লুই ডি ব্রগলি: কোয়ান্টাম তত্ত্বের রাজপুত্র

শুধু কথার কথা নয়, বাস্তবেই তিনি রাজপুত্র। প্রিন্স। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শুরুর দিকে জেনারেল ফিজিকস পরীক্ষায় ফেল করেছেন। অথচ ১৯২৯ সালে সেই মানুষটি নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেলেন পদার্থবিজ্ঞানে। তিনি লুই ভিক্টর পিয়েরে রেমন্ড ডি ব্রগলি। ইলেকট্রনের তরঙ্গধর্ম আবিষ্কারের জন্য তাঁর খ্যাতি কিংবদন্তীতুল্য। আজ ১৫ আগস্ট তাঁর জন্মদিন। এই দিনে চলুন জেনে নিই তাঁর আশ্চর্য সরল জীবন ও বিস্ময়কর গবেষণার পেছনের কাহিনি।

আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের জন্য সবচেয়ে দরকারি এবং কার্যকর তত্ত্ব হলো কোয়ান্টাম তত্ত্ব। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ও নীলস বোর কোয়ান্টাম তত্ত্বের গাণিতিক প্রয়োগ শুরু করেন। এর মাত্র কয়েক বছর আগে ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে ১৮৯৫ সালে এক্স-রে, ১৮৯৬ সালে তেজস্ক্রিয়তা এবং ১৮৯৭ সালে ইলেকট্রন আবিষ্কৃত হয়েছে। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন আলোর ফটোইলেকট্রিক ইফেক্টের কার্যকর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ১৯১১ সালে পরমাণুর নিউক্লিয়াস এবং প্রোটন আবিষ্কার করেছেন আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। এসবের ভিত্তিতে নীলস বোর পরমাণুর কোয়ান্টাম মডেল দাঁড় করিয়েছেন।

কোয়ান্টাম মেকানিকসের ভিত্তি তখন দিন দিন শক্ত হচ্ছে। আলো ফোটন কণা হিসেবে যেমন কাজ করে, তেমনি তরঙ্গ হিসেবেও কাজ করতে পারে; অর্থাৎ আলোর দ্বৈত চরিত্র—কণা এবং তরঙ্গ, তা তত দিনে প্রমাণিত হয়ে গেছে। আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের (স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি) সাহায্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন সর্বকালের জনপ্রিয় সমীকরণ E = mc2। এই সূত্র থেকে দেখা যায়, পদার্থকে শক্তিতে রূপান্তরিত করা যায়, আবার শক্তিকেও রূপান্তর ঘটিয়ে পদার্থ পাওয়া যায়। আলোর কণা ও তরঙ্গের দ্বৈত সত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে পদার্থেরও যে কণা ও তরঙ্গের দ্বৈত সত্তা থাকতে পারে, সেই তত্ত্ব সামনে নিয়ে এলেন পদার্থবিজ্ঞানের জগতে প্রায় নবাগত লুই ডি ব্রগলি। ১৯২৪ সালে লুই ডি ব্রগলি তাঁর পিএইচডি থিসিসে এই তত্ত্ব প্রকাশ করেন যে আলোর যেমন কণা ও তরঙ্গের দ্বৈত ধর্ম আছে, অর্থাৎ স্বাভাবিক অবস্থায় আলো তরঙ্গ হলেও কণার ধর্মও প্রদর্শন করে, তেমনি ইলেকট্রন স্বাভাবিক অবস্থায় কণা হলেও তরঙ্গের ধর্ম প্রদর্শন করতে পারে। তারপর মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই এই তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার অর্জন করে। প্রিন্স লুই ভিক্টর পিয়েরে রেমন্ড ডি ব্রগলি ইলেকট্রনের তরঙ্গধর্ম আবিষ্কার করার জন্য ১৯২৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো, লুই ডি ব্রগলি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শুরুর দিকে জেনারেল ফিজিকস পরীক্ষায় ফেল করে বিজ্ঞান পড়াই ছেড়ে দিয়েছিলেন। তারপর নানা পথ পেরিয়ে ফিরে এসেছেন তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে। আর তার ১০ বছর পরই তিনি পদার্থবিজ্ঞানে ইতিহাস তৈরি করলেন।

প্রিন্স লুই ভিক্টর পিয়েরে রেমন্ড ডি ব্রগলি ইলেকট্রনের তরঙ্গধর্ম আবিষ্কার করার জন্য ১৯২৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো, লুই ডি ব্রগলি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শুরুর দিকে জেনারেল ফিজিকস পরীক্ষায় ফেল করে বিজ্ঞান পড়াই ছেড়ে দিয়েছিলেন
ডি ব্রগলি

প্রিন্স বা রাজপুত্র বলতে যে রকম কোনো রাজ্যের রাজার পুত্রকে বোঝায়—ঠিক সে রকম না হলেও ফ্রান্সের অত্যন্ত ধনী, বনেদি ও ক্ষমতাশালী পরিবারের সন্তান লুই ডি ব্রগলি। পারিবারিক উত্তরাধিকারসূত্রেই তিনি ছিলেন প্রিন্স। রোমান সাম্রাজ্যের উচ্চপদাধিকারীদের এ উপাধি দেওয়া হতো। লুই ডি ব্রগলির প্রপিতামহ ভিক্টর ফ্রাঁসোয়া ডি ব্রগলি প্রিন্স উপাধি পেয়েছিলেন অস্ট্রিয়ার সম্রাটের কাছ থেকে। ভিক্টর ও পলিন ডি ব্রগলির পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার ছোট লুই ডি ব্রগলির জন্ম ১৮৯২ সালের ১৫ আগস্ট। ভিক্টর ছিলেন ডিউক—ফ্রান্সের অত্যন্ত উচ্চপদমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ। ডিউক পদমর্যাদা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। ডিউকের বড় ছেলে ডিউক হবেন, এটাই নিয়ম। ভিক্টরের মৃত্যুর পর তাঁর বড় ছেলে মরিস ডিউক হলেন। লুইয়ের চেয়ে ১৭ বছরের বড় মরিস ডি ব্রগলি ছিলেন তখনকার সময়ে ইউরোপের খ্যাতিমান পরীক্ষণ–পদার্থবিজ্ঞানীদের একজন। নিজের টাকায় নিজের বাড়িতে তিনি বিশাল ল্যাবরেটরি তৈরি করে গবেষণা করতেন।

বাড়িতে খ্যাতিমান অগ্রজ থাকলে অনুজদের যা হয়, লেখাপড়া নিয়ে সারাক্ষণই একটা মানসিক চাপের মধ্যে থাকতে হয়; মরিসের ছোট ভাইবোনদের ক্ষেত্রেও তা হলো। লুইয়ের চেয়ে চার বছরের বড় বোন পলিনের নাম রাখা হয়েছিল মায়ের নামে। পলিন পদার্থবিজ্ঞান পড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু মরিস তাতে বাদ সাধলেন। ইউরোপে তখনো মেয়েদের বিজ্ঞান শিক্ষায় উৎসাহিত করা হতো না। পলিন বিজ্ঞান পড়তে না পেরে সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং পরে ফ্রান্সের অত্যন্ত খ্যাতিমান সাহিত্যিক হয়ে উঠেছিলেন। পলিনের সঙ্গে লুইয়ের খুব বন্ধুত্ব ছিল।

বড় ভাই বিজ্ঞানী মরিসের তত্ত্বাবধানে বাড়িতেই প্রাইভেট টিউটরদের কাছে লেখাপড়া শুরু হলো লুইয়ের। ১৯০৬ সালে বাবার মৃত্যুর পর মরিস ডিউক হলেন। মরিস এবার ১৪ বছর বয়সী লুইকে প্যারিসের বিখ্যাত স্কুল লাইসি জ্যানসন দ্য সেইলিতে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করলেন। তিন বছর পর দর্শন ও গণিতে ভালো নম্বর পেয়ে স্কুল ফাইনাল পাস করলেন লুই।

উরোপের প্রথম সারির সব পদার্থবিজ্ঞানীর মধ্যে কোয়ান্টাম মেকানিকসের ক্রমবর্ধমান গতিপথ লক্ষ করে ১৯ বছরের তরুণ লুই ডি ব্রগলি তাঁর ভবিষ্যতের পথ খুঁজে পেলেন। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা অনুভব করলেন

