৬.
পরের দিন যার সঙ্গে দেখা হলো, সে লোকটাকে ভালোমানুষ ও বুদ্ধিমান বলে মনে হলো। ফার্মের প্রধান দালানটার দ্বিতীয় তলায় তার কাজের ঘরে আমায় নিয়ে আসা হয়েছিল। একগাল হেসে লোকটা হাত বাড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো।
‘আরে প্রফেসর রাউখ, ভারি খুশি হলাম আপনাকে দেখে।’
সংযতভাবে বললাম, ‘নমস্কার। কিন্তু জানতে পারি কার সঙ্গে কথা কইছি?’
‘আমার নাম বলৎস, হ্যান্স বলৎস। আমাদের কর্তা আমায় একটা অস্বস্তির কাজ চাপিয়েছেন—তাঁর হয়ে আপনার কাছে ক্ষমা চাওয়া।’
‘ক্ষমা চাওয়া? আপনার কর্তা কি সত্যিই বিবেকে ভোগেন?’
‘জানি না রাউখ, সত্যিই জানি না। অন্তত, যা কিছু ঘটেছে তার জন্যে তিনি অকৃত্রিমভাবে মাপ চেয়ে পাঠিয়েছেন। রাগ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। মানে অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে উনি ভারি রুষ্ট হন।’
একটু হাসলাম আমি।
‘আমি তো তাঁর অতীত ঘাঁটাঘাঁটি করার জন্যে আসিনি। আমার উদ্দেশ্য ছিল অন্যরকম। অমন চমৎকার করে যাঁরা অঙ্ক কষেছেন তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিলাম আমি...’
‘বসুন প্রফেসর, ঠিক এই বিষয়েই কথা বলতে চাই আমি।’
এগিয়ে দেওয়া চেয়ারটায় বসে মস্ত ডেস্কের ওপারের স্মিত মুখখানাকে লক্ষ্য করতে লাগলাম আমি। খাঁটি উত্তরদেশীয় জার্মান চেহারা বলৎসের,
লম্বাটে মুখ, ফ্যাকাশে চুল, বড় বড় নীল চোখ। একটা সিগারেট কেস নিয়ে খেলা করছিল তার আঙুলগুলো। বলল, ‘এখানকার গণিত বিভাগের দায়িত্বে আছি আমি।’
‘আপনি? আপনি কি গণিতজ্ঞ?’
‘খানিকটা। অন্তত তা নিয়ে খানিকটা মাথা খাটাই।’
‘তার মানে আপনার মারফত এখানকার গণিতজ্ঞদের দেখা মিলবে।’
‘তাদের সকলকেই আপনি ইতিমধ্যে দেখেছেন রাউখ।’ বলৎস বলল। হাঁ করে চেয়ে রইলাম আমি।
‘একটা দিন, একটা রাত আপনি কাটিয়েছেন তাদের সঙ্গে।’
মনে পড়ল ওই ওয়ার্ড আর তার অধিবাসীদের কথা, প্রেরণা আর কোড নিয়ে তাদের যত বাজে বকুনি।
‘আপনি বলতে চান ওই পাগলেরাই আমার অঙ্ক কষে দিয়েছে অমন প্রতিভাধরের মতো?’
উত্তরের অপেক্ষা না করে হেসে উঠলাম আমি।
‘ঠিক ওরাই। আপনার শেষ অঙ্কটা কষেছেন ডেনিস নামে একজন লোক। যতদূর জানি, কাল রাতে আপনাকে সে নিউরোকিবারনেটিক্স বিদ্যা সম্পর্কে একটা বক্তৃতা দিয়েছিল।’
কিছুক্ষণ ভেবে বললাম: ‘তাহলে দেখা যাচ্ছে আমি কিছুই বুঝিনি। আপনি একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?’
