ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ – ৩

চেতনা ফিরে আসতে টের পেলাম, একটা বিছানায় শুয়ে আছি। আমার চারপাশে উত্তেজিত তর্ক চলছে কয়েকজন লোকের...এআই আর্ট

আগের পর্ব

চেতনা ফিরে আসতে টের পেলাম, একটা বিছানায় শুয়ে আছি। আমার চারপাশে উত্তেজিত তর্ক চলছে কয়েকজন লোকের। প্রথম কিছুক্ষণ শুধু এটুকু ধারণা হলো যে তাদের বিষয়টা বৈজ্ঞানিক। পরে মাথাটা আরেকটু খোলাসা হলে তাদের কথা বোধগম্য হলো কিছুটা।

‘কিন্তু তোমার নিকলস্ কোনো দৃষ্টান্তস্থানীয় নয়। উত্তেজনা কোডের ব্যাপারটা খুবই ব্যক্তিনির্ভর। একটা লোকের যাতে ইচ্ছাশক্তির উদ্রেক হচ্ছে, তাতে অন্য একটা লোকের একেবারে অন্য একটা ভাবের উদ্রেক হতে পারে। যেমন যে বিদ্যুৎ-উত্তেজনায় নিকলস্ আনন্দ পায়, তাতে আমার কানে তালা ধরে যায়। সেটা সইবার সময় মনে হয় যেন আমার দুকানে দুটো নল ঢোকানো হয়েছে, আর নলের দুপ্রান্তে গোঁ গোঁ করছে দুটো অ্যারোপ্লেন।’

‘তাহলেও মানুষের মস্তিষ্কের নিউরন গ্রুপগুলোর ক্রিয়াচ্ছন্দে মানুষে মানুষে অনেক সাদৃশ্য আছে। আমাদের গুরু সেটাই কাজে লাগাচ্ছেন।’

‘খুব সাফল্যের সঙ্গে নয় অবশ্য।’ বলল একটা ক্লান্ত স্বর, ‘আপাতত গাণিতিক বিশ্লেষণ ছাড়া বেশি এগোয়নি।’

‘অপরাধ একটা আপেক্ষিক কথা। সব নির্ভর করে উদ্দেশ্যের ওপর। উদ্দেশ্য মহান হলে যেকোনো পদ্ধতিই ভালো।’ এক নিঃশ্বাসে বলল আমার ডানপাশের সঙ্গীটি

‘সেটা সময়ের ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ পরীক্ষার চেয়ে পরোক্ষ পরীক্ষার গুরুত্ব বেশি। মস্তিষ্কের ভেতরে একটা ইলেকট্রোড ঢুকিয়ে সেখানে কোন প্রেরণা সচল, তা দেখা তো সম্ভব নয়। তাতে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ফলে প্রেরণাটাও। কিন্তু একটা জেনারেটরের ক্ষেত্রে কোডবদ্ধ প্রেরণা পরিবর্তনের একটা ব্যাপক পরিধি মেলে। তাতে মস্তিষ্কের ক্ষতি না করেও পরীক্ষা চালানো যায়।’

‘যাই বলো,’ শোনা গেল সেই ক্লান্ত স্বরটা, ‘গোরিন আর ভয়েডের ব্যাপারটায় সে কথা সমর্থিত হচ্ছে না। ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ন্ত্রণক্ষেত্রে রাখার দশ সেকেন্ডের মধ্যে মারা যায় গোরিন, সেখানে পাঁচের দশ সেকেন্ড অন্তর অন্তর সত্তর ফ্রিকোয়েন্সির উত্তেজনা-প্রেরণা দেওয়া হয়েছিল পরপর দশটি। আর ভয়েড যন্ত্রণায় এমন চিৎকার করে ওঠে যে সঙ্গে সঙ্গে জেনারেটর বন্ধ করে দিতে হয়। নিউরোকিবারনেটিকসের প্রধান কথাটাই তুমি ভুলে গেছ ভায়া, সেটা হলো মানবদেহে নিউরন জাল থেকে অসংখ্য সিন্যাপস জাগে—এরা যে প্রেরণা সঞ্চালন করে, তার নিজস্ব ফ্রিকোয়েন্সি আর কোড আছে। এই স্বাভাবিক ফ্রিকোয়েন্সির সঙ্গে বিদ্যুৎ ফ্রিকোয়েন্সির সঙ্গতি ঘটে, অনুরণন হলেই মস্তিষ্কের সার্কিট প্রচণ্ড উত্তেজিত হতে পারে। ডাক্তার কাজ চালাচ্ছে বলা যেতে পারে অন্ধের মতো। এখনো যে আমরা বেঁচে আছি, সেটা নেহাৎই দৈবাৎ।’

এই সময় চোখ মেললাম আমি। যে ঘরটায় শুয়ে আছি, সেটা একটা হাসপাতালের বড় ওয়ার্ডের মতো, দেয়াল বরাবর বিছানার সারি। মাঝখানে একটা মস্ত কাঠের টেবিল, ভুক্তাবশিষ্ট, খালি টিন, সিগারেটের টুকরোয় তা আকীর্ণ। আবছা আলো আসছে একটা বিজলি বাতি থেকে। কনুইয়ে ভর দিয়ে চারদিকে চেয়ে দেখলাম। সঙ্গে সঙ্গে আলাপ থেমে গেল।

সবচেয়ে যা খারাপ হওয়া সম্ভব, তা-ই ঘটেছে। সত্যি সত্যিই পাগলাদের মধ্যে এসে পড়েছি আমি
এআই আর্ট

‘কোথায় আমি?’ আমার দিকে চেয়ে থাকা মুখগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলাম অস্ফুটস্বরে।

কে একজন বলল, ‘নতুন লোকটার জ্ঞান ফিরেছে।’

‘আমি কোথায়?’ ওদের সবার উদ্দেশে ফের জিজ্ঞাসা করলাম।

আমার ডান দিকে আন্ডারওয়্যার পরা একটা লোক বসে ছিল বিছানার ওপর। সে বলল, ‘সে কি, আপনি জানেন না? এ হলো আমাদের স্রষ্টা ও গুরু ক্রাফৎশ্‌তুদতের ফার্ম।’

‘স্রষ্টা ও গুরু?’ লোহার মতো ভারি কপালটা রগড়ে বললাম, ‘কী বলছেন, গুরু? সে যে একজন যুদ্ধাপরাধী!’

‘অপরাধ একটা আপেক্ষিক কথা। সব নির্ভর করে উদ্দেশ্যের ওপর। উদ্দেশ্য মহান হলে যেকোনো পদ্ধতিই ভালো।’ এক নিঃশ্বাসে বলল আমার ডানপাশের সঙ্গীটি।

সবচেয়ে যা খারাপ হওয়া সম্ভব, তা-ই ঘটেছে। সত্যি সত্যিই পাগলাদের মধ্যে এসে পড়েছি আমি। সবচেয়ে আশ্চর্য, এদের সবার বাতিকই এক: আমার অনুভূতির ওপর কোনো একটা কোড ও প্রেরণার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া

এই ইতর ম্যাকিয়াভেলিপনায় অবাক হয়ে কৌতূহলে তাকালাম লোকটার দিকে।

‘এই জ্ঞান আপনি কোথা থেকে আহরণ করেছেন যুবক?’ পা ঝুলিয়ে আমি বসলাম ওর মুখোমুখি।

‘হের ক্রাফৎশ্‌তুদৎ আমাদের স্রষ্টা ও গুরু।’ হঠাৎ পরস্পরকে বাধা দিয়ে বলতে লাগল সবাই।

বিষন্নচিত্তে ভাবলাম, বটে, ‘জ্ঞানীগৃহেই’ এসে পড়েছি তাহলে।

‘সত্যিই, আপনারা যদি তাই ভাবেন, তবে অবস্থা আপনাদের খুব খারাপই বলতে হবে,’ বললাম ওদের দিকে ফের একবার চোখ বুলিয়ে।

‘বাজি রেখে বলতে পারি, এই নতুন লোকটার গণিত এলাকা থাকবে নব্বই থেকে পঁচানব্বই চক্রের ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডে।’ বিছানা থেকে অল্প একটু গা তুলে চেঁচিয়ে উঠল একজন তাগড়া লোক।

‘আর যন্ত্রণা জাগবে ১৪০ চক্রের বেশিতে নয়, সুষম ত্বরান্বিত প্রেরণার কোডে।’ হাঁকল আরেকজন।

‘আর দুসেকেন্ড পরপর সেকেন্ডে ৮ প্রেরণার কোড সঞ্চালন করলেই ঘুমুবে।’

