ক্যালিব্রেট করুন নিজের বানানো থার্মোমিটার

সাইকেল চালাতে শিখতে হলে কেবল তত্ত্ব শিখলেই হয় না, সত্যিকারে চালিয়েই শিখতে হয়। একইভাবে ইলেকট্রনিকস শিখতে হলে তত্ত্বের পাশাপাশি হাতে-কলমে সার্কিট তৈরি করতে হয়। সার্কিটের বিভিন্ন বিন্দুতে পরিমাপ করে তত্ত্বের সঙ্গে তার মিল-অমিলের কারণ চিন্তা করে খুঁজে বের করতে হয়। আবার কেবল সার্কিট তৈরিই নয়, কীভাবে তাকে খোলসবন্দী করে অন্য সবার ব্যবহারের উপযোগী করা যায়, তা-ও শিখতে হয়। নইলে ওই সার্কিট কোনো কাজে আসবে না। এ পাঠশালায় তাই কিছু কাজের সার্কিট বানানো শেখানো হবে। সেই সঙ্গে তার প্রয়োগ ও প্রয়োজনীয় তত্ত্বও ধাপে ধাপে আলোচনা করা হবে। তাতে একসঙ্গে সব কটি দিকই শেখা হয়ে যাবে।

পর্ব: ২

ক্যালিব্রেট কীভাবে করতে হবে

আপনার বানানো থার্মোমিটার ঠিক কত ডিগ্রি তাপমাত্রা নির্দেশ করছে, তা জানতে প্রথমে এতে ব্যবহার করা থার্মিস্টরটির রেজিস্ট্যান্সের মান অন্য একটি জানা থার্মোমিটারের বিপরীতে ক্যালিব্রেট (calibrate) করে নিতে হবে। ঘরে শরীরের তাপমাত্রা মাপার জন্য আমরা যে ক্লিনিক্যাল থার্মোমিটার ব্যবহার করি, তার ব্যাপ্তি বা রেঞ্জ কম। এটি সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠার পর তা ধরে রাখে, তাপমাত্রা কমলেও তা আর দেখায় না। এ জন্য ল্যাবরেটরির পারদওয়ালা লম্বা থার্মোমিটার জোগাড় করতে হবে। একবার ক্যালিব্রেট করে ফেললে পরে আর তা লাগবে না। পরে অন্য থার্মিস্টরকে ক্যালিব্রেট করতে হলে আপনার প্রথম ক্যালিব্রেট করা থার্মিস্টরই ব্যবহার করতে পারবেন।

তাপমাত্রা ও রেজিস্ট্যান্স সারণি
এটি সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠার পর তা ধরে রাখে, তাপমাত্রা কমলেও তা আর দেখায় না। এ জন্য ল্যাবরেটরির পারদওয়ালা লম্বা থার্মোমিটার জোগাড় করতে হবে। একবার ক্যালিব্রেট করে ফেললে পরে আর তা লাগবে না।

ক্যালিব্রেট করতে আমরা বিভিন্ন তাপমাত্রার পানি ব্যবহার করব। এ জন্য ছবিতে (পরের পৃষ্ঠায়) যেভাবে দেখানো হয়েছে, সেভাবে থার্মিস্টর প্রোব ও পারদ থার্মোমিটারের বাল্ব যতটা কাছে আনা যায় সেভাবে রেখে দুটোর দণ্ডকে একসঙ্গে টেপ দিয়ে পেঁচিয়ে দিতে হবে বা সুতা দিয়ে বেঁধে ফেলতে হবে। কিন্তু পানির মধ্যে ডোবালে থার্মিস্টরের প্রান্ত দুটির সামান্য বিন্দুও পানির সংস্পর্শে এলে পানির রেজিস্ট্যান্সও পরিমাপে এসে যাবে। তাতে ভুল মান পাওয়া যাবে। তাই প্রথমে একটি পাতলা পলিথিন শিটের টুকরো দিয়ে দুটি থার্মোমিটারের মাথা থেকে শুরু করে ওপরের দিকে কয়েক ইঞ্চি পরিমাণ চেপে চেপে ঢেকে দিতে হবে, যাতে ভেতরে বাতাস তেমন না থাকে। এবার রাবার ব্যান্ড দিয়ে পলিথিন শিটের ওপরের অংশ থার্মোমিটার দণ্ডের সঙ্গে ভালোভাবে আটকে দিন।

এখন একটি প্লাস্টিকের মগে দুই ইঞ্চির মতো গভীর পানি নিন। পলিথিনে মোড়া থার্মোমিটার দুটির মাথা পানির মধ্যে ডুবিয়ে দিন, যেন পলিথিনের খোলা ওপরের অংশ পানির বাইরে থাকে। ভেতরে পানি যেন কোনোভাবেই না ঢোকে, সেদিকে যথেষ্ট খেয়াল রাখতে হবে। মিনিট খানেক অপেক্ষা করে দুটো থার্মোমিটারের মানগুলোই লিখে রাখতে হবে (পারদেরটি দেবে সরাসরি সেলসিয়াস এককে, আর আপনার তৈরিটি দেবে রেজিস্ট্যান্স মানে, ওহম এককে)। এবার মগের পানিতে একটু গরম পানি যোগ করুন। মিনিট খানেক অপেক্ষা করে তাপমাত্রা স্থির হয়ে এলে থার্মোমিটার দুটির পরিমাপ পাশে দেওয়া উদাহরণের মতো একটি ছকে লিখে রাখুন। আবারও একটু গরম পানি যোগ করে একটু অপেক্ষা করুন। তাপমাত্রা স্থির হয়ে এলে থার্মোমিটার দুটির নতুন পরিমাপ একই ছকে নিচের সারণিতে লিখে রাখুন।

থার্মিস্টর প্রোবের ক্যালিব্রেশনের জন্য করা ব্যবস্থা

এভাবে তাপমাত্রা বাড়িয়ে বাড়িয়ে অনেকগুলো মাপ নিতে হবে। প্রতি মান নেওয়ার আগে কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, পলিথিনের ভেতর কিছুটা হলেও বাতাস থেকে যাবে, বাতাস গরম হয়ে দুটো থার্মোমিটারের মাথাই গরম হয়ে একই তাপমাত্রায় আসতে একটু সময় নেবে। ছকের উদাহরণে মাত্র কয়েকটি তাপমাত্রার জন্য আনুমানিক রেজিস্ট্যান্স দেখিয়েছি। আপনারা আরও বেশি তাপমাত্রা পর্যন্ত করবেন। সম্ভব হলে, আরও ঘন ঘন তাপমাত্রার পার্থক্যে অনেকগুলো বিন্দু নিন। আবার বরফ বা ফ্রিজের ঠান্ডা পানি ব্যবহার করে নিচের তাপমাত্রায়ও যেতে পারেন। ছকটি তৈরির জন্য কম্পিউটারে স্প্রেডশিট (Excel) ব্যবহার করা যেতে পারে, যা পরে গ্রাফ আঁকতেও সাহায্য করবে।

ক্যালিব্র্রেশন কার্ভ থেকে ওই রেজিস্ট্যান্সের বিপরীতে তাপমাত্রা কত হবে, তা তাপমাত্রার অক্ষ থেকে পড়ে নিতে হবে, যেমনটি দেখানো হয়েছে দুটো তীর চিহ্ন দিয়ে। ব্যস, তৈরি হয়ে গেল ইলেকট্রনিক থার্মোমিটার।

ছকের মানগুলো নিয়ে নিচের ছবির মতো একটি গ্রাফ এঁকে ফেলুন। এর আনুভূমিক অক্ষে আছে তাপমাত্রা আর ওপরের অক্ষে রয়েছে থার্মিস্টরের রেজিস্ট্যান্স। এটিই হবে এই ইলেকট্রনিক থার্মোমিটারের ‘ক্যালিব্রেশন কার্ভ’। এখন পারদের থার্মোমিটারটি ফেরত দিয়ে দিতে পারেন। থার্মিস্টরটি দিয়ে কোনো স্থানের বা বস্তুর তাপমাত্রা মাপতে হলে কেবল তার রেজিস্ট্যান্সটি মাল্টিমিটারে পড়ে নিতে হবে। তারপর ক্যালিব্র্রেশন কার্ভ থেকে ওই রেজিস্ট্যান্সের বিপরীতে তাপমাত্রা কত হবে, তা তাপমাত্রার অক্ষ থেকে পড়ে নিতে হবে, যেমনটি দেখানো হয়েছে দুটো তীর চিহ্ন দিয়ে। ব্যস, তৈরি হয়ে গেল ইলেকট্রনিক থার্মোমিটার।

থার্মিস্টর দিয়ে তৈরি আমাদের থার্মোমিটারের ক্যালিব্রেশন গ্রাফ

প্রশ্ন উঠতে পারে, বাজারের ইলেকট্রনিক থার্মোমিটারে তো সেলসিয়াস এককে তাপমাত্রা দেখায়, কিন্তু আপনারটি তা দেখাচ্ছে না, ছক থেকে বা কার্ভ থেকে মিলিয়ে বের করতে হচ্ছে। আসলে এখানে আপনার মস্তিষ্ক যে কাজ করছে বাজারের ইলেকট্রনিক থার্মোমিটারে, সেটি করছে ভেতরে ঢোকানো ছোট একটি কম্পিউটার। একে আজকাল ‘মাইক্রো-কনট্রোলার’ বলা হয়। যন্ত্রটি থার্মিস্টরের রেজিস্ট্যান্স ঠিকই মাপে। কিন্তু কম্পিউটারের স্মৃতির ভেতরে ওই ছকের তথ্যও ঢুকিয়ে রাখা আছে। প্রোগ্রাম করে তাকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে কীভাবে ছকের সঙ্গে মিলিয়ে তাপমাত্রা বের করে সেটিকে ডিসপ্লে বা পর্দায় দেখাতে হবে। আগামী পর্বে আমরা আলোচনা করব থার্মিস্টরের ভেতরের কথা, কী থাকে তাতে, কেন সে এ রকম আচরণ করে, তার গাণিতিক তত্ত্ব আর থার্মিস্টরের কয়েকটি প্রয়োগের উদাহরণ ইত্যাদি।

(চলবে...)

*লেখাটি ২০১৬ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত