ভিনগ্রহের ক্রিকেটার - পর্ব ১

এক

আজকের ক্লাসে ছেলেরা একটা নতুন দুষ্টুমি চালু করেছে। এক টুকরো কাগজে লিখতে হয় ‘পাত্রী চাই’ অথবা ‘৪২০’। তারপর সেটা লাগিয়ে দিতে হয় কারো পিঠে। তারপর মুখ টিপে হাসি গোপন করতে হয়। হাসি জিনিসটা গোপন করা খুব কঠিন। একটু পরেই দেখা যায়, কেউ একজন একটু মুচকি হাসল। তাকে দেখে আরেকজন হেসে ফেলল আরেকটু জোরে। ব্যস শুরু হয়ে গেল হাসির ফুলঝুরি। কিন্তু যাকে নিয়ে এ হাসাহাসি, সে কিছুই বুঝছে না। সে ছাড়া আর সবাই বুঝছে। তাতেই হাসির পরিমাণ যাচ্ছে বেড়ে।

এতক্ষণ ঘটনার করুণ শিকার ছিল শান্ত। কিন্তু সে বোধহয় টের পেয়ে যাবে। কারণ সে ছাড়া আর সবাই হাসছে। নিশ্চয় ব্যাপার কিছু আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শান্ত তার পিঠে হাত দিয়ে খুঁজতে শুরু করল কিছু আছে নাকি! প্রথম দফায় কাগজটা তার হাতে লাগল না। তখন মিজান বলল, কী রে শান্ত, তোর কেমন পাত্রী চাই, ফর্সা নাকি কালো।

মিজানটা একটা আস্ত গর্দভ। আরে তোর অতো কথা বলার কী দরকার! শান্তকে স্যার নিশ্চয় ব্লাকবোর্ডে অঙ্ক কষতে ডাকতেন। তখন পুরো ক্লাসই শান্তর পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন দেখতে পেত। এতে তার পাবলিসিটি হতো বেশি। ও নিশ্চয় মনের মতো একটা পাত্রী যোগাড় করে ফেলতে পারত। তাতো না, আগেই কী রে শান্ত, তোর কেমন পাত্রী চাই…।

মিজানটাকে একটা শাস্তি দেওয়া দরকার। ওর পিঠে লিখে দিতে হবে: আমি গর্দভ, ইতি মিজান। যে কথা সেই কাজ। আবীর আর সোহান একটা কাগজের টুকরায় লিখে ফেলল, আমি গর্দভ, ইতি মিজান। কাগজটা ওর পিঠে লাগানোটাই আসল কাজ।

সোহান আর আবীর দাঁড়িয়ে পড়ল। গামা স্যারের নিয়ম কঠিন হলেও আগাগোড়া একই রকম। যারা পড়া করে আসেনি, তারা তা স্বীকার করে নিলে শাস্তি কম।

সোহানের কাছে স্কচটেপ আছে। আস্তে করে টেপ দিয়ে মিজানের শার্টে কাগজটা লাগিয়ে দেওয়া তেমন কঠিন কিছু না। আবীর কাজটা সহজেই সারতে পারল। ততক্ষণে সমাজবিজ্ঞান স্যার ক্লাসে ঢুকে পড়েছেন। স্যারের ভালো নাম ওয়ালিউর রহমান। ডাকনাম গামা। এই নামটা কেন প্রচলিত জানা যায় না। স্যারের স্বাস্থ্য ভালো আর স্যার পিটুনি দিতে পারেন আচ্ছা করে, এটা একটা কারণ হতে পারে।

স্যার ঢুকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্লাস একেবারে শান্ত হয়ে পড়ল। একেবারে পিন-পতন নীরবতা। আবীর তাড়াতাড়ি করে সমাজবিজ্ঞান বইটা মেলে ধরে তাতে চোখ রাখল। তার হাসি পাচ্ছে। কিন্তু হাসা চলবে না। গম্ভীর মুখে বই পড়ে যেতে হবে। সোহানও খুব মন দিয়ে বই দেখছে। একেবারে বেটা সাধুবেশে পাকাচোর। ভিজে বেড়াল আর কাকে বলে। মনে হচ্ছে যে একমাত্র বই পড়া ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো ব্যাপারেই উৎসাহ তার নেই।

