ভিনগ্রহের ক্রিকেটার – পর্ব ৯

১৩

মিজান এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। সবাই তাকে ভালো বলছে, সবাই তার প্রশংসা করছে, সবার ভালোবাসা তার দিকেই ধেয়ে আসছে, এ রকম এর আগে কখনো হয়নি তো! আজ তার জন্যই টিম জিতেছে, এটা ভাবতে তার খুব ভালো লাগছে। কিন্তু তার আশপাশের সবার মনোভাব একেবারে যাকে বলে ১৮০ ডিগ্রি বদলে গেল এক দুপুরেই, এটা তার কাছে অভূতপূর্ব। মিজানের যেন কেমন বোকা বোকা লাগছে। সবাই যখন তাকে বলছে কংগ্রাচুলেশন্স, তখন সে কী বলবে! সে বোকার মতো হাসছে।

মাঠের হইহল্লা শেষে মিছিলের কাঁধে চড়ে সে চলে এল হোস্টেলে। এই জায়গা এখনো তার কাছে আপন হয়ে ওঠেনি। সেটা তার নিজের দোষ নয়। এমনিতে তার খুব মা–বাবার কথা মনে পড়ে। তাদের আদরের কথা। বাবা যে তাকে মাঝেমধ্যে মিষ্টির দোকানে নিয়ে যেত আর সবচেয়ে বড় মিষ্টিটার অর্ডার দিত, এসব ভাবতেই তার মন ভিজে আসে। কিন্তু হোস্টেলটা তার আপন হচ্ছে না, সেটা তার খুব বাড়ির কথা মনে পড়ে বলে নয়, মোহনের ব্যবহারটা এখনো সহনীয় পর্যায়ে আসেনি বলে। 

এখন তারা তাকে দিয়ে কাপড় কাচিয়ে নিচ্ছে। রোজ তাকেই ঘরটা ঝাড়ু দিতে হয়। এসব কাজ সে আগে কখনো করেনি। ফলে কাজটা ভালো হয় না। ঝাড়ু দেওয়ার পরও ঘরে ময়লা থেকে যায়, আবীর আর মোহনের শার্ট ধোয়ার পরও দেখা যায় ময়লা রয়ে গেছে। ফলে তাকে বকা তো খেতেই হয়। 

মিজান না করতে পারে না। কেন পারে না, কে জানে! হয়তো জলে নেমে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করা উচিত নয় বলে। তার ওপর হায়দার ভাই ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছেন। চার বেডের রুমে তারা এখন তিনজন আছে। এ দুজন এককাট্টা। তাদের সঙ্গে লড়াই করে সে কি টিকতে পারবে? তারা আবার রাতের বেলা তার বিছানায় পানি ঢেলে দিয়ে বলবে মিজান মুতেছে। তাদের কিছু বিশ্বাস নেই। 

আজ কিন্তু মিজান হোস্টেলে ফিরল ছেলেদের ঘাড়ে চড়ে। তারা মিজান মিজান বলে চেঁচাতে চেঁচাতে এসেছে। এই মিছিলের পেছনে পেছনে এল রাজীব আর মোহন। তাদের রুমেই যে মিজান থাকে, এটা তারা বলছে বড়ই গর্বভরে। তারা মিছিলটাকে তাদের রুম দেখিয়ে দিল। 

মিছিল মিজানকে নামিয়ে দিয়ে খানিকক্ষণ পর চলে গেল। ঘরে এখন রাজীব, মোহন আর মিজান। ক্লাস সেভেনের তিন ছেলে। রাজীব আর মোহনও খেলা দেখেছে। তারাও খেলা দেখে উত্তেজিত হয়েছে। নিজ দলের যখন খারাপ অবস্থা, তখন মন খারাপ করেছে। যখন ভালো অবস্থা, তখন খুশি হয়েছে। আর শেষে যখন মিজানের কারণে তাদের ক্লাস টিম জিতে গেছে, তারা আনন্দে মেতেছে। 

এখন এই ঘরে তারা তিনজন। প্রথমে খানিকক্ষণের নীরবতা। তারপর কথা পাড়ল প্রথম মোহন। বলল, দোস্ত, তুমি আজকে আমাদের ইজ্জত বাঁচাইছ। আর রাজীব বলল, আর তুমি বাঁচাইছ আমার ২০০ টাকা। আমি তো ক্লাস এইটের ইলিয়াসের সঙ্গে ২০০ টাকা বাজি ধরছি। 

যাও, গোসল করে এস। আমরা আজ একসঙ্গে খাব৷

মিজানের চোখ দুটো জলে ভিজে আসে। রাজীব আর মোহন পর্যন্ত তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছে। 

মিজান গোসল করতে গেল কলতলায়। হোস্টেলের বয় আনসার এগিয়ে এল। স্যার দেন আমি পানি তুইলা দিই। আজকা স্যার যা খেলা দেখাইছেন। কি আনসার ভাই, আপনিও খেলা দেখতে গিয়েছিলেন নাকি?

