সোনার মাছ

অলংকরণ: আরাফাত করিম

১০ কেজি ওজনের অদ্ভুত সুন্দর একটি মাছ ধরা পড়েছে বালিখোলা আড়তে। মিঠামইনের তুল্লাপুর গাঁয়ের জেলে হাসন আলী তার ছেলেকে নিয়ে ঘাগড়া নদী থেকে ধরেছে ওই মাছটা। খবর পেয়ে দৈনিক কিশোরগঞ্জ বার্তার সাংবাদিক কামাল চৌধুরী এসে গেছেন এই কাকভোরে। ছবি তুলবেন। আড়তে হাসন মিয়াকে ঘিরে ভিড়। ক্রেতা–বিক্রেতা–দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ–উদ্দীপনা। সাংবাদিকের ক্যামেরা দেখে হাসন মিয়া সুন্দর মাছটা তার ১৪ বছরের ছেলে রিপনের কোলে তুলে দিল। ছেলেটার ছবি পত্রিকায় ছাপা হলে তার মা কী খুশিই না হবে!

বছরটা খুবই খারাপ গেছে হাসন মিয়ার। বর্ষার শুরুতেই একদিন জাল টানতে গিয়ে কোমরে চোট পেয়েছিল সে। টানা সাত দিন বিছানায়। আয়রোজগার বন্ধ। প্রায় না খেয়ে মরার দশা। তারপর গঞ্জের ওষুধের দোকান থেকে ব্যথার ওষুধ কিনে খাওয়ার পর আবার মোটামুটি দাঁড়াতে পেরেছে। এরপর আবার বিপদ—জালটা গেল ছিঁড়ে। এদিক–ওদিক থেকে ধারদেনা করে নতুন জাল কেনা হলো এরপর। এ অঞ্চলে তাদের রোজগারের মৌসুম এটা। শুকনো মৌসুমে হাওড় যায় শুকিয়ে, তখন আর এমন মাছ ধরা পড়ে না। সে সময় অন্য কাজ জোটাতে হয় তাদের। এই এক বর্ষা মৌসুমের রোজগারপাতি দিয়েই সারা বছর চালাতে হয়। তবে এই মৌসুমে হাসন মিয়া বেশির ভাগ সময় বাড়িতেই বসে ছিল।

মিঠাপানির মাছের জন্য তাদের এই ঘাগড়া নদী বিখ্যাত। এই নদী অতীতে তাকে অনেক দিয়েছে। বাপ–ছেলে মিলে বিরাট বিরাট বোয়াল, আইড়, মৃগেল, বাউশ ও শোল মাছ ধরেছে গেলবার। এই বালিখোলা আড়ত থেকে দিনে কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয় দেশে। সেই মাছ ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ চলে যায় ইউরোপ–আমেরিকায়। মাছ ধরা তাদের বংশগত পেশা। এ বছর থেকে কিশোর ছেলে রিপনকে সঙ্গে নিয়ে নদীতে নাও ভাসাচ্ছে হাসন মিয়া। অভাবের জন্য ছেলের স্কুলটা ছাড়াতে হলো। এবার তাহলে বাপ–দাদার কাজটা শিখুক।

মাঝেমধ্যে এই আড়তে বিশাল সব মাছ নিয়ে আসে কেউ। আড়তদারদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকায় খবর পেলেই সাংবাদিকেরা ছবি তুলতে আসেন। ‘হাওড়ে ধরা পড়ল বিরল প্রজাতির পাতা মাছ’—এ–জাতীয় সংবাদ ছাপা হয় ছবিসহ। এতে বিক্রিবাট্টা যেমন বাড়ে, তেমন বাড়ে হাটের সুখ্যাতিও। কিন্তু এমন সুন্দর মাছ এ পর্যন্ত দেখেনি কেউ। মাছটার শরীর ভারি মসৃণ, জলপাই রঙের, তাতে নানা রঙের টানা টানা দাগ। যেন একটা রংধনু। দুই দিকে আবার লালচে লম্বা বর্ডার দেওয়া—লেজ থেকে কানকো অবধি। আর কানকোটা কী সুন্দর চকচকে রুপালি! রিপনের দুই হাতজুড়ে মাছ আর পাশে দাঁড়ানো হাসিমুখের বাপ হাসন মিয়ার ছবি পরদিন ছাপা হলো স্থানীয় পত্রিকায়। আর মাছটা বিক্রি হয়ে গেল ছয় হাজার টাকায়। আড়তের অন্যরা সেদিন হিংসাই করল একটু হাসন আলীকে। পত্রিকায় ছবি আর সংবাদের সঙ্গে মৎস্যবিজ্ঞানীর একটি মতামতও ছাপা হলো সঙ্গে—ডক্টর অমুক বলেন, বিরল প্রজাতির এই মাছের নাম রেইনবো ট্রাউট। এই মাছের নিবাস বহু দূরে—রাশিয়ার কামচাটকা পেনিনসুলায় পাওয়া যায় এই মাছ। এটি বাংলাদেশের ঘাগড়া নদীতে কোন পথে এল, তার কোনো সদুত্তর দিতে পারলেন না মৎস্যবিজ্ঞানী।

বাড়িতে ফিরে মাকে কত না গল্প রিপনের! সেই যে একটি রূপকথার গল্প শুনেছে সে মায়ের কাছে, এক জেলে, খুবই গরিব জেলে, দুই বেলা ভাত জোটে না তার, গিয়েছিল মাছ ধরতে। আর জালে উঠে এসেছিল সোনার মাছ! এবার নিশ্চিত বড়লোক হয়ে যাবে, আর কোনো চিন্তা নেই—সেই খুশিতে যে–ই না জেলে মাছটা খলুইয়ে ভরতে যাবে, অমনি মাছটা কথা বলে উঠল! বলল, ‘আমাকে ছেড়ে দাও।’ আর তা শুনে জেলেটার মন গেল নরম হয়ে।

হাসন মিয়া পরদিন ছেলেকে বলে, ‘চল, আইজকাও ওই জাগাত যাই। ওই যেইখানে পানির ঘূর্ণন দেইখা ডরে কেউ যায় না। চাইরদিকে চোরাবালি। সেইখানেই তো মাছডা পাইলাম।’

হাসনের বউ বলে, ‘থাউক, বেশি ঘূর্ণির মইদ্যে না যাওনই ভালা। আপনের নাও তো ছুডো।’

‘আরে ধুর, ডরাও ক্যান। আমার চৌদ্দ পুরুষ জাউলা। ডরাইও না।’ হাসন উত্তর দেয়।

সেদিন তেমন কিছু না ঘটলেও তিন দিন পর সেই জায়গায় আবার অভিনব ঘটনা ঘটে। এবার হাসনের জালে ধরা পড়ে একটা ছোট্ট অদ্ভুতদর্শন মাছ। মাছটার শরীর কেমন স্বচ্ছ, ভেতরের সবকিছু দৃশ্যমান, বিশেষ করে হুকের মতো প্যাঁচানো নাড়িগুলো। আর সেটির মাথার সামনের দিকে বড় বড় দুটি অ্যান্টেনা, চোখ দুটি অস্বাভাবিক রকমের বড়। তার চেয়ে আশ্চর্য হলো মাছটা অন্য মাছগুলোর মতো সাঁতার কাটছিল না, বরং পানিতে লাফিয়ে লাফিয়ে চলছিল ব্যাঙের মতো। এবারও ছবি তোলা হলো, সাংবাদিক এলেন, সঙ্গে এলেন ফিশারিজ ডিপার্টমেন্টের একজন বিজ্ঞানীও। তিনি গুগল ঘেঁটে বললেন, এই মাছের নাম ড্যাফনিয়া, আর এর নিবাস উত্তর গোলার্ধে, বিশেষ করে হোলার্কটিকে। আমাদের আবহাওয়ায় এর বাঁচারই কথা নয়। এবার ভোজনরসিক কেউ নন, খবর পেয়ে ঢাকার এক অ্যাকুয়ারিয়াম ব্যবসায়ী অনেক দাম দিয়ে কিনে নিয়ে গেল মাছটা। হাসন মিয়া বাড়িতে ফিরে বউকে বলল, ‘রিপনের মা, আমরা সোনার মাছ পাইছি। এইবার আর অভাব থাকব না। আল্লায় মুখ ফিরা চাইছে।’