‘সানন্দে। কেবল এই জিনিসটা আগে একবার দেখুন।’
এই বলে বলৎস সকালবেলাকার কাগজটা এগিয়ে দিল আমার দিকে। ধীরে ধীরে খুললাম কাগজটা। তারপর লাফিয়ে উঠলাম। প্রথম পাতায় কালো বর্ডারের মধ্যে থেকে তাকিয়ে আছে... আমারই নিজের ছবি। তার নিচে বড় হরফে ক্যাপশেন: ‘পদার্থবিদ্যার প্রফেসর ডা. রাউখের শোচনীয় মৃত্যু।’
‘এর মানে কী বলৎস? এ আবার কী রসিকতা? চেচিয়ে উঠলাম আমি।
‘শান্ত হোন। ব্যাপারটা খুবই সোজা। কাল রাতে হ্রদের কাছে একটু পায়চারি করে বাড়ি ফেরার সময় সাঁকোর ওপর ‘জ্ঞানীগৃহের’ দুটো পালাতক পাগল আপনাকে আক্রমণ করে, খুন করে থ্যাঁতলা করে ফেলে দেয় নদীতে। আজ ভোরে আপনার লাস পাওয়া গেছে বাঁধের কাছে। পোষাক এবং পকেটের কাগজপত্র থেকে সনাক্ত হয়েছে লাসটা আপনার। আজ সকালে পুলিস এসেছিল ‘জ্ঞানীগৃহে’, আপনার শোচনীয় মৃত্যুর পুরো কাহিনীটা তারা বার করেছে।’
কেবল তখনই তাকিয়ে দেখলাম আমার পোষাকের দিকে। যে স্যুটটা পরে আছি সেটা আমার নয়। পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম যা দলিলপত্রাদি ছিল তার কিছু নেই।
‘কিন্তু এ যে একেবারে নির্লজ্জ মিথ্যা, প্রতারণা, বদমাইশি...’
‘তা ঠিক। আপনার সঙ্গে আমি একমত। কিন্তু কী করি বলুন রাউখ, কী করা যাবে? আপনাকে নইলে ক্রাফৎশ্তুদৎ ফার্মকে ভয়ানক লোকসান সইতে হতে পারে, বলতে কি একেবারেই ফেসে যেতে পারে। আপনাকে বলতে অসুবিধা নেই যে অর্ডারে আমরা একেবারে ডুবে আছি। সবই সামরিক অর্ডার এবং অত্যন্ত দামী। তার মানে দিন রাত কাজ। সামরিক মল্লিদপ্তরের প্রথম কিস্তি অর্ডার শেষ করার পরই কারবার বলা যেতে পারে চাঙ্গা হতে শুরু করেছে।’
ফের লাফিয়ে উঠে উদভ্রান্তের মতো তাকালাম বলৎসের দিকে। বলৎস একটা সিগারেট ধরিয়ে মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করলে চেয়ারের দিকে।
‘আপনাদের জন্যে আর একটা ডেনিস হতে হবে আমায়?’
‘না, না, রাউখ মোটেই নয়!’
‘তাহলে এ প্রহসনের অর্থ?’
‘আমরা আপনাকে চাই গণিতের শিক্ষক হিসাবে।’
‘শিক্ষক?’
ফের লাফিয়ে উঠে উদভ্রান্তের মতো তাকালাম বলৎসের দিকে। বলৎস একটা সিগারেট ধরিয়ে মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করলে চেয়ারের দিকে। একেবারে হতভম্বের মতো বসে পড়লাম আমি।
‘গণিতজ্ঞ দরকার আমাদের প্রফেসর রাউখ। পেতেই হবে নইলে শিগগিরই কারবারের দফা রফা।’
আমি নীরবে তাকিয়ে রইলাম বলৎসের দিকে। এখন আর তাকে মোটেই তেমন ভালোমানুষ মনে হচ্ছিল না। মুখের ওপর কেমন একটা পাশবিক আভাস চোখে পড়তে লাগল আমার, খুব অস্পষ্ট হলেও কিন্তু ইতিমধ্যেই সেটা তার হার্দ্য ভাবটাকে ছাপিয়ে উঠতে শুরু করেছে।
‘কিন্তু আমি যদি অস্বীকার করি? জিজ্ঞেস করলাম আমি।’
‘খুবই খারাপ হবে তাহলে। সে ক্ষেত্রে ওদের একজন হতে হবে আপনাকে, মানে... কম্পিউটারদের একজন।’
‘সেটা কি এতই খারাপ?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘হ্যাঁ,’ দৃঢ়ভাবে জবাব দিয়ে উঠে দাঁড়াল বলৎস, ‘তার অর্থ আপনার জীবন শেষ হবে জ্ঞানীগৃহে।’