গেছি মানে; আমি তো আপনার নাম লইয়া চিল্লাইতে চিল্লাইতে গলা বসায়া ফেলাইছি। 

আবীর চলে গেল সৈনিক আঙ্কেলের কাছে। মুখে যথাসম্ভব বিনয় ফুটিয়ে বলল, আঙ্কেল, আমরা সরকারি স্কুলের ছাত্র। আজকে আমাদের ক্লাস টিম ক্রিকেটে জিতেছে।

আনসার টিউবওয়েলে চাপ দিয়ে বালতি ভরে দেয়। মিজান আরাম করে গোসল করে। বেলা সাড়ে তিনটায় খেতে ঢোকে ডাইনিংয়ে। তারা তিনজন—রাজীব, মোহন আর মিজান। ঠান্ডা ভাত। তাদের জন্য বাবুর্চি তুলে রেখেছিল। আনসার বলল, স্যার একটা ডিম ভাইজা দিই, খাইবেন?

রাজীব বলল, দাও দাও।

খেয়েদেয়ে তারা তিনজন ঘরে এসেছে। কী করবে ভাবছে। এমন সময় রুমে সোহান আর আবীর এসে হাজির। চল, আমরা সিনেমা দেখতে যাই। রাজীব আর মোহন, তোরাও চল। তোদের প্যান্ট ছেঁড়ার ক্ষতি পূরণ করে দিই। 

চল। রাজীব আর মোহন রাজি। তবে একটা সমস্যা। সিরাজ স্যার সন্ধ্যা ৭টায় মাঝেমধ্যে রোলকল করেন। কে আছে, কে নাই খেয়াল করেন। এখন যদি তারা সিনেমা দেখতে যায়, পিঠে বেত পড়ার আশঙ্কা আছে। 

আরে কী হবে, চল। 

সোহান আর আবীরের প্ররোচনায় তারা তিনজন বেরিয়ে গেল শহরের ভেতরে সিনেমা হলের উদ্দেশে। সিনেমা হলের নাম বলাকা। ছবি চলছে ‘কেন ভালোবাসলাম’। সোহান আর আবীর চাঁদা দিল টিকিটের টাকার জন্য। মোহন লাইনে দাঁড়াল টিকিটের জন্য। আজ শুক্রবার। নতুন ছবি মুক্তি পেয়েছে। বেজায় ভিড়। তাদের পক্ষে টিকিট পাওয়া সম্ভব নয়। কালোবাজারিরাও বেশ তৎপরতা দেখাচ্ছে। কাউন্টারে টিকিট না পেলে তাদের পক্ষে কালোবাজারে বেশি দাম দিয়ে টিকিট কাটা সম্ভব নয়। ওদিকে একটা কাউন্টার দেখা যাচ্ছে, তাতে লেখা—সৈনিক। ওই লাইনে মাত্র দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। 

আবীর বলল, দাঁড়া, এক কাজ করি। সৈনিক আঙ্কেলকে বলি, উনি আমাদের টিকিটটা যদি করে দেন। যে কথা সেই কাজ।

আবীর চলে গেল সৈনিক আঙ্কেলের কাছে। মুখে যথাসম্ভব বিনয় ফুটিয়ে বলল, আঙ্কেল, আমরা সরকারি স্কুলের ছাত্র। আজকে আমাদের ক্লাস টিম ক্রিকেটে জিতেছে। আমরা সে আনন্দে সিনেমা দেখতে এসেছি। আমাদের কি পাঁচটা টিকিট একটু কেটে দেবেন। 

আঙ্কেল বললেন, আচ্ছা, দাও দেখি টাকা। 

আবীর তাড়াতাড়ি মোহনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এল। তুলে দিল সৈনিক চাচার হাতে। তিনি বললেন, এত টাকা লাগবে না। এই কাউন্টারে টিকিট চার টাকা করে। ৫টার জন্য ২০ টাকা দাও । 

৬০ টাকার বদলে মাত্র ২০ টাকা। আহ, আজকে যে তারা কার মুখ দেখে উঠেছিল!

স্যার বললেন, আমি জানি, তোরা কেন ওকে বাঁচাতে চাইছিস। কারণ, ও আজ ক্রিকেটে খুব ভালো করেছে। গুড। তোরা তোদের ক্লাস টিমের বোলারকে বেতের হাত থেকে বাঁচাতে চাইছিস।

সিনেমাটা খুবই করুণ। শাবনূর ভালোবাসে রিয়াজকে। কিন্তু রিয়াজের মা–বাবা এই সম্পর্ক মেনে নেবেন না। রিয়াজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিয়ে করল শাবনূরকে। তাদের হাতে টাকাপয়সা তেমন নেই। খুবই অভাবের সংসার। এর মধ্যে রিয়াজকে ধরে নিয়ে গেল পুলিশ ভুল–বোঝাবুঝি থেকে। শাবনূর একা একা থাকে। শেষে সে রিয়াজের বাড়িতেই আশ্রয় নিল কাজের মেয়ের বেশে। তার একটা ছেলে হলো। কিন্তু নিজের দাদুর বাড়িতে সে বড় হচ্ছে পরিচারিকার ছেলে হিসেবে। খুবই দুঃখের ঘটনা। মিজান কাঁদতে শুরু করেছে। এই পৃথিবী বড় নিষ্ঠুর কেন? এখানে এত কান্না, এত অশ্রু কেন?

