আনন্দ বাড়ি

তুরিন বাড়ি থেকে বের হয়ে দেখে ঘন কুয়াশা। বেলা প্রায় ১১টা। এখন পর্যন্ত সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। মাঘ মাস শুরু হয়েছে। শীত এবার জাঁকিয়ে পড়েছে। পৌষ মাস থেকেই শীতে কাঁপুনি উঠে গেছে।

তুরিনের বয়স ২৫ বছর। শরীরের গঠন হালকা–পাতলা। বেশ লম্বা। পরনে হুডি, পায়ে কেডস। পিঠে ব্যাকপ্যাক। তাতে ড্রয়িং খাতা, তুলি, রং, গল্পের বই, হারমোনিকা আর কয়েকটা জামাকাপড় আছে। বাড়ি ছেড়ে তুরিন চলে এসেছে। তার মন অত্যধিক খারাপ। মন খারাপ হওয়ার কারণ হচ্ছে বাবা বকেছেন। উচ্চমাত্রার বকাঝকা।

সকালে নাশতার টেবিলে বসে বাবা বললেন, তোমার চাকরির খবর কী?

ডিমভাজিতে পেঁয়াজ আছে কাঁচা অবস্থায়। কাঁচা পেঁয়াজ মুখের নিচে পড়লে তুরিনের শরীর গুলিয়ে ওঠে। সে একবার মাকে বলেছে, আমার জন্য ডিম ভাজলে পেঁয়াজ দেবে না। নয়তো আমার জন্য ডিমটা আমাকে ভাজতে দেবে। মা তাকে ডিম ভাজতেও দেন না, ডিমে পেঁয়াজ দেওয়াও বন্ধ করেন না।

ডিমভাজি থেকে কাঁচা পেঁয়াজ আলাদা করতে গিয়ে তুরিন খেয়াল করেনি বাবা তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করেছেন। তার মনোযোগ তখনো ডিমের ভেতর আধা সেদ্ধ পেঁয়াজের দিকে।

বাবা আচমকা বাজখাঁই গলায় চিত্কার করে উঠলেন, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বাবাকে অগ্রাহ্য করা শুরু করে দিয়েছ! আমার কথা তোমার কানে যায় না! চাকরি করে দুই টাকা কামাই করলে তো আমাকে বলবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও। পাস করার পর বছর পার হয়ে গেল। হাত গুটিয়ে বাড়িতে বসে আছ। তোমার বন্ধুদের চাকরি হয়, তোমার চাকরি হয় না। রুটিতে ঘি মাখিয়ে ডিমভাজি দিয়ে খাও। দেব বাড়ি থেকে বের করে। রাস্তায় গিয়ে বাতাস খেয়ে থাকবে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছে, চাকরি হয় না!

তুরিনের অবাক লেগেছে মা কোনো কথা বললেন না দেখে। তিনি বলতে পারতেন, মেয়ে কাজের সন্ধান করছে।

গত বছর অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছে তুরিন। তাদের চাকরির পরিধি এমনিতেই এ দেশে খুব কম। গত এক বছরে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়েনি। আগে যারা পাস করেছে, তাদের সঙ্গে সে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। চাকরির জন্য নিজের মতো করে চেষ্টা করে যাচ্ছে। মাঝে কিছুদিন টিউশনি করেছে। বাবা রাজি হননি বলে টিউশনি ছেড়ে দিয়েছে।

নাশতা শেষ করে বাবা অফিসে চলে গেলেন। মা ঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে নিয়ে তুরিন বের হয়ে পড়ল। সে কোথায় যাবে, সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। প্রথমে যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে খোলা মাঠে ভেজা ঘাসে বসে থাকবে কিছুক্ষণ। ছোট খালার বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। ছোট খালা গ্রামে থাকেন। গহিন গ্রামে। এখান থেকে বাস কিংবা ট্রেনে যেতে হয়। তারপর ভ্যানরিকশা অথবা নৌকায়। বর্ষায় নৌকা চলে। এখন ভ্যানরিকশায় যেতে হবে। ইজিবাইক পাওয়া যেতে পারে। তুরিন প্রথমে যাবে ট্রেনে, তারপর ভ্যানরিকশায়।

