ওরা বাগানে ছিল। ‘জো, শোনো’, নয় বছরের মেয়েকে বললেন জেলিয়া হকিন্স, ‘দুষ্টুমি বন্ধ করো, বাবা তোমাকে গল্প শোনাবে।’
জো হ্যামকে এসে বলল, ‘বাবা, একটা সত্যি গল্প বলো।’
‘আমি তোমাকে যে গল্পটা বলব তা সত্যি সত্যি ঘটেছিল’, বললেন ড্রেক হকিন্স, মেয়ের গাল টিপে দিয়ে। ‘এখন থেকে দুই হাজার এগারো বছর আগে, অর্থাৎ ১৯৮৫ সালের গল্প—পৃথিবীর ক্যালেন্ডারের হিসাবে বলছি—ডগস্টারের সিরিয়াস গ্রহবাসী পৃথিবী আক্রমণ করে।’
‘আচ্ছা, ওরা দেখতে কেমন ছিল?’
‘মানুষের মতো প্রায়। প্রত্যেকের দুটো করে হাত, দুটো পা, অন্যান্য সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মানুষের মতো।’
‘আচ্ছা বাবা, ডগস্টারের সঙ্গে মানুষের কোনো পার্থক্য ছিল না?’
‘ছিল। ওদের প্রত্যেকের দুটো করে সবুজ ডানা ছিল আর ছিল লাল লেজ।’
‘ওরা কতজন ছিল?’
তুমি জানো, এই নবাগতরা পৃথিবীবাসীর তুলনায় অনেক বেশি বুদ্ধিমান ছিল। আসলে নবাগতরা ছিল এই সৌরমণ্ডলে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ম্যাথেমেটিশিয়ান।’
‘ত্রিশ লাখ একচল্লিশ জন ছিল পুরুষ আর ছিল তিনজন মহিলা। সার্দিনিয়া নামে এক দ্বীপে ওরা প্রথমে নামে। তারপর পাঁচ সপ্তাহের ভেতর ওরা পৃথিবীর অধীশ্বর হয়ে ওঠে।’
‘পৃথিবীবাসী তাদের বাধা দেয়নি?’
‘পৃথিবীবাসী দখলদারদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। গুলি, সাধারণ বোমা, সুপার অ্যাটম বোমা এবং গ্যাস ব্যবহার করেছিল ওদের বিরুদ্ধে।’
‘অস্ত্রগুলো দেখতে কেমন ছিল?’
‘ওহ্, ওগুলো তো অনেক আগেই সেকেলে হয়ে গিয়েছিল, যেগুলোকে ওরা “অস্ত্র” বলে। মানুষেরা সেসব সেকেলে অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।’
‘আর সে যুগে তখনকার মতো লড়াই হতো না, তাই না, বাবা?’
‘না, বন্দুক নিয়ে লড়াই করত, তোমাকে আগেই বলেছি। তবে আক্রমণকারীদের কোনো অস্ত্র দিয়ে রোখা গেল না। পৃথিবীবাসীর অস্ত্রের সামনে তারা নিরাপদ রইল।’
‘নিরাপদ মানে?’
‘নিজেদের ক্ষতি হওয়া থেকে নিরাপদ থাকা। তারপর পৃথিবীবাসী জীবাণু আর ব্যাকটেরিয়া দিয়ে আক্রমণ করল।’
‘ওগুলো কী?’
‘সূক্ষ্ম জীব। পৃথিবীবাসী আক্রমণকারীদের শরীরে সেসব ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু ইনজেক্ট করে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু তারাবাসীর কোনো ক্ষতি হলো না।’
‘বলে যাও বাবা। ওগুলো পুরো পৃথিবী দখল করে নিল, ওখান থেকে শুরু করো।’
'তুমি জানো, এই নবাগতরা পৃথিবীবাসীর তুলনায় অনেক বেশি বুদ্ধিমান ছিল। আসলে নবাগতরা ছিল এই সৌরমণ্ডলে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ম্যাথেমেটিশিয়ান।’
‘সৌরমণ্ডল কী? আর ম্যাথেমেটিশিয়ান মানে কী?’
