থ্রিটুথ্রি

এরিক অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নতুন অতিথির দিকে। নতুন অতিথি ভালোবাসা মাখানো চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। হাসি হাসি মুখ। দেখে মনে হচ্ছে, এক্ষুনি তাকে আদর করে কোলে তুলে নেবে।

মা বললেন, ‘এরিক, এ হচ্ছে তোমার নতুন বন্ধু। বাবা আর আমি যখন অফিসে যাব, দিদিভাই স্কুলে যাবে, তখন বাসায় তুমি তোমার নতুন বন্ধুর সঙ্গে খেলা করবে। সে তোমাকে ছড়া শোনাবে, গান শোনাবে। তোমরা ছবি আঁকবে।’

এরিকের বয়স আড়াই বছর। সে কী বুঝল, বোঝা গেল না। তবে নতুন বন্ধুকে তার পছন্দ হয়েছে, সেটা বোঝা গেল। এরিক থপথপ করে তার দিকে এগিয়ে গেল এবং বলল, ‘ওটা দিদিভাই। বাবা অফিসে যায়। মা আদর করে।’

এরিকের মা–বাবা হাসপাতালে চাকরি করেন। মা ডাক্তার, বাবা রেডিওলজিস্ট। বড় বোনের নাম তুরি। তার বয়স দশ বছর। সে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। প্রতিদিন সকালে স্কুলবাস এসে তাকে বাসা থেকে নিয়ে যায়। বেলা তিনটায় তুরিকে স্কুলবাস আবার বাসায় পৌঁছে দিয়ে যায়। সপ্তাহে তিন দিন মা আর চার দিন বাবা বাসায় ফেরেন বেলা দুইটার সময়। দুই সপ্তাহ পরপর অফিস থেকে তারা তিন দিন করে ছুটি নেন। তখন সারা দিন বাসায় থাকেন।

মা আর বাবা অফিসে যাওয়ার আগে এরিককে পাশের হ্যাপি ডে সেন্টারে রেখে যান। হ্যাপি ডে সেন্টার ভেঙে বড় করা হচ্ছে। এক মাস বন্ধ থাকবে। অভিভাবকদের বলা হয়েছে, তারা যেন সন্তানদের অন্তত এক মাসের জন্য নিজ দায়িত্বে রাখেন।

আশপাশে আর কোনো হ্যাপি ডে সেন্টার নেই। এরিকের মা মিশেল তাতাই ফোন করলেন বাড়ির কাছের হোম সার্ভিস রোবট অফিসে। তারা বাড়ির কাজের জন্য যেমন দরকার তেমন রোবট ভাড়া দেয়। তবে সেসব রোবট দেখতে মোটেও লোহালক্কড়ের যন্ত্রের মতো নয়। রোবটগুলো দেখতে অবিকল মানুষের মতো। মানুষ আর রোবট আলাদা করা যায় না।

হোম সার্ভিস রোবট অফিসের যে মেয়ে ফোন রিসিভ করল, সে হাসিমাখা গলায় যান্ত্রিক সুরে বলল, ‘পাশে আছি প্রিয়জন হোম সার্ভিস থেকে ভিকুটা বলছি। কীভাবে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’

মিশেল তাতাই বললেন, ‘আমাদের একটা রোবট লাগবে। অ্যান্ড্রয়েড।’

‘তাকে কী কাজে ব্যবহার করা হবে?’

‘বাসায় আমার ছেলের সঙ্গে খেলা করবে। ছেলের বয়স আড়াই বছর। আপনাদের কাছে সস্তা ধরনের রিকন্ডিশন অ্যান্ড্রয়েড রোবট হবে?’

‘কত মাত্রার রোবট নেবেন?’

‘তিন মাত্রার হলেই চলবে। এক মাসের জন্য তো!’