মুঠোফোন বাসায় রেখে এসেছে। তাকে কেউ খুঁজে পাবে না। তার চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট গুগল ড্রাইভে আছে। ছোট খালার বাড়িতে নেট পাওয়া গেলে সেখান থেকে সে চাকরি খোঁজার কাজ চালিয়ে নিতে পারবে। তুরিন ঠিক করেছে, যত দিন তার চাকরি হবে না, তত দিন সে বাড়ি ফিরবে না।

জমাট বাঁধছে কুয়াশা। এত ঘন কুয়াশা তুরিন আগে কখনো দেখেনি। তীব্র শীত লাগছে। হুড মাথায় এঁটে বুকের ওপর আড়াআড়ি দুই হাত মুড়িয়ে তুরিন হাঁটতে থাকল। হাঁটতে হাঁটতে কুয়াশা তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলল। কুয়াশার ভেতর নিজের হাতের আঙুল দেখা যাচ্ছে না। সামনে যাবে, নাকি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে, ভাবতে ভাবতে কুয়াশা চলে গেল।

তুরিন দেখল সে একটা ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের আবহাওয়া বেশ উষ্ণ। আরাম বোধ হচ্ছে। নরম নীল আলোয় ভরে আছে ঘর। খানিকটা ঝিনুকের খোলসের ভেতরটা যেমন হয়, সে রকম গোলাকার ঘর। তুরিনের মনে হলো, সে নীলাভ কোনো এক ঝিনুকের খোলের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে।

তোমার নাম কী?

চমকে উঠেছে তুরিন। সামনে দুজন মানুষ দাঁড়ানো, সে খেয়াল করেনি। তাদের দেখাচ্ছে অস্বাভাবিক। চোখের দৃষ্টি স্থির। মাথায় চুল নেই। লম্বাটে মুখ কাচের মতো স্বচ্ছ। গাঢ় নীল চোখ। কান দুটো ওপরের দিকে বেঢপ খাড়া। তারা তুরিনের দিকে তাকিয়ে আছে।

এ রকম পরিস্থিতিতে তুরিনের ভয় লাগার কথা। তার ভয় লাগছে না। সে বুঝে ফেলেছে, স্বপ্ন দেখছে। স্বপ্নেও মানুষ ভয় পায়। স্বপ্নের নিয়ন্ত্রণ নিজের কাছে থাকে না। মস্তিষ্ক স্বপ্নে কাহিনি বানায়। এখন স্বপ্নে তুরিন ভয় পাচ্ছে না। শুধু সে মনে করতে পারছে না কখন ঘুমিয়ে পড়ল। নাশতা শেষে বাবা অফিসে চলে গেলে সে ব্যাগ গুছিয়েছে। মা রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। মায়ের পাশ দিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে বাড়ি থেকে বের হয়ে এল। পথে ছিল ঘন কুয়াশা। এর ভেতর সে ঘুমাল কখন!

তুরিন তালগোল পাকিয়ে ফেলার আগে নিজেকে সামলে নিল। শীতল গলায় বলল, কারও কাছে তার পরিচয় জানার আগে নিজের পরিচয় দিতে হয়। এটা সাধারণ ভদ্রতা।

সামনের দুজনের মুখে বিব্রতভাব দেখা গেল না। একজন বলল, আমার নাম রিবো।

পাশেরজন বলল, আমি কাসিদ।

রিবো বলল, তোমাদের হিসাবে এই গ্রহ থেকে আমাদের গ্রহের অবস্থান ১০০ আলোকবর্ষ দূরে। অল্প দিন হলো তোমরা আমাদের গ্রহের সন্ধান পেয়েছ।