১৯১০ সালে ১৮ বছর বয়সে ভর্তি হলেন সরবোন ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু তখনো তিনি জানেন না, ঠিক কী হতে চান জীবনে। তাঁর সমবয়সী ভাগনে চার্লসও ভর্তি হয়েছেন সরবোনে। চার্লসের প্রভাবে লুই ইতিহাস বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন। কিন্তু ইতিহাসের গৎবাঁধা গবেষণা-বিশ্লেষণহীন পড়াশোনা তাঁর ভালো লাগল না। অনেক দিন ইতিহাস পড়ার পর মাঝপথে ছেড়ে দিলেন। পারিবারিক প্রভাব খাটিয়ে তিনি সহজেই বড় আমলা হতে পারতেন, কিংবা রাজনৈতিক নেতা হতে পারতেন। কিন্তু সেসবের কিছুই লুইকে টানে না। কী হতে চান, সেটা তখনো না জানলেও আমলা বা নেতা কোনোটাই যে হতে চান না, সে ব্যাপারে তিনি মনস্থির করে ফেলেছিলেন। ইতিহাসে আনন্দ না পেয়ে তিনি আইন পড়তে শুরু করলেন। এক বছর তিনি আইন পড়লেন। কিন্তু তাতেও কোনো আগ্রহ পেলেন না। গণিতের বিশেষ কোর্স করার পর তিনি ক্রমে পদার্থবিজ্ঞান, বিশেষ করে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলেন। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের একটি পরীক্ষায় (জেনারেল ফিজিকস) তিনি ফেল করেন। এতে তাঁর মনোবল একেবারেই ভেঙে গেল। শৈশব–কৈশোরে যে লুই এত প্রাণবন্ত ছিলেন, তিনি এবার হঠাৎ খুবই নিষ্প্রাণ হয়ে গেলেন। কারও সঙ্গে তেমন মেশেন না, চিন্তিত থাকেন সারাক্ষণ।

১৯১১ সালে ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত প্রথম সলভে কনফারেন্সের অন্যতম সেক্রেটারি ছিলেন মরিস ডি ব্রগলি। তিনি ব্রাসেলসে যাওয়ার সময় ছোট ভাই লুইকেও সঙ্গে নিয়ে গেলেন। ইউরোপের প্রথম সারির সব পদার্থবিজ্ঞানীর মধ্যে কোয়ান্টাম মেকানিকসের ক্রমবর্ধমান গতিপথ লক্ষ করে ১৯ বছরের তরুণ লুই ডি ব্রগলি তাঁর ভবিষ্যতের পথ খুঁজে পেলেন। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা অনুভব করলেন। ১৯১৩ সালে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘লাইসেনসিয়েট ইন সায়েন্স’ বা বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করলেন।

১৯১১ সালে ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত প্রথম সলভে কনফারেন্সের অন্যতম সেক্রেটারি ছিলেন মরিস ডি ব্রগলি। তিনি ব্রাসেলসে যাওয়ার সময় ছোট ভাই লুইকেও সঙ্গে নিয়ে গেলেন

পরবর্তী ধাপের পড়াশোনা কিংবা গবেষণা শুরু করার আগেই ১৯১৩ সালে তাঁর বাধ্যতামূলক মিলিটারি সার্ভিস শুরু হয়ে গেল। পরের বছরই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ লেগে গেল। যুবকদের যুদ্ধে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক। লুইয়ের পোস্টিং হয়ে গেল মিলিটারির ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে। প্রচণ্ড বিরক্তিকর কাজ তাঁর জন্য। প্রভাবশালী বড় ভাই থাকলে তখনো কমবেশি কাজ হতো। ডিউক মরিস ডি ব্রগলি সেনাবাহিনীর উঁচু পর্যায়ে তদবির করে লুইকে সম্মুখযুদ্ধে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে আইফেল টাওয়ারের নিচে পোস্টিং দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন—যেখানে একটি রেডিওট্রান্সমিটার বসানোর কাজ চলছিল। পরে ছয় বছর ধরে লুই ডি ব্রগলি এ ট্রান্সমিটারের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করেছেন ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে। এটাকে পরে তিনি তাঁর হাতে–কলমে বেতার যোগাযোগের ইলেকট্রনিক পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণের সুযোগ হিসেবে দেখেছেন।

১৯১৯ সালের আগস্ট মাসে মিলিটারি সার্ভিস থেকে অব্যাহতি পেলেন লুই ডি ব্রগলি। ছয় বছরের মিলিটারি সার্ভিসের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে অ্যাডজুট্যান্ট পদবি দেওয়া হয়। বাড়িতে ফিরে এসে আবার লেখাপড়া শুরু করলেন লুই ডি ব্রগলি। মরিসের ল্যাবে এক্স-রে–সংক্রান্ত পরীক্ষণ-গবেষণায় কিছুদিন হাত লাগালেন। এক্স-রে বর্ণালি এবং ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট–সংক্রান্ত অনেক পরীক্ষণে তিনি অংশ নিলেন। পরীক্ষণ ফলাফলগুলোর ওপর কোয়ান্টাম পরমাণু তত্ত্ব প্রয়োগ করে বিশ্লেষণমূলক অনেক গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন তিনি।

কোয়ান্টাম মেকানিকসের অগ্রগতি তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। আলোর তরঙ্গ ও কণার দ্বৈত ধর্ম প্রমাণিত হয়ে গেছে। লুই ডি ব্রগলি ১৯২৩ সালে পরপর তিনটি ছোট গবেষণাপত্রে প্রমাণ করে দিলেন যে আলো তরঙ্গ হয়েও যেভাবে কণার ধর্ম প্রদর্শন করে, তেমনি ইলেকট্রন কণা হয়েও তরঙ্গের ধর্ম প্রদর্শন করতে পারে; অর্থাৎ যেকোনো বস্তুকণা ও তরঙ্গের দ্বৈত ধর্ম ধারণ করে।

লুই ডি ব্রগলি ১৯২৩ সালে পরপর তিনটি ছোট গবেষণাপত্রে প্রমাণ করে দিলেন যে আলো তরঙ্গ হয়েও যেভাবে কণার ধর্ম প্রদর্শন করে, তেমনি ইলেকট্রন কণা হয়েও তরঙ্গের ধর্ম প্রদর্শন করতে পারে; অর্থাৎ যেকোনো বস্তুকণা ও তরঙ্গের দ্বৈত ধর্ম ধারণ করে; প্রতীকী ছবি
আরও পড়ুন

লুই ডি ব্রগলির বস্তু-তরঙ্গের গাণিতিক ভিত্তি কয়েকটি সহজ সমীকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। আইনস্টাইনের শক্তি ও পদার্থের সমীকরণ E = mc2, যেখানে E = শক্তি, m = বস্তুর ভর, c = আলোর বেগ। আবার শক্তি ও তরঙ্গের সমীকরণ লেখা যায়, E = hf, যেখানে E = শক্তি, h = প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক = 6.63×10-34 জুল-সেকেন্ড, এবং f = তরঙ্গের কম্পাঙ্ক। শক্তির উভয় সমীকরণের সাম্যতা বিবেচনা করে লেখা যায়, mc2 = hf। আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যদি L হয়, কম্পাঙ্ক যদি f হয়, তাহলে আলোর বেগ c = Lf; যা থেকে লেখা যায় f = c/L; কম্পাঙ্কের মান বসানোর পর সমীকরণ দাঁড়ায়, mc2 = hc/L, যেখান থেকে লেখা যায়, L = h/mc, অর্থাৎ বস্তুর তরঙ্গদৈর্ঘ্য = প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক/বস্তুর ভরবেগ।

১৯২৪ সালে লুই ডি ব্রগলি তাঁর পিএইচডি থিসিস প্রকাশ করলেন। ইউরোপের অনেক বিজ্ঞানীর চোখেই পড়েছে তাঁর বস্তু-তরঙ্গের সূত্র, কিন্তু কেউই খুব একটা পাত্তা দিলেন না। কিন্তু আইনস্টাইন আর শ্রোডিঙ্গার খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিলেন তাঁর এই তত্ত্ব। শ্রোডিঙ্গার তাঁর ওয়েভ মেকানিকসে লুই ডি ব্রগলির বস্তু–তরঙ্গ তত্ত্ব প্রয়োগ করলেন।

পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্ব যতক্ষণ পর্যন্ত পরীক্ষণের সাহায্যে প্রমাণিত নয়, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই তত্ত্ব খুব একটা গুরুত্ব পায় না। অনেক বিজ্ঞানীকে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয় তাঁদের তত্ত্ব প্রমাণিত হওয়ার জন্য। পিটার হিগস ১৯৬৫ সালে যে হিগস বোসন তত্ত্ব দিয়েছিলেন, তার ৪৭ বছর পর হিগস বোসন কণা পাওয়া গেছে। লুই ডি ব্রগলিকে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। মাত্র তিন বছরের মধ্যেই তাঁর তত্ত্ব প্রমাণিত হয়ে গেল। ১৯২৭ সালে আমেরিকার পদার্থবিজ্ঞানী ক্লিনটন ডেভিডসন ও লেস্টার জারমার এবং ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী জর্জ থমসন পরীক্ষণের সাহায্যে প্রমাণ করেন যে ইলেকট্রনও তরঙ্গের ধর্ম প্রদর্শন করে। পরে ইলেকট্রনের ধর্মাবলি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে লুই ডি ব্রগলির তত্ত্ব বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ডি ব্রগলির তত্ত্ব থেকেই পাওয়া গেছে ম্যাগনেটিক লেন্স, যা কাজে লাগিয়ে উদ্ভাবিত হয়েছে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ।