কিন্তু খবরটা চাউর হতে দেরি হলো না। ঘাগড়া নদীর উত্তর–পূর্ব কোণে একটা ঘূর্ণন স্রোতের চোরাবালির মধ্যে ধরা পড়ছে আজব আজব সব মাছ। চোরাবালিতে আটকা পড়ার ভয়ে ওই এলাকায় সাধারণত কেউ মাছ ধরতে যায় না। এর আগে অনেক জেলেনৌকা ডুবেছে ওখানটায়, ভেসে গেছে অনেকে। কেবল হাসন আলী তার কিশোর ছেলেকে নিয়ে রোজ শেষ রাতে সূর্য ওঠার আগে ওই বিপজ্জনক স্থানে মাছ ধরতে যায়। আর তার এই সাহসের পুরস্কারও সে পাচ্ছে বটে। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে আরও বেশ কিছু আশ্চর্য দুর্লভ মাছ ধরা পড়েছে তার হাতে। হাসন আলীর বেড়ার ঘরে এখন পাকা দালান উঠছে, বউয়ের জন্য সোনার গয়না গড়িয়েছে সে।

একদিন ঢাকা থেকে এক বিশেষজ্ঞ দল এসে উপস্থিত হাসনের বাড়িতে। তারা জায়গাটা নিয়ে গবেষণা করতে চায়। কী এমন আছে ওই ঘূর্ণনে যে ওখানে এসব দূরদেশি মাছ ধরা পড়ে? যেসব মাছের নিবাস এই বদ্বীপ হওয়ার কথা নয়?

‘আমার মনে লয়, এই চোরাবালির তলা দিয়া ভিন দেশোত যাওয়া যায়, স্যার। কুনো একটা সুড়ঙ্গ আছে, যেইডা দিয়া বিদেশি মাছ আইসা ঢুইকা পড়ে।’ হাসন আলী সহজ সমাধান দেয়।

কিন্তু যন্ত্রপাতি আর স্পিডবোট নিয়ে টানা চার দিন অনুসন্ধান করেও অনুসন্ধানী দল অস্বাভাবিক কিছু খুঁজে পায় না ওখানে। পায় শুধু চোরা ঘূর্ণিস্রোত, মিশমিশে কালো জল আর কিছু চিংড়ি। দলটি শেষ পর্যন্ত ওখানকার পানি নিয়ে যায় ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করার জন্য। হাসনকে বলে এরপর আজব কোনো মাছ ধরা পড়লে মৎস্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটই তা কিনে নেবে গবেষণার জন্য, সে যেন আর কারও কাছে না বেচে সেগুলো।

হাসনের কপাল ফিরতে দেখে লোভে আরও দু–তিনজন ভোরে ওখানে নৌকা নিয়ে গিয়েছিল বৈকি। কিন্তু তারা দু–চারটা টাকি, মেনি ও পুঁটি ছাড়া কিছু পায়নি। তার ওপর ঘূর্ণিস্রোতে পড়ে তাদের একজনের নৌকাই উল্টে গিয়েছিল। কোনোমতে দাঁড় দিয়ে তাকে পানি থেকে টেনে তোলা হয়। রেইনবো ট্রাউট ধরা পড়ার দুই মাসের মাথায় এলাকায় রটে গেল হাসন আলীর পোলাকে জলদেবী ধরেছে। ছেলেটা তার ভারি মিষ্টি দেখতে, আর এমন সুন্দর কিশোর ছেলেদের দিকেই না পরিদের কুদৃষ্টি পড়ে। নানা অলৌকিক গল্প ছড়াতে লাগল বাপ–ছেলেকে নিয়ে। কে নাকি অপরূপ সুন্দরী এক জলদেবীকে নৌকায় রিপনকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে দেখেছে—এমন কথাও রটল। জেলেপাড়ার ছেলেরা নানা আদিরসাত্মক গল্প ছড়াতে লাগল। রিপনের মা রাতভর কেঁদে স্বামীকে বলল, ‘পোলাডারে নিয়া আর ওইখানে যাইয়েন না, কিরা কাটেন। সত্যই আমার ডর করে।’

