ভিনগ্রহের ক্রিকেটার - পর্ব ২

পরদিন স্কুলে এক হুলুস্থুল কাণ্ড দেখা গেল। সোহান তার প্যান্ট উল্টো করে পরে এসেছে। প্যান্টের বোতাম, জিপার—সব পেছন দিকে আর পেছনের পকেটটা সামনের দিকে। শুধু যে প্যান্ট এভাবে পরেছে, তা–ই নয়; শার্টও উল্টো করে পরে সে আবার ইন করেছে। তাকে যে দেখছে, সেই হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কিন্তু সোহান গম্ভীর।

বাংলার স্যার জয়েনউদ্দীন ক্লাস টিচার। তিনি ক্লাসে ঢুকতেই ক্লাস ক্যাপ্টেন আবদাল উঠে দাঁড়াল। স্যার, সোহান...সে ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না। তার শুধু হাসি পাচ্ছে।

কী হলো, হাসি থামা। বল।

স্যার, সোহান...আবদাল কিছুতেই বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারে না। সে খালি হাসে।

স্যার সোহানের দিকে তাকালেন। প্রথমে ঠিক বুঝতে পারলেন না। খানিক পর ভালোমতো দেখে তিনি নিজেই হাসতে লাগলেন খিলখিল করে। তারপর অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, কী ব্যাপার, এ অবস্থা কেন?

সোহান বলল, গামা স্যার, থুক্কু ওয়ালিউর রহমান স্যার দেখতে চেয়েছেন।

জয়েন স্যার বললেন, ওয়ালিউর স্যার দেখতে চেয়েছেন, তাহলে তুই আমার ক্লাসে এই রকম জোকার সেজে এসেছিস কেন?

সোহান বলল, স্যার আমি তো স্কুল ড্রেসই পরে এসেছি। কোথাও তো স্যার লেখা নাই স্কুল ড্রেসের কোনটা সামনে কোনটা পেছনে...

স্যার বললেন, তা লেখা নাই। তাই বলে কি তুই শার্ট নিচে পরে প্যান্টটা কাঁধে জড়িয়ে আসবি! তোর নিজের কোনো আক্কেল নাই? হেড স্যার দেখলে তো তোকে বের করে দেবেন রে হতভাগা। নে, শার্টটা এখনই খুলে ঠিক করে পর। আর শার্টটা ইন করার দরকার নাই। প্যান্টটা ঢাকা থাকুক। আর শোন, মেরে তোর হাড্ডি যে গুঁড়া করলাম না, তার একটা কারণ আছে। আমাদের স্কুলে ইন্টারক্লাস ক্রিকেট শুরু হতে যাচ্ছে। আমি চাই, ক্লাস সেভেন এই স্কুলে চ্যাম্পিয়ন হোক। তুই তো আবার খালি দুষ্টুমিতে সেরা না, ক্রিকেটটাও ভালো খেলিস। এখন তোকে মেরে যদি আমি ইনজুরড বানিয়ে দিই, তাহলে এ রকম একটা অলরাউন্ডার আমরা আর কোথায় পাব। এই জন্যে তোকে আজ মারলাম না। খেলাটা হয়ে যাক, যদি চ্যাম্পিয়ন হতে না পারিস, তখন বুঝবি, মার কাকে বলে। স্যারের ঘোষণার সাথে সাথে পুরো ক্লাস গুনগুন করে উঠল। ইন্টারক্লাস ক্রিকেট, কী মজাটাই না হবে।

সোহান বলল, স্যার আমি তো স্কুল ড্রেসই পরে এসেছি। কোথাও তো স্যার লেখা নাই স্কুল ড্রেসের কোনটা সামনে কোনটা পেছনে...

মিজান কিন্তু চুপচাপ বসে আছে তার ক্লাসে। তার মন খুব খারাপ। ক্লাসের ছেলেগুলো তাকে ডাকে গাধা মিজান বলে। সে পড়াশোনাতে তেমন ভালো না।

আবার খেলাধুলাতে রীতিমতো খারাপ। তার হাতে জোর নেই। ক্রিকেট বল সে ছুড়তে পারে না। মারে জোর হয় না। ব্যাটিং করার চেষ্টা করেও সে কখনো সুবিধা করতে পারেনি। সব সময়ই তার ব্যাট নড়ার আগেই বল চলে যায়। আবার সে যখন খুব প্রস্তুতি নিয়ে আগেভাগে ব্যাট চালিয়ে দেয়, দেখা যায়, তার অনেক পরে বল আসছে; অর্থাৎ কিনা টাইমিংটাই সে ঠিকমতো করে উঠতে পারে না।

