অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি
পরমাণুতে ফাঁকা জায়গা না থাকলে বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষ এঁটে যেত চিনির দানায়!
পরমাণু নিয়ে আমরা সাধারণত ভাবি না। যা চোখে দেখা যায় না, শুধু বিজ্ঞান বইয়ের পাতায় থাকে, তা নিয়ে ভাবতে বয়েই গেছে! কিন্তু একটু ভাবলেই বুঝব, মহাবিশ্বের সবকিছুই পরমাণু দিয়ে গঠিত। আমি-আপনি-আমরা সবাই তা-ই। পরমাণুর এ জগৎ বেশ আকর্ষণীয়। বিশাল নক্ষত্র থেকে আমাদের মাথার চুল—সবকিছুর ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখা যাবে খুদে এই কণাদের রাজত্ব। পদার্থবিজ্ঞানের কল্যাণে আজ আমরা এসব অতি খুদে পরমাণু নিয়ে জেনেছি অনেক অজানা তথ্য। চলুন, সেরকম ৫টি অবাক করা তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
১. মানুষের চুল ৫ লাখ পরমাণু দিয়ে তৈরি
অত্যন্ত ছোট কিছু বোঝাতে প্রায়ই ‘চুল পরিমাণ’ কথাটি ব্যবহার করি আমরা। এ সময় মূলত চুলের প্রস্থ বোঝানো হয়। চুল যেহেতু খুব সরু, তাই চুলের সঙ্গে তুলনাটা করা হয়। কিন্তু চুল পরমাণুর তুলনায় কিছুই না। একজন সাধারণ মানুষের চুলে প্রায় ৫ লাখ পরমাণু থাকে।
২০০৪ সালে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো ০.৬ অ্যাংস্ট্রম (Å) রেজুল্যুশনে সবকিছু স্পষ্টভাবে দেখতে সক্ষম—এমন মাইক্রোস্কোপ তৈরি করেন। অ্যাংস্ট্রম এককটি তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও আন্তঃপারমাণবিক দূরত্ব বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। ১ অ্যাংস্ট্রম সমান ১ সেন্টিমিটারের ১০০ মিলিয়ন ভাগের এক ভাগ। ১০-১০ মিটার (১ মিটারকে ১০১০ তথা ১-এর পরে ১০টা শূন্য দিয়ে ভাগ করলে যা হয়)। এই মাইক্রোস্কোপের নিচে চুল রাখলে ৫ লাখ গুণ বড় দেখায়। কারণ একটি গড় পরমাণুর ব্যাস এক অ্যাংস্ট্রম। চুলের ধরন অনুযায়ী এটি ৩ থেকে ১০ লাখ পরমাণু পর্যন্ত হতে পারে। অর্থাৎ বলা যায়, প্রায় ১০ লাখ পরমাণু একসঙ্গে জড়ো করলে একটা চুলের সমান পুরুত্ব পাওয়া যাবে। আর ১০ কোটি পরমাণুকে সারিবদ্ধ করে সাজালে হাতের আঙুলের নখের সমান হতে পারে।
২. মহাবিশ্বে যত নক্ষত্র আছে, মানবদেহে আছে তার চেয়েও বেশি পরমাণু
একটি চুলের প্রস্থ বরাবর যদি প্রায় পাঁচ লাখ পরমাণু থাকে, তাহলে মানুষের শরীরে কত পরমাণু আছে? কেউ কেউ হয়তো বলবেন, অগণিত। কেউ যদি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলেন, মানুষের শরীরে মহাবিশ্বের মোট নক্ষত্রের চেয়েও বেশি পরমাণু আছে, তাহলেও হয়তো বাড়িয়ে বলা হবে না।