তুরিন বলল, সেই গ্রহের নাম দেওয়া হয়েছে টিওআই সেভেন হানড্রেড ডি।

তোমার বুদ্ধি উচ্চ পর্যায়ের।

মস্তিষ্কের কারবার অত্যন্ত জটিল। আমি কখনো মহাকাশ নিয়ে ভাবিনি। অথচ মস্তিষ্ক আমাকে স্বপ্নে ভিনগ্রহের দুজন মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

কাসিদ বলল, তুমি স্বপ্ন দেখছ না। তুমি এখন আমাদের স্পেসশিপে আছ। আমরা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে পৃথিবীতে এসেছি।

খানিকটা ক্লান্ত বোধ করছে তুরিন। এটা স্বপ্ন নাকি স্বপ্ন নয়, তা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা করছে না। সে ঘাড় ঘুরিয়ে নাক দিয়ে বাতাস টেনে নিল। মুখ অল্প হাঁ করে হাই তুলল। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, আমরা নিশ্চয় বসে কথা বলতে পারি।

নিষ্প্রাণ গলায় কাসিদ বলল, অবশ্যই।

তিনজন তিনটা চেয়ারে বসেছে। আরামদায়ক চেয়ার। তাদের মাঝখানে গোলাকার টেবিল। তুরিন তার পিঠ থেকে ব্যাকপ্যাক নামিয়ে পাশে রাখল। বলল, আশা করি স্পেসশিপে চা বা কফির ব্যবস্থা আছে। শীতের সময় গরম চা বা কফি খেতে ভালো লাগে।

তারা কথা বলল না। রিবো উঠে গিয়ে ক্রিস্টাল গ্লাসে স্বচ্ছ পানীয় নিয়ে এল। তুরিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, খেয়ে আরাম পাবে। উষ্ণ ও উত্তেজক পানীয়।

তুরিন গ্লাসে চুমুক দিল। হালকা উষ্ণ, হালকা মিষ্টি, একটুখানি টক বা নোনতা ভাব আছে, কোনো একটা ফুল বা ফলের গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। খেতে অপূর্ব। চুমুক দিতেই শরীর চনমনে হয়ে উঠল।

তুরিন বলল, ধন্যবাদ।

কাসিদ বলল, তোমাদের গ্রহ অতি সুন্দর। তোমাদের গ্রহের সব প্রাণী অত্যন্ত আন্তরিক। তবে এখন পর্যন্ত আমাদের কেবল মানবপ্রজাতির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে।

তোমরা কি পৃথিবীর দখল নিতে এসেছ?

এটা তোমাদের ভুল ধারণা। যে যার গ্রহে থাকবে। এক গ্রহের প্রাণী কেন আসবে অন্য গ্রহ দখল করতে?

বিজ্ঞানের আধুনিক কোনো প্রযুক্তি পরীক্ষা করতে এসেছ এখানে?

রিবো শুকনা গলায় বলল, তুমি এখনো তোমার নাম বলোনি।

তুরিন বলল, কথায় কথায় কথা এগিয়ে গেছে। আমি দুঃখিত। আমার নাম তুরিন। অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। পড়া শেষ করে পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছি। বর্তমানে চাকরি জোগাড় করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

রিবো বলল, বিজ্ঞানের কী জানো তুমি?

উড়োযান খাড়া উঠিয়ে দিতে পারি। পাখির মতো তাকে আকাশে ভাসাতে পারি।

আমাদের গ্রহে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসব শেখানো হয়। প্রযুক্তিতে আমরা এগিয়েছি অনেক দূর।

গ্লাসের উষ্ণ পানীয় শেষ হয়ে এসেছে। তুরিন গ্লাসে চুমুক দিয়ে ঢক করে শেষ পানীয়টুকু খেয়ে নিল। সে প্রশান্তি বোধ করছে।

কাসিদ বলল, প্রযুক্তি আমাদের সব দিয়েছে। শুধু নিজের ভেতর থেকে প্রাণবন্ত হওয়ার কোনো কৌশল আমরা আবিষ্কার করতে পারিনি।

রিবো বলল, পৃথিবীতে তোমরা কয়েক লাখ বছর ধরে টিকে আছ। তোমাদের মুখে হাসি। ক্লান্তি তোমাদের স্পর্শ করে না। কেমন করে সম্ভব?

তুরিন বুঝে গেছে সে বেশ জটিল স্বপ্নে জড়িয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে সে ঘুমিয়ে নেই। জেগে আছে। চোখ খুললেই ঘুম ভেঙে যাবে। স্বপ্নও চলে যাবে। সে চাইছে না স্বপ্ন চলে যাক। বরং যতক্ষণ স্বপ্নের ভেতর থাকা যায়, ততক্ষণ মজা পাওয়া যাবে।

সে বলল, তোমাদের পানীয় বেশ উত্তম। এক কাজ করি এসো, আমরা গরম শরবতের দোকান চালু করি। কোল্ড কফি টাইপ। তোমরা শরবত বানাবে, আমি বিক্রি করব। রোজগার যা হবে, তার অর্ধেক তোমাদের, অর্ধেক আমার।

কাসিদ উঠে চলে গেল। রিবো একদৃষ্টে তুরিনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখের পাতা পড়ছে না। তুরিন ভেবেছিল শরবতের দোকান দেওয়ার কথা শুনে রিবো হাসবে নয়তো রেগে যাবে।

রিবো বলল, তোমরা কীভাবে হাজার বছর ধরে ক্লান্ত না হয়ে বেঁচে আছ?

তুরিন বুকের ভেতর থেকে ফস করে বাতাস ছেড়ে দিয়ে বলল, চাকরি রে ভাই, চাকরি। মনের মতো একটা চাকরির জন্য ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হওয়ার সুযোগ পাওয়া যায় না। এটা বিশেষ ধরনের লড়াই। একটা চাকরি পাওয়া গেলে সেটা পছন্দ হয় না। হয় বস খারাপ, না হয় বেতন কম, কিংবা পরিবেশ জঘন্য। তখন আরেকটা চাকরির খোঁজে নতুন লড়াই শুরু হয়। তোমাদের গ্রহে বুঝি পাস করার সঙ্গে সঙ্গে সবার চাকরি হয়ে যায়! আরামদায়ক পরিবেশ, ভালো বেতন, চমত্কার বস। এত ভালো তোমাদের ভালো লাগে না। তাই তোমরা হতাশ হয়ে পড়ো।

কাসিদ রাস্তার পাশ থেকে একজনকে নিয়ে এসেছে। মাফলার দিয়ে তার মাথা মোড়ানো। পরনে লুঙ্গি। গায়ে জ্যাকেটের ওপর চাদর জড়ানো। রিবোকে ডেকে কাসিদ বলল, একবার এদিকে এসো। আরেকজনকে আনা হয়েছে।

রিবো উঠে পড়েছে। সে তুরিনকে ঘরে একা রেখে হেঁটে বেরিয়ে গেল। রিবো ঘরের যেদিক দিয়ে বেরিয়েছে, সেই পাশটা একা একাই আস্তে করে বন্ধ হয়ে গেল। যেন সেখানে কোনো দরজা নেই। সমান দেয়াল। উজ্জ্বল আলোয় ভরে আছে ঘর। তুরিন বুঝতে পারছে, সে আটকা পড়ে গেছে। তার আর কিছু করার নেই।

রাস্তার পাশ থেকে কাসিদ যাকে নিয়ে এসেছে, তার নাম মজনু। বয়স ৫৪ বছর। ঠোঁটের ওপর ঝাঁটার কাঠির মতো খাড়া খাড়া গোঁফ। পেকে সাদা হয়ে গেছে। মুখে কয়েক দিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি। মজনুর মেজাজ হয়ে আছে অতিরিক্ত খারাপ। প্রতিদিন সে এখানে ভ্যানের ওপর খেজুরের রসের ঠিলা নিয়ে বসে। সকালে যারা হাঁটতে আসে, তারা খেজুরের রস খায়। প্রতিদিন তার রস বিক্রি হয় আট ঠিলা। আজ সকাল থেকে এখন পর্যন্ত রস বিক্রি হয়েছে মাত্র দুই ঠিলা। ঘন কুয়াশায় মানুষ হাঁটতে বের হয়েছে কম। বেলা যত বাড়বে, রস তত অন্য রকম হয়ে যাবে।

কাসিদ বলল, আমার নাম কাসিদ। তার নাম রিবো। আমরা এসেছি আপনাদের হিসাবে এখান থেকে ১০০ আলোকবর্ষ দূরের গ্রহ থেকে। আপনারা আমাদের গ্রহের নাম দিয়েছেন টিওআই সেভেন হানড্রেড ডি। আপনার নাম কী?

কাসিদ কী বলল, তাতে মজনুর বিশেষ আগ্রহ দেখা গেল না। সে বলল, আমার নাম মজনু। আমি বিরাট আনন্দে আছি, স্যার। আপনাদের অশেষ দোয়া। দুই ঠিলা রস বিক্রি করেছি মাত্র। পাঁচ ঠিলা বাকি। টাকাপয়সার করুণ অবস্থা। আজ টাকা দিতে পারব না। দুজন দুই গ্লাস রস খেয়ে যান।

কাসিদ আর রিবোকে অবাক দেখাচ্ছে। আগে কখনো তারা কোনো ব্যাপারে অবাক হয়নি। এখন হলো। এমন অনুভূতি তাদের নতুন। রিবো বলল, আপনার কথা বিভ্রান্তিকর। বলছেন আশানুরূপ রস বিক্রি হয়নি। আবার বলছেন আনন্দে আছেন। আপনার কাছে কোনো টাকা চাওয়া হয়নি। আপনি টাকার প্রসঙ্গে কথা বলছেন।

মজনু বলল, রাস্তার ধার থেকে পুলিশ কেন ধরে আনে, তা আমরা জানি। ভ্যানে করে মাল বিক্রি করি। জায়গার ট্যাক্স, ইনকাম ট্যাক্স—সবই পুলিশকে দিতে হয়। রস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আপনারা দুজন আজ দুই ঠিলা রস নিয়ে যান। বেশি দেরি হয়ে গেলে রস খাওয়ার পর ঝিমুনি আসবে। তখন ট্যাক্স হয়ে যাবে দ্বিগুণ।

রিবো বলল, তাকে যেখান থেকে নিয়ে এসেছ, সেখানে রেখে এসো।

মজনুকে সঙ্গে নিয়ে কাসিদ বের হয়ে গেল।

তুরিন যেখানে বসে আছে, সেখানে ফিরে এসে রিবো হকচকিয়ে গেল। এমন অনুভবের মুখোমুখি সে প্রথম হয়েছে। ঘরের দেয়ালে অসম্ভব সুন্দর ছবি আঁকা। ১০-১২ বছর বয়সের একজন কিশোরী। মাথার চুল রুক্ষ, তাতে লালচে ভাব। গায়ে লাল ছাপা কামিজ, পরনে নীল সালোয়ার। তার বাঁ কাঁখে গরুর গোবরের ডালি। বাঁ হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে আছে। সামনে ছোট্ট খেজুরগাছ। বাঁশের সরু নল দিয়ে খেজুরের রস চুইয়ে পড়ছে। নলের ওপর ফিঙে বসে আছে। কিশোরী ডান হাতের আঁজলা পেতে তাতে ঠোঁট ঠেকিয়ে রস খাচ্ছে। তার হাতের ফাঁক দিয়ে সূর্য ডুবছে। টকটকে লাল গোল সূর্য।

রিবো বলল, বাহ্! অসাধারণ! অপূর্ব!

ছবির দিকে মুগ্ধ চোখে রিবো তাকিয়ে আছে। সে আগে কখনো এ ধরনের বিস্ময়সূচক শব্দ উচ্চারণ করেনি। তুরিন বুঝতে পারছে না এত সাধারণ ছবি দেখে এমন মুগ্ধ হওয়ার কী আছে! সে ছবি সুন্দর আঁকে সত্য, তাই বলে প্রবল বিস্ময়ে থমকে দেওয়ার মতো ছবি সে আঁকে বলে মনে হয় না।

ছবির নিচে কবিতা লেখা:

আবার নামিবে সন্ধ্যা কোনো একদিন

শীতের বিকেল শেষে কুয়াশা মেখে,

নামিবে বুঝি সন্ধ্যা সেদিন নিঃসঙ্গ বেশে।

সন্ধ্যা নামিবে বুঝি আলভাঙা মাঠে

ফসলের খেতে, তিরতিরে ঢেউ তোলা

রুপালি মাছের দেশে।

এমনি করেই সেদিন বুঝি ফিরে যাবে পাখি

মেঠোপথ ধরে দূর বহুদূর সন্ধ্যাকালে!

কাসিদ ফিরে এসেছে। সে ঘরে ঢুকে ছবি দেখে থমকে দাঁড়াল। কী বলতে এসেছিল, ভুলে গেছে। আত্মহারা হয়ে তাকিয়ে আছে দেয়ালে আঁকা ছবির দিকে।

রিবো বলল, ছবি তুমি এঁকেছ?

তুরিন বলল, হ্যাঁ। আমি ছবি আঁকি।

ছবির পাশে কবিতা লেখা। কার কবিতা?

আমি লিখলাম। মন খারাপ হলে কবিতা লিখি। মন ভালো হয়ে যায়। আমার মন অনেক খারাপ ছিল। ভালো হয়ে গেছে।

মন খারাপ হলে তুমি আর কী করো?

হারমোনিকা বাজাই।

ব্যাকপ্যাক থেকে হারমোনিকা বের করে তাতে ফুঁ দিয়েছে তুরিন। বিহ্বল হয়ে গেছে রিবো আর কাসিদ। তারা কোনো কথা বলছে না। তাদের ভেতর অদ্ভুত আবেগের সৃষ্টি হয়েছে। এমন আবেগ তারা আগে বোধ করেনি। তাদের নিশ্বাস গাঢ় হয়ে এসেছে। বুক ওঠানামা করছে। ভেতরে অপরিচিত কেমন যেন তোলপাড় ভাব।

হারমোনিকার আওয়াজ থেমে গেছে। তুরিন চোখ বন্ধ করে বসে আছে। কাসিদ বলল, মজনুকে বাইরে নিয়ে গিয়ে দেখি পুলিশ ধাক্কা দিয়ে তার ভ্যান উল্টে ফেলে দিয়ে গেছে। তাতে রসের ঠিলা ভেঙেছে। কেউ একজন এসে কোনোরকমে এক ঠিলা রস বাঁচাতে পেরেছে। ভ্যানের চাকা হয়ে গেছে বাঁকা। মানুষ অতি অল্পে খুশি হয়। আমি তার ভ্যানের চাকা ঠিক করে দিলাম। সে অত্যন্ত খুশি হয়ে আমাকে খেজুরের রস খেতে দিল। নিরাপত্তা কোড আমাকে রস খেতে নিষেধ করেছে। এতে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখাচ্ছে।

তুরিন চোখ মেলে তাকিয়েছে। রিবো দেয়ালে আঁকা ছবি থেকে মুখ ফিরিয়ে এনে তার দিকে তাকাল। রিবোর চোখে এখনো প্রবল বিস্ময়।

কাসিদ বলল, রাস্তা দিয়ে যারা যাচ্ছিল, তারা ঘটনা শুনে টাকা জোগাড় করে মজনুকে দিয়েছে। মজনু তীব্র আনন্দ নিয়ে বেঁচে যাওয়া এক ঠিলা রস নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ক্লান্ত না হয়ে মানুষের বেঁচে থাকার রহস্য আমি পেয়ে গেছি।

ঘাড় ঘুরিয়ে রিবো বলল, কী সেটা?