ঘরময় কয়েকবার পায়চারি করে বলৎস বক্তার মতো সুরে বলতে লাগল: ‘মানব মস্তিষ্কের হিসাব ক্ষমতা একটা ইলেকট্রনিক যন্ত্রের চেয়ে কয়েক লাখগুণ বেশি। একশ কোটি গাণিতিক কোষ, তার ওপর স্মৃতি, অবদমন, যুক্তি, স্বতঃবোধ ইত্যাদি সহায়ক যন্ত্রের ফলে মস্তিষ্ক যে কোনো সম্ভাব্য যন্ত্রের চেয়ে উচ্চস্তরের জিনিস। তাহলেও যন্ত্রের একটা প্রধান সুবিধা আছে।’
‘কী সুবিধা?’ ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কী বলতে চাইছে বলৎস।
‘ধরুন, যদি একটা ইলেকট্রনিক যন্ত্রের একটা বা একগুচ্ছ ট্রিগার নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে ভালভ, রেজিস্টার, ক্যাপাসিটর ইত্যাদি বদলে দিলেই যন্ত্রটা ফের কাজ করতে শুরু করবে। কিন্তু মস্তিষ্কের হিসাব এলাকাটার একটা কোষ বা একগুচ্ছ কোষ নষ্ট হলে তার ক্ষতিপূরণ অসম্ভব। দুর্ভাগ্যবশত, এখানে মস্তিষ্কের ট্রিগারগুলোকে ভয়ানক দ্রুত বেগে খাটাতে হচ্ছে আমাদের। ফলে বলা যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অসম্ভব বাড়ে। জীবন্ত কম্পিউটাররা শিগগিরই ফুরিয়ে যায় এবং তখন...’
‘তখন?’
‘তখন তাদের গতি হয় জ্ঞানীগৃহে।’
‘কিন্তু এটা যে অমানুষিকতা এবং অপরাধ!’ বলে উঠলাম উত্তেজিতভাবে।
আপনি পদার্থবিদ, জটিল মাধ্যমের বিদ্যুৎ-চুম্বক প্রক্রিয়ায় আপনার কৌতূহল আছে। আপনি কী বোঝেন না যে, আপনার মাথাটার ওপর একটা উপযুক্ত বিদ্যুৎ-চুম্বক ক্ষেত্র রেখে আমরা যে কোনো নিউরনগুচ্ছের সেরকম উত্তেজনা বন্ধ করে দিতে পারি।
বলৎস আমার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রাখল আমার। এক গাল হেসে বলল, ‘ওই সব কথা আর সংজ্ঞা আপনাকে এখানে ভুলে যেতে হবে রাউখ। আপনি নিজে থেকে যদি না ভোলেন তো আপনার স্মৃতি থেকে তা আমাদেরই মুছে ফেলতে হবে।’
‘সে আশা দুরাশা আপনাদের।’
কাঁধ থেকে ওর হাত সরিয়ে চেচিয়ে উঠলাম আমি।
‘ডেনিসের কথাগুলো আপনার মাথায় ঢোকেনি দেখছি। খুবই আফশোস। কিন্তু খাঁটি কথাই বলেছিল সে। আচ্ছা, বলুন তো স্মৃতি কী জিনিস?’
‘তার সঙ্গে কী সম্পর্ক? কী জন্যে আপনারা সবাই এখানে অমন ঢঙ শুরু করেছেন? কেন আপনারা...’
‘স্মৃতি হলো, প্রফেসর রাউখ, একটা পজিটিভ উল্টো সংযোগের ফলে একগুচ্ছ নিউরোনের দীর্ঘায়ত উত্তেজনা। অন্য কথায়, আপনার মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট এক গুচ্ছ কোষে প্রবহমান বৈদ্যুতিক রাসায়নিক উত্তেজনাই হলো স্মৃতি। আপনি পদার্থবিদ, জটিল মাধ্যমের বিদ্যুৎ-চুম্বক প্রক্রিয়ায় আপনার কৌতূহল আছে। আপনি কী বোঝেন না যে, আপনার মাথাটার ওপর একটা উপযুক্ত বিদ্যুৎ-চুম্বক ক্ষেত্র রেখে আমরা যে কোনো নিউরনগুচ্ছের সেরকম উত্তেজনা বন্ধ করে দিতে পারি। এর চেয়ে সহজ আর কিছু নেই। আপনি যা জানতেন, তা ভুলিয়ে দেওয়া শুধু নয়, যা কখনো জানতেন না তাকেও স্মৃতিবদ্ধ করে দিতে পারি আমরা। তবে এই সব, মানে, কৃত্রিম পদ্ধতি গ্রহণ করায় আমাদের লাভ বেশি নেই। আশা করি, আপনার কাণ্ডজ্ঞানই বড় হবে। ডিভিডেন্ডের একটা মোটা অংশ আপনাকে দিতে রাজী আছে আমাদের ফার্ম।’
‘কী কাজ করতে হবে?’