সিনেমা শেষ হলো রাত ৯টার দিকে। বাইরে তখন বেশ রাত। ছোট জেলা শহরের রাস্তাঘাট এখন ফাঁকা হয়ে পড়েছে। আবীর আর সোহান বলল, এহ, এত রাত হয়ে গেছে। আমরা যাইরে। তোরা তিনজন হোস্টেলে চলে যেতে পারবি না?

পারব, পারব। বলল তারা। 

হোস্টেলে ফিরে এসে দরজার তালা খুলে তারা ঘরের ভেতরে ঢুকল। বাতি জ্বালাল। কাপড়চোপড় ছেড়ে ডাইনিংয়ে খেতে গেল। তখন আনসার এসে বলল, স্যার আপনাগো অনেক খুঁজছে। দেখা কইরেন।

তাদের রাতের খাওয়াটা ভালো হলো না। স্যার যে আজকে কী বলবেন, কী করবেন, কে জানে!

খেয়েদেয়ে তারা তিনজন সিরাজ স্যারের রুমের সামনে গেল৷

স্যার বললেন, কী খবর বৎস! কীবা হেতু এ বিলম্ব?

তারা তিনজন চুপ করে রইল। 

স্যার বললেন, বৎস, সত্য বলো। মনরে আজ কহ যে ভালো–মন্দ যাহাই আসুক সত্যরে লও সহজে। 

রাজীব বলল, সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম স্যার। 

স্যার হাসলেন, সিনেমা! কী সিনেমা?

রাজীব বলল, ‘কেন ভালোবাসলাম’। 

স্যার হেসে বললেন, বৎস, কেন ভালোবাসলে কিছু বোঝা গেল?

তারা নীরব হয়ে রইল। 

আর এই নতুনটার কী খবর! আমি নিজে গিয়ে বাসা থেকে এনে হোস্টেলে রাখলাম কি এ জন্যে?

মোহন বলল, ও যেতে চায়নি, আমরা জোর করে নিয়ে গেছি স্যার। 

রাজীব বলল, জি স্যার। মিজান একদমই যেতে চায়নি। আমরা ওকে বলেছি, না গেলে রাতের বেলা ভূতের ভয় দেখাব। তাই ও ভয় পেয়ে রাজি হয়েছে। স্যার বললেন, এই স্বীকারোক্তির শাস্তি কী, তোরা জানিস?

তারা কেউ কোনো কথা বলছে না। 

স্যার বললেন, আমি জানি, তোরা কেন ওকে বাঁচাতে চাইছিস। কারণ, ও আজ ক্রিকেটে খুব ভালো করেছে। গুড। তোরা তোদের ক্লাস টিমের বোলারকে বেতের হাত থেকে বাঁচাতে চাইছিস। এটা খুব ভালো। কিন্তু এ জন্য তোদের দুজনকে বেশি করে বেত খেতে হবে। রাজি?

তারা চুপ করেই রইল। 

স্যার বললেন, আজ মিজানের প্রথম অপরাধ বলে ক্ষমা করে দিলাম। আর কোনো দিন ক্ষমা করব না। মনে থাকে যেন। যা। চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা। 

স্যার। আমি একটা কথা বলতে এসেছি। সিনেমায় আমি নিজের ইচ্ছায় গেছি। আবীর আর সোহান এসে আমাকে নিয়ে গেছে। আমিই বরং মোহন আর রাজীবকে আমার সঙ্গে নিয়ে গিয়েছি।

১৪

ছেলেরা চলে গেল। সিরাজ স্যার তার রুমের দরজা বন্ধ করে দিলেন। তার মনটা আজ খুব খারাপ। আজকের দিনটা একটা বিশেষ দিন। আজ তার বিবাহবার্ষিকী। কিন্তু তার স্ত্রী মিরা আজ তার থেকে অনেক দূরে। সে চলে গেছে এবং যাওয়ার সময় তার একমাত্র সন্তান শাহেদকে নিয়ে গেছে। এই দুঃখে সিরাজ আর বিয়ে করেননি। একা একা এই স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে থাকেন। 

মিরা তাকে কেন যে বিয়ে করতে গিয়েছিল? বড়লোকের মেয়ে। বড়লোক বর তার জন্য মানানসই। কিন্তু সে তার সহপাঠী সিরাজকে পছন্দ করে ফেলেছিল, সম্ভবত তার নাটক দেখে। ছাত্র অবস্থা থেকেই সিরাজ নাটক-ফাটক করেন। কথাও বলেন নাটকীয় ভঙ্গিতে। মিরা বোধ হয় এসব দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। কিন্তু এ মুগ্ধতা স্থায়ী হতে পারে না। হয়ওনি। বড়লোকের সুন্দরী মেয়ে, অল্পদিনের মধ্যেই নিজের ভুলের সংশোধন করে ফেলেছে। কোলের শিশুকে নিয়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে? এখন কোথায় আছে সে? লন্ডনে? আর তাদের ছেলে শাহেদ। সে এখন কোন ক্লাসে পড়ে? দেশে থাকলে মনে হয় ক্লাস সেভেনেই পড়ত। 

দরজা বন্ধ করে সিরাজ স্যার কাঁদতে বসেন। তার সামনে তার স্ত্রী-পুত্রের একটা পুরোনো ছবি। 

দরজায় ঠকঠক আওয়াজ। 

কে?

আবার দরজায় ঠকঠক।

কে?

স্যার, আমি!