‘মিল্কিওয়ে। একজন ভালো ম্যাথেমেটিশিয়ান অঙ্ক কষা, ভর নির্ণয় করা, পরিমাপ করা এবং সংখ্যা নিয়ে ভালো খেলতে পারে।’
‘তারপর, বাবা, পৃথিবীবাসীকে ওরা মেরে ফেলল।’
‘সব না, তারা অসংখ্য পৃথিবীবাসীকে হত্যা করেছিল। তবে অবশিষ্টদের নিজেদের কাজে লাগিয়েছিল। পৃথিবীবাসী যেভাবে ঘোড়া ও গরু ব্যবহার করত, ঠিক তেমনভাবে নবাগতরা ওদের ব্যবহার করত। কাজের লোকজনদের বাদ দিয়ে বাকিদের নিজেদের খাদ্যের প্রয়োজনে হত্যা করত।’
‘বাবা, এই ভিনগ্রহীরা কোন ভাষায় কথা বলত?’
‘খুবই সাধারণ ভাষায় কথা বলত। কিন্তু পৃথিবীবাসী কখনোই সেই ভাষা আয়ত্ত করতে পারেনি। আক্রমণকারীরা সবার চেয়ে চতুর ছিল বলেই সবকটা ভাষা অল্প দিনের মধ্যে শিখে ফেলল।’
‘পৃথিবীবাসী কী নামে ডাকত ওদের?’
‘এন-ভিল’। আধা দেবদূত, আধা শয়তান।’
‘তারপর মানুষ এন-ভিলদের দাসত্ব মেনে নেওয়ার পর পৃথিবীতে শান্তি ফিরে এসেছিল?’
'নোওয়াল’, ড্রেক বলে যেতে লাগল, ‘এন-ভিলদের মনের ভেতর মানুষের ভালোবাসা, ঘৃণা, উচ্চাশা, ঈর্ষা, হিংসা, হতাশা, আবেগ, ভয়, আতঙ্ক, লজ্জা ঢুকিয়ে দিতে লাগল। অল্পদিনের ভেতর এন-ভিলরা মানুষের মতো আচরণ শুরু করে দিল। ফলে ১০ দিনে তিন ভাগের দুই ভাগ এন-ভিল গৃহযুদ্ধে মারা পড়ল।’
অল্প কয়েক দিনের জন্য। মানুষের ভেতর সাহসী একজন মানুষ, নাম নোওয়াল। তার নেতৃত্বে একদল মানুষ বিদ্রোহ করে বসল, পালিয়ে গ্রিনল্যান্ডের গভীরে লুকিয়ে রইল। এই নোওয়াল ছিল একজন সাইকিয়াট্রিস্ট।’
‘সাইকিয়াট্রিস্ট কী?’
‘যারা মনের ভেতরের কথা পড়তে পারে।’
‘তারপর সে ছিল খুব বুদ্ধিমান?’
‘সে ছিল পৃথিবীবাসীর মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ। কিছুদিন ভাবার পর সে পৃথিবীবাসীকে এন-ভিলদের হাত থেকে মুক্তির পথ দেখাল।’
‘কীভাবে?’
‘সে একটা নিয়মকে সঠিক পথে নিয়ে এল, যে নিয়মটার নাম দেওয়া হলো নোওয়াল-হিউজেস ইলিনস্কি টেকনিক, যার মাধ্যমে মানুষের সব ভাবাবেগ এন-ভিলদের মনের অনুভূতি ঢুকিয়ে দিল।’
‘অনুভূতি কী?’
‘সে তাদের মনের ভেতর আবেগ ঢুকিয়ে দিল।’
জিনিয়া বাধা দিল, ‘ড্রেক, তুমি কি একটি বাচ্চার ওপর কঠিন সবকিছু চাপিয়ে দিচ্ছো না?’
