বস্তুর ভরের যে রহস্যের সমাধান মেলেনি আজও

ভর বিজ্ঞানীদের কাছে আজও রহস্য। কোনো বস্তুতে পদার্থের পরিমাণ তার ভর—এত সহজ নয় বিষয়টা। একটা বস্তুকে অনেকগুলো টুকরো করে, সব কটির ভর মেপে যোগ করলে দেখা যাবে, মূল বস্তুটির ভরের চেয়ে কম হচ্ছে! সেই রহস্যের সমাধান ও নেপথ্যের কথা…

কোনো বস্তুর ভরের কথা বলতে গেলে স্বাভাবিকভাবে মনে আসে, ওই বস্তুতে কতটুকু পদার্থ আছে

মা–বাবা যে মাঝেমধ্যে রেগে গিয়ে আপনাকে বলেন, ‘তোর মাথায় কিচ্ছু নেই!’ সেটা কি মিথ্যা? একদিকে ভাবলে, কথাটা কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে সত্য। মানে অতিপারমাণবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আংশিক হলেও সত্য। পদার্থবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষের দেহের বেশির ভাগ অংশ ফাঁপা। এমনকি মাথাও নাকি তা–ই! কথাটা ব্যক্তিগত আক্রমণ হিসেবে নেবেন না, প্লিজ। পুরোটা শুনলে সত্যটা আপনিও স্বীকার করতে বাধ্য হবেন।

মানবদেহ বা মাথা ফাঁপা হওয়ার মূল কারণ, এগুলো যেসব পদার্থ তথা পরমাণু দিয়ে তৈরি, তার বেশির ভাগ শূন্য বা ফাঁপা। সেটা প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন নিউজিল্যান্ডের পদার্থবিদ আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। সেই ১৯০৭ সালের দিকে। এরপর নানা পরীক্ষায় সেটা প্রমাণিত হয়েছে আরও শক্তপোক্তভাবে। এ কথার অর্থ একটু খোলাসা করি৷ পদার্থের পরমাণু গঠিত হয় একটা নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রন দিয়ে। আর পরমাণুর কেন্দ্রীয় অংশ নিউক্লিয়াস গঠিত হয় প্রোটন ও নিউট্রন দিয়ে। নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘুরতে থাকে ইলেকট্রন। রাদারফোর্ড পরীক্ষায় দেখতে পান, পরমাণুর কেন্দ্রে গুচ্ছভাবে থাকে নিউক্লিয়াস। একটা পরমাণুর তুলনায় সেটা অতি ক্ষুদ্র একটা জায়গা। আর নিউক্লিয়াস থেকে ইলেকট্রনের কক্ষপথ পর্যন্ত বিশাল একটা ফাঁকা জায়গা। কিন্তু কতটা ফাঁকা?

প্রায় তিন কিলোমিটার ব্যাসের একটা মাঠের কথা ভাবুন। জায়গাটা মোটামুটি মাঝারি আকৃতির বিমানবন্দরের সমান। এখন ওই মাঠের কেন্দ্রে একটা বাস্কেটবল রাখুন। খুব বেশি হলে বলটির আকৃতি হবে ১ ফুট বা ৩০ সেন্টিমিটারের মতো। তিন কিলোমিটার আকৃতির মাঠকে যদি একটা পরমাণু হিসেবে ধরে নিই, তাহলে মাঠের মধ্যে খুদে ওই বল হলো পরমাণুর নিউক্লিয়াস। তার চারপাশে বিপুল শূন্যতা। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, পরমাণুর ভেতরটা কত ফাঁকা! পরমাণুর এই বিপুল জায়গা ফাঁকা দেখে মনে হতে পারে, আমরা হয়তো দেয়াল ফুঁড়ে ওপাশে চলে যেতে পারব। স্রেফ ভোজবাজির মতো! বাস্তবে আসলে তা সম্ভব নয়। ভর নিয়ে এ আলোচনায় পরমাণুর কাহিনি ফাঁদার পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে। আসলে ভরের গভীর এক রহস্য লুকিয়ে আছে এই পারমাণবিক ও অতিপারমাণবিক পর্যায়ে।

আরও পড়ুন
নিউটনিয়ান সংজ্ঞামতে, আপনার দেহ যেসব বস্তুকণা দিয়ে গঠিত, আপনার দেহের ভরের বেশির ভাগের উৎস হওয়ার কথা সেসব কণার। কিন্তু বাস্তবে আসলে তা হয় না। মূল ভরের উৎস ওই সব কণা নয়, অন্য কিছু।
প্রোটনের ভেতরে দুটি আপ কোয়ার্ক ও একটি ডাউন কোয়ার্ক থাকে

সেটা বলার আগে জানা যাক, ভর কী? ভর সম্পর্কে প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক সংজ্ঞা দিয়েছিলেন বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন। নিউটনিয়ান পদার্থবিজ্ঞান অনুযায়ী, কোনো বস্তুর মধ্যে পদার্থের মোট পরিমাণ ওই বস্তুর ভর। কিন্তু ভর যে আসলে কী এবং আমাদের বা বস্তুর ভর কেন থাকে, তা আমরা কমই বুঝি। ভরের বেশ কয়েকটি ব্যাপার বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো রহস্যময়।

আমরা সবাই ভর অনুভব করি। আসলে ছোটবেলা থেকে ভর সম্পর্কে আমাদের অনুভূতি বিকশিত হয়। তখন থেকে বুঝতে শুরু করি, কিছু জিনিস ঠেলতে কম শক্তি লাগে, আর কিছু বস্তুর জন্য লাগে বেশি শক্তি। কিন্তু অনুভূতি যতই পরিচিত হোক না কেন, এই আপাতসরল ব্যাপারটা তাত্ত্বিকভাবে ব্যাখ্যা করতে হিমশিম খান বেশির ভাগ পদার্থবিদ। কারণ, নিউটনিয়ান সংজ্ঞামতে, আপনার দেহ যেসব বস্তুকণা দিয়ে গঠিত, আপনার দেহের ভরের বেশির ভাগের উৎস হওয়ার কথা সেসব কণার। কিন্তু বাস্তবে আসলে তা হয় না। মূল ভরের উৎস ওই সব কণা নয়, অন্য কিছু। শুধু তা–ই নয়, আমরা এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি, কেন কিছু জিনিসের ভর থাকে আর কিছু জিনিসের থাকে না। ভর নিয়ে কিছু প্রশ্নে বিজ্ঞানীরা এখনো লা-জবাব। সেগুলো এখনো আমাদের কাছে রহস্য। চলুন, সেই রহস্যের পেছনে ধাওয়া করা যাক।

আরও পড়ুন

কোনো বস্তুর ভরের কথা বলতে গেলে স্বাভাবিকভাবে মনে আসে, ওই বস্তুতে কতটুকু পদার্থ আছে। এ রকম ভাবার কারণ, আমরা ভরকে স্বাভাবিক জিনিস হিসেবে চিন্তা করছি। মানে গরু, ছাগল কিংবা মাছ, মাংস বা কেকের মতো স্বাভাবিক জিনিস। সে হিসেবে কোনো বস্তুর ভর মানে তার ভেতরে থাকা সব কণার যোগফল। অর্থাৎ একটা কেক যদি দুই ভাগ করা হয়, তাহলে তার মোট ভর হবে দুই টুকরা কেকের ভরের মোট যোগফল। কেকটিকে চার ভাগ করা হলে মোট ভর হবে ওই চার ভাগের যোগফলের সমান। এভাবে যত ভাগ করা হবে, তত ভাগের যোগফল হবে মোট ভর। ধরা যাক, কেকটিকে n ভাগে ভাগ করা হলো। তাহলে স্বাভাবিকভাবে কেকের মোট ভর n সংখ্যক টুকরার যোগফল হওয়ার কথা।

ঠিক তো?

কিন্তু উত্তর আসলে পুরোপুরি সঠিক নয়। ভুলও বলা যায়। n-এর মান যদি ২, ৪, ৮ থেকে শুরু করে ১০২৩ পর্যন্ত হয়, তাহলে আগের উত্তর সঠিক হবে। কিন্তু n-এর মান ১০২৩-এর বেশি হলে ওই নিয়ম আর কাজ করবে না। কথাটা শুনতে পাগলাটে বা অদ্ভুত বলে মনে হতে পারে, কিন্তু বিজ্ঞানীরা অসংখ্যবার এর প্রমাণ পেয়েছেন। আসলে কেকটার মোট ভর মানে শুধু তার মধ্যে থাকা মোট কণার যোগফল নয়, তার কণাগুলোকে একত্রে ধরে রাখা শক্তিগুলোও যোগ করতে হবে। কী, মাথায় ঢুকছে না? তাহলে আরেকটু গভীরে ঢোকা যাক।

যদি কেউ আগে না শুনে থাকেন, তাহলে তার কাছে মনে হতে পারে, এখানে পরিভাষাগত কোনো কৌশল খাটানো হয়েছে। কিংবা ভর বলতে তাত্ত্বিকভাবে সাধারণ অর্থের চেয়ে ভিন্ন কিছু বোঝানো হচ্ছে।

এ ধারণা যদি কেউ আগে না শুনে থাকেন, তাহলে তার কাছে মনে হতে পারে, এখানে পরিভাষাগত কোনো কৌশল খাটানো হয়েছে। কিংবা ভর বলতে তাত্ত্বিকভাবে সাধারণ অর্থের চেয়ে ভিন্ন কিছু বোঝানো হচ্ছে। কিন্তু ঘটনা আসলে তা নয়, বরং ভর বলতে সাধারণভাবে আপনি যা বোঝেন, ঠিক তা–ই বোঝানো হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, ভর বলতে আপনি যতটুকু বোঝেন, সেটা সবকিছু নয়।

সংজ্ঞা অনুসারে ভর বলতে বস্তুর এমন এক ধর্মকে বোঝানো হয়, যা তার বেগের পরিবর্তন ঠেকাতে পারে। সহজ কথায়, কোনো কিছুতে ঠেলা দিলে তা ত্বরিত (বেগের পরিবর্তন) হয়। কিন্তু বিভিন্ন বস্তুর ওপর একই পরিমাণ বল প্রয়োগ করা হলে দেখা যাবে, কোনোটার ত্বরণ বেশি পাওয়া যাচ্ছে আর কোনোটার ত্বরণ পাওয়া যাচ্ছে কম। ঘরে বসে সহজ পদ্ধতিতে বিষয়টা নিজেও একবার পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। সে জন্য ইউটিউব দেখে শেখার দরকার নেই। একটা টিস্যু পেপার আর একটা ঘুমন্ত হাতি ঠেলতে গেলে ব্যাপারটা হাতেনাতে টের পাবেন। অবশ্য ঘুমন্ত হাতি যদি হাতের কাছে না পান, তাহলে ঘরের সোফা বা খাট ঠেলে দেখতে পারেন। দেখা যাবে, একই পরিমাণ বল প্রয়োগ করে টিস্যুর যে ত্বরণ পাওয়া যায়, ঘুমন্ত হাতির ক্ষেত্রে ত্বরণ পাওয়া যাবে অনেক কম। একে আমরা ভর বলি।

আরও পড়ুন
প্রোটন বা নিউট্রনে একত্রে আবদ্ধ তিনটি কোয়ার্কের ভরের মধ্যে বড় ধরনের তফাত পাওয়া যাবে। বন্ধন ছাড়া আলাদা একেকটা কোয়ার্কের ভর প্রোটন বা নিউট্রনের ভরের মাত্র ১ শতাংশ।
আমরা এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি, কেন কিছু জিনিসের ভর থাকে আর কিছু জিনিসের থাকে না। ভর নিয়ে কিছু প্রশ্নে বিজ্ঞানীরা এখনো লা-জবাব। সেগুলো এখনো আমাদের কাছে রহস্য

দৈনন্দিন জীবনে ভর নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা এ রকম। এখানে পরিভাষাগত কোনো চালাকি নেই। একটা হাতির ভর টিস্যুর তুলনায় বেশি। তাই তাকে ঠেলতে টিস্যু পেপারের চেয়ে বেশি বল লাগে। তবে বিজ্ঞানের ভাষায়, এটাই হাতিকে নড়ানো কঠিন হওয়ার মূল কারণ নয়। বরং বেশি ভর থাকার অর্থ হলো, একই বল দিয়ে ঠেলা দিলে একে কম ত্বারিত করা যায়। এই ভরকে বলা হয় ইনারশিয়াল মাস বা জড় ভর। এই ধর্ম ত্বরণ রোধ করে, তাই এটি ইনারশিয়া বা জড়তা নামে পরিচিত। কোনো বস্তুকে ধাক্কা দেওয়া বলের পরিমাণ ও তা থেকে পাওয়া ত্বরণ ব্যবহার করে এই জড় ভর সহজে নির্ণয় করা যায়। বলে রাখি, মহাকর্ষীয় ভর নামে আরেকটা ব্যাপার আছে। সে সম্পর্কে পরে বলব।

এতক্ষণ ভরের সংজ্ঞা হিসেবে আমরা যা বললাম, সেটা ব্যবহার করে কোনো বস্তুর ভর নির্ণয় করতে পারি। এটুকু মাথায় রেখে এবার টুকরা করা কেকের প্রসঙ্গে ফিরি। ধরা যাক, কেকটাকে পারমাণবিক পর্যায়ে অসংখ্য টুকরায় ভাগ করা হয়েছে। তার সব পরমাণুকে যেসব বন্ধন একত্রে ধরে রাখে, সেগুলো ভেঙে ফেলা হলো। এমনকি বন্ধনগুলোতে যে শক্তি থাকে, তা–ও ছেড়ে দেওয়া হলো। এবার কেকের সব টুকরা যোগ করলে কিছুটা কম ভর পাওয়া যাবে। তবে n=২ হলে, ওই তফাত চোখে পড়বে না। কিন্তু কেকটাকে পুরোপুরি অ্যাটোমাটাইজ করার পর সব পরমাণু যোগ করলে তফাত ধরা পড়বে। আসলে ওই বন্ধনগুলোয় যে শক্তি সঞ্চিত থাকে, সেগুলো কেকের ভর বাড়িয়ে দেয়। এটা কোনো তাত্ত্বিক অনুমান নয়, সত্যিকার পরীক্ষামূলক পর্যবেক্ষণ।

এখানে কেকের ক্ষেত্রে সেই তফাত আহামরি কিছু নয়। যেমন কেকের সব পরমাণু একত্রে ধরে রাখা রাসায়নিক বন্ধন ভেঙে ফেলা হলেও কেকটার ভর এবং সব পরমাণুর মোট ভরের মধ্যে বড় কোনো পার্থক্য দেখা যাবে না। এমনকি পরমাণুগুলোকে যদি তাদের গাঠনিক একক প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রনে ভেঙে ফেলা হয়; তবু ওই দুই ভরের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য পাওয়া যাবে না। সেই পার্থক্যের পরিমাণ হবে ০.০০৫ শতাংশ।

পরমাণুর আরেকটু গভীরে যাওয়া যাক। কেকটাকে আরও ছোট কণায় ভেঙে ফেলা হলে আমাদের কাহিনি মোড় নেবে ভিন্ন দিকে। মানে এসব প্রোটন ও নিউট্রনকে যদি তাদের গাঠনিক কণা কোয়ার্কে ভেঙে ফেলা হয়, তাহলে ভরের ক্ষেত্রে বিপুল পার্থক্য দেখা যাবে। জানেন নিশ্চয়, প্রতিটি প্রোটন ও নিউট্রন গঠিত হয় তিনটি কোয়ার্ক কণা দিয়ে। এই কোয়ার্ক কণাগুলো একত্রে ধরে রাখে গ্লুয়ন। আসলে প্রোটন ও নিউট্রনের ভর আসে এই তিন কোয়ার্ককে একত্রে ধরে রাখা বন্ধন শক্তি থেকে।

আরও পড়ুন
কোন বলের পরিপ্রেক্ষিতে ওই কলমগুলো কতটা জোরে বা আস্তে চলবে, তার ওপর কলমগুলো একত্র করে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি কীভাবে প্রভাব ফেলে, তা আমাদের কাছে এখনো বোধগম্য নয়।

সহজ কথায়, যদি ওই তিন কোয়ার্কের ভর যোগ করা হয়, তাহলে একটা প্রোটন বা নিউট্রনে একত্রে আবদ্ধ তিনটি কোয়ার্কের ভরের মধ্যে বড় ধরনের তফাত পাওয়া যাবে। বন্ধন ছাড়া আলাদা একেকটা কোয়ার্কের ভর প্রোটন বা নিউট্রনের ভরের মাত্র ১ শতাংশ। তাহলে বাকি বেশির ভাগ ভর কোথায় গেল? তার উত্তর হলো, বাকি ভর থাকে কোয়ার্কগুলো একত্রে ধরে রাখা বন্ধনগুলোর শক্তির ভেতর।