আমি কে? মিজান স্যার। 

সিরাজ স্যার ওঠেন। চোখ মুছে দরজা খোলেন। কী ব্যাপার?

স্যার। আমি একটা কথা বলতে এসেছি। সিনেমায় আমি নিজের ইচ্ছায় গেছি। আবীর আর সোহান এসে আমাকে নিয়ে গেছে। আমিই বরং মোহন আর রাজীবকে আমার সঙ্গে নিয়ে গিয়েছি। ওদের কোনো দোষ নেই। 

সিরাজ স্যার চুপ করে মিজানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তার চোখ আবার জলে ভিজে আসে। 

মিজান কিছুই বুঝতে পারে না।

স্যার বললেন, আয় মিজান ভেতরে এসে বস। 

মিজান ভেতরে যায়। স্যারের বিছানায় বসে। স্যারের রুমে শুধু বই আর

বই। স্যার এত বই পড়েন!

তোর বাবাকে ছেড়ে থাকতে তোর কেমন লাগে?

মিজান মাথা নিচু করে থাকে। 

বল, কথা বল। কেমন লাগেরে বাবাকে ছেড়ে থাকতে!

খারাপ লাগে স্যার। 

তোর মাকে ছেড়ে থাকতে?

খারাপ লাগে স্যার। 

তোর মায়ের মাথাটা একটু গরম। এ জন্য তোকে মারধর করেছে বুঝলি?

জি স্যার। 

তোর মাকে ডাক্তার দেখাতে হবে। তোর বাবাকে আমি বলে দিয়েছি। তোর মায়ের মাথা ঠান্ডা হলে তুই আবার মায়ের কাছে ফিরে যাবি, বুঝলি!

জি স্যার। 

সেদিন তোর খুব ভালো লাগবে নারে?

জি স্যার। 

তোর বাবারও খুব ভালো লাগবে, তুই দেখিস!

আমি জানি। তবে মায়ের ব্যাপারটা ঠিক জানি না। 

কেন রে, এটা তুই কী বললি?

স্যার আমি নাকি মা–বাবার কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে।

বলিস কী? এসব সব মা–বাবাই তাদের ছেলেকে বলে। বানিয়ে বলে। 

আমাকে মা–বাবা বলেননি। বলেছেন, ধাইমা বুড়ি। 

কী বলেছেন?

আমার মায়ের প্রথম সন্তান জন্মের পরে মারা যায়। তারপর আমাকে তারা কুড়িয়ে পায়। 

তুই এসব কথা বিশ্বাস করিস?


করতে চাই না স্যার। কিন্তু মাঝেমধ্যে খুব খারাপ লাগে। স্যার আমার অনেক কষ্ট। 

যাহ। এভাবে বলে না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। যা, অনেক রাত। রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। 

মিজান রুমে আসে। তার রুমমেটরা ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘরের এককোণে একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। মিজানও মশারি পেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কিন্তু তার ঘুম আসছে না। আজ তার একটা ঘটনাবহুল দিন। সকালে ক্রিকেটে ভালো করল। তারপর কত ভালোবাসা ও অভিনন্দন সে পেল। সিনেমা হলে গিয়ে আবার অন্য কাহিনি। বাইরে এসে এখন আরেক সিনেমা। 

তার খুব বাবাকে মনে পড়ছে। কাল একবার সে যাবে বাবাকে দেখতে। কত দিন সে বাবাকে দেখে না! এটা কি হতে পারে যে এই বাবা তার নিজের না? কাঁদতে কাঁদতে মিজান ঘুমিয়ে পড়ল। 

১৫

জয়েন স্যার বলে দিলেন, ক্লাস এইটের সঙ্গে জেতা সহজ। পারলে জেতো তো দেখি ক্লাস নাইনের সঙ্গে। ক্লাস নাইন ইতিমধ্যে হারিয়ে দিয়েছে ক্লাস টেনকে। ক্লাস নাইনে দুজন আছে ক্লাব টুর্নামেন্টে খেলেছে। তারা খুবই দুর্ধর্ষ।

আগামী বুধবারে ক্লাস নাইনের সঙ্গে তাদের খেলা। এটাই ফাইনাল। 

স্যার বললেন, শোন তোদের তো আজকে আমি ডবল টিফিন খাওয়াচ্ছি, কিন্তু তোরা আমাকে কী খাওয়াবি বল। কারণ, তোরা তো জিতেছিস আমার জন্য। 

আপনার জন্য? ছেলেরা গুনগুন করে উঠল। 

হ্যাঁ। আসল ক্রেডিট তো সিলেক্টরের। আমি যদি এত যত্ন করে প্রত্যেক ছেলের টেস্ট না নিতাম, তাহলে তোরা কি মিজানকে কোনো দিনও তোদের টিমে নিতি? ওর জন্যই তো সেদিন তোরা জিতেছিস, নাকি?