জয়েন স্যার বললেন, আজ টিফিন পিরিয়ডের পর আর ক্লাস হবে না। সবাই মাঠে যাবি। আমি থাকব। ড্রিল স্যার থাকবেন। আজ ক্রিকেট খেলার প্র্যাকটিস হবে। আমরা দেখব, কে কেমন খেলে। তারপর কাল-পরশু টিম সিলেক্ট করা হবে।

এটা শুধু সিলেকশন টেস্ট না, তোদের ফার্স্ট টার্মিনালের গেমস পরীক্ষাও।

টিফিনের পর ক্লাস সেভেনের ছেলেরা মাঠে গিয়ে হাজির। সবার মনেই দারুণ উৎসাহ। স্যাররা এখনো আসেননি। ছেলেরা নিজেরাই প্র্যাকটিস করছে। কেউ বল করছে, কেউ ব্যাট! বাকিরা ফিল্ডিং। মাঠে প্রায় ৩০ জন ছাত্র ঢুকে পড়েছে। ক্লাস ক্যাপ্টেন আবদাল চিৎকার করে বলছে, এই, সবাই মাঠে কেন? ২ জন ব্যাট করো, ১১ জন ফিল্ডিং, বাকিরা বাইরে। মোট ১৩ জন মাঠে থাকতে পারবে।

তার কথা কেউ শুনছে না।

আবীর বলল, সোহান যা তো, ব্যাট কর। এই আবদাল চামচিকাটার মাথা টার্গেট করে একটা স্ট্রেট ড্রাইভ মার। এত ফচফচ করে ক্যান?

সোহান ব্যাট হাতে নিয়ে দাঁড়াল স্ট্যাম্পের সামনে। আবীর বল করছে। সহজ বল। আবীর সপাটে ব্যাট হাঁকাল। বল আকাশে উঠে গেল। ওই দিকে দাঁড়িয়ে আছে মিজান। সবাই চিৎকার করে বলতে লাগল, মিজান, ক্যাচ ইট। ধর, ধর। মিজান গিয়ে বলটার নিচে দাঁড়াল। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে আর বল খুঁজে পাচ্ছে না। বল এসে পড়ল তার সামনে। সে হাতটাও লাগাতে পারল না বলে।

দৌড়ে এসে বল কুড়িয়ে নিল গণেশ। সে হলো শহরের মিষ্টির দোকানদার নগেন বাবুর ছেলে। বাড়িতে সারাক্ষণ ভালো দুধ-ছানা-ননী খেয়ে খেয়ে তার আকারটা হয়েছে মাশা আল্লাহ একেবারে একটা ছোটখাটো হাতি। সে যখন হাঁটে, তখন ধরণি বলে, আমি কেন দ্বিধা হচ্ছি না, এই ওজন আমার পক্ষে সহ্য করা সত্যি মুশকিল।

গণেশ বল কুড়িয়ে নেবার সঙ্গে সঙ্গে সবাই হইহই করে উঠল। কেননা, তার দৌড়ানো, বল কুড়াতে উপুড় হওয়া—সবকিছুই ছেলেদের কাছে এক মজার ব্যাপার।

গণেশ বল কুড়িয়ে নিয়ে ছুড়ে মারল আবীরের দিকে, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। বল গিয়ে লাগল সোজা আবদালের পিঠে। সে–ও বাবাগো–মাগো বলে পিঠ হাতড়াতে লাগল। কিন্তু তার হাত পিঠের যথাস্থানে পৌঁছল না।

আবদালের লাফালাফি তখন দেখে কে? মনে হচ্ছে, একটা ফড়িং লাফাচ্ছে। সোহান চিৎকার করে উঠল, হাউ ইজ দ্যাট। আবীর বলল, শাবাশ গণেশ শাবাশ। তোকে আজ যদি একটা আস্ত চমচম না খাওয়াই...

আবদাল লাফানো বন্ধ করে বলল, ভালো হবে না আবীর।

আবীর বলল, আমি কী করলাম?

গণেশকে শাবাশ শাবাশ বলছিস কেন? উরে, আমার পিঠটা চিনচিন করছে রে!