কাসিদ বলল, মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, তাদের ক্লান্ত না হয়ে হাজার বছর ধরে টিকে থাকার একমাত্র কৌশল।

তুরিন বলল, তোমাদের দেয়াল নষ্ট করেছি। আমার কিছু করার ছিল না। বসে বসে ছবি আঁকছিলাম। ছবি এঁকে কবিতা লিখলাম।

রিবো বলল, আমরা দিনরাত পরিশ্রম করি। আমাদের শুধু কাজ আর কাজ। জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে এগিয়ে গেছি অনেক দূর। আমাদের গ্রহে গান নেই। কবিতা নেই। আমরা ছবি আঁকতে জানি না। ছকে বাঁধা আমাদের জীবনের সবকিছু। আমরা কেবল নিয়মমাফিক কাজ করে যাই। কোনো ব্যাপারে কখনো বিস্মিত হই না। তাই ক্লান্ত হয়ে পড়ি।

তুরিন তাকিয়ে আছে রিবোর দিকে। রিবো বলল, তোমাকে আমাদের বিশেষ পছন্দ হয়েছে। তোমার সহযোগিতা চাইছি।

তুরিন খানিকটা ভ্যাবাচেকা খাওয়া গলায় বলল, আমি কীভাবে তোমাদের সহযোগিতা করব?

কাসিদ বলল, আমাদের গ্রহে চলো। তুমি সেখানে গান শেখাবে, ছবি আঁকা, কবিতা লেখা শেখাবে।

তুরিন বলল, পৃথিবী ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।

তাহলে এখানে ইশকুল বানাও। আমরা ব্যবস্থা করব। আমাদের গ্রহ থেকে তোমার ইশকুলে ছেলেমেয়েরা শিখতে আসবে। একসঙ্গে ১০০ জন আসবে। কেউ গান শিখবে, কেউ কবিতা লেখা শিখবে। কেউ ছবি আঁকা শিখবে। আর যা কিছু শেখাতে চাও, তারা শিখে যাবে।

তুরিন বুঝে উঠতে পারছে না ঘটনা কী ঘটছে। সে হয়তো স্বপ্নেই আটকে আছে এখনো।

কাসিদ বলল, প্রযুক্তিতে আমরা সেখানে পৌঁছেছি যে আমাদের চেহারা বদলে অবিকল মানুষের চেহারা ধারণ করতে পারি। আমাদের গ্রহ থেকে যারা তোমার স্কুলে শিখতে আসবে, তাদের চেহারা হবে হুবহু মানুষের মতো।

তুরিনের ঘোরলাগা ভাব কাটেনি। সে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকল। রিবো বলল, তোমাকে একটা কথা দিতে হবে।

কী কথা?

যেন তুরিন বলল না, তার ভেতর থেকে অন্য কেউ বলে উঠল।

রিবো বলল, তুমি কোনো দিন কাউকে বলতে পারবে না তোমার স্কুলে ভিনগ্রহের প্রাণী আছে।

কাসিদ বলল, আমরা এমন ব্যবস্থা করব, যাতে তোমাদের রাডারে কখনো আমাদের অস্তিত্ব ধরা না পড়ে।

রিবো বলল, তুমি কথা দাও। প্রতিজ্ঞা করো।

তুরিন বলল, প্রতিজ্ঞা করছি, কোনো দিন কাউকে বলব না ভিনগ্রহের প্রাণীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে।

নরম নীল আলোর ঘর সরে গেছে। চারপাশে ঘন কুয়াশা। তুরিন রাস্তার পাশে শীতে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ ভ্যানের ওপর ঠিলাতে করে খেজুরের রস বিক্রি করছেন। তুরিন তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনার নাম কী?

সেই লোক তুরিনকে চমকে দিয়ে নিজের নাম বলল, মজনু।