের সময় একটি ছুরি পকেটস্থ করা গেল। তারপর প্রার্থনার জন্য সবই চলে গেলে আমি পায়খানায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওপরের ইনস্যুলার আবরণটা ছাড়িয়ে নিয়ে মিটার দেড়েক লম্বা সরু সরু তার পাওয়া গেল একগুচ্ছ। তারপর সাবধানে পেনসিলটা ভেঙে তার গ্রাফাইট শিষটা বার করলাম এবং দশভাগের তিনভাগ পরিমাণ দৈর্ঘ্য ভেঙে ফেললাম। বাকি অংশ যা রইল সেটার রেজিস্টেন্স হবে ঠিক আমি যা চাই। তারপর গ্রাফাইটের দুই প্রান্তে দুটো খাঁজ কেটে তার জুড়ে দেওয়া গেল। রেজিস্টার তৈরি। বাকি রইল এখন একপ্রান্ত কনডেন্সর প্লেটের সঙ্গে সংযুক্ত করা আর অন্য প্রান্তটিকে আর্থ করা।

সেটা করা দরকার আমার কাজের মধ্যে। পরিগণকদের কাজের দিন আট ঘণ্টা, প্রতি ঘণ্টার পর দশ মিনিট করে বিরতি। একটার সময়, লাঞ্চের ছুটির পরে সাধারণত পরিগণকদের কাজের ঘরে দর্শন দেয় ক্রাফৎশ্‌তুদৎ কোম্পানির কর্মকর্তারা। গাণিতিক যন্ত্রণায় বারোটা লোক আঁকুপাঁকু করছে, এ দৃশ্যটা উপভোগ করতে ফার্মের কর্তার খুব ভালোই লাগে বোঝা যায়। ঠিক করলাম, ফ্রিকোয়েন্সি বদলে তখনই হবে উপযুক্ত সময়। সেদিন সকালে পকেটে তৈরি রেজিস্টার নিয়ে চমৎকার মেজাজে কাজের জায়গায় গেলাম। আমার কাজের ঘরের দরজায় দেখা হয়ে গেল ডাক্তারের সঙ্গে। নতুন অঙ্ক নিয়ে এসেছে সে।

আমি ডেকে বললাম, ‘এই যে বদ্যি, এক মিনিট।’

ডাক্তার থেমে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলে আমায় হতভম্বের দৃষ্টিতে। ‘একটু কথা আছে আপনার সঙ্গে।’

‘কী কথা?’ আশ্চর্য হয়ে বললে সে।

বললাম, ‘ব্যাপারটা এই—কাল কাজ করার সময় মনে হলো, হের বলৎসের সঙ্গে প্রথমে আমার যে কথাবার্তা হয়েছিল সেটা ফের তোলা ভালো। চটাচটি করে আমার খারাপই হয়েছে। আপনি বলৎসকে জানিয়ে দেবেন যে আমি ক্রাফৎশ্‌তুদৎ ফার্মের নতুন ভর্তিদের জন্যে শিক্ষকতার কাজ করতে রাজী আছি।’

আরও পড়ুন

অকপটেই ডাক্তার ঘোষণা করল: ‘সত্যি বলছি, ভারি আনন্দ হলো। আমি এদের বলেছিলাম, তোমার যা স্পেকট্রাম তাতে এই গাণিতিক দঙ্গলটার ওপর পরিদর্শক বা শিক্ষকের কাজই সবচেয়ে ভালো। ভালো একজন পরিদর্শক আমাদের খুবই দরকার। তার জন্যে তুমিই সবচেয়ে যোগ্য লোক। তোমার কাজের ফ্রিকোয়েন্সি একেবারেই অন্য রকম। যারা আলসেমি করে কাজ করছে বা যাদের গাণিতিক উত্তেজনার অনুরণন হচ্ছে না, তাদের তাড়া দিতে পারো তুমি সোজাসুজি ওদের মধ্যে থেকেই।’

‘তা ঠিক ডাক্তার, তবে আমার মনে হয় নতুন ভর্তিদের অঙ্ক শেখাবার কাজই আমার পক্ষে সবচেয়ে ভালো। ইস! কয়েকদিন আগে যা দেখেছি, সে রকমভাবে টেবিলে মাথা ঠুকে মরার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।’

‘বুদ্ধিমানের মতোই সিদ্ধান্ত নিয়েছ,’ বললে সে, ‘ক্রাফৎশ্‌তুদৎ-এর সঙ্গে কথা বলা দরকার। আমার মনে হয় তিনি রাজী হবেন।’

‘আর ফল জানতে পাব কবে?’