গামা স্যার বললেন, আজ কত পৃষ্ঠা থেকে কত পৃষ্ঠা পড়া।

আবদাল আহমেদ হলো ক্লাস ক্যাপ্টেন। সে বলল, ৪৪ থেকে ৪৬ স্যার।

স্যার বইয়ের ৪৪ পৃষ্ঠা বের করলেন। ইতিহাস অংশ। সেন বংশের গোড়া পত্তন থেকে শুরু।

কে কে পড়া মুখস্থ করে এসেছিস, হাত তোল।

অনেকে হাত তুলল। অনেকে তুলল না।

যারা পড়া মুখস্থ করে আসিসনি, তারা দাঁড়া। দাঁড়িয়ে থাক।

সোহান আর আবীর দাঁড়িয়ে পড়ল। গামা স্যারের নিয়ম কঠিন হলেও আগাগোড়া একই রকম। যারা পড়া করে আসেনি, তারা তা স্বীকার করে নিলে শাস্তি কম। শুধু দাঁড়িয়ে থাকা। কিন্তু যারা স্বীকার করবে না, আবার পড়া পারবেও না, তাদের পাছার ছাল পর্যন্ত স্যার তুলে ফেলতে পারেন। স্যারের একটা স্পেশাল বেত আছে।

মিজান ছেলেটা গাধা। সে পড়া করে আসেনি। আবার কেমন চুপচাপ বসে আছে। স্যার বললেন, মিজান, তুই পড়া করেছিস?

জি স্যার।

বল, সেন বংশের শেষ রাজা কে ছিলেন?

মিজান চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

আয় এদিকে আয়। আবদাল, বেতটা দে।

ইসরে গাধাটা আবার স্যারকে নাম বলে দিল। সোহান আর আবীর মাথা নিচু করে আসন্ন ঝড়ের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।

স্যারের বেত আবদাল লুকিয়ে রাখে ব্ল্যাক বোর্ডের পেছনে। সে সেটা বের করে আনল। মিজান স্যারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তার পিঠে লেখা: আমি গাধা, ইতি মিজান। পুরো ক্লাস মুখ টিপে টিপে হাসছে। স্যারের হাতে বেত। তিনি হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন।

পড়া শিখে আসিসনি, তো বসে আছিস কেন। পায়ে ফোঁড়া হয়েছে?

না স্যার।

তাহলে বসে আছিস কেন?

সে মাথা চুলকাতে লাগল। সবাই হাসছে।

স্যার বললেন, এই তোরা হাসিস কেন?

সবাই আবার গম্ভীর হয়ে গেল।

স্যার বললেন, এই গাধা, পা পাত।

মিজান বুঝছে না সে কী করবে। স্যার বললেন, আরে গাধা, তোকে এখন বেত মারব। তুই তো গাধা, তোর তো হাত নাই, গাধার কি হাত থাকে, পা পাত।

মিজান সত্যি সত্যি পা এগিয়ে দিল। স্যার বললেন, আরে গাধা, দুই পা।

মিজান বলল, পড়ে যাব যে স্যার।

স্যার বললেন, তোকে আমি তোর পেছনের পা দুটো তুলতে বলেছি নাকি? সামনের পা পাত। গাধা কোথাকার!

স্যারের কথার মাথামুণ্ডু মিজান কিছুই বুঝছে না। সে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইল।

পাত সামনের পা!

সামনের পা তো নাই স্যার!                                 

তাহলে হাত পাত। তাহলেই চলবে।

মিজান একটা হাত পাতল। স্যার গর্জে উঠলেন, দুই হাত।

সে দুই হাত পাতল। স্যার হেসে ফেললেন। দেখলি, কেমন দুই পা বাড়িয়েও তুই দাঁড়িয়ে আছিস। স্যার তার পেছনের দিকে গেলেন। তার পিঠে বেত বোলাবেন। হঠাৎ স্যারের চোখ পড়ল মিজানের পিঠে। কী ব্যাপার, তোর পিঠে এটা কী লেখা? আমি গাধা, ইতি মিজান।

কী ব্যাপার, এই রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য তুই জানলি কী করে! আরে গাধা তুই যে গাধা এটা তুই জানলি কী করে? মিজান পিঠে হাত দিল। কাগজটা তার হাতে উঠে এল। সে বলল, স্যার এটা আমি লাগাইনি স্যার!

তাহলে কে লাগিয়েছে?

সোহান আর আবীর স্যার।

ইসরে গাধাটা আবার স্যারকে নাম বলে দিল। সোহান আর আবীর মাথা নিচু করে আসন্ন ঝড়ের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।

স্যার বললেন, ওরাই যে লাগিয়েছে সেটা তুই জানলি কী করে? তুই দেখেছিস?

হ্যাঁ স্যার।

তাহলে তুই ওদের লাগাতে দিলি কেন? খুলে ফেললি না কেন?

আমারটা লাগাতে দেখিনি। একটু আগে ওরা শান্তর পিঠে লাগিয়েছিল স্যার। তখন দেখেছি!