সবাই স্যারের যুক্তি মেনে নিল। সত্যিই তো এ রকম একটা গাধা ধরনের ছেলেকে টিমে নেওয়ার সব কৃতিত্ব তো স্যারেরই। 

ক্লাসে আজ মিজানের কদর গেছে বেড়ে। তাকে পাশে বসানোর জন্য শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা। ক্লাস ক্যাপ্টেন আবদাল মনে করে, মিজান তার পাশেই বসবে। আর টিম ক্যাপ্টেন সোহান মনে করে, টিমের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করার প্রয়োজনে মিজানকে তার আর আবীরের মধ্যখানে বসতে দেওয়া উচিত। অন্য দিকে স্বাধীন ভাবছে, সে ক্লাসের ফার্স্ট বয়। তার পাশে যদি মিজান বসে, তাহলে পড়াশোনায় তাকে সে কিছু সাহায্য করতে পারে। এটা মিজানের দরকার।

মিজান কিন্তু বসেছে মোহন আর রাজীবের সঙ্গে। হাজার হলেও তারা তার রুমমেট।

টিফিন পিরিয়ডে ডবল টিফিন পেয়ে গণেশ বড় খুশি। সে মিজানকে বলল, দোস্ত, ক্লাস নাইনকে হারিয়ে দে, স্যার নিশ্চয় আমাদের কাচ্চি বিরিয়ানি খাওয়াবে। 

নিশ্চয় বলে এগিয়ে এল আবীর। বলল, গণেশ, আমি টিমের সহ–অধিনায়ক, আয় আমার সঙ্গে কোলাকুলি কর। তাহলে তোর কাচ্চি বিরিয়ানি হবে। 

গণেশ এগিয়ে গেল। আসলে টিফিনের জিলাপির রস মেখে আছে আবীরের হাতে। সে সেটা মুছে নিল গণেশের পিঠে।

সবাই সেটা বুঝে হেসে উঠল কেবল গণেশ বুঝল না। বেচারা!

ক্লাস সেভেনের মুখ শুকিয়ে গেছে। ১০ ওভার বল হতে না হতেই তাদের ৭ জন ব্যাটসম্যান আউট। রান মোটে ১৭। ক্লাস নাইনের ছেলেরা চেঁচিয়ে আকাশ মাথায় তুলে ফেলে আরকি!

১৬

ক্লাস নাইনের সঙ্গে খেলা ক্লাস সেভেনের। দুই বছর বয়সের ব্যবধান। ক্লাস সেভেনের ছেলেদের দেখাচ্ছে পিচ্চি। তবে তারা ভয় পাচ্ছে না। মুখে বলছে—বড়দের সঙ্গে হারতে লজ্জা কী? কিন্তু তারা উপস্থিত হয়েছে বিপুল উৎসাহ–উদ্দীপনা নিয়ে । ড্রাম তো তারা এনেছেই। পটকাও জোগাড় করেছে বেশ কিছু।

ক্লাস নাইনের ছেলেরাও এসেছে দল বেঁধে। তারা তো নিশ্চিত যে তারা জিতবে। তাদের সঙ্গে আছে মিনহাজ আর কৌশিক—দুই বিখ্যাত খেলোয়াড়। তারা দুজনেই অলরাউন্ডার। তাদের হারাবে কে?

প্যান্ডেলের মতো সাজানো হয়েছে মাঠের এক পাশে। তাতে স্যাররা বসে আছেন। জয়েন স্যার বসেননি, তিনি পায়চারি করছেন উত্তেজনায়। হেডস্যার এসেছেন। তিনি বসে আছেন কোট-প্যান্ট-টাই পরে। 

প্রথমে টস। টসে জিতল ক্লাস সেভেনই। সোহান আবার ব্যাট নিল। কিন্তু ওপেনার ফিরে এল জিরো রানে। ওরে বাবা। মিনহাজ যে বল করে। তার সামনে দাঁড়াবে কে?

ক্লাস সেভেনের মুখ শুকিয়ে গেছে। ১০ ওভার বল হতে না হতেই তাদের ৭ জন ব্যাটসম্যান আউট। রান মোটে ১৭। ক্লাস নাইনের ছেলেরা চেঁচিয়ে আকাশ মাথায় তুলে ফেলে আরকি! গবেষণা হচ্ছে, পৃথিবীর সবচেয়ে কম রানের রেকর্ডটা কি আজ ক্লাস সেভেন ভেঙে ফেলবে!

মিজানের ব্যাটিং অর্ডার একদম শেষের দিকে। সে হলো ১০ নম্বর ব্যাটসম্যান। তার নামার আগে গনি এক পাশে হাল ধরে আছে। আর অন্য পাশে একজন করে ব্যাটসম্যান ঢুকছে আর আউট হচ্ছে। দলীয় ২১ রানের মাথায় ১০ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে নামল মিজান। মিজানের ব্যাটিং? মহাহাস্যকর ব্যাপার। এর আগে তার ব্যাট লেগে ড্রিল স্যার আহত হয়েছিলেন। সবাই একটা কৌতুক দেখার জন্য রেডি। 

তার বিরুদ্ধে বল করবে কৌশিক। এ শহরের সবচেয়ে ভালো বোলারদের একজন। কী হাস্যকর হতে যাচ্ছে ঘটনাটা!