‘সে তো আপনাকে আগেই বলেছি—গণিত শেখাবেন। আমাদের দেশে সৌভাগ্যবশত বেকার অনেক, তাদের মধ্যে থেকে অঙ্কে মাথা আছে এমন বিশ ত্রিশ জন লোককে বেছে ক্লাস করব। তারপর তাদের উচ্চ গণিত শেখাব মাস দুই তিনের মধ্যে...’
‘সে অসম্ভব...’ বললাম আমি, ‘এ একেবারে অসম্ভব। এত অল্পদিনের মধ্যে...’
‘খুবই সম্ভব রাউখ। মনে রাখবেন যে আপনার ছাত্ররা অতি বুদ্ধিমান, গাণিতিক স্মৃতি তাদের অত্যাশ্চর্য। সে ব্যাপারটা আমরা দেখব। ওটা আমাদের আয়ত্তের মধ্যে...’
‘এটাও কৃত্রিম উপায়ে? প্রেরণা জেনারেটরের সাহায্যে?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি। বলৎস মাথা নাড়ল।
‘রাজী তাহলে?’
‘প্রফেসরকে টেস্ট ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যাও,’ নির্বিকার গলায় নির্দেশ দিয়ে বলৎস আমার দিকে পেছন ফিরে তাকাল জানলার দিকে।
চোখ বুজে ভাবতে লাগলাম আমি। ডেনিস ও ওয়ার্ডের অন্যান্য লোকেরা তাহলে স্বাভাবিক মানুষ, আমায় তারা সত্যি কথাই কাল বলছিল। তার মানে ক্রাফৎশ্তুদৎ কোম্পানি সত্যিই বিদ্যুৎ-চুম্বক প্রেরণা ক্ষেত্রের সাহায্যে মানব চিন্তা, ইচ্ছাশত্তি ও সংবেদনকে নিয়ে ব্যবসা করার পদ্ধতি বের করেছে। টের পাচ্ছিলাম বলৎসের তীক্ষ দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অথচ সিদ্ধান্ত নেওয়া বিটকেলে রকমের শক্ত। যদি রাজী হই, তাহলে আমার ছাত্রদের জন্যে ‘জ্ঞানীগুহে’ যাবার পথ প্রশস্ত করব, যদি রাজী না হই তাহলে নিজেই সেখানে পৌঁছব।’
আমার কাঁধে হাত দিয়ে ফের জিজ্ঞেস করল বলৎস, ‘রাজী তো?’
‘না,’ দৃঢ়ভাবে বললাম আমি, ‘না, এই জঘন্যতার সহযোগী হতে পারি না আমি।’
‘আপনার যা অভিরুচি,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল বলৎস, ‘দুঃখ হচ্ছে আপনার জন্যে।’
পরের মুহূর্তেই কাজের ভাব করে টেবিল ছেড়ে দরজার কাছে গিয়ে ডাকল:
‘এইডার, শ্রাঙ্ক, আসুন এদিকে!’
আমিও উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করবেন আমায়?’
‘প্রথমত, আপনার স্নায়ুপরিস্থিতির প্রেরণা-কোড কী কী তার একটা স্পেকট্রাম নেব।’
‘তার মানে?’
‘তার মানে কী কী রূপ, প্রখরতা, ও ফ্রিকোয়েন্সির প্রেরণায় আপনার কী কী আত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থা হয় তার চার্ট বানাব।’
‘কিন্তু তাতে আমার আপত্তি আছে। আমি প্রতিবাদ করব। আমি...’
‘প্রফেসরকে টেস্ট ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যাও,’ নির্বিকার গলায় নির্দেশ দিয়ে বলৎস আমার দিকে পেছন ফিরে তাকাল জানলার দিকে।