‘আপনি মডেল পছন্দ করুন। ওয়ারেন্টি পাবেন। যন্ত্রপাতি নষ্ট হলে আমরা বদলে দেব। তবে রিকন্ডিশন অ্যান্ড্রয়েড রোবটে ফ্রি সার্ভিস দিতে পারব না।’

পাশে আছি প্রিয়জন হোম সার্ভিস থেকে আজ এই রোবট পাঠানো হয়েছে। বয়স ২০ বছর। দুই কাঁধে ছড়ানো লালচে চুল। চোখ গাঢ় নীল। গায়ের রং অতিমাত্রায় ফরসা। সে হাসি হাসি মুখে এরিকের দিকে দুহাত বাড়িয়ে দিল। এরিক ছুটে এসে তার দুহাতের ভেতর ঢুকে পড়ল। এরিকের নতুন বন্ধু এরিককে বুকে জড়িয়ে ধরে গালে আলতো করে চুমু দিল। দেখে মোটেও মনে হলো না, আজই তাদের প্রথম দেখা হয়েছে। মনে হলো, তারা অনেক দিনের পরিচিত, আপনজন।

সন্ধ্যা। তুরি পড়ছে। তার পড়ার ঘর আলাদা। এরিক বাবার সঙ্গে খেলা করছে। মায়ের কাছে একজন এসেছেন। মনে হয় অসুখের কথা বলতে। পাশের কটেজে থাকেন।

রোবট এসে দাঁড়িয়ে আছে তুরির পাশে। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি বিনয়ী। তুরি ই-রিডার থেকে চোখ তুলে তাকাল। রোবট কিছু বলল না। তুরি জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু বলবে?’

রোবট বলল, ‘তুমি পড়ছ। যেটা পড়ছ, সেটা বোঝার চেষ্টা করছ। বুঝতে পারছ না। তোমার কষ্ট হচ্ছে।’

তুরি বলল, ‘তুমি কেমন করে জানো?’

রোবট বলল, ‘শর্টওয়েভ দিয়ে আমাকে মানুষের ব্রেনের ফাংশন বুঝতে হয়। এরিক কী ভাবছে, সেটা আমি আমার শর্টওয়েভ দিয়ে বুঝি। তার সঙ্গে তখন সে রকম আচরণ করি।’

তুরি বলল, ‘তুমি কি আমার পড়াটা বুঝিয়ে দিতে পারবে?’

রোবট বলল, ‘আমি তিন মাত্রার রোবট। ইন্টেলিজেন্ট পাওয়ার কম। আট মাত্রার রোবট হলে পারত।’

তুরি জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, তোমার নাম কী?’

রোবট বলল, ‘থ্রিটুথ্রি।’

‘নামটা একটু ছোট করা যায়? যেমন আমার বন্ধু অপলা। তাকে আমরা ডাকি পলা নামে। তোমাকে থ্রিটু বা টুথ্রি নামে যদি ডাকি?’

মিশেল তাতাই পাশে আছি প্রিয়জন হোম সার্ভিসে কল করলেন। সেখান থেকে একজন এসে ডিগাকে আবার চালু করে দিয়ে গেলেন।

‘তাহলে আমার মডেল কমে যাবে। আমি তিন মাত্রার ৩২৩ মডেলের রোবট। তুমি আমাকে টুথ্রি ডাকলে আমি দুই মাত্রার ২৩ নম্বর মডেলের রোবট হয়ে যাব। সেটা আমার সম্পর্কে ভুল বার্তা দেবে।’

‘বেশ, আমি তোমাকে ডিগা বলে ডাকব। তুমি দেখতে অবিকল মানুষ। সংখ্যা দিয়ে তোমার নাম মানায় না।’

তুরির কথায় থ্রিটুথ্রি খুশি হলো, নাকি বেজার হলো, বোঝা গেল না। তবে সে আপত্তি করল না। তার নাম হয়ে গেল ডিগা।

তুরি বলল, ‘আচ্ছা ডিগা, তুমি আর আমি একদম এক রকম দেখতে। অথচ তুমি রোবট আর আমি মানুষ। বুঝব কীভাবে দুজন আলাদা?’

ডিগা বলল, ‘তোমার হৃৎস্পন্দন আছে। আমার হৃৎস্পন্দন নেই। আমার কবজি ধরে দেখো, সেখানে কোনো স্পন্দন পাবে না।’

তুরি হৃৎস্পন্দন অনুভব করতে পারে। সে ডিগার ডান হাত নিজের হাতের ভেতর তুলে নিয়ে কবজির কাছে দুই আঙুল চেপে ধরল। আশ্চর্য ব্যাপার! সেখানে হৃৎস্পন্দনের কোনো অনুভব নেই!

তুরি জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাদের অসুখ করে না?’

ডিগা বলল, ‘অনেক সময় মাদারবোর্ডে সমস্যা হয়। তা ছাড়া কোনো জটিল বিষয় নিয়ে ভাবতে গেলে প্রসেসর গরম হয়ে যায়। সিস্টেম হ্যাং করে। আমি তিন মাত্রার রোবট। তার ওপর রিকন্ডিশন। আমার প্রসেসরের অবস্থা খুবই দুর্বল। আমার ঘন ঘন হ্যাং করার আশঙ্কা আছে। তাই আমাকে কোনো জটিল প্রশ্ন করবে না।’

ডিগার কথায় তুরি ভীষণ মজা পেয়েছে। সে ঘটনাটা পরীক্ষা করে দেখতে চাইল। চোখ বড় বড় করে বলল, ‘আজ আমাদের ক্লাসে কী হয়েছে শোনো। আমাদের ক্লাসে জিটু নামে এক ছেলে আছে। ক্লাসে বসে সে দোল খাচ্ছিল। ঘটনা দেখে স্যার বিরাট ধাক্কা খেয়েছেন। জিটু স্যারের কাছে প্রথমে খেয়েছে বকা। তারপর চড় খেয়েছে। তখন হোঁচট খেয়ে ডায়াস থেকে আছাড় খেয়ে নিচে পড়েছে।’

তুরি তাকিয়ে দেখল ডিগার চেহারায় কেমন যেন অনিশ্চিত ভাব চলে এসেছে। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। তারপর চোখ পিটপিট করতে শুরু করল। তার গাঢ় নীল চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে।

তুরি বলল, ‘তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ?’

ঘসঘসে গলায় ডিগা বলল, ‘খেতে হয় চিবিয়ে, না হয় গিলে। দোল, ধাক্কা, বকা, চড়, হোঁচট, আছাড়—এসব কীভাবে চিবিয়ে কিংবা গিলে খাওয়া যায়, তা আমার মেমোরি বিশ্লেষণ করতে পারছে না। প্রসেসর গরম হয়ে যাচ্ছে।’

তুরি বলল, ‘জিটু দেয়ালের সঙ্গে ঠকাস করে গোত্তা খেল। তারপর ভিরমি খেয়ে পড়ে গেল।’

ডিগা পুরোপুরি হ্যাং হয়ে গেছে। সে কোনো সাড়াশব্দ করছে না। তাকে বারবার ডেকেও কোনো লাভ হলো না।

মিশেল তাতাই পাশে আছি প্রিয়জন হোম সার্ভিসে কল করলেন। সেখান থেকে একজন এসে ডিগাকে আবার চালু করে দিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় বললেন, ‘থ্রিটুথ্রি রিকন্ডিশন রোবট। বুঝতেই পারছেন। একটু সতর্কভাবে মানিয়ে নেবেন।’

লিলিথের সঙ্গে মিশেল তাতাইয়ের অনেকবার দেখা হয়েছে। তাকে কখনো এমন অস্থির মনে হয়নি।

মিশেল তাতাই তাদের এলাকায় নতুন একটা মেডিকেল রিসেপশন সেন্টার চালু করতে যাচ্ছেন। সেখানে সাধারণ রোগীদের চিকিত্সা দেওয়া হবে। এই এলাকায় হাঁটা দূরত্বে কোনো মেডিকেল রিসেপশন সেন্টার নেই। মানুষজনকে জরুরি চিকিত্সার জন্য কয়েক কিলোমিটার দূরে যেতে হয়।

সরকারের অনুমোদন পাওয়া গেছে। মেডিকেল রিসেপশন সেন্টার তৈরির খরচ দেবে চিচা অ্যাগ্রো ফার্ম।

আজ অফিস ছুটি। বেলা ১১টার সময় চিচা অ্যাগ্রো ফার্ম থেকে লিলিথের আসার কথা। চুক্তির ই-পেপার নিয়ে আসবেন স্বাক্ষর করাতে।

লিলিথ চলে এসেছেন সকাল সাড়ে ১০টার সময়। তার নাকি হঠাৎ কিছু কাজের তাড়া পড়ে গেছে। তাই একটু আগে চলে এসেছেন। ই-পেপার প্রস্তুত করে এনেছেন। স্বাক্ষর করে দিলেই তিনি চলে যেতে পারেন।

লিলিথের সঙ্গে মিশেল তাতাইয়ের অনেকবার দেখা হয়েছে। তাকে কখনো এমন অস্থির মনে হয়নি। আজ বেশি অস্থির মনে হচ্ছে। মিশেল তাতাই বললেন, ‘আপনি আধা ঘণ্টা আগে এসে আমার সব এলোমেলো করে দিলেন। আমার এখনই আরও একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে পনেরো মিনিটের।’

লিলিথ বললেন, ‘পেপার রেডি। আপনি স্বাক্ষর করে দিলেই কাজ শেষ।’

মিশেল তাতাই বললেন, ‘একটু বসুন। আমি ১০ মিনিটের ভেতর কাজ শেষ করে ফিরে আসছি।’

লিলিথ সময় দেখলেন। ১১টা বাজতে এখনো ২০ মিনিট বাকি আছে। মিশেল তাতাই চলে গেলেন। লিলিথ চুক্তিপত্রে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিতে থাকলেন।

ডিগা এসে তুরির পাশে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়েছে। তাকে দেখে যথেষ্ট উত্তেজিত মনে হচ্ছে। তুরি তখন আইসরক সি–প্লেনের মডেল তৈরি করছে। স্কুল প্রজেক্টের কাজ।

ডিগা বলল, ‘বসার ঘরে যে লোকটা বসে আছে, সে মানুষ নয়, অ্যান্ড্রয়েড রোবট।’

তুরি স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘হতেই পারে! তুমিও তো রোবট।’

শীতল ঘরের ভেতর মিশেল তাতাই ঘামতে শুরু করলেন। লিলিথ তার অনেক দিনের পরিচিত। অত্যন্ত ভালো মানুষ।

ডিগা বলল, ‘তাকে বিচলিত বোধ হচ্ছে। সে কিছু লুকাচ্ছে। তার ওয়েভ অতিরিক্ত জটিল ও খাপছাড়া।’

‘তুমি কেমন করে বুঝলে সে রোবট?’

শর্টওয়েভে খেয়াল করলাম তার আচরণ বিশৃঙ্খল। ঘন ঘন ধাক্কা দিচ্ছে এবং দুলছে। ফ্রিকোয়েন্সি মিলিয়ে ম্যাগনেটিভ ওয়েভ চেক করলাম। আমার মনে হচ্ছে, সে বড় ধরনের কোনো ঝামেলা করবে।’

তুরি উঠে বসার ঘরে গেল। লিলিথ ঘরের এক পাশে ডিভানে বসে আছেন। তার হাতে ই-রিডার। তিনি ই-রিডার থেকে মুখ তুলে ঘন ঘন বাড়ির ভেতরের দিকে তাকাচ্ছেন। মিশেল তাতাই এখনো ফেরেননি।

তুরির ইচ্ছা করছে লিলিথের কবজি ধরে দেখতে সেখানে হৃৎস্পন্দনের অনুভব পাওয়া যায় কি না। আচমকা লিলিথের হাত ধরা যাচ্ছে না। তুরি বলল, ‘হাই!’

লিলিথ শুকনা মুখে বললেন, হাই কিউট বেবি!

তুরি বলল, ‘তুমি কী করো?’

লিলিথ গম্ভীর গলায় বললেন, ‘আমি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট।’

তুরি অত্যন্ত খুশি হওয়ার মতো করে বলল, ‘ও তাই! তাহলে তো বেশ মজা হলো। তুমি নিশ্চয়ই অনেক ভালো অঙ্ক জানো। আমাদের অঙ্ক স্যার গতকাল ক্লাসে নতুন একটা অঙ্ক দিয়েছেন। খুব কঠিন। আমি পারছি না। তুমি একটু সহজ করে বুঝিয়ে দেবে?’

সময় চলে যাচ্ছে। পাঁচ মিনিটকে মনে হচ্ছে ২৫ মিনিট। মিশেল তাতাই আসছেন না। লিলিথের অস্থির বোধ হচ্ছে। তার মনে হলো, কন্যার সঙ্গে কথা বললে অস্থিরতা কেটে যাবে। তিনি বললেন, ‘কী অঙ্ক বলো শুনি।’

তুরি বলল, ‘তিন বন্ধু রেস্টুরেন্টে খেতে গেছে। খাওয়া শেষে ওয়েটার বিল নিয়ে এলেন। বিল হয়েছে ২৫ ইউনিট। তিন বন্ধু প্রত্যেকে ১০ ইউনিট করে ওয়েটারের হাতে ৩০ ইউনিট দিয়েছে। ওয়েটার ৩০ ইউনিট নিয়ে গিয়ে ম্যানেজারকে দিলেন। ম্যানেজার সেখান থেকে ২৫ ইউনিট রেখে ৫ ইউনিট ফেরত দিলেন। সেই ৫ ইউনিট এনে ওয়েটার দিলেন তিন বন্ধুর কাছে। তারা সেখান থেকে ওয়েটারকে ২ ইউনিট বকশিশ দিয়েছে। আর প্রত্যেকে ফেরত নিয়েছে ১ ইউনিট। তারা একেকজন বিল দিয়েছিল ১০ ইউনিট। ১ ইউনিট ফেরত পেয়েছে। তার মানে একজনের খরচ হয়েছে ৯ ইউনিট। সেই হিসাবে তিনজনের খরচ হয়েছে ২৭ ইউনিট। তারা ২ ইউনিট দিয়েছে ওয়েটারকে। ২৭ ইউনিট আর ২ ইউনিট, মোট হলো ২৯ ইউনিট। দিয়েছিল ৩০ ইউনিট। তাহলে আর ১ ইউনিট গেল কোথায়?’

লিলিথ শরীর কাত করে হাত-পা ছড়িয়ে ডিভানের পাশে ঠকাস করে পড়ে গেলেন। তখন ঘরে ঢুকলেন মিশেল তাতাই। তিনি ঘরে ঢুকে হকচকিয়ে গেছেন। ঘটনা কী ঘটেছে, বুঝতে পারলেন না। ছুটে এসে লিলিথের পালস দেখলেন। হৃৎস্পন্দন পাওয়া যাচ্ছে না। তিন আঙুল দিয়ে গলার কাছে পরীক্ষা করলেন। কোনো সাড়া নেই।

শীতল ঘরের ভেতর মিশেল তাতাই ঘামতে শুরু করলেন। লিলিথ তার অনেক দিনের পরিচিত। অত্যন্ত ভালো মানুষ। বড় কোনো অসুখ ছিল বলে শোনেননি। অথচ এখন মনে হচ্ছে, তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। দ্রুত পুলিশকে খবর দেওয়া দরকার।

ডোরবেল বাজছে। কেউ এসেছে। মিশেল তাতাই সিদ্ধান্ত নিতে অল্প কিছুক্ষণ সময় নিলেন। আগে দরজা খুলবেন, নাকি পুলিশকে খবর দেবেন? তিনি আগে দরজা খুললেন।

দরজা খুলেই মিশেল তাতাই হতভম্ব হয়ে গেলেন। তার সামনে লিলিথ দাঁড়িয়ে আছেন। লিলিথের সঙ্গে আরও একজন এসেছেন। লিলিথ হেসে বললেন, ‘ঠিক সময়মতো চলে এসেছি।’

মিশেল তাতাই ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরের ভেতর দেখার চেষ্টা করলেন। লিলিথ বললেন, ‘আপনাকে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। কোনো অসুবিধা হয়েছে?’

মিশেল তাতাই বললেন, ‘ভেতরে আসুন।’

ঘরে ঢুকে লিলিথও হতভম্ব হয়ে গেলেন। ডিভানের পাশে হাত-পা ছড়িয়ে অসাড় হয়ে তিনি পড়ে আছেন।

দরজা খুলে মিশেল তাতাই থমকে গেলেন। তিনি স্থির চোখে তাকিয়ে থাকলেন। সামনে থ্রিটুথ্রি দাঁড়িয়ে আছে।

ঘটনার কিছুক্ষণ পর পুলিশ চলে এল। ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট অদ্ভুত ব্যাপার আবিষ্কার করেছে। অনুমোদনবিহীন বেশ কিছু কোম্পানি অ্যান্ড্রয়েড রোবট তৈরি করছে। তারা বিশেষ কোনো ব্যক্তির চেহারার অ্যান্ডয়েড রোবট বানায়। তারপর সেই মানুষকে বোকা বানিয়ে ঠকায়।

বিজ্ঞান একাডেমি মানুষের চেহারার অ্যান্ড্রয়েড রোবট তৈরি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে দিল। সেন্ট্রাল অপারেটিং সিস্টেম থেকে সব অ্যান্ড্রয়েড রোবট অকেজো করে দেওয়া হলো। পাশে আছি প্রিয়জন হোম সার্ভিস থেকে একজন এসে থ্রিটুথ্রি রোবটকে নিয়ে চলে গেল।

থ্রিটুথ্রিকে যখন নিয়ে যাওয়া হয়, তখন এরিক বাসায় ছিল না। বাবা তাকে নিয়ে পার্কে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তবে তুরি মন খারাপ করেছিল ভীষণ।

সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ হলো। তুরি পড়তে বসেছে। মা–বাবা দুজনই অফিস থেকে তিন দিনের ছুটি নিয়েছেন। এই তিন দিন তারা এরিকের জন্য নতুন হ্যাপি ডে সেন্টার খুঁজে বের করবেন। অবশ্য আগের হ্যাপি ডে সেন্টারও শিগগিরই চালু হবে বলেছে।

ডোরবেল বাজছে। রাতে কেউ বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে মিশেল তাতাইয়ের খোঁজে আসে। সে রকম কেউ আসতে পারে। ডোর মনিটর দুই দিন হলো নষ্ট হয়ে আছে। সার্ভিস সেন্টারকে জানানো হয়েছে। তারা বলেছে, এ মুহূর্তে তাদের সবাই ব্যস্ত আছে। আরও এক দিন লাগবে ডোর মনিটর মেরামত করার জন্য কাউকে পাঠাতে।

মিশেল তাতাই গেলেন দরজা খুলতে। এরিক টলোমলো পায়ে হেঁটে মায়ের সঙ্গে গেছে। হাঁটতে গিয়ে এরিক যেন হুট করে পড়ে না যায়, সে জন্য তুরি গেল।

দরজা খুলে মিশেল তাতাই থমকে গেলেন। তিনি স্থির চোখে তাকিয়ে থাকলেন। সামনে থ্রিটুথ্রি দাঁড়িয়ে আছে। ‘ডিগা এসেছে, ডিগা এসেছে...’ বলতে বলতে এরিক ছুটে গিয়ে থ্রিটুথ্রির কোলে উঠে পড়ল। তুরি অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি কেমন করে এলে!’

থ্রিটুথ্রি ধীর পায়ে ঘরে ঢুকল। নরম গলায় বলল, ‘আমি রিকন্ডিশন এক রোবট। তিন মাত্রার। অনেক দিন ওয়ার্কশপে পড়ে ছিলাম। তোমরা যখন সস্তা রোবট চাইলে, তখন তারা আমাকে ঠিকঠাক করে তোমাদের কাছে পাঠিয়ে দিল। আমার জিপিএস অনেক আগেই অচল হয়ে গেছে। সেন্ট্রাল কমিউনিকেশন সিস্টেমের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। তাই বিজ্ঞান একাডেমি যখন সেন্ট্রাল থেকে অ্যান্ড্রয়েড রোবটদের সার্কিট বিচ্ছিন্ন করে দিল, তখন আমার কিছু হয়নি। আমি আগের মতোই আছি।’

আতঙ্কিত গলায় মিশেল তাতাই বললেন, ‘কিন্তু তুমি একটা রোবট। রোবট হোম সার্ভিসের খাতায় তোমার নাম আছে। তুমি থ্রিটুথ্রি।’

থ্রিটুথ্রির গলা ধরে এরিক ঝুলে আছে। হাত আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে তুরি। থ্রিটুথ্রির নীল চোখ উজ্জ্বল হয়ে গভীর নীল দেখাচ্ছে। সে বলল, ‘আমার নাম ডিগা। আমি এখানেই থাকব। এরিক আর তুরির সঙ্গে থাকব।’

মিশেল তাতাই হাসলেন। হাসিমুখে বললেন, ‘বেশ। আজ থেকে আমার ছেলেমেয়ে তিনজন।’