‘আর প্রেরণার শক্তির লগারিদমিক বৃদ্ধিসহ ১০৩ চক্রে প্রেরণা হলে ক্ষিদে পাবে লোকটার।’

আরও পড়ুন

সবচেয়ে যা খারাপ হওয়া সম্ভব, তা-ই ঘটেছে। সত্যি সত্যিই পাগলাদের মধ্যে এসে পড়েছি আমি। সবচেয়ে আশ্চর্য, এদের সবার বাতিকই এক: আমার অনুভূতির ওপর কোনো একটা কোড ও প্রেরণার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া। সবাই তারা আমায় ঘিরে ধরে সোজাসুজি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হাঁকতে লাগল কতকগুলো অঙ্ক, কত মডুলেশন, কত প্রখরীকরণে জেনারেটরের অভ্যন্তরে আর দেয়ালের মাঝখানে কী প্রতিক্রিয়া ঘটবে আমার এবং কতটা শক্তি দরকার হবে।

বই পড়ে জানা ছিল, পাগলের কথায় কখনো প্রতিবাদ করতে নেই। তাই ঠিক করলাম, কোনোরকম তর্ক না করে তাদেরই মতো ব্যবহার করার চেষ্টা করব। তাই যথাসম্ভব নিরীহ স্বরে আলাপ শুরু করলাম ডানপাশের লোকটার সঙ্গে। মনে হলো অন্য সবার চেয়ে সে-ই একটু স্বাভাবিক।

‘আচ্ছা বলবেন কি, কী নিয়ে আলাপ করছেন আপনারা? সত্যি বলতে কি ও বিষয়টা আমার একেবারে জানা নেই। এই সব কোড, প্রেরণা, নিউরন, উত্তেজন...’

হো হো হাসিতে ঘর ফেটে গেল। হেসে লুটোপুটি খেতে লাগল সবাই। রেগে উঠে দাঁড়ালাম, ইচ্ছে হচ্ছিল ধমকে দিই সবাইকে। হাসি কিন্তু থামল না।

‘১৪ নং সার্কিট; ৮৫ চক্রের ফ্রিকোয়েন্সি! ক্রোধের উত্তেজনা।’ চেঁচিয়ে উঠল একজন, সঙ্গে সঙ্গে আরও হররা উঠল হাসির।

তখন বিছানায় বসে ঠিক করলাম, হাসি থেমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাক।

সবার আগে হাসি থামল আমার ডানপাশের লোকটির। আমার বিছানায় বসে সে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে।

‘মানে, সত্যিই কিছু জানো না তুমি?’

‘দিব্যি দিয়ে বলছি, কিছুই জানি না। এ সব একটা কথাও মাথায় ঢুকছে না।’

‘সত্যি বলছ?’

‘সত্যি বলছি।’

বই পড়ে জানা ছিল, পাগলের কথায় কখনো প্রতিবাদ করতে নেই। তাই ঠিক করলাম, কোনোরকম তর্ক না করে তাদেরই মতো ব্যবহার করার চেষ্টা করব। তাই যথাসম্ভব নিরীহ স্বরে আলাপ শুরু করলাম ডানপাশের লোকটার সঙ্গে

‘বেশ, তোমার কথাই বিশ্বাস করছি, যদিও এমন ঘটেছে খুবই কম। ডেনিস উঠে বসে এই নতুনটাকে একটু বুঝিয়ে বলো, কেন আমরা এখানে।’

‘হ্যাঁ ডেনিস, বুঝিয়ে বলো ওকে। সে-ও আনন্দে থাক আমাদের মতো।’

‘আনন্দ?’ জিজ্ঞেস করলাম অবাক হয়ে, ‘আনন্দে আছ তোমরা?’

‘অবশ্যই, অবশ্যই আনন্দে আছি।’ চেঁচিয়ে উঠল সবাই, ‘আত্মজ্ঞান হয়েছে আমাদের। মানুষের চরম সুখ হলো যখন সে নিজেকে জানে।’

‘আগে জানতে না নিজেদের?’ অবাক হলাম।

‘নিশ্চয় না। মানুষ নিজেকে জানে না। কেবল যারা নিউরোকিবারনেটিক বিদ্যা জানে, তাদেরই আত্মজ্ঞান সম্ভব।’

‘জয় হোক আমাদের গুরুর!’ কে যেন ধ্বনি দিল।

‘জয় হোক আমাদের গুরুর!’ যন্ত্রের মতো প্রতিধ্বনি করল সবাই।

ওরা যাকে ডেনিস বলেছিল, সে এসে বসল আমার পাশের বিছানায়। ফাঁপা, ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কতদূর পড়েছ, বলো তো?’