পদার্থবিজ্ঞানীরা সাধারণত ঠোঁটকাটা হয়ে থাকেন। নম্রতা ও ভদ্রতার প্রচলিত সামাজিক সংজ্ঞাগুলো নিয়ে তাঁরা খুব একটা মাথা ঘামান না। কিন্তু লুই ডি ব্রগলি ছিলেন খুবই ব্যতিক্রমী একজন। কয়েক প্রজন্মের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পারিবারিক ঐশ্বর্য, খ্যাতি এবং ক্ষমতার কোনো কিছুই তিনি ব্যক্তিগত অর্জনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেননি

১৯২৪ সালের নভেম্বর মাসে পিএইচডি অর্জন করার পর সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছর অবৈতনিক শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করার পর নিয়মিত শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সময়েই ১৯২৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার অর্জন করলেন লুই ডি ব্রগলি। ১৯৩২ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অব প্যারিসে যোগ দেন। সেই সময় হেনরি পয়েনকেয়ার ইনস্টিটিউটে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ খোলা হয় এবং লুই ডি ব্রগলির জন্যই ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান পদ সৃষ্টি করা হয়। ১৯৩২ সালের শেষের দিকে তিনি সেই পদে যোগ দেন এবং পরবর্তী ৩০ বছর সেখানেই ছিলেন। ১৯৬২ সালে অবসর গ্রহণ করেন তিনি।

১৯৩৩ সালে ফ্রান্সের একাডেমি অব সায়েন্সের সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৪২ সালে নির্বাচিত হন একাডেমির পারমানেন্ট সেক্রেটারি। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি সেই পদে ছিলেন। ১৯৪৮ সালে তিনি আমেরিকান একাডেমি অব সায়েন্স এবং ১৯৫৩ সালে রয়্যাল সোসাইটির সদস্য মনোনীত হন।

শিগগিরই বাজারে আসছে বিজ্ঞানচিন্তার আগস্ট সংখ্যা। অর্ডার করুন আজই। 

আরও পড়ুন

পদার্থবিজ্ঞানীরা সাধারণত ঠোঁটকাটা হয়ে থাকেন। নম্রতা ও ভদ্রতার প্রচলিত সামাজিক সংজ্ঞাগুলো নিয়ে তাঁরা খুব একটা মাথা ঘামান না। কিন্তু লুই ডি ব্রগলি ছিলেন খুবই ব্যতিক্রমী একজন। কয়েক প্রজন্মের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পারিবারিক ঐশ্বর্য, খ্যাতি এবং ক্ষমতার কোনো কিছুই তিনি ব্যক্তিগত অর্জনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেননি। সবার সঙ্গে খুব নম্রভাবে কথা বলতেন লুই ডি ব্রগলি।

এত ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন। বড় ভাই মরিসের মৃত্যুর পর—মরিসের ছেলেসন্তান না থাকাতে লুই ডি ব্রগলি ডিউক হলেন। তাতেও তাঁর জীবনযাপনে কোনো পরিবর্তন আসেনি। জগৎসংসারের প্রতি একধরনের বৈরাগ্যই ছিল তাঁর। ব্যক্তিগত কোনো গাড়ি তিনি ব্যবহার করতেন না। দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিলেন। কখনো বিয়ে করেননি। শেষ বয়সে দেখাশোনার জন্য দুজন বিশ্বস্ত কাজের লোক ছিলেন। অনেকটা ঘরকুনো স্বভাবের মানুষ ছিলেন তিনি। কয়েকবার সলভে কনফারেন্স আর একবার নোবেল পুরস্কার নেওয়ার জন্য স্টকহোম ছাড়া আর কোনো দেশে ভ্রমণ করেননি। অদ্ভুত নির্লিপ্ত নিস্তরঙ্গ জীবন যাপন করেছেন রাজপুত্র লুই ডি ব্রগলি। ১৯৮৭ সালের ১৯ মার্চ ৯৫ বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসান হয়।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, আরএমআইটি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া

সূত্র: (1) Ioan James, Remarkable Physicist, Cambridge University Press, UK, 2004; (2) Biographical Encyclopedia of Scientists, World Book Chicago, 2003; (3) Heinrich A. Medicus, Fifty years of matter waves, Physics Today, February 1974; Mary Jo Nye, Aristocratic culture and the pursuit of science: the De Broglies in Modern France, JSTOR Vol 88, No 3, (1997).