মানবদেহের বেশির ভাগ পরমাণু হলো কার্বন, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন ও নাইট্রোজেন। এই চার উপাদানে গড়ে উঠেছে আপনার দেহের প্রায় ৯৬ শতাংশ। বাকিটুকু ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, তামা, স্বর্ণসহ আরও অনেক কিছু। কিন্তু শিরোনাম থেকে নিশ্চয়ই আপনার মনে প্রশ্ন জাগছে, মহাবিশ্বে নক্ষত্রের সংখ্যা ঠিক কত? এরচেয়ে বেশি পরমাণু কি সত্যিই কারো দেহে থাকতে পারে? আসুন, হিসাব কষে দেখি।
আমরা পুরো মহাবিশ্ব দেখতে পাই না। যতটুকু দেখি, তাকে বলা হয় পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব। এর ওপর ভিত্তি করে একটা হিসাব কষে মোটামুটি একটা সংখ্যা বের করা সম্ভব। এভাবে বিজ্ঞানীরা যে সংখ্যাটা পেয়েছেন, তা হলো প্রায় ২০০ বিলিয়ন ট্রিলিয়ন। এই সংখ্যাটা এত বড় যে এটাকে শুধু ‘বড় সংখ্যা’ বলা ঠিক হবে না। তাই এটাকে ২০০ স্কুইডিলিয়ন (বা স্কুইলিয়ন) বলা ভালো। সত্যি সত্যি এরকম কোনো সংখ্যা নেই—বড় সংখ্যারও বড় বোঝাতে এই শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয়। কারণ, মনে করা হয়, এটা এত বড় সংখ্যা যে তা আমরা কল্পনাও করতে পারব না।
এখন আসা যাক আমাদের দেহের কথায়। আমাদের শরীরে কতগুলো পরমাণু আছে? মানুষের শরীরে পরমাণুর সংখ্যা ১০২৭, মানে ১ অক্টিলিয়ন। আবার কোনো কোনো বিজ্ঞানী বলেন, শরীরে ৬.৫ অক্টিলিয়ন পরমাণু পর্যন্ত থাকতে পারে। এর কারণ, আমাদের জীবনকালে সব সময় শরীরে পরমাণু আসে-যায়। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে এগুলো প্রবেশ করে, আবার শরীর থেকে বের হয়ে যায়। তবে উচ্চতা, ওজন, বয়সভেদে পরমাণুর সংখ্যা ভিন্নও হতে পারে।
শুরুর সেই প্রশ্নটার উত্তর দিই এবারে। অক্টিলিয়ন স্কুইডিলিয়ন বা স্কুইলিয়নের চেয়ে অনেক বড় সংখ্যা। ঠিক ধরেছেন, মহাবিশ্বে যত নক্ষত্র আছে, মানবদেহে আছে তার চেয়েও বেশি পরমাণু।
৩. পরমাণু এর নিজের নিউক্লিয়াসের চেয়ে হাজার হাজার গুণ বড়
পরমাণু এত ছোট যে এদের আকার কল্পনা করা বা আমাদের রোজকার জীবনে এদের গুরুত্ব বোঝা কঠিন। তবুও যখন এদের কথা জানার সুযোগ আসে, তখন অবাক হতে হয়। কেমন হয় পরমাণু? আমরা জানি, প্রতিটি পরমাণুর মাঝখানে থাকে নিউক্লিয়াস। এর ভেতরে থাকে প্রোটন ও নিউট্রন। আর নিউক্লিয়াসকে ঘিরে থাকে এক বা একাধিক ইলেকট্রন।
পরমাণু যত ছোট, নিউক্লিয়াসও সে হিসেবে তত ছোট হয়। কত ছোট? একটা নিউক্লিয়াসের আকার প্রায় ১০-১৫ মিটার। অর্থাৎ এটি গোটা পরমাণুর আকারের পায় ১০-৫ ভাগ। কেউ যদি একটা পরমাণুকে ফুটবল মাঠের সমান বলে কল্পনা করেন, তাহলে নিউক্লিয়াসের আকার হবে ওই মাঠে পড়ে থাকা একটা ছোট্ট মটরদানার সমান। বুঝতেই পারছেন কত ছোট!