‘আশা করি আজ বেলা একটার সময়, যখন পরিগণনা কেন্দ্রে হাজিরা দিয়ে কাজ দেখা শোনা করা হয়।’

‘বেশ, অনুমতি দিলে তখন আপনাদের কাছে আসব আমি।’

মাথা নেড়ে চলে গেল ডাক্তার। টেবিলের ওপর দেখলাম একটা কাগজ, তাতে নতুন একটা প্রেরণা জেনারেটরের জন্য হিসেব কষার তথ্যাদি দেওয়া আছে—এটা হবে বর্তমানটার চেয়ে চারগুণ শক্তিশালী। বোঝা গেল, ক্রাফৎশ্‌তুদৎ তার কারবার বাড়াতে চাইছে চারগুণ। ও চাইছে তার এই পরিগণনা কেন্দ্রে তের জন নয়, বাহান্ন জন কাজ করবে। মায়াভরে পকেটে হাত দিয়ে আমার তার-বাঁধা গ্রাফাইটটা পরখ করলাম। খুব ভয় ছিল পকেটের মধ্যে ভেঙে না যায়।

নতুন জেনারেটরের যেসব তথ্য দেওয়া ছিল তা থেকে খতিয়ে দেখলাম, বর্তমান জেনারেটরটা নিয়ে আমি যে হিসাব করে রেখেছি সেটা সঠিক। সাফল্যের আশা বেড়ে উঠল আমার। একটা বাজার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম অধীর হয়ে। দেয়ালের ঘড়িতে যখন পৌনে একটা, তখন আমার রেজিস্টারটি বার করে তার একটা প্রান্ত যোগ করলাম মাথার ওপরকার অ্যালুমিনিয়ম চাকতির একটা স্কুয়ের সঙ্গে। অন্য প্রান্তটা তারের পর তার জুড়ে লম্বা করে টেনে নিয়ে এলাম কোণের পাইপটার কাছে।

আরও পড়ুন
মাথা নেড়ে চলে গেল ডাক্তার। টেবিলের ওপর দেখলাম একটা কাগজ, তাতে নতুন একটা প্রেরণা জেনারেটরের জন্য হিসেব কষার তথ্যাদি দেওয়া আছে—এটা হবে বর্তমানটার চেয়ে চারগুণ শক্তিশালী। বোঝা গেল, ক্রাফৎশ্‌তুদৎ তার কারবার বাড়াতে চাইছে চারগুণ।

শেষ মুহূর্তগুলো যেন আর কাটতে চাইছিল না। শেষ পর্যন্ত মিনিটের কাঁটা এসে পৌঁছল বারোর ঘরে। সঙ্গে সঙ্গে ওপ্রান্তটা রেডিয়েটরের সঙ্গে যোগ করে আমি বেরিয়ে এলাম বারান্দায়। প্‌ফাফ্‌ফ্‌, বলৎস এবং ডাক্তার সমভিব্যাহারে ক্রাফৎশ্‌তুদৎ আসছিল এই দিকেই। আমায় দেখে হাসি ফুটল ওদের মুখে। বলৎস ইশারা করে আমায় সঙ্গে ডাকলে। আমিও ওদের পেছন পেছন গিয়ে দাঁড়ালাম হিসেব কষার ঘরটার কাচের দরজার সামনে।

সামনে ছিল প্‌ফাফাফ্ আর ক্রাফৎশ্‌তুদৎ। ভেতরে কী হচ্ছিল আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না।

‘ভালো সিদ্ধান্তই নিয়েছেন,’ চাপা গলায় বলৎস বলল, ‘হের ক্রাফৎশ্‌তুদৎ আপনার প্রস্তাবে রাজী হয়েছেন। আপনার আফশোসের কারণ থাকবে না...’

‘কী ব্যাপার?’ হঠাৎ তার অনুচরবর্গের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলে ক্রাফংশ্তুদৎ। ইঞ্জিনিয়র প্‌ফাফ্‌ফ্‌ গুড়ি মেরে কী যেন দেখার চেষ্টা করল জানলা দিয়ে। বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল আমার।

‘কাজ করছে না দেখছি! মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে সবাই!’ সক্রোধে প্‌ফফ্‌ফ্‌ বলল ফিসফিসিয়ে।

আমি জানলার দিকে মুখ বাড়িয়ে চেয়ে দেখলাম। যা দেখলাম সেটা আমার উদ্দাম স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে গেল। যে লোকগুলো আগে বাধ্যের মতো হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকত টেবিলের ওপর, তারা এখন সিধে হয়ে বসেছে, সদর্পে তাকাচ্ছে। দৃঢ় সংকল্পের উঁচু গলায় কথা বলাবলি করছে।

‘এ অত্যাচারের অবসান করার সময় হয়েছে ভাইসব। বুঝতে পারছিস তোরা, কী এরা করছে আমাদের নিয়ে?’ উত্তেজিতভাবে বলছিল ডেনিস।

‘নিশ্চয়! এই পিশাচেরা আমাদের অনবরত বোঝাচ্ছে যে তাদের প্রেরণা জেনারেটরের কাছে আত্মসমর্পণ করে আমরা সুখের পরাকাষ্ঠায় পৌঁছচ্ছি। ওরা নিজেরা একবার বসে দেখুক না!’

‘কী হচ্ছে ওখানে?’ হুঙ্কার ছাড়ল ক্রাফৎশ্‌তুদৎ।

‘কিছুই বুঝতে পারছি না,’ ঘরের ভেতরকার লোকগুলোর দিকে বিবর্ণ চোখ মেলে বিড়বিড় করলে প্‌ফাফ্‌ফ্‌। ‘স্বাভাবিক মানুষের মতো হাবভাব দেখছি। হিসেব কষছে না কেন?’

লাল হয়ে উঠল ক্রাফৎশ্‌তুদৎ।

আরও পড়ুন

‘অন্তত পাঁচটা সামরিক অর্ডার সময়মত দিতে পারব না আমরা,’ দাঁত চেপে বলল সে, ‘এক্ষুনি কাজে লাগান ওদের।’

বলৎস চাবি খুলল, আমাদের গোটা দলটা ঢুকল ভেতরে।

‘তোমাদের গুরু ও ত্রাতাকে অভিনন্দনের জন্যে দাঁড়াও।’ জোর গলায় হুকুম দিলে বলৎস।

একটা পীড়িত স্তব্ধতা নেমে এল ঘরের মধ্যে। ক্রোধে রোষে উদ্দীপিত চব্বিশটি চোখ চাইল আমাদের দিকে। বিস্ফোরণের জন্যে এবার কেবল একটা স্ফুলিঙ্গের প্রয়োজন। হৃদয় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল আমার। ক্রাফৎশ্‌তুদৎ ফার্ম এবার ডকে উঠছে। সামনে এগিয়ে গিয়ে গোটা দলটার উদ্দেশ্যে উচু গলায় বললাম:

‘এখনো চুপ করে আছো কিসের জন্যে? মুক্তির সময় হয়েছে। তোমাদের ভাগ্য সে তোমাদের নিজেদেরই হাতে। শেষ করে দাও এই হারামজাদাদের—তোমাদের জন্যে ‘জ্ঞানীগৃহের’ রাস্তা খুঁড়ছে এরা।’

কথাটা বলতেই নিজেদের জায়গা ছেড়ে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল হতভম্ব ক্রাফৎশ্‌তুদৎ আর তার অনুচরবর্গের ওপর। বলৎস আর ডাক্তারকে মাটিতে আছড়ে ফেলে টুটি টিপে ধরল তাদের। কিল, ঘুসি, লাথি মারতে মারতে তারা ক্রাফৎশ্‌তুদৎকে ঠেলে নিয়ে গেল কোণের দিকে। ধরাশায়ী প্‌ফফ্‌ফে্‌র ওপর চেপে বসে ডেনিস তার কান ধরে টাক পড়া মাথাটা ঠুকতে লাগল মেজের ওপর। কেউ কেউ গিয়ে ভেঙে ফেলল অ্যালুমিনিয়মের চাকতিগুলো, চূর্ণ হতে লাগল সার্শি, লাউডস্পিকারটা খসিয়ে নিয়ে চুরমার করা হলো মেজের ওপর। তারপর টেবিল চেয়ার। কুটি কুটি করে ছোঁড়া অঙ্কের পাতায় আকীর্ণ হয়ে উঠল মেঝে।

যুদ্ধ ক্ষেত্রের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিতে লাগলাম আমি। ‘ক্রাফৎশ্‌তুদৎকে ছেড়ো না। ও এক যুদ্ধাপরাধী। এই শয়তানী গণনাকেন্দ্রটা গড়েছে ওই, যেখানে মস্তিষ্কের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করে প্রাণ দিয়েছে লোকে। আর ওই বদমাইশ প্‌ফফ্‌ফফটাকে আটকে রাখো। এই প্রেরণা জেনারেটরটি ওরই কীর্তি। বলৎসকে বেশ এক চোট দাও। লোকে শেষ পর্যন্ত পাগলা হয়ে গেলে তাদের জায়গা পূরণ করার নতুন শিকার তৈরি করছে ও...’

মানবিক রোষে উদ্দীপ্ত এই লোকগুলোর চেহারা তখন দেখবার মতো। দুষমনদের টুঁটি টিপে কিল ঘুঁসি লাথি চালাতে লাগল তারা।

আরও পড়ুন
উত্তপ্ত এক বসন্তের সূর্যে মুহূর্তের জন্যে চোখ ধাঁধিয়ে থেমে গেলাম আমরা। কিন্তু সেটা কেবল সূর্যের জন্যেই নয়। ক্রাফৎশ্‌তুদৎ দালানের দরজার সামনে ভিড় করে এসেছে এক বিপুল জনতা। কী একটা চিৎকার করছিল তারা, কিন্তু আমাদের দেখে থেমে গেল হঠাৎ।

প্রেরণা জেনারেটরের প্রভাব অনেকক্ষণ থেমে গেছে। কিন্তু তাদের এই শুভক্রোধ তখনো ফুঁসে চলছে। দাসত্বের জোয়াল ভাঙা জীবন্ত মানুষ জেগে উঠেছিল তাদের মধ্যে। রক্তাক্ত মুখে ক্রাফৎশ্‌তুদৎ, বলৎস, পাফ্ফ্ফ আর ডাক্তারকে টেনে আনা হলো বারান্দায়। তারপর গোলমাল করে ঠেলতে ঠেলতে তাদের নিয়ে যাওয়া হল বের হওয়ার দরজার দিকে।

উত্তেজিত লোকগুলোর আগে আগে পথ দেখিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। তাদের নিপীড়কদের উদ্দেশ্যে চিৎকার ও ব্যঙ্গোক্তি করতে করতে এই ভূতপূর্ব পরিগণকেরা এগোল সেই গহন প্রকোষ্ঠটার মধ্যে দিয়ে, যেখানে আমি আমার অঙ্কগুলো প্রথম এনে দিয়েছিলাম। তারপর ভূগর্ভের সেই সরু গোলকধাঁধার মধ্যে দিয়ে চেঁচামেচি করতে করতে শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে এল উন্মুক্ত রাস্তায়।

উত্তপ্ত এক বসন্তের সূর্যে মুহূর্তের জন্যে চোখ ধাঁধিয়ে থেমে গেলাম আমরা। কিন্তু সেটা কেবল সূর্যের জন্যেই নয়। ক্রাফৎশ্‌তুদৎ দালানের দরজার সামনে ভিড় করে এসেছে এক বিপুল জনতা। কী একটা চিৎকার করছিল তারা, কিন্তু আমাদের দেখে থেমে গেল হঠাৎ। তারপর কে যেন চিৎকার করে উঠল:

‘আরে ওই তো প্রফেসর রাউখ। সত্যিই বেঁচে আছেন তাহলে?’

আরও পড়ুন

ডেনিস আর তার সঙ্গীরা সামনে ঠেলে দিল ক্রাফৎশ্‌তুদৎ কোম্পানির লাথি খাওয়া কর্মকর্তাদের। ধীরে ধীরে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে তারা কাপুরুষের মতো একবার আমাদের দিকে একবার ওই আগুয়ান ভয়ঙ্কর জনতার দিকে চাইতে লাগল।

ভিড় থেকে বেরিয়ে এল একটা রোগা ফ্যাকাশে মেয়ে—এলজা ব্রিন্টার। আমি যা বলেছিলাম তা সে সাহস করে করেছে তাহলে!

ক্রাফৎশ্‌তুদৎ-এর দিকে দেখিয়ে সে বললে, ‘এই লোকটা!’ তারপর প্‌ফাফ্ফ-এর দিকে নির্দেশ করে বললে, ‘আর এই লোকটা। এরাই নাটের গুরু...’

একটা গুঞ্জন উঠল জনতার মধ্যে। ক্রুদ্ধ কণ্ঠ শোনা যেতে লাগল। মেয়েটির পিছনে পিছনে এগিয়ে আসতে লাগল পুরুষেরা। আর এক মুহূর্ত দেরি করলেই অপরাধীদের হাড়-মাংস আর কিছু থাকত না। কিন্তু ডেনিস হাত তুলে চেঁচিয়ে বলল:

‘বন্ধুগণ, আমরা সভ্য মানুষ। নিজের হাতে বিচারের ভার নেওয়া আমাদের পক্ষে মর্যাদাকর হবে না। মানবতার স্বার্থে বেশি কাজ হবে যদি এদের পাপের কথা দুনিয়ার লোক জানতে পারে। এদের আদালতে সোপর্দ করতে হবে। আমরা হব সাক্ষী। জঘন্য সব অপরাধের অনুষ্ঠান হয়েছে এই দেয়ালগুলোর ভেতরে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সুযোগ নিয়ে এই পিশাচেরা মানুষকে দাস বানাতে, তাদের নিঃশেষ করে শোষণ করতে চেয়েছে।’

‘আদালতে পাঠাও অপরাধীদের!’ চিৎকার করল সবাই। ‘বিচার হোক অপরাধীদের!’

অপরাধী দলটাকে ঘিরে শহরের দিকে চলতে লাগল জনতা। আমার পাশে পাশে হাঁটছিল সেই রোগা মেয়েটা, এলজা ব্রিন্টার। আমার হাত আঁকড়ে ধরে বললে:

‘আমাদের সেই কথাবার্তাটার পর আমি অনেক ভেবেছিলাম। পরে কেমন যেন বুকে জোর পেলাম। ভারি রাগ হচ্ছিল আপনার আর আপনাদের ওই বন্ধুদের কথা ভেবে, নিজের কথাও ভেবে। কোত্থেকে যে সাহস পেলাম...’

‘যারা তাদের শত্রুদের ঘৃণা করে আর বন্ধুদের ভালোবাসে, তাদের বেলায় ঠিক এই হয়।’ আমি বললাম।

সরকারী কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল ক্রাফৎশ্‌তুদৎ আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের। মস্ত একটা বক্তৃতা দিলেন নগরপাল, তাতে বাইবেল আর সুসমাচার থেকে অনেক উদ্ধৃতি গিজগিজ করছিল। বক্তৃতা শেষ করলেন এই বলে, ‘এই সব সূক্ষ অপরাধের জন্যে ক্রাফৎশ্‌তুদৎ ও তার অনুচরদের বিচার হবে সর্বোচ্চ ফেডারেল কোর্টে।’

পুলিশের গাড়িতে করে তারপর তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হলো আমাদের শহর থেকে। পরে তাদের কী হল কিছু শোনা যায়নি। খবরের কাগজেও কোনো রিপোর্ট বের হয়নি। কিন্তু গুজব শোনা যায় ক্রাফৎশ্‌তুদৎ আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা সরকারী কাজে ঢুকেছে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রিদপ্তরের জন্যে একটা বড় কম্পিউটার কেন্দ্র গড়ার ভার পেয়েছে তারা।

আর খবরের কাগজের শেষ পৃষ্ঠায় যখনই আমি নিচের এই বিজ্ঞাপনটি দেখি, তখনই রাগে পিত্তি জ্বলে যায় আমার:

কর্মখালি

একটি বড় কম্পিউটার কেন্দ্রের জন্য ২৫-৪০ বছর বয়স্ক উচ্চ গণিতের জ্ঞানসম্পন্ন পুরুষ কর্মচারী আবশ্যক। লিখুন বক্স নং...

* সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘প্রগতি প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত গল্প সংকলন গ্রহান্তরের আগুন্তুক থেকে নেওয়া।

মূল: আনাতলি দনে্‌প্রভ

অনুবাদ: ননী ভৌমিক

আরও পড়ুন