ব্যাট হাতে নিয়ে মাঠে নেমে মিজান এদিক–ওদিক তাকাল। তারপর কী সব দাগ আঁকল ক্রিজে। ব্যাট ধরে অপেক্ষা করতে থাকল বলের জন্য। কৌশিক ছুটে আসছে বাঘের মতো। ইতিমধ্যে সে ৭ উইকেট নিয়ে নিয়েছে একাই। বল হয়ে গেল। 

এগিয়ে এসে বলটা ফুলটাস বানিয়ে নিয়ে ব্যাট চালাল মিজান। ছক্কা।

আরে আরে এ কোন মিজান। সবাই অবাক। ক্লাস সেভেনের সমর্থকেরা জেগে উঠল। তাদের আনা পটকাগুলো এতক্ষণ কোনো কাজে লাগেনি। এবার সেসব ফুটে উঠল সশব্দে। 

কৌশিক খুব অপমানিত বোধ করল। এবার সে একটা বাউন্সার দিল। মিজান যেন সেটা জানতই। ব্যাট উঁচিয়ে উইকেটকিপারের ওপর দিয়ে সে সেটা পাঠিয়ে দিল সোজা বটগাছের ডালে। 

ওভার শেষ। মিজান নন–স্ট্রাইকিং এন্ডে এল। স্ট্রাইকিং এন্ডে এবার ব্যাট হাতে দাঁড়িয়েছে গনি। ইতিমধ্যে কৌশিকের বলের কোটা শেষ হয়ে গেছে। এই মাঠের নিয়ম অনুযায়ী, কেউ ৬ ওভারের বেশি বল করতে পারে না। এবার এসেছে মিনহাজ। সে মিডিয়াম পেস বোলার। 

গনি কোনোমতে তাকে ঠেকিয়ে রাখছে। একবার তার পায়ে বল লাগায় সে দৌড়ে জায়গা বদল করল। একটা রানও হলো। আর মিজানও স্ট্রাইক পেল। রান এখন ৩৪ । ৯ উইকেটে। 

ভীষণ করতালি, পটকার বিস্ফোরণ, ঢোলঢাকের শব্দ আর জয়ধ্বনির মধ্যে দুবার মিজানকে উঠতে হলো তার পুরস্কার নেওয়ার জন্য। আর চ্যাম্পিয়ন শিল্ড নিল সোহান আর আবীর।

মিনহাজের বল বাউন্স করল না। পড়েই গড়িয়ে এল। মিজান স্ট্রেইট ড্রাইভ খেলল। ব্যস, ৪। মিনহাজ এবার দেবে ইয়র্কার। বলের লক্ষণ দেখেই এগিয়ে গেল মিজান। ব্যস, ছক্কা। 

রান হলো গিয়ে ৪৪। এরপরের বলটা মিনহাজ এত ভালো করল যে মিজান কোনোমতে ডিফেন্স করল। কোনো রান নয়। তারপরের বলে আবার ৪ । 

কিছুক্ষণের মধ্যেই আউট হয়ে গেল গনি। এল আশরাফ। শেষ পর্যন্ত সেভেনের রান হলো ৭৮। এর মধ্যে মিজান অপরাজিত ৪৮। 

ক্লাস নাইনের লাফলাফি শুরু হলো বিরতির সময়। মাত্র ৭৮ রান। এটা কোনো রান হলো । যেন ১০ ওভারেই তারা এই রান করে ফেলবে। 

তারা ঢোল বাজাচ্ছে। মাঠের চারদিকে দৌড়াদৌড়ি করে মিছিল করছে। লাঞ্চের পরে আবার শুরু হলো খেলা। বোলিং অ্যাটাক শুরু করল মিজান। প্রথম বলেই বোল্ড আউট হয়ে গেল মিনহাজ। দ্য বিগ স্টার। এবার এল কৌশিক। তাকেও প্রথম বলে বোল্ড করে সাজঘরে পাঠিয়ে দিল মিজান। ২ উইকেটে ০ রান। এবার এল ৩ নম্বর ব্যাটসম্যান। সে ব্যাট না তুলে মাটি কামড়ে পড়ে রইল। ০ রান। এক ওভার চলে গেল। এবার প্রান্ত বদল। আরেক উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান এ পাশে এল। আসার সঙ্গে সঙ্গে অনেক উঁচুতে বল পাঠিয়ে দিল ব্যাটসম্যান। তবে ফিল্ডার সে বল ধরতে পারল না। এর মধ্যে একটা রান পেয়ে গেল ক্লাস টেন। 

শেষ পর্যন্ত ফল দাঁড়াল ক্লাস নাইন করেছে ২৩ রান। অল আউট। মিজান একাই নিয়েছে ৭ উইকেট। এমন একটা ফাইনাল ম্যাচ এ রকম বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শেষ হয়ে গেল। নিরপেক্ষ দর্শকেরা হতাশ হলো। ক্লাস নাইনের ছেলেরা লজ্জায় মুখ নিচু করল। আর ক্লাস টেনের ছেলেরা তাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে, বুঝতে পারল না। কারণ, এত ছোট ক্লাস তাদের স্কুলে ক্রিকেট চ্যাম্পিয়ন হবে, এটা তারা ঠিক মেনে নিতে পারছে না। আবার ক্লাস নাইনের চেয়ে ক্লাস সেভেন ভালো। 

ম্যান অব দ্য ম্যাচ আর ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট দুটোই হলো মিজান। তাকে দেওয়া হলো দুটো মেডেল। আর ক্লাস সেভেন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পেল একটা বড় শিল্ড। ক্লাস নাইন রানার্সআপ হিসেবে পেল একটা ছোট শিল্ড। হেডমাস্টার নিজ হাতে পুরস্কার বিতরণ করলেন। 