‘না, মা’, জো বলল, ‘আমি বাবার সব কথাই বুঝতে পারছি। তুমি বাধা দিয়ো না।’
‘নোওয়াল’, ড্রেক বলে যেতে লাগল, ‘এন-ভিলদের মনের ভেতর মানুষের ভালোবাসা, ঘৃণা, উচ্চাশা, ঈর্ষা, হিংসা, হতাশা, আবেগ, ভয়, আতঙ্ক, লজ্জা ঢুকিয়ে দিতে লাগল। অল্পদিনের ভেতর এন-ভিলরা মানুষের মতো আচরণ শুরু করে দিল। ফলে ১০ দিনে তিন ভাগের দুই ভাগ এন-ভিল গৃহযুদ্ধে মারা পড়ল।’
‘তারপর এন-ভিলরা নিজেরা মারামারি করে মারা গেল?’
‘প্রায় সবাই মারা পড়ল, তাদের ভেতর একজন, যার নাম জালিবার, এন-ভিলদের মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তুলল। অল্পদিনের মধ্যে আক্রমণকারীরা দ্রুত নিজেদের মাঝে হাতাহাতি বন্ধ করে সহমর্মিতায় আবদ্ধ হলো। এর ফলাফল পৃথিবীবাসী আবার নতুন করে দাসে পরিণত হলো।’
‘ওহ্, বাবা, গ্রিনল্যান্ডে বসে নোওয়াল নিশ্চয়ই এই পদ্ধতি ফেল করায় মর্মাহত হয়েছিল?’
‘কিছুক্ষণের জন্য। এরপর নোওয়াল তার শেষ অস্ত্রটা প্রয়োগ করল।’
‘শেষ অস্ত্র?’
‘হ্যাঁ ঠিক তাই। কপ নি গ্রেস। নিজ বুদ্ধিটাকে অস্ত্রের মতো করে কাজে লাগল।’
‘বুদ্ধিটা কী বাবা? কী করেছিল?’
‘নোওয়াল, এন-ভিলদের মনে গৃহকাতরতা ঢুকিয়ে দিল।’
‘গৃহকাতরতা কী?’
‘নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য হাহাকার।’
‘তাহলে তো বাবা নোওয়াল বেশ বুদ্ধিমান ছিলেন? এর মানে হলো তারাবাসী যেখান থেকে এসেছিল, সেখানে ফিরে যেতে পাগল হয়ে উঠল।’
‘ঠিক তা-ই। তাই, একদিন সব এন-ভিল উত্তর আমেরিকার কালো পাহাড়ে জড়ো হতে লাগল। তারপর তাদের সবুজ ডানা মেলে দূর নক্ষত্রলোকের উদ্দেশে উড়াল দিল এবং পৃথিবীবাসী আনন্দের গান গাইতে লাগল।’
‘তারপর, আর একটাও এন-ভিল পৃথিবীতে ছিল না, ছেড়ে চলে গেল?’
‘সব যায়নি। ছোট দুই এন-ভিল ছেলে-মেয়ে সবার সঙ্গে যাত্রা করেছিল, কিন্তু স্ট্রাটোসফিয়ার থেকে ফিরে এসেছিল পৃথিবীতে। ওদের বয়স ছিল মাত্র দুই বছর। পৃথিবীতেই তাদরে জন্ম। জন্মভূমির মায়া ওরা কাটাতে পারেনি। তাদের নাম হলো জিজেজা আর জিজনা।’
‘জিজেজা আর জিজনার কী ঘটেছিল পরে?’
‘অন্য এন-ভিলদের মতো ওরা ম্যাথেমেটিশিয়ান হয়ে উঠল। ওরা সংখ্যায় বেড়ে চলল।’
‘বাবা’, হাসল জো, তারপর তার ছোট দুটো সবুজ পাখা ঝাপটাল, গল্পটা খুব ভালো ছিল।