হাসন আলী বউয়ের কথা হেসেই উড়িয়ে দেয়। বরং সে ওই ঘূর্ণি থেকে পরবর্তী দুই সপ্তাহে ব্লু গিল সান ফিশ, ক্র্যা ফিশ আর ফেইরি শ্রিম্প ধরে ফেলেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ভোরবেলা সাংবাদিকেরা আড়তদারকে ফোন করে প্রথমেই জানতে চান, হাসন আলীর জালের খবর কী? তারপর একদিন ফিশারিজ থেকে একজন এসে হাসন আলী আর তার ছেলেকে গাড়িতে করে জেলা সদরে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের ছবি তোলা হয়, পরীক্ষা করার জন্য রক্ত আর প্রস্রাব নেওয়া হয়। চোখের রেটিনার ছবি তোলা হয়। হাসন আলী ভয় পেয়ে যায় একটু। সে তো কোনো অপরাধ করেনি। তার জালে যা নিজ থেকে উঠেছে, সে কেবল সেগুলোই আড়তে নিয়ে এসেছে। তার কী দোষ? সে চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার আহাদ সাহেবের পা ধরে হাউমাউ করে ওঠে, ‘আমারে ছাইড়া দ্যান, স্যার। আমার কুনো দুষ নাই। আমি গরিব জাউলা।’

আহাদ সাহেব হাসেন, আরে তোমার কেন দোষ হবে? আমরা একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত। প্রথম কথা, এসব মাছ আমাদের নদীর মাছ নয়, এগুলো বিদেশ থেকে আসে। কিন্তু কোন পথ দিয়ে আসে? আর দ্বিতীয় কথা, যেটা আরও চিন্তার বিষয়, পরীক্ষা করে আমরা একধরনের লবণ পেয়েছি এগুলোর শরীরে। সোডিয়াম ফ্লুরোঅ্যাসিটেট। খেতে এবং দেখতে একবারে সাধারণ লবণের মতোই। কিন্তু এটা সাধারণ লবণ নয়। এর আরেক নাম ১০৮০। আজব না নামটা? নামটা এ রকম, কারণ, এই লবণ দেখতে ও খেতে নিরীহ লবণের মতো হলেও আসলে বিষ। মারাত্মক পয়জন।

হাসন আলী আবার কেঁদে ওঠে, ‘কন কি স্যার? আমি তো মুরুক্ষু মানুষ। আমি কেমনে জানুম এইগুলা বিষাক্ত?’

না, এই মাছগুলো বিষাক্ত না। বিষাক্ত হলো ওই লবণটা। এটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার বলেন আহাদ সাহেব, ১০৮০ একসময় পশুপাখি মারতে ব্যবহার করা হতো। বিশেষ করে নিউজিল্যান্ড–অস্ট্রেলিয়া—ওই সব শীতের দেশে। সাধারণ লবণের মতোই স্বাদ বলে খাবারে মিশিয়ে দিলে কেউ টেরই পেত না যে এটা বিষ। ফলে দলে দলে মারা পড়ে পশুপাখি ও কীটপতঙ্গ। কেবল মাছকে এই বিষ কিছুই করতে পারে না। এমনকি উচ্চ মাত্রার ১০৮০ কিছু মাছ শরীরে নিয়ে দিব্যি বেঁচেবর্তে থাকতে পারে। তার মধ্যে এই মাছগুলো, যেগুলো তুমি ধরেছ, সেগুলোই অন্যতম। এই ভয়ংকর বিষ তারা হজম করে ফেলতে পারে। কী করে হজম করে, তা কেউ জানে না।

হাসন আলী বেকুবের মতো চেয়ে থাকে। আহাদ স্যারের কথার মাথামুণ্ডু সে কিছুই ধরতে পারে না। আহাদ স্যার আবার জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা, তোমরা কি এই ঘূর্ণি থেকে ধরা মাছটাছ খেয়েছ নাকি কখনো?

হাসন আলী ভয়ে ভয়ে বলে, ‘হ স্যার, খাইছি তো। যেদিন বেশি মাছ উডে নাই, দুই–চাইরটা উঠছে, ওই দিন তো আর হাটোত যাই নাই। নিজেরাই ভাইজা রাইন্দা খাইয়ালছি। অহন আর রোজ হাটোত যাইতে ইচ্ছা করে না, স্যার। দরকারও পড়ে না। স্যার, আমাগো রক্তে কি তাইলে বিষ আছে?’

আহাদ স্যার মাথা নাড়েন, না নেই। এটাই দেখতে ডাকছিলাম। ল্যাবরেটরি থেকে জানাল, তোমাদের রক্তে কোন ১০৮০ পাওয়া যায়নি। এর মেটাবলাইটও না। তুমি এখন যেতে পারো হাসন। ভয় নেই।

হাসন বাড়ি যাবে কি, এর মধ্যেই মহা দুঃসংবাদ। হাসনের ছেলে রিপনকে নাকি সাপে কেটেছে। তার বউ আলুথালু বেশে পাগলের মতো ছেলেকে নিয়ে সদর হাসপাতালে চলে এসেছে। হাসন ফিশারিজ অফিস থেকে ছুটল হাসপাতালে। গিয়ে দেখে ছেলে তার দিব্যি বিছানায় বসে কলা খাচ্ছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাচ্ছেন একজন ডাক্তার। হাসনকে দেখে ডাক্তার সাহেব বললেন, যে সাপে ওকে কামড় দিয়েছে, ওটা কেউটে। ভীষণ বিষধর। সাপটাকে মেরে ওর বন্ধুরা ঝুড়িতে করে নিয়ে আসছে। এই সাপ কামড়ালে ৫ ঘণ্টার মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে নিশ্চিত মৃত্যু। কিন্তু আপনার ছেলের ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না। ওর তো কিছুই হয়নি!

সে রাতে হাসনের বউ স্বামীর সঙ্গে ভীষণ ঝগড়া করল। ‘আপনে কথা দ্যান আর আমার পোলারে নিয়া ওই বদ জায়গায় যাইবেন না। আমার বাড়িঘর, সোনার গয়না কিসসু লাগব না। কতা দ্যান আমারে। কিরা কাটেন।’

হাসন আলী চুপ করে থাকে। রিপন উঠানে বসে ডাংগুলি খেলছে আপন মনে। তার ডান গোড়ালির ওপর সাপের দাঁতের স্পষ্ট দুটি গভীর দাগ। হাসন আলী ভাবে যে সে সত্যি সত্যি সোনার মাছের সন্ধান পেয়েছে। এই জলের ঘূর্ণি তাদের ভবিষ্যৎ পাল্টে দেবে একদিন। তার ছেলেকে সে ঢাকায় পড়তে পাঠাবে। ছেলে তার একদিন আহাদ স্যারের মতো বিরাট সরকারি অফিসার হবে, জিপগাড়িতে চড়বে, সরকারি ভবনে থাকবে। হাসন আলী স্বপ্ন দেখে তার বংশ আর জেলে বংশ থাকবে না, তারা জাতে উঠে যাবে এই সোনার মাছ বেচে। স্যুট আর প্যান্ট পরে ভদ্রলোক হয়ে যাবে সে। না, বউয়ের কথায় এই পয়া জায়গা ত্যাগ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। আর জায়গাটা নিজেই তাকে বেছে নিয়েছে, ওখানে অনেকবার গিয়েও অন্য জেলেরা কিছুই খুঁজে পায়নি।

সে রাতে স্বামীর ওপর রাগ করে হাসন আলীর বউ ইঁদুর মারার বিষ খেল। সামান্য নয়, পুরো এক টিন বিষ। তারপর টিনটা স্বামীর সামনে ছুড়ে ফেলে হিসহিস করে বলল, ‘সত্যি সত্যি জলপরিতে পাইছে আপনেরে। ওই পরি মাথা খাইছে আপনের। আপনে তারে লইয়াই থাকেন। আমি মরলাম।’

হাসন আলী পাঁজাকোলা করে বউকে নৌকায় ওঠাল। বাপ–ছেলে মিলে জোরে জোরে বইঠা বেয়ে পৌঁছাল সদর হাসপাতালে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নার্স চেঁচিয়ে ডাক্তারকে ডাকতে লাগল, ‘স্যার, জলদি আসেন, পয়জন কেইস। এক টিন খাইছে। ওপিসি।’

ডাক্তার সাহেব ছুটে এসে অবাক হয়ে দেখলেন হাসন আলীর বউ হাসপাতালের বিছানায় নির্বিকার বসে আছে, তার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।

আরে শুয়ে পড়েন, সিস্টার ক্যানুলা করেন। অ্যাই, স্যালাইন আনো—ডাক্তারের হইচই দেখে সে শান্ত মুখে বলল, ‘তড়বড় কইরেন না স্যার। আমার কিছুই হইব না। আমরা বিষ হজম করবার পারি! আমগো সোনার মাছ আছে!’