আবীর বলল, আমার ফিল্ডারকে আমি উৎসাহ দেব না! নে, ফিল্ডিং কর। মিজানের কিন্তু মনটা আরও দমে গেল। এ রকম একটা ক্যাচও সে ধরতে পারল না।

মিজান মাঠের বাইরে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। আর ভাবছে, এভাবে চললে তার পালা আসতে কত দিন লাগবে। ইশ্‌ তার আগে যদি ভূমিকম্প এসে দুনিয়াটা ধ্বংস করে দিত

জয়েন স্যার এলেন একটু পর। ড্রিল স্যার এলেন হাফপ্যান্ট পরে। তাঁর পায়ে কেডস। মাথার টাকটা তিনি ঢেকেছেন সাদা ক্যাপে। ড্রিল স্যারের পকেটে বাঁশি। তিনি বাঁশিতে ফুঁ দিলেন। হাঁক ছাড়লেন, বয়েজ, কাম হেয়ার । হারি আপ। মেক আ লাইন।

সবাই লাইন করে দাঁড়াল।

ড্রিল স্যার বললেন, আজ আমি দেখব কে কেমন বল করে। আর কে কেমন ব্যাট করে। রোল ১ থেকে ১১ পর্যন্ত আজ ১ ওভার করে বল করবে। আর ১২ থেকে ২২ পর্যন্ত ১ ওভার করে ব্যাট করবে। আর বাকিরা মাঠের চারদিকে গিয়ে দাঁড়াও। বাউন্ডারি হলে আজ তোমাদের বল কুড়াতে হবে।

মিজান একটু স্বস্তি পেল। কারণ, সে ক্লাসের একদম লাস্ট বয়। তার রোল ৪৬। আজ আর তাকে বল–ব্যাট কিছুই করতে হচ্ছে না। সে মাঠের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

ক্লাসের ফার্স্ট বয় স্বাধীন। তার অবস্থাও বেশি ভালো না। চোখে চশমা। লিকলিকে শরীর। তার হাতেও জোর নেই। সে বল করবে। আর ব্যাট করবে রোল ১২, শান্ত। শান্ত প্যাড পরে নিল। মাথায় হেলমেট। তাকে বেশ দেখাচ্ছে। রোল ১৩ হাসিবও রেডি হচ্ছে।

স্বাধীন বল ধরেছে মেয়েদের মতো। কাঁধের ওপর বল তুলে সে ঢিল মারছে। জয়েন স্যার হেসেই খুন। বললেন, স্বাধীন, তুই বরং আম্পায়ার হ। বইয়ের দোকানে গিয়ে তুই ক্রিকেট খেলার নিয়মকানুন বইটা কিনে নিবি। বুঝলি?

মিজান মাঠের বাইরে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। আর ভাবছে, এভাবে চললে তার পালা আসতে কত দিন লাগবে। ইশ্‌ তার আগে যদি ভূমিকম্প এসে দুনিয়াটা ধ্বংস করে দিত।

আরও পড়ুন

8

মিজানের মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল বাসার একটা ঘটনায়। সে ছিল বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তার বাবা আর মা দুজনেই তাকে খুবই আদর করতেন। কিন্তু কিছুদিন আগে তার একটা ছোট ভাই হয়েছে। তার নাম এখনো রাখা হয়নি। তবে মা তাকে ডাকছেন ময়না বলে। এই ময়নাকে মিজান খুবই আদর করে। তাকে কোলে নিতে চায়। কিন্তু তার মা ময়নার জন্মের পর থেকেই মিজানের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার শুরু করেছেন। তাকে মায়ের ঘরে ঢুকতে দেন না। বাবা অবশ্য এখনো মিজানকে খুব ভালোবাসেন। কালকের ঘটনা। মিজান ময়নার ঘরে ঢুকে ময়না কেমন আছ বলে বাবু সোনা উ–উ–উ করছিল, মা তখন ছিলেন গোসলখানায়। তিনি ঘরে ঢুকে যেই দেখলেন মিজানকে, প্রায় পাগলের মতো চিৎকার করে উঠলেন । এই ছোড়া তুই এই ঘরে ঢুকে পড়েছিস কেন? ভাগ ভাগ।

মিজানের কানে ধরে মা এমন করে টান দিলেন যে ব্যথায় তার কান একেবারে অচল হয়ে পড়ল। সে কাঁদতে কাঁদতে ওঘর থেকে বেরিয়ে এল। তখন তার সঙ্গে দেখা বাবার। বাবা বললেন, কী রে মিজান, কী হয়েছে। আয় বাবা, কাছে আয়। বাবা তাকে কাছে টেনে নিলেন। তার চোখের পানি মুছিয়ে দিলেন। তারপর তাকে পাড়ার দোকানে নিয়ে খাওয়ালেন আলুপুরি। আলুপুরি আবার মিজানের বিশেষ রকম প্রিয়।

বাবা বললেন, মিজানরে, তোর মায়ের ব্যবহারে বিশেষ কিছু মনে করিস না। বাচ্চা হওয়ার পর মায়েদের নানা সমস্যা হয়। কেউ কেউ আছে নিজের বাচ্চাকে দেখতে পারে না। কেউ কেউ আছে আবার ছোট বাচ্চাটাকে বাঘের মায়ের মতো যত্ন করে পাহারা দিয়ে রাখে।

মিজান বাবার কথা কিছু বুঝল, কিছু বুঝল না।

কিন্তু মায়ের বাচ্চা হওয়ার কাজে সাহায্য করতে যে দাইকে আনা হয়েছে, তিনি কিন্তু তাকে আজ অন্য কথা বলেছেন। বুড়ি বসে ছিলেন বাড়ির ভেতরের বারান্দায়। একটা চিরুনি দিয়ে বুড়ি মাথার চুল আঁচড়াচ্ছেন আর বিকেলের হলুদ রোদ গায়ে মাখছেন। মিজান স্কুল থেকে এসে বই–খাতা রেখে হাতমুখ ধোবার জন্যে যাচ্ছে কলতলায়।

দাইমা বুড়ি বললেন, কে মিজান। কী বাবা, স্কুল ছুটি হলো! যা হাতমুখ ধুয়ে নিয়ে ভাত খা। তোর জন্যে আমার খুব দুঃখ হয় রে মিজান। এদের কাছে তো ভালোই ছিলি। এরা তো তোকে এত দিন নিজের ছেলের মতো করেই মানুষ করেছে। এখন তো এদের নিজের ছেলেই হলো। এখন কি আর তোকে আগের মতো আদর করবে?

দাইমা বুড়ি বললেন, কে মিজান। কী বাবা, স্কুল ছুটি হলো! যা হাতমুখ ধুয়ে নিয়ে ভাত খা। তোর জন্যে আমার খুব দুঃখ হয় রে মিজান

মিজান প্রথমে দাই মার কথায় তেমন পাত্তা দিল না। এ ধরনের ইয়ার্কি বেশ প্রচলিত। এই, তোকে তো তোর বাবা-মা কুড়িয়ে পেয়েছে। প্রায়ই ছেলেপুলেদের এ ধরনের কথা শুনতে হয়। লোকে বলে। খ্যাপানোর জন্যে বলে। কিন্তু বুড়ি মা চিরুনির গায়ে উকুন মারতে মারতে বলেই চলেছেন, আল্লাহর লীলা বোঝা খুবই ভার। আজ থেকে ১২ বছর আগের কথা। তোর মায়ের বাচ্চা হবে। কাকে আর ডাকবে। আমাকেই ডাকা হলো। আহারে বাচ্চাটা, কী সুন্দর চোখমুখ হয়েছিল। সাত দিন বেঁচে ছিল। তারপর হঠাৎ করে বলা নাই কওয়া নাই বাচ্চাটা মরে গেল। তোর মার তখন পাগল পাগল অবস্থা।

তখন তোকে পাওয়া গেল। এক হাসপাতালের নার্স তোকে এনে এই বাসায় রেখে গেল। বলল, বাচ্চাটার মা মরে গেছে। বাবার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আমার কাছে আছে কদিন। আমি আর পারছি না। আপনারা কি রাখবেন?

তোর বাবা তোকে তুলে দিল তোর মায়ের কোলে। তখন থেকে তুই এ বাড়িতেই আছিস। নিজের ছেলের মতোই আছিস। কিন্তু এখন আল্লাহর কী ইচ্ছা তিনিই জানেন, তোর মার নিজের ছেলে হয়েছে। এখন কি আর তুই আগের মতো আদর-যত্ন পাবি?

বুড়ি এসব কী বলছে? এসব কথা কি সত্যি! মিজান এ কথা কাকে জিজ্ঞেস করবে? বাবাকে? যদি কথা সব সত্য হয়? মিজানের ভারি কান্না পাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে, সে গলা ছেড়ে দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদে।

কাউকে কিছু না বলে সে নদীর ধারে গিয়ে বসে রইল সমস্ত সন্ধ্যা। নির্জন নদীতীরে বসে সে চোখের জল ফেলতে লাগল অঝোরে। আহারে, তার ১২ বছরের ছোট্ট শরীর কি এত দুঃখ সহ্য করতে পারবে?

বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। এসেই শুনতে পেল, ওঘর থেকে মায়ের চিৎকার: মরে না কেন হতভাগাটা, অ্যা। এত রাত হয়ে গেছে, ছেলের ফেরার নাম নাই। ওগো, শুনছ, ওকে বের করে দাও। যেদিকে খুশি চলে যাক। তাহলে যদি আমার হাড় জুড়ায়!

(চলবে...)