নিউক্লিয়াসেই পরমাণুর বেশির ভাগ ভর মজুত থাকে। এতে বোঝা যায়, পরমাণুর অধিকাংশ জায়গা আসলে ফাঁকা। বিজ্ঞানের ভাষায়, পরমাণুর প্রায় ৯৯.৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯ ভাগই ফাঁকা। সে হিসেবে পরমাণুর এই শূন্যস্থান যদি কোনোভাবে চুপসানো সম্ভব হতো, তাহলে বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষকে একটা চিনির দানার মধ্যে আঁটানো যেত!
৪. শরীরের অর্ধেক পরমাণু অন্য গ্যালাক্সি থেকে এসেছে
নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দেহের পরমাণুসহ মিল্কিওয়ের প্রায় অর্ধেক পদার্থ বাইরের কোনো গ্যালাক্সি থেকে এসে থাকতে পারে। বিজ্ঞানীরা আগে যা ভেবেছিলেন, তার চেয়ে এ পরিমাণ অনেক বেশি।
সুপারকম্পিউটার সিমুলেশনের ওপর ভিত্তি করে এই নতুন তথ্য পাওয়া গেছে। এতে ‘ইন্টারগ্যালাক্টিক ট্রান্সফার’ নামে নতুন এক ঘটনা দেখা গেছে। গ্যালাক্সিগুলো কীভাবে তৈরি হয়, সেই রহস্য উন্মোচনে এই ঘটনা বিজ্ঞানীদের সাহায্য করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির জ্যোতিঃপদার্থবিদদের করা মডেলগুলো দেখায়, সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে প্রচুর গ্যাস ও পদার্থ ছিটকে যায়। আর বিপুল ধাক্কা ও আন্তঃগ্যালাক্টিক বায়ুর মাধ্যমে এসব পদার্থ এক গ্যালাক্সি থেকে অন্য গ্যালাক্সিতে চলে যেতে পারে। গবেষণাটি প্রকাশিত হয় রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি জার্নালে।
৫. গ্রাফিন এক পরমাণু সমান পুরু
গ্রাফিন মাত্র একটি পরমাণুর সমান পাতলা। এটা কাচের মতো স্বচ্ছ হলেও ইস্পাতের চেয়ে ১০০ গুণ বেশি শক্তিশালী এবং তাপ ও বিদ্যুৎ পরিবহনে দারুণ কার্যকর। প্রকৃতপক্ষে এটি কার্বনের একধরনের ব্যতিক্রমী রূপ। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ভবিষ্যতে বিশ্বকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এই গ্রাফিন। এর ভার বহনের ক্ষমতা ৪২.০ নিউটন/মিটার, যেখানে ইস্পাতের ভার বহনের ক্ষমতা মাত্র ০.৪০ নিউটন/মিটার। যদি ১ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১ মিটার প্রস্থের একটি গ্রাফিন শিট দুটি খুঁটির মধ্যে টানটান করে বাঁধা হয়, তবে এর ওপর ৪ কিলোগ্রাম ভর রাখলেও সেটা ছিঁড়বে না।
গ্রাফিন এত পাতলা যে খালি চোখে দেখা যায় না। এর ওপর একটি বিড়াল শুয়ে থাকলে মনে হবে যেন বিড়ালটি শূন্যে ভাসছে। গ্রাফিন শিটের ওজন ১ মিলিগ্রামেরও কম, যেখানে একটি বিড়ালের গোঁফের ওজনও ১ মিলিগ্রামের বেশি। গ্রাফিন বিদ্যুৎ এবং তাপের অত্যন্ত ভালো পরিবাহী। এর বিদ্যুৎ পরিবাহিতা তামার চেয়ে বেশি এবং তাপ পরিবাহিতা তামার চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি।