সূর্য যদি ব্ল্যাকহোল হতো, তবে এর ঘটনা দিগন্তের ব্যাসার্ধ হতো প্রায় ৩ কিলোমিটারের মতো। যদিও বাস্তবে সূর্যের ব্ল্যাকহোলে পরিণত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
ব্ল্যাকহোল চেনা যায় এর ঘটনা দিগন্ত বা ইভেন্ট হরাইজন দেখে। অর্থাৎ ঘটনা দিগন্তকে ব্ল্যাকহোলের সীমানা বলয় বলা যায়। এই বলয়ের মধ্যে কোনো বস্তু ঢুকে পড়লে আর বেরিয়ে আসতে পারে না। প্রচণ্ড মহাকর্ষ বলের জালে আটকা পড়ে যায়; ছুটে যায় নিশ্চিত ধ্বংসের মুখে, ব্ল্যাকহোলের দিকে। মজার বিষয় হলো, কোনো বস্তু ঘটনা দিগন্তের ভেতরে ঢুকে পড়লে সেটা কিন্তু হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায় না। বরং ঘুরতে থাকে ঘটনা দিগন্ত ধরে। এভাবে ঘোরার সময়েই ধীরে ধীরে বস্তুর অণু-পরমাণু ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে মহাকর্ষের টানে, মিশে যেতে থাকে ব্ল্যাকহোলের সঙ্গে। অনেকটা পানির ঘূর্ণির এক প্রান্তে ভঙ্গুর কিছু ছেড়ে দিলে যেমন দেখায়, সেরকম।
ঘটনা দিগন্তে কোনো বস্তু (বেশিরভাগ সময় সেগুলো গ্রহ, নক্ষত্র বা তাদের ভগ্নাবশেষই হয়) প্রচণ্ড বেগে ঘোরে। ফলে তৈরি হয় বিপুল তাপ ও আলো। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, অন্ধকার কোনো গহ্বরকে ঘিরে ঘুরছে আগুনের বলয়। ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর নামটা সে কারণেই দেওয়া।
সূর্য যদি ব্ল্যাকহোল হতো, তবে এর ঘটনা দিগন্তের ব্যাসার্ধ হতো প্রায় ৩ কিলোমিটারের মতো। যদিও বাস্তবে সূর্যের ব্ল্যাকহোলে পরিণত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, কৃষ্ণগহ্বর হতে একটি নক্ষত্রের ন্যূনতম যে পরিমাণ ভর লাগে, সূর্যের ভর তার চেয়ে অনেক কম। ন্যূনতম সূর্যের ১.৪ গুণ ভারী নক্ষত্রগুলো কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হতে পারে।
কোনোভাবে আপনি এই ঘটনা দিগন্ত পার হতে পারলে দেখবেন, সেখানে আর স্থাল-কালের চিরাচরিত নিয়ম কাজ করছে না। স্থান-কাল জিনিসটাই ভেঙে পড়েছে।
বড় বড় অতিভারী কৃষ্ণগহ্বরগুলোর ভর সূর্যের চেয়ে সহস্র কোটি গুণ বেশি। এগুলো সাধারণত বিভিন্ন গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকে। কারণটা অবশ্য এখনও অজানা। অতিভারী এসব কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তের পরিধি সৌরজগতের চেয়েও বড় হয়। কোনোভাবে আপনি এই ঘটনা দিগন্ত পার হতে পারলে দেখবেন, সেখানে আর স্থাল-কালের চিরাচরিত নিয়ম কাজ করছে না। স্থান-কাল জিনিসটাই ভেঙে পড়েছে। কাল বা সময় হয়ে গেছে স্থান, আর স্থান হয়ে গেছে সময়। গোলমেলে ব্যাপার বটে।
গাণিতিকভাবে ঠিক এ কারণেই কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রে পাওয়া যায় অসীম ঘনত্বের বিপুল ভরবিশিষ্ট এক বিন্দু—সিঙ্গুলারিটি। বাংলায় বলা হয় পরম বিন্দু বা অনন্যতা। চাইলে আরেকটু সরল করে বলতে পারেন, এই পরম বিন্দুটাই আসলে কৃষ্ণগহ্বর। কারণ, গোটা কৃষ্ণগহ্বরের সব ভর ওতেই কেন্দ্রীভূত হয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই পরম বিন্দুর অবস্থান কোনো স্থান বা স্পেসে নয়, বরং সময়ের মধ্যে। ভবিষ্যতে। আমরা যেমন ‘আগামীকাল’ এড়িয়ে যেতে পারি না, তেমনি কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে পরম বিন্দুকেও পাশ কাটানোর সুযোগ নেই।
খুব বেশি জটিল লাগছে? তাহলে আরেকটু সহজ করি। কৃষ্ণগহ্বর বলতে যেহেতু পরম বিন্দুটিকেই বোঝানো হয়; তাই কৃষ্ণগহ্বরের অন্যপাশ দেখতে চাওয়ার অর্থ পরম এই বিন্দুর অন্যপাশ দেখতে চাওয়া। আর ‘পাশ’ মানে স্পেস বা স্থান। যে জিনিস নিজেই স্থানের মধ্যে নেই, তার পেছনের স্থান দেখবেন কীভাবে? সে অর্থে এ প্রশ্নই তাই অর্থহীন।
পরম বিন্দু তাই আজও রয়ে গেছে আমাদের জ্ঞানের সীমানার বাইরে। এর চারপাশে যে ঘটনা দিগন্ত রয়েছে, ওর ভেতরে আর কাজ করে না পদার্থবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত কোনো তত্ত্ব।
তবে অর্থহীন প্রশ্ন করাও বিজ্ঞানের কাজ। বিজ্ঞানীরা প্রশ্ন করেছেন, উত্তর খুঁজেছেন। এখনও খুঁজছেন। অনেক বিজ্ঞানী হাইপোথিসিস বা অনুকল্প দিয়েছেন। অর্থাৎ, সেগুলো এখনো অপ্রমাণিত সম্ভাব্য ব্যাখ্যা। তাঁদের মতে, পরম বিন্দুর অন্যপাশে আছে মহাবিশ্বের দূর কোনো প্রান্ত। কিংবা অন্য কোনো মহাবিশ্ব। মানে এই বিন্দুটি স্থান-কালের মধ্যে ফুটোর মতো কাজ করছে। কিন্তু পরম বিন্দুর ধারণা ও সংশ্লিষ্ট তত্ত্বগুলোই এর বিরোধিতা করে। কারণটা তো ইতিমধ্যেই বলেছি। এ পর্যায়ে তাই পরম বিন্দুর ও পাশে কী আছে, সে বিষয়ে যৌক্তিক কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়।
আসলে ঠিক কী ঘটছে কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রে বা অন্যপাশে কী আছে—এই প্রশ্নগুলোকে অর্থবহ করার মতো পদার্থবিজ্ঞান এখনও আমাদের হাতে নেই। কারণ, মহাকর্ষ ভারী ও বড় পরিসরের বস্তুগুলোকে ব্যাখ্যা করে। পরমাণুর চেয়েও অনেক ছোট, বিন্দুর মতো কোনো কিছুর আচরণ এটা ব্যাখ্যা করতে পারে না। এরকম ক্ষুদ্র বস্তুদের ব্যাখ্যা করতে ব্যবহৃত হয় কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। কিন্তু সেটা আবার এরকম বিপুল ভারী কিছুর মহাকর্ষীয় আচরণ ব্যাখ্যার জন্য যথেষ্ট নয়।
পরম বিন্দু তাই আজও রয়ে গেছে আমাদের জ্ঞানের সীমানার বাইরে। এর চারপাশে যে ঘটনা দিগন্ত রয়েছে, ওর ভেতরে আর কাজ করে না পদার্থবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত কোনো তত্ত্ব। অনেক বিজ্ঞানী বলেন, এই বিন্দুতে মিলে যায় কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ও আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। যুগ্ম এই তত্ত্বের নাম দেওয়া হয়েছে মহাকর্ষের কোয়ান্টাম তত্ত্ব বা কোয়ান্টাম মহাকর্ষ তত্ত্ব।
বর্তমানে পদার্থবিজ্ঞানীদের সামনে এরকম একটি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। চাইলে একটু আগে বেড়ে একে সর্বশেষ চ্যালেঞ্জও বলতে পারেন, যদি এ ধারণা ঠিক থাকে। কারণ, অনেকে বলেন, এই কোয়ান্টাম মহাকর্ষ মহাবিশ্বের সব কিছুর ব্যাখ্যা দিতে পারবে। ইংরেজিতে তাই অনেকে এ তত্ত্বকে বলেন ‘থিওরি অব এভরিথিং’। মানে, সবকিছুর তত্ত্ব।
আপনিও চাইলে এই চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন। আপনার হাত ধরেই হয়তো মানুষ উঁকি দেবে কৃষ্ণগহ্বরের অন্যপাশে। কে জানে!
লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা
সূত্র: সায়েন্স ফোকাস