‘আমি পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক!’

‘নিউরোসাইকোলজির কিছু জানো?’

‘কিছু না।’

‘কিবারনেটিকস বিদ্যা?’

‘ঝাপসা।’

‘নিউরোকিবারনেটিকস আর জৈবিক নিয়ন্ত্রণের সাধারণ তত্ত্ব?’

‘বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।’

বিস্ময়ের ধ্বনি উঠল ঘরে।

ডেনিস বলল, ‘কোনো আশা নেই। কিছু বুঝতে পারবে না ও।’

‘তবু চালিয়ে যাও দয়া করে। বোঝার চেষ্টা করব যথাসাধ্য।’

‘বিশ দফা জেনারেটরে গেলেই ঠিক বুঝে যাবে।’ কে যেন বলল।

‘আমি বুঝতে পেরেছিলাম পাঁচবারের পর!’ হাঁকল একজন।

‘দেয়ালের মধ্যে বার দুয়েক থাকলেই বেশি কাজ হবে।’

‘সে যাই হোক, ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলুন, ডেনিস,’ জেদ ধরলাম আমি। ভয় পেয়ে বসল আমায়।

‘আচ্ছা, জীবন জিনিসটা কী, তা বোঝ?’

কথা না বলে বহুক্ষণ চেয়ে রইলাম ডেনিসের দিকে।

অবশেষে বললাম, ‘জীবন একটা জটিল প্রাকৃতিক ঘটনা।’

কে একবার জোরে হিহি করে উঠল। দ্বিতীয়বার হিহি। আরও আরও।

ঘরের সবাই আমার দিকে তাকাল এমনভাবে যেন কী একটা অশ্লীল বাজে কথা বলেছি। কেবল ডেনিস মাথা নাড়ল ভর্ৎসনাভরে।

‘তোমার হাল খুব খারাপ। অনেক কিছুই শিখতে হবে।’

‘ভুল বলে থাকলে, বলো কোথায় ভুল?’

‘বুঝিয়ে দে ওকে ডেনিস, বুঝিয়ে দে,’ সমস্বরে চেঁচাল সবাই।

‘বেশ, শোনো। জীবন হলো তোমার দেহযন্ত্রের নিউরনের মধ্য দিয়ে কোডবদ্ধ বৈদ্যুতিক রাসায়নিক উত্তেজনার অবিরত সঞ্চালন।’

ঘরের সবাই আমার দিকে তাকাল এমনভাবে যেন কী একটা অশ্লীল বাজে কথা বলেছি। কেবল ডেনিস মাথা নাড়ল ভর্ৎসনাভরে

একটু ভাবলাম। নিউরনের মধ্য দিয়ে উত্তেজনার সঞ্চালন। এরকম কথা আগেও কোথাও শুনেছি বলে মনে হলো।

‘বেশ, বলে যাও।’

‘যে সব সংবেদন দিয়ে তোমার আত্মিক অহং তৈরি, সেটা আর কিছু নয়, কেবল কতকগুলো বিদ্যুৎ-রাসায়নিক প্রেরণা, গ্রাহক-ইন্দ্রিয় থেকে তা বাহিত হয়ে পৌঁছায় মস্তিষ্কের উচ্চতম রেগুলেটরে, সেখানে জারিত হয়ে ফিরে আসে কারক ইন্দ্রিয়ে।’

‘বেশ, তারপর?’

‘বহির্জগতের সব সংবেদন স্নায়ুতন্তু দিয়ে পৌঁছায় মস্তিষ্কে। প্রতিটি সংবেদনের আছে নিজস্ব কোড, ফ্রিকোয়েন্সি ও বিস্তারের গতি। আর এই তিনটি জিনিসের ওপরেই নির্ভর করে তার চরিত্র, প্রখরতা ও স্থায়িত্ব। বুঝলে?’