শান্তর পিঠে লাগানোর সময় দেখেছ। নিজেরটা লাগানোর সময় দেখোনি?

না স্যার।

তাহলে কী করে বললি ওরাই লাগিয়েছে?

ওরা ছাড়া এই কাজ আর কেউ করে না স্যার।

আবীর আর সোহান—এদিকে আয়।

সর্বনাশ। আবীর আর সোহান মাথা নিচু করে বেঞ্চ ছেড়ে স্যারের কাছে গেল।

এই, তোরা ওর পিঠে এই কাগজ লাগিয়েছিস?

সোহান আর আবীর কোনো কথা বলছে না।

সত্য কথা বল। সত্য বললে শাস্তি কম। দুই জনে মাথা নাড়ল। তারা লাগিয়েছে।

স্যার বললেন, শোন তাহলে তোরা দুজন দুটো কাগজে লেখ আমি বাঁদর। লেখ।

আবীর আর সোহানকে স্যারের কথা শুনতে হলো। তারা কাগজে লিখল, আমি বাঁদর।

মিজান, এই কাগজগুলো ওদের পিঠে লাগা! গামা স্যার বললেন।

মিজান কাগজ দুটো এখন ওদের পিঠে লাগায় কী দিয়ে? ওর কাছে তো আর স্কচটেপ নেই। সে কাগজ হাতে দাঁড়িয়ে রইল।

স্যার বললেন, কীরে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তুই কি বাঁদর নাকি!

স্যার, আমার কাছে তো স্যার টেপ নাই।

টেপ ছাড়া অন্য কোনো ভাবে লাগাতে পারবি না?

মিজান মাথা চুলকাতে লাগল।

কী, পারবি না?

সে তার মাথা দুদিকে নাড়ল। অর্থাৎ পারবে না।

আবীর, সোহান, তোরা পারবি?

আবীর বলল, পারব স্যার।

ওই গাধাটার পিঠেই লাগা। স্যার মিজানকে দেখিয়ে দিলেন।

স্কুল ছুটির পর মিজানের অবস্থা খারাপ। সব ছাত্র তাকে ক্ষেপাতে লাগল। কেউ বলে, গাধা মিজান। কেউ হাঁক ছাড়ে, মিজান বান্দর, দেখতে ভারি সুন্দর। মিজান ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।

আবীর একটা আমি বাঁদর লেখা কাগজ মিজানের হাত থেকে নিয়ে ওপরের দিকে ছিড়ে একটা বোঁটার মতো বের করল। তারপর সে বোঁটাটা লাগিয়ে দিল মিজানের শার্টের পেছনের কলারের ভেতরে। দিব্যি ঝুলে রইল কাগজটা।

স্যার বললেন, এর নাম এপ্রোপ্রিয়েট টেকনোলজি। আবীর যা, জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাক।

সোহান, তুই পারবি?

পারব স্যার।

কীভাবে?

আলপিন দিয়ে। স্কচটেপ দিয়ে।

নানা, আলপিন টালপিন চলবে না। অন্য কোনো ভাবে পারবি কিনা, বল।

খালি হাতে? পারব স্যার।

লাগা।

সোহান আমি বাঁদর লেখা আরেকটা কাগজ মিজানের হাত থেকে নিয়ে তাতে একটা ছোট ছিদ্র করে সেটা সোজা তার বুকের কাছের বোতামে লাগিয়ে দিল। স্যার বললেন, এটা কি ওর পিঠে লাগানো হলো।

সোহান বলল, স্যার, শার্টটা খুলে ওকে উল্টো করে পরিয়ে দিলেই হলো। পিঠের দিকে বোতাম হলে বেশ দেখা যাবে।

স্যার হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, সেটা করলে তো আবার পেছনের কাগজটা সামনে চলে আসবে। তবে এরকম করে শার্ট পরলে কেমন দেখা যায়, এটার একটা মহড়া দেখতে পারলে বেশ হতো। যা, তুইও জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাক।

স্কুল ছুটির পর মিজানের অবস্থা খারাপ। সব ছাত্র তাকে ক্ষেপাতে লাগল। কেউ বলে, গাধা মিজান। কেউ হাঁক ছাড়ে, মিজান বান্দর, দেখতে ভারি সুন্দর। মিজান ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। চারদিকে এত ছেলেপুলে, একেকটা বিচ্ছুর চাইতেও বিচ্ছু, তাদের সাথে একা মিজান পারবে কী করে?

সে স্কুল-মাঠের বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ভ্যা করে কেঁদে ফেলল। তখন ছেলের দল শ্লোগান ধরল, বান্দরে ক্যান কান্দে রে।

মিজান মাকে ডাকতে লাগল, মা, মা ...।

(চলবে...)