ভীষণ করতালি, পটকার বিস্ফোরণ, ঢোলঢাকের শব্দ আর জয়ধ্বনির মধ্যে দুবার মিজানকে উঠতে হলো তার পুরস্কার নেওয়ার জন্য। আর চ্যাম্পিয়ন শিল্ড নিল সোহান আর আবীর। তারা সেটা নিয়ে হেডস্যারের সামনে থেকে এ দিকে এসে তুলে দিল মিজানের হাতে। তারপর পুরো টিম আর তাদের সমর্থকেরা শুরু করল ট্রফি হাতে মিছিল। জিতল কে জিতল কে? ক্লাস সেভেন ক্লাস সেভেন; মিজান বড় ভালো ছেলে জয়ের মালা তারই গলে...মিছিলের আগে আগে চলেছেন জয়েন স্যার, সবকিছু ভুলে।

সেই মিছিলের দিকে এগিয়ে এলেন সিরাজ স্যার। মিজানকে টেনে নিয়ে তিনি বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর আবেগের আতিশয্যে মিজানকে স্যার কোলে তুলে নিলেন। সবাই চেঁচিয়ে উঠল, থ্রি চিয়ার্স ফর মিজান হিপ হিপ হিপ হুররে... 

১৭

ক্লাস সেভেনের ছেলেরা চাঁদা তুলছে। তারা কাচ্চি বিরিয়ানি খাবে। উপলক্ষ ইন্টার ক্লাস ক্রিকেট টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়া। জয়েন স্যার বলেছেন, মিজান শুধু আমার ক্লাসের অ্যাসেট না। সে এই স্কুলের অ্যাসেট। ওকে তোরা সবাই দেখে রাখবি। আমি দোয়া করি যেন ও একদিন বাংলাদেশ ন্যাশনাল টিমে খেলতে পারে। 

সবই ভালোয় ভালোয় চলছিল। দুর্ঘটনা ঘটে গেল হঠাৎ। ক্লাস নাইনের গুন্ডা বলে কুখ্যাত শাহিন স্কুল ছুটির পর হোস্টেলে যাওয়ার পথে একদিন ধরে ফেলল মিজানকে। তার হাতে একটা চাকু। সঙ্গে অবশ্য রাজীব আর মোহন ছিল। কিন্তু ঘটনা ঘটে গেল কিছু বুঝবার আগেই। 

নাইনের সঙ্গে বাড়াবাড়ি করছিস, নে তার ফল বোঝ বলে হঠাৎ শাহিন চাকুটা বের করে এক পোচ মারল মিজানের গলা বরাবর। মিজান লাফিয়ে সরে যেতে চেষ্টা করতেই চাকু গিয়ে লাগল তার ডান বাহুতে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতেই শাহিন দৌড়ে পালিয়ে গেল স্কুলের এক পাশের হাফ দেয়াল টপকে। 

রাজীব আর মোহন চিৎকার করে উঠল। হইচইয়ে স্কুলের পিয়ন আবদুল হালিম এল ছুটে। মিজানকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো স্কুলের সামনের একটা ক্লিনিকে। ব্যথায় মিজানের দুই চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। ক্লিনিকে তাকে তিনটি সেলাই দিতে হলো। তারপর ব্যান্ডেজ করে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো তার হোস্টেলে। 

খবর রটে গেল সারা শহরে। ক্লাস সেভেনের ছেলেরা তো বটেই, অন্য ক্লাসের ছেলেরাও তাকে দেখতে তার রুমে ভিড় জমাতে লাগল। হেডস্যার এলেন। জয়েন স্যার এলেন। সিরাজ স্যার তো তার শিয়রের পাশে বসে রইলেন। এই ভিড়ভাট্টার মধ্যে একজন অপরিচিত লোক এসে হাজির। তার চোখে চশমা। কেউ তাকে চিনল না। কিন্তু মিজান ঠিকই চিনল তাকে। তিতি। 

মিজান ব্যাপার ঠিক বুঝছে না। তিতি তার স্বপ্নে দেখা মানুষ। সে বাস্তবে এল কীভাবে? নাকি সে আসলে স্বপ্ন দেখেনি? আসলেই গিয়েছিল পাহাড়ের ওপারে?

নাকি সে হ্যালুসিনেশন দেখছে? তার ব্যথা কমানোর জন্য তাকে নিশ্চয় ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। 

তিতি এসে বলল, মিজান। তোমার তো এখন রেস্ট নেওয়া দরকার। সবাইকে তুমি বিদায় করে দাও। 

মিজান বলল, আচ্ছা। তারপর সবার উদ্দেশে সে বলল, শুনুন। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আপনারা এখন আমাকে যদি ক্ষমা করেন।

সবাই চলে গেল। 

শুধু ঘরে রইল তিতি, মোহন আর রাজীব। 

তিতি মোহন আর রাজীবকে বলল, শুনুন। আমি একজন ডাক্তার। ওর ব্যাপারটা আমি একটু দেখতে চাই। আপনারা কি একটু ৫ মিনিট বাইরে কাটিয়ে আসবেন। এখন বাজে ৫টা ২৫। ঠিক ৫টা ৩০-এ আপনারা আসতে পারেন। 

মোহন আর রাজিব বাইরে চলে গেল। তিতি দরজা আটকে দিল। তারপর চটজলদি স্পেস-টাইম ভেরিয়েটর বেল্ট পরিয়ে দিল মিজানের কোমরে। কয়েক পলকের মধ্যে মিজান আর তিতি পৌঁছে গেল সেই গোলাকার ঘরে। 

তিতি সরাসরি মিজানকে নিয়ে শুইয়ে দিল একটি বিছানায়। বলল, তোমার হাতের কাটাটা মারাত্মক। আমাদের ডাক্তাররা ব্যাপারটার চিকিৎসা করবেন। আশা করি, তুমি তাতে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করবে। আমাদের চিকিৎসা হবে লেজার দিয়ে। ফলে এতে সময়ও কম লাগবে, আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা ৯৯.৯৯৯৯৯৯৯ ভাগ। ওকে?

মিজানের মুখে একটা মাস্ক পরিয়ে দেওয়া হলো। মিজান চলে গেল অন্য এক আনন্দের জগতে। সে বুঝল আবার তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করছে। নখ। মিজানের হাতের ক্ষত তারা লেজার সার্জারি করে প্রায় সারিয়ে তুলল। তারপর জায়গাটায় আবার আগের মতো ব্যান্ডেজ করে দিল, যাতে অন্য কেউ ধরতে না পারে। 

অপারেশন শেষ হলে তার মাস্ক সরিয়ে ফেললে সে দেখতে পেল দুজন নারী চিকিৎসাকর্মীকে। তারা মিষ্টি হাসি হেসে এই প্রকোষ্ঠ ত্যাগ করল। তিতি এল। বলল, ক্যানটিনে যাবে? নাকি খেলবে?

মিজান বলল, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে না? আপনি না মোহন আর রাজীবকে বলে এসেছেন শুধু ৫ মিনিটের কথা। 

তিতি বলল, ওদের ৫ মিনিট তো অনেক সময়। আমাদের এখানে পুরো ৫ ঘণ্টা। তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো। 

মিজান বলল, না, আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। আপনি আমাকে হোস্টেলের সিটেই রেখে আসুন। 

ঠিক আছে। মিষ্টি হাসি হেসে তিতি বলল। 

তিতি তাকে নিয়ে চলল হোস্টেলের সিটে। মিজান ঘুমিয়ে পড়ল। তিতি দরজা খুলে দিল। দেখল, কেউ নেই। সে অন্তর্হিত হলো। 

মিজান বাথরুমে গেল। নিজের ব্যান্ডেজটা খুলল। দেখল, ক্ষত নেই বললেই চলে। শুধু একটুখানি দাগ রয়ে গেছে। মিজান চুপ মেরে গেল। এসব কথা কাউকে বলা যাবে না৷

মিজানের ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়। চোখ মেলে দেখতে পেল বাবা তার পাশে বসে আছেন। তার ধাতস্থ হতে খানিক সময় লাগল। আস্তে আস্তে তার মনে পড়ে গেল তিতির কথা, আর তাদের শিপে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে ফিরে এল কখন আর কীভাবে? নাকি সে ঘুমিয়ে আবার স্বপ্ন দেখল?

বাবা বললেন, বাবা মিজান, আমি তোর বাবা। মিজান বলল, বাবা, তুমি কেমন আছ?

বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আছি একরকম। মা কেমন আছে?

আছে। ভালোই। 

ময়না? ভালোই। 

বড় হয়েছে?

মনে হয়। রোজ দেখি তো বুঝতে পারি না। 

আমি দেখলে বুঝব। 

বাবা, ময়নার নাম রেখেছ?

হ্যাঁ। 

কী?

মৃদুল। মৃদুল রহমান। 

সুন্দর নাম। 

বাবা বললেন, তোর জন্য কিছু কমলা এনেছি। আর কিছু টাকা। টেবিলে রেখে গেলাম। 

আচ্ছা। 

বাবা চলে গেলেন। আবার ফিরে এলেন। বললেন, বাবারে আমার ওপর কোনো রাগ রাখিস না। 

না। তোমার ওপর আমার কোনো রাগ নাই। মার ওপরেও নাই। 

বাবা চলে গেলে সিরাজ স্যার এলেন। বসে রইলেন শিয়রের কাছে। চুপচাপ।

রাতের বেলা তার খাবার এসে গেল রুমেই। বাঁ হাত দিয়ে খেতে খেতে মোহন আর রাজীবকে মিজান জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, বিকেলে কি একজন লোক এসেছিল আমার কাছে? চশমা পরা?

হ্যাঁ। 

সে কি দরজা বন্ধ করে আমাকে দেখেছিল?

হ্যাঁ। 

তারপর?

আমরা মিনিট পাঁচেক পরে এসে দেখি সে আর নাই। দরজা খোলা। 

আচ্ছা, ঠিক আছে। 

কেন রে?

না। কিছু না। এমনি। ঘুমের ওষুধ দিয়েছে তো। কী ঘটল না ঘটল মনে থাকে না৷

মিজান বাথরুমে গেল। নিজের ব্যান্ডেজটা খুলল। দেখল, ক্ষত নেই বললেই চলে। শুধু একটুখানি দাগ রয়ে গেছে। মিজান চুপ মেরে গেল। এসব কথা কাউকে বলা যাবে না৷

চলবে…