‘ধরলাম তা-ই।’

‘সুতরাং জীবন আর কিছু নয়, তোমার স্নায়ুতন্তু বেয়ে কোডবদ্ধ সংবাদের গতি। তার কমও নয়, বেশিও নয়। চিন্তা হলো স্নায়ুব্যবস্থার কেন্দ্রস্থলে, অর্থাৎ মস্তিষ্কের নিউরন-সিন্যাপসগুলোতে নিয়ন্ত্রিত ফ্রিকোয়েন্সির সংবাদ সঞ্চালন।’

স্বীকার করলাম, ‘ঠিক মাথায় ঢুকছে না।’

‘ব্যাপারটা এই। মস্তিষ্ক হলো প্রায় এক হাজার কোটি নিউরন দিয়ে গড়া—এগুলো অনেকটা বৈদ্যুতিক রিলের মতো। পরস্পরের সঙ্গে গ্রুপ ও আংটির আকারে তারা সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে বিশেষ তন্তু মারফত, এই সংযোগ তন্তুগুলোকে বলে অ্যাক্সন। এক নিউরন থেকে আরেক নিউরনে উত্তেজনা বাহিত হয় এগুলো দিয়ে, এক নিউরন গ্রুপ থেকে আরেক গ্রুপে। বিভিন্ন নিউরনের ওপর উত্তেজনার এই ভ্রমণকেই আমরা বলি চিন্তা।’

আরও ভয় পেয়ে গেলাম আমি।

‘জেনারেটরে কিংবা দেয়ালের মধ্যে না যাওয়া পর্যন্ত ও কিছুই বুঝবে না।’ একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল কয়েকজন।

‘ধরে নিলাম তোমার কথা ঠিক। কিন্তু তা থেকে কী দাঁড়াচ্ছে?’ ডেনিসকে বললাম আমি।

‘দাঁড়াচ্ছে এই যে জীবনকে খুশি মতো গড়ে নেওয়া যায়। তা করা যায় প্রেরণা জেনারেটরের মারফত, যা নিউরন-সিন্যাপসগুলোতে প্রয়োজনীয় কোডের উত্তেজনা ঘটাবে। এ জিনিসটার ব্যবহারিক তাৎপর্য প্রচণ্ড।’

‘তার মানে,’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম আমি, টের পাচ্ছিলাম ক্রাফৎশ্‌তুদৎ ফার্মের কাজের রহস্য এবার স্বচ্ছ হয়ে ওঠার উপক্রম হয়েছে।

‘একটা উদাহরণ দিয়ে তা ভালো বোঝানো যায়। ধরা যাক, গাণিতিক কর্মের উত্তেজনা। পশ্চাৎপদ দেশেরা বর্তমানে ইলেকট্রনিক কম্পিউটার তৈরি করছে। এসব যন্ত্রে ট্রিগার বা রিলের সংখ্যা পাঁচ থেকে দশ হাজারের বেশি নয়। কিন্তু মানবমস্তিষ্কের গাণিতিক এলাকায় ট্রিগারের সংখ্যা প্রায় একশ কোটি। এর কাছাকাছি একটা সংখ্যার ট্রিগার আছে, এমন যন্ত্র কেউ কখনো তৈরি করতে পারবে না।’

‘বেশ, কী হলো তাতে?’

‘সুতরাং জীবন আর কিছু নয়, তোমার স্নায়ুতন্তু বেয়ে কোডবদ্ধ সংবাদের গতি। তার কমও নয়, বেশিও নয়। চিন্তা হলো স্নায়ুব্যবস্থার কেন্দ্রস্থলে, অর্থাৎ মস্তিষ্কের নিউরন-সিন্যাপসগুলোতে নিয়ন্ত্রিত ফ্রিকোয়েন্সির সংবাদ সঞ্চালন।’

‘হলো এই: গাণিতিক সমস্যা যেকোনো মহার্ঘ যন্ত্রের চেয়ে অনেক দক্ষতার সঙ্গে এবং সুলভে সমাধান করা যায় এমন একটা ব্যবস্থায় যা প্রকৃতিমাতা নিজেই সৃষ্টি করে স্থাপিত করেছে এখানে।’ কপালের ওপর হাত বুলিয়ে দেখাল ডেনিস।

‘কিন্তু যন্ত্র কাজ করে অনেক তাড়াতাড়ি,’ আমি বলে উঠলাম, ‘যত দূর মনে পড়ে, একটা নিউরনকে সেকেন্ডে দুই শ বারের বেশি উত্তেজিত করা যায় না, অথচ একটা ইলেকট্রনিক ট্রিগার লক্ষ লক্ষ প্রেরণা নিতে পারে। সে জন্যই দ্রুতক্রিয় যন্ত্রগুলো এত সুবিধাজনক।’

ফের হাসির হররা উঠল ঘরে। মুখ গম্ভীর করে রইল কেবল ডেনিস।

‘এখানেই তোমার ভুল। যদি উত্তেজকটার ফ্রিকোয়েন্সি হয় যথেষ্ট উঁচু, সে ক্ষেত্রে যেকোনো গতিতে প্রেরণা গ্রহণ করতে পারে নিউরন। তা করা যায় একটা ইলেকট্রোস্ট্যাটিক জেনারেটর দিয়ে, যা কাজ করছে প্রেরণাদায়ক একটা ব্যবস্থায়। এ রকম জেনারেটরের বিকিরণক্ষেত্রের মধ্যে মস্তিষ্ককে রাখলে তা যেকোনো গতিতে কাজ করতে পারে।’

‘ক্রাফৎশ্‌তুদৎ কোম্পানি তাহলে এই উপায়েই টাকা কামায়!’ চেঁচিয়ে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠলাম আমি।

‘তিনি আমাদের গুরু,’ সমস্বরে চিৎকার করে উঠল সবাই, ‘তুমিও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে বলো, তিনি আমাদের গুরু।’

‘ছেড়ে দাও ওকে,’ ডেনিস হুকুম করল হঠাৎ, ‘যথাসময়ে ও বুঝবে যে হের ক্রাফৎশ্‌তুদৎ আমাদের গুরু। এখনো ও কিছুই জানে না। এই কথাটা মনে রেখো হে, প্রতিটি অনুভূতির নিজস্ব কোড, প্রখরতা ও স্থায়িত্ব আছে। সুখের অনুভূতি হলো ১০০ প্রেরণার এক একটা কোড সিরিজের সেকেন্ডে ৫০ সাইকেল। দুঃখের অনুভূতি হলো ৬২ চক্র, দুই স্পন্দনের মধ্যে ০.১ সেকেন্ড বিরতি। আনন্দের অনুভূতি—৪৭ চক্র, প্রেরণার শক্তি অনুসারে ক্রমবর্ধমান প্রখরতা। বিষাদের অনুভূতি—১৪ চক্র, কাব্যিক মেজাজ—৩১, ক্রোধ—৮৫, ক্লান্তি—১৭, নিদ্রাতুরতা—৮ চক্র ইত্যাদি। এ সব ফ্রিকোয়েন্সিতে কোডবদ্ধ প্রেরণা নিউরনের বিশেষ বিশেষ সিন্যাপসগুলোর ওপর সচল হয়, তাই যা বললাম সে সব অনুভূতির অভিজ্ঞতা হয়। আমাদের গুরুর তৈরি একটা প্রেরণা জেনারেটরে তা সবই উৎপন্ন করা যায়। জীবনের অর্থ কী, সেদিকে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন তিনি।’

আরও পড়ুন

এ সব কথা শুনে মাথা ঘুরছিল। কী যে ভাবব, তার দিশা পাচ্ছিলাম না। হয় এসবই নিতান্ত উন্মাদ প্রলাপ, নয়তো সত্যিই এমন একটা কিছু, যাতে মানবজীবনের নতুন একটা দিক উন্মোচিত হচ্ছে। তখনো মাথায় অজ্ঞানের ওষুধটার ক্রিয়া কাটেনি। ক্লান্তিতে দেহ অবশ হয়ে এল। শুয়ে পড়ে চোখ বুজলাম।

‘ওর ফ্রিকোয়েন্সি এখন সাত থেকে আট চক্র! ঘুম পাচ্ছে ওর!’ কে একজন বলল।

‘ঘুমোক। কাল থেকে ওর আত্মজ্ঞান শুরু হবে। জেনারেটরের কাছে ওকে নিয়ে যাওয়া হবে কাল।’

‘না, কাল রেকর্ড করা হবে ওর স্পেকট্রাম ছক। অস্বাভাবিকতা থাকতে পারে কিছু।’

আর কিছু কানে আসেনি। গভীর ঘুমে ঢলে পড়েছিলাম।

মূল: আনাতলি দনে্‌প্রভ

অনুবাদ: ননী ভৌমিক

(চলবে…)

 * সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত গল্প সংকলন গ্রহান্তরের আগুন্তুক থেকে নেওয়া।