এসব উদাহরণ থেকে দেখা যাচ্ছে, কণাগুলোর বন্ধনে শক্তি সঞ্চিত থাকলে কী ঘটে। এর কারণে সম্মিলিত কোনো বস্তুর ভর, তার টুকরাগুলোর (অতি ক্ষুদ্র কণা পর্যায়ের) যোগফলের চেয়ে বেশি হয়।

কণাগুলোর বন্ধনে শক্তি সঞ্চিত থাকলে কী ঘটে। এর কারণে সম্মিলিত কোনো বস্তুর ভর, তার টুকরাগুলোর (অতি ক্ষুদ্র কণা পর্যায়ের) যোগফলের চেয়ে বেশি হয়

ব্যাপারটা যে কত অদ্ভুত, সেটা একবার ভেবে দেখা যাক। ধরা যাক, আপনার কাছে তিনটি কলম আছে। এগুলোর প্রতিটির আলাদাভাবে ভর মাপলেন। তাহলে কলম তিনটির মোট ভর কত? সেটা তো ওই ভরগুলো যোগ করলে পাওয়া যাবে। সরল হিসাব। এবার ধরা যাক, কলম তিনটি ছোট্ট একটা পলিথিনের ব্যাগে রেখে খুব শক্ত করে কোনো তার বা দড়ি দিয়ে বাঁধলেন। এরপর সেগুলোর ভর আবার মাপা হলো। এখন যদি দেখা যায়, আগের মাপা ভরের সঙ্গে একত্রিত ভরের তফাত রাত–দিন, তাহলে ব্যাপারটা কেমন লাগবে? অতিপারমাণবিক পর্যায়ে ঠিক এ উদ্ভট ব্যাপারই ঘটে। বুঝতেই পারছেন, এখানে বাড়তি ভরটুকু এসেছে ওই শক্ত করে বাঁধার কারণে।

কাজেই আপনার দেহের বেশির ভাগ ভরের উৎস অতি ক্ষুদ্র কোয়ার্ক বা ইলেকট্রন কণা নয়, বরং কণাগুলোকে একত্রে বেঁধে রাখা বন্ধনের শক্তি থেকে আসা ভর। মহাবিশ্বের অন্য সবকিছুর ক্ষেত্রে সেই একই কথা খাটে। সবচেয়ে মজার ও বিস্ময়ের কথা হলো, এর সামনের বা পেছনের কারণ যে আসলে কী, সেটা এখনো বিজ্ঞানীদের কাছে রহস্য। কারণ, এ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনো কিছুই জানেন না।

আরও পড়ুন

এখানে বোঝাতে চাইছি, কোন বলের পরিপ্রেক্ষিতে ওই কলমগুলো কতটা জোরে বা আস্তে চলবে, তার ওপর কলমগুলো একত্র করে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি কীভাবে প্রভাব ফেলে, তা আমাদের কাছে এখনো বোধগম্য নয়। আমাদের কাল্পনিক তিনটি কলমের ব্যাগ যদি আমরা ধাক্কা দিই, তাহলে এ তিনটিকে একত্রে ধরে রাখা শক্তি আমরা কেন অনুভব করব, তার পেছনের সত্যিকার কারণও আমাদের অজানা। এটাই ভরের অন্যতম বড় এক রহস্য। আবার আমরা জড়তা মাপতে পারি। কিন্তু এই জড়তাই-বা কী এবং এটা কণাগুলোর ভর ও বন্ধনের শক্তিকে একত্রে কেন বেঁধে রাখে, তা–ও আমরা জানি না।

আসলে মহাবিশ্বের বড় রহস্য বহুদূর নক্ষত্র বা গ্যালাক্সিতেই শুধু নয়, আপনার আশপাশেও রহস্যের কমতি নেই। আপনার ভেতরেও আছে ভরসংক্রান্ত এমন আরও কিছু রহস্য। পরের পর্বে সেই রহস্য সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: উই হ্যাভ নো আইডিয়া, উইকিপিডিয়া

*লেখাটি ২০২৩ সালে বিজ্ঞানচিন্তা মে সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন